এমনিতে সকালে ঘুম থেকে উঠতে শাহানার খুব একটা ভাল লাগে না,এত আনন্দের ঘুম থেকে উঠার মত কঠিন কাজ এই ইহকালে নেই , বেশির ভাগ সময়ই অবশ্য ঘুমানোর সুযোগ থাকে না, ক্লাস থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠে মোটামুটি ঝড়ের বেগে ক্লাসের জন্য দৌড়াতে হয় । তারপর ও এইখানে যা সুযোগ পাওয়া যায় বাড়িতে থাকলে তা ও পাওয়া যায় না, বাবার কড়া নির্দেশ সবাইকে ফজরের নামাজের সময় উঠতে হবে, মেয়েদের সকালে ঘুমানো তিনি পছন্দ করেন না ।
বাড়ির কথা মনে হওয়ায় শাহানার মন খারাপ হয়ে গেল ,কতদিন মাকে দেখা হয় না!! ছোট ভাইটার সাথে সাথে কতদিন ধরে মারামারি করা হয় না! কেন যে ঢাকায় পড়তে আসল ! পিচ্চিটা কেমন আছে কে জানে? দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল!! এই সেদিনের বাচ্চাটা কখন যে এত বড় হয়ে গেল !!
শেষবার আসার সময় পাগলটা কি কান্নাটাই না কেঁদেছিল !! এই কান্নার ডাক ছেড়ে আসাটা কি কষ্ট তা শুধুমাত্র সেই জানেই ,হৃদয়ের একটা খণ্ড মনে হচ্ছিল রেখে যাচ্ছে ,বাবা মানুষটা এত শক্ত অথচ আসার সময় খুব ভালভাবে খেয়াল করে শাহানা দেখতে পায় চশমার কোনা দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল চিকচিক করছে , এত শক্ত মানুষ ও যদি কাঁদে তাহলে কি আর আসা সম্ভব হয়!! তারপর ও শাহানাকে আসতে হয় !!
আবার যে কবে যাবে!! কবে যে ছুটি হবে!! অবশ্য ঢাকার অবস্থা যে রকম তাতে শাহানার বাসায় চলে যেতে মনে চায়, ভার্সিটিতে শুধু নামেই ক্লাস হয় , শুধু ভার্সিটিতে যাওয়া আর আসা ।এর মাঝে কোন কাজ নেই , ঢাকার অবস্থা খুব একটা ভাল না, বাসায় যাবে কিনা বুঝছে না ।
আরও কিছুক্ষণ শুধু শুধু শুয়ে রইল শাহানা , আজকে ভার্সিটি যেতে ইচ্ছা করছে না, বিকেলের দিকে নিউমার্কেট যাওয়া যায়,পিচ্চিটার জন্য কিছু কেনা দরকার,গতবার ‘লাল শার্টের” জন্য খুব বায়না ধরছিল । একটা লাল শার্ট কিনতে হবে । পিচ্চিটার সাইজ কত?? এখন কি আরও বড় হয়ে গেছে?? সমস্যা হল কাকে নিয়ে যাওয়া যায়?? “আজাদ”কে কি পাওয়া যাবে? তার তো আবার অনেক কাজ, এই মিছিল এই মিটিং ,এই সভা, এ সব করেই তো তার দিন শেষ , সে কি আর তার সাথে নিউমার্কেট যেতে রাজি হবে??
আজাদ আর ও একই সাথে পড়ে , বেশ অনেকদিন থেকেই ওদের সম্পর্ক । আজাদ যখন ওর স্বপ্নের কথা বলে তখন শুনতে ওর খারাপ লাগে না, বরং ওর অনেক ভালই লাগে ,আজাদ মাঝে মাঝেই স্বাধীন দেশের কথা বলে , তখন অনেক আনন্দ হয়, আচ্ছা ,দেশটা কি আসলেই স্বাধীন হবে, কেমন হবে সেই দেশ ? সেই দেশের আকাশ কি আরও বেশি নীল হবে ??
আজাদকে ভার্সিটিতেই পাওয়া গেল , এবং সব চেয়ে অবাক করা ব্যাপার সে আজ শাহানার সাথে নিউমার্কেটে যেতে রাজি হয়েছে ,শাহানা বুজতে পারছে না সূর্য আজ কোনদিকে উঠল !!!
-এই একটা রিকশা নাও ।
রিকশায় উঠে আজাদ হুড উঠিয়ে দেয় ,খুব ঘনিষ্ঠভাবে শাহানার পাশে বসে , শাহানার খুব ইচ্ছে করে এমনি ভাবে রিকশায় ঘুরে বেড়াতে, কিন্তু সুযোগ খুব কমই আসে !!
-নিউমার্কেট গিয়ে কি করবা?
-নাচবো!! ,কেন আমার সাথে যেতে তোমার কোন সমস্যা আছে ?? নাকি কোন মিটিং আছে??
– আরে তা না!! বললাম কি করবা?
-ছোটনের জন্য একটা লাল শার্ট কিনব।
-এখন লাল শার্ট কিনে কি করবা?? ছোটনকে তুমি কোথায় পাবা???
-ভাবছি বাসায় চলে যাব, ক্লাস তো কিছু হয় না, আর অনেকদিন যাওয়া হয় না।
-তাই নাকি!! কবে যাবা??
-দেখি আর কিছুদিন, ক্লাস যদি এমন করে হয় তাহলে চলে যাব।
-ইশ!! তোমাকে কয়েকদিন দেখতে পাব না!!
-আমি ঢাকায় থাকলে ও তুমি কয়দিন দেখতে পাও??
-তা অবশ্য ঠিক !! বুঝলা আমার যা মনে হয় আমাদের আন্দোলন ছাড়া গতি নাই, ইয়াহিয়ার সাথে “নেতার’ আলোচনায় ভাল কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। ওরা আমাদের দাবি মানবে না, আমি জানি ।যুদ্ধ আমাদের কর চিন্তা করতেই হবে ।আচ্ছা মনে কর দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে ,আমরা একটা স্বাধীন দেশে আছি, যে দেশটা একান্তই আমাদের ,আর কারও না। যে দেশে আমাদের আর কেউ বাধা দিবে , কি আনন্দ, কি অদ্ভুত!! তাই না!!!!
-তুমি আবার তোমার ভাষণ শুরু করছ ?? আমি কিন্তু রিকশা থেকে নেমে যাব!!
-আচ্ছা ,ঠিক আছে ,ঠিক আছে, তবে শোন একটু সাবধানে থেকো , অবস্থা খুব একটা ভাল না।
-জি ,জনাব , এখন রিকশা থেকে নামেন , আমাকে শার্ট কিনতে হবে
একটা শার্ট কিনতে কেন সারা মার্কেট ঘুরতে হয় তা “আজাদ” কিছুতেই বুঝতে পারল না !!! মাত্র একটা শার্ট কিনার জন্য শাহানা সম্পূর্ণ মার্কেট ঘুরল , কিনাবে না তার পর ও অনেক কিছুর দামাদামি করল ,মেয়েদের এই আচরণ “আজাদ’ কিছুতেই বুঝতে পারে না , এই কারনে সে শাহানার সাথে মার্কেটে সহজে আসতে চায় না ।কিন্তু আজকে এসে যে কি বিপদে পড়ল!!
শার্ট কিনে শাহানার মনে হল সে কিছুটা লস খেয়েছে আরও কিছু দোকান ঘুরলেও হত!! কিন্তু “আজাদের জন্য পারা গেল না,!!
-চল তোমাকে হলে নামিয়ে দিয়ে ,আমি হলে যাব,
-এখনই!!! আরও কিছুক্ষণ থাক না!!
-না, দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ,তোমাকে তাড়াতাড়ি হলে যেতে হবে
শামছুনাহার হলে শাহানাকে পৌঁছে দিয়ে “আজাদ” নিজের হলের দিকে হাঁটতে শুরু করল ।
-যাই, কালকে দেখা হচ্ছে………
-দেখি, আর তুমি ও ঠিক মত যেও সময়টা ছিল ২৫শে মার্চ ১৯৭১ ,
‘শাহানা” “আজাদ” কেউই জানত না, কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য !! তারা জানত না আর তাদের দেখা হচ্ছে না। তারা কল্পনা ও করতে পারেনি কিছুক্ষণ পর ঘটতে যাওয়া ইতিহাসের সব চেয়ে বড় ‘গণহত্যার’ সাক্ষি হতে যাচ্ছে ওরা ।
২,কিছুক্ষণ পর ঘটতে যাওয়া ঘটনা চিন্তা করে ব্রিগেডিয়ার আরবাব খুবই পুলকিত অনুভব করলেন , তার উপর ঢাকা অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে , জেনারেল টিক্কা খান ঢাকা অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে বললেন
“ঢাকা শহরে এমন তাণ্ডব তৈরি করতে হবে যেন আতঙ্কে দুগ্ধবতী মাতার বুকের দুধ জমে দই হয়ে যায়।
“ব্রিগেডিয়ার আরবাব এর চেয়ে ভয়ানক কিছু করতে চাচ্ছে, এমন কিছু যা দেখে শিশুর কান্না বন্ধ হয়ে যায় , আর কিছু পরই তারা শুরু করবেন তাদের কর্মকাণ্ড ।এই ঢাকাবাসী অতিরিক্ত ঝামেলা করছিল বিশেষ করে ‘ছাত্র’ গুলা । আজকে তাদের উচিত শিক্ষা দেয়া হবে , তার অবশ্য নিজের একটা ইচ্ছা আছে , বাঙ্গালি নারী তার খুবই পছন্দ , আজকে সুযোগ এসেছে স্বাদ নেবার!! তিনি কিছুটা উত্তেজনা বোধ করলেন ।
তিনি ইশারায় অভিযান শুরু করার নির্দেশ দিলেন ।শুরু হল “অপারেশন সার্চ লাইট” ।
শাহানা কিছুই বুজতে পারছে না , হঠাৎ করে শহরে মিলিটারি নেমে পড়েছে ,তাদের কর্মকাণ্ড কিছুই বুঝা যাচ্ছে না, ড. মনিরুজ্জামান ,জ্যোতির্ময় স্যার , ড. জিসি দেবকে মেরে ফেলেছে , মিলিটারিরা যাকে পাচ্ছে তাকেই মারছে , মেয়েদের হলে ও কি ঢুকবে নাকি??
শামসুন্নাহার নাহার হলে মেয়েরা রুমের দরজা বন্ধ করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে ,চাপা এক আতঙ্ক বয়ে যায় সবার মাঝে দিয়ে ,সবাই অপেক্ষা করতে থাকে সকালের জন্য , সকালের সোনালি সূর্যের জন্য ,রাতের এই অন্ধকারে এত দিনের পরিচিত “হল” সবার কাছে অপরিচিত লাগছে , এমন সময় তারা শুনতে পায় গেট ভেঙ্গে মিলিটারিরা ঢুকছে , শাহানার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ভয়ের শিতল স্রোত নেমে যায় ।কি হতে যাচ্ছে বুঝে যায় শাহানা , অন্ধকার জগতের খবর “মেয়েদের” কাছে আগে পৌছায় ।
মিলিটারিরা দরজা ভেঙ্গে সব গুলো রুমে প্রবেশ করতে থাকে , শাহানাদের রুমের দরজা ভেঙ্গে যায় , শাহানা মিলিটারিদের চোখের দিকে তাকায় ,সব গুলো হায়েনার চোখ জ্বল জ্বল করছে, সে চোখের ভাষা পড়তে কোন মেয়েরই কোন দিন ভুল হয় না “ বাচাও” বলে চিৎকার দেবার মত “শক্তি’ টুকু ওদের ছিল না।
অত্যন্ত নিরব পরিবেশে চলতে থাকে ‘গনধর্ষণ’, নিরবে ঘটতে থাকে ইতিহাসে “এক কাল অধ্যায় ” শাহানার বার বার মনে হতে থাকে “ছোটনের’ কথা, ওকে আর লাল শার্টটা দেয়া হল না । পাগলটাকে আর দেখা হল না, ছোটন আর ওর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে না, আর ওর সাথে মারামারি করা হবে না !!! আজাদের সাথে ও আর দেখা হল না। ‘আজাদের ‘স্বাধীন” দেশটাকে দেখে যেতে পারল না!!! এমন সময় শাহানার উপর নেমে আসে একজন নরপশু।
সকালে রাস্তার পাশে আরও অনেক মেয়ের সাথে শাহানার থ্যাতলানো লাশ পাওয়া যায়, আর সব মেয়ের মত তার নিতম্বের ও বুকের মাংস কেটে ফেলা হয়েছিলো। শাহানার হাতে তখন ও একটা লাল শার্ট ছিল !!
আজাদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেদিনের অনেক লাশের মধ্যে কোন একটা লাশ ওর ছিল,যার জায়গা হয় গণকবরে।
এই ঘটনার নয় মাস পর ‘একটা নতুন দেশের জন্ম হয়, নুতন একটি পতাকার জন্ম হয়, দেশটির নাম বাংলাদেশ । লাল সবুজের বাংলাদেশ ।