মাধবকুণ্ড ঝর্ণা ভ্রমণ

মাধবকুণ্ড ঝর্ণা ভ্রমণ

৯শে অক্টোবর ২০১৪ইং তারিখে সিলেটের একটা ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড ভ্রমণের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের গাড়ি ছাড়া হল ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে। পথে তখনও কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি। পথের ধারের চিরোচেনা গ্রামবাংলার আবহমান দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলি। “শ্রীমঙ্গলের পথে” চলতে চলতে আমরা যখন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে পৌছাই তখন ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। “লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ” শেষে আমরা পৌছাই মাধবপুর লেকে। “মাধবপুর লেক” ভ্রমণ শেষে আমাদের এবারের গন্তব্য প্রায় ৭২ কিলোমিটার দূরের মাধবকুন্ড ঝর্ণা।

“মাধবপুর লেক” টু “মাধবকুন্ড ঝর্ণা”

মাধবপুর লেক দেখে যখন বেরিয়ে এলাম তখন দেখি সমনেই এক মৌয়াল চাবাগান থেকে মধু কাটছে। টাটকা মধু দেখে আমরা কেনার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওদের বিক্রি করা এখন নিষেধ আছে, আগে বাগানের দারোয়ানদের সাথে মধু আধা আধি ভাগ হবে তারপর বিক্রি করতে পারবে। তাই আমরা ফ্রি ফ্রি কিছু মধু খেয়ে একটা ছোট কোকের বোতলের এক বোতল মধু নিয়ে মৌয়ালকে ২০০ টাকা দিয়ে সেখান থেকে কেটে পরলাম।

টাটকা মধু

অনেক দূরের পথ মাধবকুন্ড ঝর্ণা তাই পথে ভানুগাছাতে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য থামলাম। এদিক ওদিক একটু খুঁজতেই চোখে পড়লো “গ্রামের বাড়ী রেস্টুরেন্ট”। পুরাই ঢাকার পরিবেশ। রান্নাটাও খারাপ না। খাবারের মান ভালো, দাম কিছুটা বেশি। দুই পিচ্চি ছাড়া ৮ জনের খাবার বিল আসলো প্রায় ১৮০০ টাকা। তবে আমাদের লস যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে সময়, চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মত অর্ডার হওয়ার পরে ওরা খাবার রান্না করে। ফলে অনেকটা সময় আমাদের লস হয়ে গেছে সেখানে খেতে বসে, ব্যাপারটা জানা থাকলে সেখানে বসতাম না।

“গ্রামের বাড়ী রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য অপেক্ষা

যাইহোক দুপুরের খাবার শেষে আবার শুরু হল যাত্রা। গন্তব্য এবার বাংলাদেশের সব চেয়ে আলোচিত সব চেয়ে পুরনো আর সব চেয়ে উঁচু ঝর্ণা মাধবকুণ্ড। এক সময় খুবই জৌলুস ছিল এই ঝর্ণার, বাংলাদেশের একমাত্র ঝর্ণা বলে তখন মনে করা হতো একে। তারপর অনেক সময় কেটেছে ঘরকুনো বাঙ্গালীর বদনাম ঘুচিয়ে একে একে আরও অনেক সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা আবিষ্কার করেছে ভ্রমণ পিপাসীরা। অনেক ঝর্ণা আবিষ্কার হলেও মাধপকুণ্ডের আলাদা কিছু আকর্ষণ অবশ্যই রয়েছে। এই ঝর্ণাটা আসলেই সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা যেটা থেকে জল কোথাও তেমন বাধা না পেয়ে সরাসরি নিচে ঝরে পরছে।
বড়সড় এটাই একমাত্র ঝর্ণা যেটার খুব কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়া যায়, অর্থাৎ এত বড় একটা ঝর্ণায় যেতে আপনাকে তেমন একটা কষ্ট করতে হবে না। তাছাড়া বর্তমানে মাধবকুণ্ড ঝর্ণাটাকে বলতে পারেন ওয়েল ডেকরেটেট। সুন্দর করে সাজিয়ে আপনার পাতে উপস্থাপন করেছে। আমার মতে এই ডেকোরেশন করে ঝর্ণার আসল থ্রিল, আসল রূপ, আসল পরিবেশের বারটা বাজিয়ে ফেলেছে।

খুঁজে দেখুন আপনার নাম আছে কিনা

অনেক বছর আগে সেই ১৯৯৯-২০০০ এর দিকে আমরা প্রথম মাধবকুণ্ডে যাই, ১৪-১৫ বছর পরে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক গেটের সামনে গিয়ে প্রথম যে শব্দ আর মুখে উচ্চারিত হয়েছে সেটা – “কিরে ভাই!! ঝর্ণা দেখি বাঘের খাঁচায় ঢুকায়ে ফেলছে!।!” আসলেই তাই, আমরা প্রথম যখন গিয়েছিলাম তখন রাস্তায় গাড়ি রেখে অনেকটা পথ ঝর্ণা থেকে বয়ে চলা নেমে আসা জলের ঝিরি পথের ধার ধরে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেবার আমরা ৫ বন্ধ ছিলাম, যার মধ্যে সাইফুল আর জালাল এবার আমাদের সাথে নাই।

ঝর্ণার দিকে পায়ে চলা পথ

এবার গিয়ে দেখি যাওয়ার সময় বামদিকের পাহারের ধার কেটে সেখানে টালি লাগিয়ে হাঁটা পথ তৈরি করা হয়েছে। ঝিরি পথ ধরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। একটু সামনে যেতেই দেখলাম কয়েকটি দোলনা আর কিছু পশুর ভাষ্কর তৈরি করে রেখেছে। ১০ টাকা টিকেট লাগে সেখানে বসলে।

আর একটু সামনে গেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে সেখানে ঝিরি পথের উপরে তৈরি করে রেখেছে কয়েকটি সাদা বকের ভাষ্কর, সেখানেও ছবি তুলতে ১০ টাকা দিতে হবে আপনাকে। এ-জিনিস কিন্তু আগে দেখি নি।

এখানে একটি ছোট্ট মন্দির ছিল, এবার দেখলাম সেটি ফুলে ফেঁপে বেশ বড় হয়ে গেছে। এর কিছুটা সামনেই সিঁড়িতে কয়েক ধাপ নামলেই দেখা যাচ্ছে সেই সুউচ্চ ঝর্ণা। সিঁড়ি থেকে ডানদিকে দুটি ঝুল বারান্দার মত দেয়া আছে যেখানে দাড়িয়ে দূর থেকে ঝর্ণা সহ ছবি তোলা যায়, এখানেও যে ১০ টাকার টিকেট দেয়নি সেটাই ভাগ্য।

সাইয়ারার পিছনে সেই ঝর্ণা

দূর থেকে মাধবকুণ্ড

প্রায় ২০০ ফুট উপর থেকে ঝর্ণার জল যেখানে পরছে সেখানে যাওয়া যায় না, কাঁটাতারের বেরা দিয়ে সেটা আলাদা করে রাখা হয়েছে। প্রথম বার যখন এসেছিলাম তখন তার আগের দিন খুব বৃষ্টি হয়ে ছিল বলে ঝর্ণাতে প্রচুর জল ছিল, এবার জলের তোড় অনেক কম।

নরমাল সাটারস্পিডে তোলা

সাটার স্পিড কমিয়ে তোলা

ঝর্ণার শেষাংশ

সাটার স্পিড কমিয়ে তোলা

সেবার জলের তোড়ের কারণে কেউ জলের নিচে যেতে পারেনি এবার কাটা তারের বেড়া পথ রোধ করেছে। ঝর্ণার জল এসে যেখানে পরছে সেখানে মাঝারি আঁকারের একটা পুকুরের মত আছে, আগেও ছিল। সেখানে এখন গোসল করা যায়না, আগে কিন্তু যেত। সেখান থেকে যে পথে জল বেরিয়ে যাচ্ছে সেখানে ঢালাই দিয়ে কয়েকটা স্তর তৈরি করে দেয়া হয়েছে, ফলে সেটা একটা প্রপাতের রূপ নিয়েছে।

হাতে বানানো প্রপাত

আয়োজন আর উপস্থাপন ভালই কিন্তু এখনকার পর্যটক ঝর্ণার প্রকৃত প্রাকৃতিক রূপটা থেকে বঞ্চিত হল। ঝর্ণার জলে ভেজা থেকে বঞ্চিত হল।

সাইয়ারা

যখন আমি স্বপনকে বলল এই ঝর্ণার ঐ উপরে আমি উঠেছি, সেখানে একটা ছোট সুইমিং পুলের মত আছে। ডান দিকের পাহার বেয়ে সেখানে উঠে ছিলাম। ওর চোখে ছিল তখন বিস্ময়। এখন আর সেখানে উঠার কোন উপায় নেই, এই প্রজন্ম বঞ্চিত হল ঝর্ণার চুড়ায় উঠা থেকে, বঞ্চিত হল চূড়ায় উঠা গল্প বলা থেকে, বঞ্চিত হল ছোট ভাই বা সন্তানের বিস্মিত সেই দৃষ্টি দেখা থেকে।

একসাইটেট স্বপন

পথে চলতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে, কেউ আবার ইচ্ছে করেই গাড়ির নিচে ঝাপ-দেয়। ট্রেন দুর্ঘটনা অহরহই হয় লোকজন মারা যায়, ট্রেন লাইনে অনেকে অত্মহত্যাও করে, লঞ্চ-ডুবিতে মানুষ মারা যায়, অনেকে জলে ঝাপ দিয়ে অত্মহত্যাও করে। তাই বলে গাড়ি, ট্রেন বা লঞ্চ তো বন্ধ করে দেয়না কেউ!! ঝর্ণার বেলায় কেন দু-একটা দুর্ঘটনা আর আত্মহত্যার কারণে সেটা বন্ধ করে দেয়া হবে? কারো কারো হঠকারিতা আর অসতর্কতার কারণে সবাইকে বঞ্চিত করার কোন কারণ দেখি না। চাইলেই কিন্তু উপরে একটু ভেতরের দিকে রেলিং এর ব্যবস্থা করে দুর্ঘটনা রোধ করা যায়, সেটা না করে মাথা ব্যথার জন্য মাথাটাই কেটে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাধবকুণ্ডের চূড়ায় আমি নিজে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলাম, (সেই কাহিনী অন্য আরেকদিন বলবো) তবুও চাই এই পথ উন্মুক্ত করা হোক।

সাটার স্পিড কমিয়ে তোলা

অনেক প্যাঁচাল পারলাম এবার মূল কাহিনীতে ফিরি। এখানে বেশী সময় থাকা যাবেনা সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে, এটা শুধু আমার জন্য নয় সবার জন্যই এখনো সন্ধ্যার পরে এ যায়গা নিরাপদ নয় মোটেই। বিকেলের আলো কমে আসছে, সন্ধ্যা সমাগত, খুব বেশী সময় নেই। এদিকে বিচিত্র কোন কারণে মাত্র ৫৫০+ ছবি তুলতেই ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ শেষে হয়ে গেছে! অথচ মিনিমাম ৮০০ ছবি উঠার কথা, অন্ধের যষ্টি হতে পারতো এসময় সনি ডিজিটাল ক্যামেরাটা কিন্তু সেটা রয়েছে মিসেসের ব্যাগে, আর তিনি ব্যাগটি রেখে এসেছেন গাড়িতে। কোন রকমে শেষ কয়েকটি ছবি তুলে ফেরার পথ ধরলাম। সন্ধ্যার আগেই বাইরে বেরিয়ে এসে রওনা হয়ে গেলাম আমাদের মূল ঘাটি যেখানে হবে আগামী ৩ রাতের জন্য সেই সিলেটের পথে।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত