অন্ধকার গলির মাথায় এসে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল লিটন। নামকরা ছিনতাইকারী হতে চেয়েছে সে;
আশপাশের সবাই চিনবে তাকে। অস্ত্র দেখাতে হবে না, নাম বললেই টাকাপয়সা বের করে দেবে মানুষ—এটাই ছিল তার স্বপ্ন।
এই গলিতেই প্রথম পজিশন নিয়েছিল লিটন। সে-ও অনেক আগের কথা। প্রথম ছিনতাই, খুব নার্ভাস ছিল লিটন।
এমনিতে সে বিশালদেহী। তবে ওজন যত বেশি, সাহস ততই কম তার। তা ছাড়া কণ্ঠটাও ছিনতাইকারীসুলভ নয় লিটনের।
চপল তরুণীর মতো রিনরিনে গলায় আর যা-ই হোক, ছিনতাই হয় না। ‘অন্য কিছু কর’—এমন পরামর্শ অনেক পেয়েছে সে।
কিন্তু দমেনি কখনোই। বন্ধুর ছুরি ধার নিয়ে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়েছিল গলির মাথায়।
ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিল এক লোক। অন্ধকার গলি, তার ওপর মনোযোগ ছিল ফোনে,
লোকটা ভাবতেও পারেনি সামনেই ঘাপটি মেরে আছে কেউ। নিঃশব্দে লোকটার সামনে হাজির হলো লিটন।
লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’
: ব্যাপার সাংঘাতিক। যা আছে দিয়া দেন তাড়াতাড়ি।
কী যেন ভাবল লোকটা। ‘জান, একটু হোল্ড করো তো’, বলে ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল ফোন।
আচমকা ডান হাত দিয়ে কষে একটা চড় বসিয়ে দিল লিটনের গালে। তারপর আবার ‘হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে…’ বলে হেঁটে চলে গেল।
হতভম্ব হয়ে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল লিটন। তারপর গলি পেরিয়ে চলে এল বন্ধুর আস্তানায়। ওকে দেখেই ছুটে এল বন্ধু।
: কিরে, কী দিল?
: থাবড়া দিছে।
: কী? ছুরি কই ছিল তর? ঢুকায় দিলি না ক্যা হালার পেটে?
: টেনশনে বাইর করতে ভুইলা গেছিলাম।
: তরে দিয়া হইব না। এর চেয়ে বাদাম, বুট বেচ, কাজে দিব।
: বাদামের টুকরি আলগাইতে পারি না। নাইলে কি এই লাইনে আহি?
সেদিনের কথা ভেবে আনমনে গালে হাত বোলাল লিটন। কী বোকা ছিল সে! হঠাৎ কারও গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরল তার।
উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে আসছে একটা লোক—‘তোরে আমি দেইখা নিমু, হাঁটুর বাটি খুইলা শোকেসে সাজায় রাখুম ব্যাট্টা! চিনস নাই আমারে…!’
হঠাৎ ছুরি হাতে তার পথ রোধ করল লিটন। কিছু বলতে হলো না, যা বোঝার বুঝে গেল লোকটা। মোবাইল, মানিব্যাগ বের করে বাড়িয়ে দিল লিটনের দিকে।
গোয়েন্দাদের মতো মোবাইল, মানিব্যাগ পরখ করতে লাগল লিটন।
: ক্যামেরা কত মেগাপিক্সেল?
: জি…১৩।
: বাহ্। মানিব্যাগ এত মোটা ক্যান? এহ্, ভিজিটিং কার্ড দিয়া ভইরা থুইছেন। কার্ড রাখার লাইগা কার্ড হোল্ডার পাওয়া যায়, কিন্না লইয়েন
এই মোটা মানিব্যাগ পিছে রাইখা সারা দিন বসলে ব্যাকসাইডে ঝামেলা হইব। বুঝছেন?
: জি।
: আর কানে ফোন নিয়া রাস্তা পার হইবেন না। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ডেইলি যত অ্যাকসিডেন্ট হয়, অর্ধেকই তো এই ফোনের কারণে। ফোনটা নিলাম।
: জি।
: আর ভাই, গালি দিয়া কোনো লাভ আছে? আমি তো গালি দেই নাই। তা-ও কী সুন্দর আপনি কথা শুনলেন।
শুনছেন না? হুদাই গালাগালি করবেন না। মানুষ কষ্ট পায়। মানুষরে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। নেন, রাখেন এইটা।
: এইটা…
: আমার ভিজিটিং কার্ড। এইডা দিয়ে মুড়ি খাইয়া ফেলাইয়েন না আবার। সঙ্গে রাখবেন। পরে আবার দেখা হইলে কার্ডটা দেখাইয়েন।
ঝামেলা কম হইব। কিছু ডিসকাউন্টও পাইবেন। আর নামটা মনে রাইখেন—লিটন। গেলাম।
দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়ল লিটন। দেশের উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে লিটনের উন্নতি নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই।
মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এবং বিকল্পধারার ছিনতাইকারী বলা যায় তাকে। তার জীবনে পরিবর্তনটা এনেছে স্মার্টফোন।
বিভিন্ন সেলিব্রিটির মোটিভেশনাল বক্তৃতা বদলে দিয়েছে তাকে। বিশেষ করে ছালিম কাদেরের ভীষণ ভক্ত সে।
ছলিম কাদের বলেন, ‘কখনো হাল ছাড়বেন না। একটু আত্মবিশ্বাস, একটু চেষ্টা আর স্বপ্ন থাকলে সফল হবেনই।’
আসলেই তা-ই। চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস মিলে লিটন এখন পকেটমার থেকে সফল ছিনতাইকারী।
লিটন জানে, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তাই টাকাপয়সা নেওয়ার সময় কিছু টিপস দেয় সে।
আজকাল ফ্রিতে কেউ উপদেশ না দিলেও লিটন দেয়। সঙ্গে নিজের কার্ডটা দিতেও ভুল হয় না তার। নিজের ডিজাইন করা কার্ড।
কার্ডে লেখা, ‘লিটন মিয়া, সিনিয়র ছিনতাইকারী’। সে খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ, তাই কার্ডের এক পাশে একটা গোলাপ, আরেক পাশে শান্তির প্রতীক পায়রা।
ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পার্টটাইম চুরিও করে লিটন। চুরি না বলে ডাকাতি বলা ভালো। কারণ, অস্ত্র থাকে তার সঙ্গে।
একবার স্পটে ঘটেছিল নজিরবিহীন ঘটনা। চুরি প্রায় শেষ, জিনিসপত্র গুছিয়ে সে বারান্দায় এসে দেখে, ফোনে কার সঙ্গে
যেন ফিসফিস করে কথা বলছে বাড়ির কর্তা। অস্ত্র বের না করে আর উপায় ছিল না লিটনের। ওকে দেখেই চমকে উঠল ভদ্রলোক।
লিটন বলল, ‘বউ থুইয়া গোপনে টাঙ্কি মারেন, এইটা তো ঠিক না। যা–ই হোক, শোনেন, গেটমেট লাগান না ক্যান ঠিকমতো?
এত উদাস হইলে হয়? আর আলমারির চাবি কেউ তালায় ঝুলায় রাখে? চাবি রাখবেন নিরাপদ স্থানে। আর আপনে প্রেমিকার ছবি
যে ড্রয়ারে রাখছেন, এইটা তো এনি টাইম ভাবির হাতে পড়বে। সাবধান হবেন না? সময়টা খারাপ, বুঝেন নাই? আর ব্যাংক থেকে
টাকা তোলার সময় দেইখা নিবেন না? এক হাজার টাকার নকল নোট পাইছি দুইটা।’
ভদ্রলোক আরও অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন কি না, তা জানে না লিটন। কারণ, তার আগেই সে বারান্দার কার্নিশ
বেয়ে নিচে নেমে চলে গেছে বহুদূর।
লিটনের চিন্তা খুব পরিষ্কার। ‘ছিনতাই, চুরি যেটাই হোক, বইলা করি। ভণ্ডামি-দুর্নীতি তো করি না। মুখে কমু “দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই”
আর নিজে ফাইল আটকাইয়া চা-বিস্কুটের টাকা চামু—আমি কি হেই পোলা?’
লিটন মনে করে, কাজটা মোটেও সহজ নয়। ছিনতাইকারীকে হতে হয় গোয়েন্দার মতো। দূর থেকে দেখেই বুঝে
ফেলতে হয় কার পকেটে পাত্তি কেমন, কোন মডেলের ফোন, জুতার নিচে টাকা লুকানো আছে কি না ইত্যাদি।
তা ছাড়া ছালিম কাদের বলেছেন, ‘কোনো কাজই ছোট নয়। যে পেশাতেই থাকো না কেন, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা–ভালোবাসা থাকা দরকার।’
সেটা ভালোই আছে তার।
বাসার কাছে এসে লিটন হঠাৎ খেয়াল করল, রাস্তার মাথায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করছে এক লোক। ঘটনা কী দেখতে এগিয়ে গেল সে।
কাছে গিয়েই চমকে উঠল। এ তো ছালিম কাদের! যার কথা শুনে বদলে গেছে তার জীবন! এই মহান ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতেই হবে, ভাবল লিটন।
মনে মনে কী বলবে তা-ও ঠিক করে নিল সে।
: ভাই, জুতা খোলেন।
: কেন?
: ধুলা পাড়াইতেন একটু। আমি সেই ধুলা নিতাম। পদধুলি আরকি…
: ছি ছি, কী বলছেন!
‘ঠাস’ করে শব্দ হলো একটা। চমকে উঠল লিটন। ছালিম কষে চড় দিয়েছেন রিকশাওয়ালার গালে। তারপর কিছু গালিও দিলেন,
যেগুলো লিটন তার বন্ধুদের দেয়। রিকশাওয়ালা চলে যেতেই রাগে রাস্তায় থুতু ফেললেন ছালিম। আরও কিছু দূর গিয়ে
ফুটপাতে হিসু করে হাঁটা শুরু করলেন হেলেদুলে।
লিটন দেখল কিছুই মিলছে না। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা নিয়ে এই লোকের একটা বক্তৃতা আছে। বিশেষ করে রিকশাওয়ালা,
সিএনজিওয়ালার মতো শ্রমজীবী মানুষকে যেন আমরা কষ্ট না দিই, তা নিয়ে। সে জন্যই তো লিটন কখনো তাদের ধরে না।
আবার একটা বক্তৃতা আছে নিজের শহরকে পরিষ্কার রাখা নিয়েও। কেউ যেন রাস্তায় ময়লা না ফেলি,
যেখানে-সেখানে হিসু না করি…আসলেই দুজন একই লোক তো? সন্দেহ হলো লিটনের।
দ্রুত শর্টকাট মেরে একটা গলি পার হয়ে লোকটার সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো লিটন। হ্যাঁ, সেই লোকই।
একদিনে দুবার খ্যাপ মারে না সে, তবু মনে হলো এই লোককে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত।
পকেট থেকে ছুরিটা বের করে লোকটার সামনে দাঁড়াতেই ভড়কে গেলেন ছালিম। তাঁর গলার কাছে ছুরি নিয়ে গেল লিটন।
ভয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তাঁর চোখ দুটো। লিটন বলল, ‘ভাই, ছিনতাইকারী ধরবেই। তাই বলে আতঙ্কিত হবেন না।
নিজের ওপর আস্থা রাখুন। আত্মবিশ্বাস হারাবেন না। তাড়াহুড়া করবেন না। বড় বড় শ্বাস নিন।
ধীরে ধীরে আপনার মূল্যবান জিনিসগুলো বের করে আমার হাতে দিয়া দেবেন। একি ভাই, আপনি তো ভয়ে কাবু হয়ে গেছেন!
এটা কেমন কথা? আপনি না বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, ভয় পাওয়া চলবে না…’
এই শীতের রাতেও ঘামছে লোকটা। ছুরিটা গলার আরও কাছে নিয়ে গেল লিটন। চাপা স্বরে বলল,
‘ভিডিওতে কত সুন্দর সুন্দর কথা কন, এদিকে রিকশাওয়ালারে থাবড় মারেন, রাস্তায় মুতেন, বিষয় কী ভাই? পেটটা ফুটা কইরা দিই?’
: প্লিজ…আমাকে ছেড়ে দেন, ভাই!
: ভণ্ডামি করস, ব্যাট্টা?
: আর করব না, ভাই।
: আজকে গিয়া আরেকটা ভিডিও বানাবি। কইবি যে এত দিন ভণ্ডামি করছস। আজ থেইকা ভালো হইয়া যাবি। পারবি না?
: অবশ্যই পারব।
: ভিডিওতে রিকশাওয়ালার কাছে মাফ চাবি। রাস্তায় হিসু করার লাইগা মাফ চাবি। পারবি না?
: পারব।
: যদি না করস রে! কিডনিমিডনি গালাইয়ালামু একদম!
: ভাই!
: হালা দুই নম্বর! আজকেই তরে আনফলো মারুম! আমি লিটন, নামটা মনে রাখিস। গেলাম।
লোকটার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে কেটে পড়ল লিটন। মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার।
সে ছিনতাইকারী হতে পারে, কিন্তু দুই নম্বর তো না। অথচ দেশটা দুই নম্বরে ভরে গেছে একেবারে!