অপ্রাপ্তি

অপ্রাপ্তি

-“জানো তো, ‘অন্যায় অবিচার’ সিনেমায় আমার এক রাঙাদাদা মিঠুন চক্রবর্তীর স্যাঙাতদের একজন হয়ে নেচেছিল।”

পোড়া হাতরুটির ফোস্কা ফুটো করে তাতে মিষ্টিকুমড়োর ঘ্যাঁট মাখিয়ে খেতে খেতে বলি আমি। হঠাৎ করেই। যেন এমন দাদার ছোটভাইকে এ’রকম পোড়া রুটি আর ঘ্যাঁট খেতে দিতে নেই। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, কাচা চাদরটা তারে মেলে দিতে দিতে সেই কাজরীর খোঁপায় লতিয়ে থাকা গামছাটা খুলে এলো। পেছন থেকে তার গলা-বুক-মুখের শ্বেতীর সামান্য ছোপগুলি দেখা যায় না আর তাকে টনটনে সুন্দর দেখায়। কাজের ঝি লতিকা জলে এক ছিপি কেরোসিন মিশিয়ে সেটা দিয়ে মুছে চকচকে করে দিয়ে গেছে পেটেন্ট স্টোনের মেঝে, সারা ঘরে মাথা ধরানো কেরোসিনের গন্ধ আর একটা চটচটে আর্দ্রতা বাতাসে। কাজরী আমার কথা গ্রাহ্যই করলো না, ওকে দেখলে মনে হবে ও এমনকি কোনো মানুষ কথা বলছে এমনটিও কানে শুনতে পায়নি। ক’দিন ধরে খুব বাড়িঘর সাফ করছে কাজরী, সব পুরনো ড্রয়ার, সিন্দুক নাড়াচাড়া দিয়ে- জিনিসপত্র বের করে বাড়িটা গোডাউন বানিয়ে ফেলেছে। বালতির বাকি কাপড় শুকোতে দিয়ে সে চটি ফটাফট করে চলে গেল আর আমার মনে হলো- কতদিন ‘হ্যাপিনেস’ শব্দটা কোথাও লেখাও দেখি না। কতদিন ধরে পোড়া হাতরুটির ফোসকা ফুটো করে মিষ্টিকুমড়োর ঘ্যাঁট মাখিয়ে খেতে খেতে আমি এই শেতলতলা, কচ্ছপখোলা- বারাসাতের একটা একতলা বাড়ির সামনের পানাপুকুর পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। পুকুরটার জলে একরকমের শাদা শাদা ফুল হয়, তার বাংলা নাম ‘চাঁদমালা’।

ইটের রাস্তার ওপারে কলাবতীর ঝাড়ের পাশে কলতলায় ঝপঝপ শব্দে স্নান সারছে মেনকা সোরেন। দূরদর্শনের সকালের অনুষ্ঠানে কে ঝুমুর গাইছে ‘মন দে যৈবন দে, দুইঠো ডানাই লাগাই দে’। সাধ কত! স্নানের শব্দে আমার মনে পড়ে গেল শোভনের নানাজান গুনগুন করতে করতে ঝপঝপিয়ে তোলা জলে স্নান করতেন- ‘যাব নূতন শ্বশুরবাড়ি/ আহ্লাদে যাই গড়াগড়ি/ সাবান মেখে ফর্সা হবো/ কাটবো মাথায় লম্বা টেরি…’, মরচে লাল সিমেন্টের মেঝে স্নানের ঘরে- শোলমাছরঙা লোহার বালতি আর মগ। বের হবেন যতক্ষণে- ততক্ষণে বুক আর পিঠ গামছার লালে নাকি রগড়ানিতে গোলাপি লাল। অম্লানবদনে বলে ফেলতেন- “ওরে আমরা জোলার জাত। কাজীবাড়ির ধার দিয়া হাঁটতে দিত না আমাদের, অথচ ভক্ত কবীররে দত্তক নিছিল এক জোলা। কাজীবাড়ির কেহ ভক্ত কবীরের নাম জানে না অবশ্যি।” (আমার ওঁর মতো করে বলতে ইচ্ছে করে, মেনকা সোরেনের বাড়ির কেহ একলব্যের নাম জানে না অবশ্যি।)আমরা শোভনদের গ্রামের বাড়িতে থেকেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমার দাদা মেঘালয়েপাহাড়ঘেরা জাওয়াই উপত্যকার ‘ইকো-১’ নামের একটা ট্রেনিং সেন্টারে চলে গেছিল, পরে ফিরে এসে খুব যুদ্ধ করেছিল দাদা- আমরা ভেবেছিলাম দাদাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি দেয়া হবে। আর কাজরী কি না আমাকে কালো রুটি আর ডেলাপাকানো ঘ্যাঁট খাওয়াচ্ছে।

শীতকাল বলে পথের ধারের নয়ানজুলি শুকিয়ে উঠেছে। নিকাশী নালার পাশে বচ্ছরকার কাদা শুকিয়ে ধুলোমাটির ঢিপি হয়েছে এখন। গেটের কাছের চালতাগাছতলায় একটা কুকুর এসে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে, দূরের কোনো পাড়ার কুকুরের ঘেউ শুনলেই কেবল ল্যাজের ডগা আছড়ে অসন্তোষ জানাচ্ছে। রোদ নিভে আসবার পরেও আকাশে বহুক্ষণ ম্লান নীল আভাটুকু থাকে।রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কোন বাইসাইক্লের আরোহী টুরুরুং করে বেল বাজিয়ে গেল। বাজারের‘মা-কালী’ দশকর্ম ভান্ডারের পাশে কাজরীর ডিসপেন্সারি। হোমিওপ্যাথির ডাক্তার সে। সারি সারি অন্ধকার ব্রাউন বোতল। আলো ঝলকানো সস্তার সবুজ পেইন্টের দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসে ডাক্তার কাজরী দত্ত রাত্রি ন’টা অব্দি রোগী দেখেন। ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করে বসে থাকি বাড়িতে- আমার তক্তাপোশের সুসমতল ক্ষেত্রফলে। লতিকার মেয়েটা ইস্কুলে যায়, সে ও-ঘরে দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করে নয় হোমওয়ার্ক করে।লতিকা মশাতাড়ানি কয়েল জ্বেলে রুটি বেলতে চলে যায়, কাজ সেরে আলগোছে চলেও যায়- সদর দরজায় ধাতব হুড়কোর শব্দ পেলে বুঝি লতিকারা গেল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে অন্ধকারে বসে থাকি। কাজরী ফিরে গেট খুলতে খুলতে শব্দ করে ডাকে- “দীলিপ!” দীলিপ আমার নাম। স্বামীর নাম মুখে নিতে নেই এইসব বালাই আমাদের নেই, ছিল না। ঐ ডাকটুকুই আমাদের সারাদিনের কথা।

যতক্ষণ সে থাকে না, আমি কোথায় থাকি সে আমি ঠিকঠাক বলতে পারি না। শুধু এইটুকু জেনো, নিত্যিদিন আমায় এই কালো রুটি আর ইয়ের মতো ঘ্যাঁট রেঁধে দেয়াটা ঠিক হচ্ছে না…

আসলে মিথ্যে বলে ফেললাম দ্যাখো। ফিরে এসে ঘাম মুছতে মুছতে কাজরী কখনো আমার বিছানায় এসে বসে, বিরক্ত হয়ে বলে- “সাঁতরা ইলেকট্রিকের ঐ ছেলেটাকে খবর দিতে বলেছিলাম লতিকাকে, আজো দিল না।” কখনো সাবানজলে মুখ ধুয়ে ফর্সা হয়ে এসেই ফসফসিয়ে বাটির দুধে আমায় রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিতে থাকে এমন করে, যেন আমি একটা তেলাপিয়া মাছ- ঐ পুকুরের টোপাপানা আর নালফুলের পাশে হাঁ করে জেগে উঠেছি। আজ যেমন ফিরে এসেই সে আমার বিছানায় গোছ করে কয়েকটা খাম ফেলে দিল- “তোমার চিঠি এসেছে। কে লিখলো চিঠি তোমায়? (চিঠি আজকাল কেউ লেখে নাকি!)” উত্তরের অপেক্ষা করলো না।

আরেকটা মিথ্যে কথা বলে ফেলেছি। মাঝে মাঝে কাজরী আমায় ভাল খেতে পরতে দেয়, যেমন আজকে। নলপাঁপড় আর দু’রকম ভাজা- নিমপাতা আরমানকচু, জিরের সম্ভার দেয়া মাছের ঝোলে নৌকো আকারের আলু,গাবের আলকাতরা দেয়া উল্টোনো নৌকোর মতো দেখা যায় ঝোলের ভেতর বেগুনের পিঠ। আজ ভাত খেতে দিচ্ছে কাজরী, বেশি খুশি হয়ে উঠলে ‘বাঙাল’ বলে গালি খেতে হবে- অতএব আমি গরম ভাতের ভাপে নাকমুখ গুঁজে দিয়ে বলি, “লতিকার মেয়েটা দুষ্টু হয়েছে কাজরী। আজ আমায় বলছিল, ‘দাদাভাই চালভাজা খাই রয়না মাছের মুড়ো’ এই ছড়ার শেষ লাইনটা নাকি‘বিছানা জুড়ে মুতে দিল ঐ জ্বালাতেই মরি’। (হাসতে গিয়ে আমার মুখ থেকে ভাত ছিটকে এলো থালায়) আমরা না শিখেছিলাম ‘ঝামটাকাটা মুখনাড়াটা ঐ জ্বালাতেই মরি’?”

মুত-টুত বলেছি বলে নাকি আমার সামনে লতিকার মেয়েটা বলেছে বলে কাজরীর কপালে বেশ বড় একটা খাঁজ দেখা দিল, তবে সে এই কথাটাও গ্রাহ্য করলো না। চুপচাপ খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে এলো, চিঠির পাঁজাটাও নিয়ে এলো সাথে করে। আর একটা পেপারনাইফ। (লেফাফা খুলতে গিয়া দীলিপ তর চিঠি ছিঁড়্যা ফালাইছে রে শুভইন্যা!) আরাম করে খেতে পেলাম না। কোনোমতে নাকেমুখে গুঁজে আমি প্রথম খামটা খুললাম। খাম খুলতেই কাজরী চেঁচিয়ে উঠলো- “সায়রা বানুর ছবি তোমায় কে পাঠালো?” চশমাটা খুলে বুকের জামায় ঘষে দ্রুত চোখে আঁটলাম আমি। ছোড়দি ছন্দুর ছবি এটা, সায়রা বানুর ছবি না। দীর্ঘ, টকটকে গায়ের রঙ, পাতলা চেহারা, টিয়া পাখির মতো নাক। ছন্দুদি সেসময় পীচফল রঙের একটা শাড়ি খুব পরতো, বোটনেক ব্লাউজ। হাতে একটা শাদা ব্যান্ডের হাতঘড়ি।আরেক হাতে দিদার দেয়া প্লেন বালা। শোভনের নানী রুপালি পাতলা জরি বসিয়ে দিয়েছিল পাড় করে, বালিহাঁসের পেটের মতো পেট দেখা যেত আবছা।রবিনদা মারা যাবার পর ছন্দুদির কি হয়েছিল আমরা কেউ জানি না। কেউ খোঁজ নেয়নি। দশ বছর পরে রাঙাদা একটা ক্যাসেট রাখার আলনার সবক’টা টিডিকে ক্যাসেটের বাইরের শিরদাঁড়ায় ছন্দুদির ছবি ফালি ফালি করে কেটে লাগিয়েছিল… দেখলে মনে হোত ক্যাসেটের আলনা বেয়ে সায়রা বানু ছন্দে ছন্দে নেমে যাচ্ছে। এইসব আমি কাজরীকে বলতেই যাচ্ছিলাম, লতিকার মেয়ের ছড়াটার কথা বেমক্কা মনে পড়ে গেল বলে বললাম না।

আমি চুপ করে রয়েছি দেখে শ্বাসের তলা থেকে একটা গালি দিয়ে কাজরী ও’ঘরে চলে গেল। একটু পর সেলাইমেশিনের ঝরঝর শব্দ হতে থাকলো, আমিও বুঝতে পেলাম- ও এখন আর এ’ঘরে আসবে না। আমি খামটা উলটে পালটে দেখলাম, কোথাও প্রেরকের ঠিকানা লেখা নেই। খামটা তুলে নিয়ে শুঁকলাম, ভাগ্যিস কাজরী এ’ঘরে নেই, শীতকালের সন্ধ্যাবেলা দা-কাটা তামাকে নলি-গুড় মাখবার মিষ্টি গভীর গন্ধখানা শোভনদের উঠানে ভুরভুর করতো, সেই গন্ধ খামে। আসলে কোনো গন্ধই নেই, কাগজের একরকম কাগুজে গন্ধ ছাড়া। খামে ঐ গন্ধটার কথা আমার বানানো। অন্য খামটা খুলতেই গড়িয়ে পড়লো একটা চিবোনো তাবিজ আর একটা অষ্টধাতুর আংটি। কার কে জানে। আমি মনে করতে পারলাম না। খেজুররসের হাঁড়ি থেকে রসচুরি রোধে কি একটা পাতা রেখে দিত সিউলিরা, সে পাতা ভেজানো রসে পেটে পাক দিয়ে উঠতো রস-চোরের, আমি প্রাণপনে সে পাতাটার নাম মনে করতে চেষ্টা করলাম। মনে পড়লো না।এরপরের খামটায় কয়েক তাড়া কাগজ, ডায়রি থেকে ছিঁড়ে রাখা কাগজ, মেয়েলি হাতের লেখা। চশমাটা আবার ঘোলা হয়ে এসেছে, আসলে বুকে ঘষে লাভ নেই- পাওয়ার বেড়েছে বোধ করি। এটা ছন্দুদির হাতের লেখা, ছন্দুদি আমায় হাতের লেখা শিখিয়েছিল, ঐ বাহারী দীর্ঘ-ঈকার আমি চিনি। জমাখরচের হিসেব লেখা। বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে কবে কোন কাজের ঝি এনেছে সেসব লেখা। একটা পাতায় গোটা গোটা করে একটা নজরুলগীতি টুকে রাখা- ‘রাঙামাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশী’… ‘চোখে ভাল লাগে যাকে/ তাকে দেখব পথের বাঁকে-’ ছন্দুদিরও চোখে ভাললেগেছিল আমার দাদাকে। দাদা হাফসোয়েটার পরতো শাদা শার্টের ওপর। স্কুলবয়দের মতো লাগতো তাকে। একটা অদ্ভূত সরলতায় ছেয়ে থাকতো তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর সবল দাঁতের সারি। চুল ব্যাকব্রাশ করা, এত চকচকে আর কালো যে মনে হতো কলপ দিয়েছে। আর চোখ। শুধু উত্তর আকাশে এমন নীল নীল আলো খেলে। আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেবার সাথে সাথে দাদার সব ছবি গায়েব হয়ে গেছিল।দাদার কথা মনে পড়তেই আমার এমন হেঁচকি তুলে কান্না এলো, ও’ঘরে সেলাইকলের ঝরঝর আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চাই না আমায় কাজরী এমন দশায় দেখুক।

মশারি গুঁজতে এসেছিল কাজরী, আজকাল প্রথম রাতে পাখা চালাতে হয়, শেষরাতের দিকে শীতে গা কুঁকড়ে আসে। আমি তো উঠে গিয়ে কমাতে বাড়াতে পারি না। কাজরীই কখনো এসে পাখা বন্ধ করে দিয়ে যায়। নিচু হয়ে মশারি হাতড়াচ্ছে কাজরী, ওর গলার সরু হারখানার একটা লকেট ঝুলছে- (স্বাস্থ্যবান একটি পুরুষ যেমন করে হাত রাখে তার স্ত্রীর গায়ে, তেমন করে কখনো রাখিনাই। আমি কেবল বেত্রাহত কুকুরের মতো কাঁদতাম…) একটু খোশামুদে সুরে সে জিজ্ঞেস করলো, “পাখা বন্ধ করে দেব এখনি?” হিন্দুর ঘরে গলগ্রহ মেয়ের অভাব হয়না, কাজরীকে তো তেলভান্ড মাথায় করে চিতায় লাফ দিতে হয়নি, জীয়ন্ত সমাধিও দেয়া হয়নি, একটা তোবড়ানো লোককে বিয়ে করতে হয়েছে শুধু। আমি মাথা নেড়ে না করলাম, সে চলে গেল শুতে। ঘুমের ভেতর আমি ছটফট করি বলে কাজরী ও-ঘরে শোয়। আগে আমার আঙুল খড়কে কাঠির মতো ওর গায়ে বিঁধতো বলে ও এ-ঘরেই পাশ ফিরে শুতো। আচ্ছা, এ আমি বানিয়ে বলছি। কাজরী বলেনি। তবে এ-ঘরে কাজরী ঘুমোয় না বলে আমি ওর গা থেকে তেজপাতাগন্ধী টুথপেস্ট- শিউলিগন্ধী ট্যালকম পাউডার- হিমানী- ঘাম সবকিছুর মিলিত গন্ধটা আর নিতে পারি না। আমার গায়ে কারো ছোঁয়াচ লাগে না বলে আমারই আর নিজের শরীরটাকে শরীর লাগে না।

আলো নিভে যেতেই জলের তোড় থেকে আমায় যত ঠেসমূল বাঁচিয়ে রাখছিল, সেগুলি ধ্বসে পড়ে। দাদার একটা ছবি যুদ্ধকালীন কে যেন আমাদের হাতে এনে দিয়েছিল, ছবিতে দাদার পেছনে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত।চকচকে চুল আর সুদূর চোখ নিয়ে দাদা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। সেই ছবিটা এখন কার কাছে?ভুলে আমার হাত পড়লো যেন পান্তাবুড়ির হাঁড়িতে, যেখানে লুকিয়ে আছে কৃষ্ণকায় শিঙ্গিমাছ। যুদ্ধের কথা আমি ভাববোই না, ভাববোই না। দাদা আর রাঙাদা কেন মণিপিসীর শাড়ি পরে কাজল-লিপিস্টিক দিয়ে আমাদের নেচে দেখাত?কাঁচের গুঁড়ো- সাবুর মাড় আর বালিটালি দিয়ে দাদার ঈগলচোখো তদারকিতে আমরা হাত-মাঞ্জা বানাতাম। আমি আর শোভন। আমাদের ঘুড়ি ছিল ময়ূরপঙ্খী- মোমবাতি- মুখপোড়া… ‘ম’ দিয়েই শুধু নাম মনে আছে কেন? চালতাগাছতলা থেকে কুকুরটা কেঁউউউ করে উঠলো আর আমি ভয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। পাশের ঘরে কাজরীর খাটে ক্যাঁচ করে শব্দ হলো, তার মানে কাজরী উঠে বসে ভাবছে একবারটি এসে দেখবে আমার কি হলো। কিছুক্ষণ পর আবার কোঁচকরে ভারমুক্ত শব্দটা হলো। মানে, কাজরী উঠবার চিন্তা বাদ দিয়ে শুয়ে পড়লো নির্ঘাত। আমিও ফিরে গেলাম একটা মাঠে- আলকুশি লতা, বনখেজুর, ময়নাকাঁটা সাফ করে একদিকে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কেটেছে দাদারা। আমরা আর শোভনরা খেলবো। পীরসাহেবের কোলে বসে শোভন কাঠের ফলকে লিখলো বিসমিল্লা। হাতেখড়িতে আমি খাগের কলমে তালপাতায় লিখলাম ‘অ’। অ-তে হয় অশোভন। হিহিহিঃ। মৌলুদশরীফের পরে বেঁটে দেয়া রসগোল্লা আর প্যারাকী, লক্ষীপূজার চিঁড়ের নাড়ু।আগরবাতির নিচে উল্লম্ব রেখায় ভস্ম ঝরে পড়তো ওদের ফরাসে। ধুনোর জ্বালায় চোখ জ্বলতো আমাদের বাড়িতে।শোভনের আব্বা শোভনের আম্মার চাচাতো ভাই। আমার দাদা আর রাঙাদা আমাদের তুতো দিদি ছন্দুর প্রেমে পড়ে গেল একসাথে, হিন্দুর ঘরে এ’সব হয় না কেউ মনে করিয়ে দিল না। মহাভারত পড়ে শোনাতো আমার দিদা, চিত্রাঙ্গদার গায়ের বন্ন ঘোর বৃষ্টিতে ভেজা মহুয়া ফুলের মতন, আমার দাদারা শুনতো-‘ছন্দুদির মতন’!গ্রামকে গ্রাম যখন ছাড়খার হতে থাকলো পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে, দাদা যুদ্ধে গেল কারণ দাদা তো এই গল্পের নায়ক, আমরা আর শোভনরা পালালাম, প্রথমে শহর ছেড়ে, তারপর গ্রাম ছেড়ে। নাম তো আর মনে নেই, একটা গ্রাম ছেড়ে পালাবার সময় দেখেছিলাম মোটে সার্কাসের তাঁবু ফেলেছিল লোকে সে গ্রামের মাঠে- আগুন দেয়া ঘরবাড়ি ফেলে মানুষ পড়িমড়ি করে পালাচ্ছে- সার্কাসের পঞ্জরসার বাঘটা খাঁচায় বসে ভয়ে কাঁপছে- হাতিটা ক্রমাগত মাথা দোলাচ্ছে আর তার গলার ঘন্টা বাজছে। ছন্দুদির গায়ে প্রতিদিন ভুষোকালি মেখে রাখা হতো, মেয়েদের হাতে পেলে আর রক্ষা নাই, গ্রামের লোকেই ধরিয়ে দিত কত মেয়েকে। যুদ্ধের ভেতর সকলে মিলে রবিনদার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল ছন্দুদির। কি না, ভাল কাবাডি খেলতো সে। সুঠাম খেলুড়ি। আর দাদা পোকার লার্ভা সরিয়ে মোটা ভাত খেতে থাকলো প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। লুকিয়ে থাকতে শিখলো জলের তলায়। আহা যুদ্ধের কথা আমি ভাববো না। আমায় বাঁচতে হবে।

সকালে ইস্কুলে যাওয়ার আগে কাজরী দিদিমনি আজ আমার ঘরের সামনে দাঁড়ালো। এমনিতে কখনো দাঁড়ায়না।

-খামক’টা খুলেছ?”

আমি মাথা নেড়ে অর্ধসত্য বললাম। কাজরী চোখের তারকাহেলনে আমায় নিকৃষ্ট গালি দিয়ে হটে গেল। গেটের কাছে লতিকার সাথে দেখা হয়ে গেল নিশ্চয়ই। লতিকার মেয়ে কলকলিয়ে ঢুকলো ঘরে, গা-গরম হলে সে ইস্কুলে যায় না। আলুকাবলি দেখলে আর নোলা সামলাতে পারে না, ও তো হবেই। আমরা যারা সাধারণ লোক তাদের দিন শুরু হলো। এই আমরা যারা জীবিকাবিচ্যুত লোক। যারা ভয়ার্ত লোক। তাই যারা মনুষ্যেতর লোক।

অন্য খামদু’টোর একটিতে আরো কয়েক গোছা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। ছন্দুদির ডায়েরিকে এমন করে ছিঁড়লো কে? তাও যদি জরুরী কিছু থাকতো। রাজ্যের মুদি দোকানের হিসেব। সংসারখরচ আর দেনার হিসেব। ঝিয়ের ঠিকানা। আহা এই বুঝি আমার দাদাদের সেই ‘মহুয়াবনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি’! অন্যটিতে একটা শাদাকালো ছবি। দরজার কপাটে আলতো হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো দিনের নায়িকা, পাউডার পাফ আলতো করে বুলানো মুখে অমলিন অবারিত হাসি, দাঁতগুলো ঝকঝক করছে। সাটিনের বুটিদার ব্লাউজ, কুঁচিয়ে পরা পাতলা জরিপাড় শাড়ি।দু’কানের সামনে আলোকঝুরির মতো জুলপি গাল আলো করে রেখেছে, সিঁথি নিপুণ করে কাটা- ঢেউ খেলানো চুল পিঠে ফেলা আর বাঁ কানের পেছনে একটা হেয়ারক্লিপ আঁটা। আচ্ছা আজকাল কি আর কেউ হেয়ারক্লিপ দেয় মাথায়? লতিকার মেয়ে দেয় অবশ্য। ছবিটার পিছে অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা- “দুঃখপ্রাপ্তি কেবল আমার জীবনেরই উদ্দেশ্য নয়, এইই জীবনের উদ্দেশ্য। কেননা জীবন পীড়াদায়ক। জীবনযাত্রার মূলসুর অবিচার। অবিরাম দুঃখের ভিতর দিয়ে যাত্রাই জীবনের যাত্রা। তোমার সকল আন্তরিক প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দেয়াই এই পাশাবতীর উদ্দেশ্য।”

এইসব জিনিস আমায় কে পাঠালো? ছন্দুদি নিজেই? সে কি বেঁচে আছে? কোথায় আছে, এপারে না ওপারে? মনে পড়েছে, পাকা চোর রসের হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে পাতাটা তুলে নিতে ভুলতো না, আরো পাকা চোর প্রথমে মেটে হাঁড়িতে একটা টোকা দিয়ে নিত, রসের রসিক কালসাপ হাঁড়িতে সেঁধিয়ে থাকলে মাথা তুলবেই- নইলে মরতে হবে। এই যেভাবে রবিনদা মারা পড়েছিলেন শুনেছিলাম। আমার নায়ক যাকে ভালবাসতো, তার স্বামী সারা বাংলাদেশ যখন রক্তস্নান করে চলেছে, তখন রসচুরি করতে গিয়ে মারা পড়লেন- একটা বীরোচিত মৃত্যুও কি তাঁর হতে পারতো না? এই যে আমি সারাদিন তক্তাপোশের আয়তক্ষেত্রখানা আর কচুঝোপে আচ্ছন্ন একটা পানাপুকুর পাহারা দিচ্ছিই দিচ্ছিই-, সন্ধ্যাবেলা ‘কৃষিদর্শন’এ পটলচাষ দেখছি আর কাজরীর হুড়কো খুলবার শব্দ শুনতে কান পাতছি, আমারই কি সাজে এমন দাদার ভাই হওয়া। যাই হোক, খাম উলটে পালটে প্রেরকের কোনো হদিশ করতে পারলাম না। গলাখাঁকারি দিয়ে লতিকাকে ডাকলাম, লতিকা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে বুকের তলা মুছতে লাগলো, শীত পড়েছে নামমাত্র- তা বলে এমনি করে ঘামবার মতো কিছু হয়নি। বলরাম বলে সেই ছেলেটাকে ডেকে এনে বারান্দার আলোটা ঠিক করাতে হবে, সেটা তাকে মনে করিয়ে দিলাম। সে গা মুছতে মুছতে চলে গেল। ঘরে রয়ে গেল বয়রা বিড়ির গন্ধ।

সে যাওয়ার পর মনে পড়লো, ওকে বলতে হবে পোস্টাপিসে গিয়ে জেনে আসতে এই খাম কোত্থেকে এসেছে। আমি মুখ্যু লোক। সীলটিল দেখে আমি বুঝি না। কাজরীকে বলে দিলেই হতো। কেন আমি লতিকাকে বলছি এ’কাজের কথা? আমার শরীর জলঢোঁড়ার মতো, নির্বিষ, সে শরীরেই সহসা রাগ এসে ভর করলো। কেন আমি কাজরীকে এ অনুরোধ করবো? কাজরী আমার কে? সে কি আমার সারাদিনের সঙ্গী? যে আমার কঁকানি শুনেও উঠে আসে না রাতে, সে কি আমার কেউ? তার ওপর ঐ কালো রুটি আর ঐ গুয়ে ঘ্যাঁট!

সন্ধ্যে নাগাদ আমার রাগ পড়ে আসে। আগেই বলেছি জীবিকাচ্যুতরা মনুষ্যেতর লোক। তাদের কিছু থাকতে নেই। রাগও না। কাজরীর ভরসায় আমি বেঁচে আছি। ও আমাকে খাইয়ে-আঁচিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে বৈকি। টালির বারান্দাটায় ওবাড়ির বৌ এসে কিছুক্ষণ অলসমনে চুল আঁচড়ালো, খোঁপা বাঁধলো আর খুললো। পুকুরের ওপারে ধুঁধুলের মাচাটার ওপর হালকা কুয়াশা জমেছে। কাজরী দিদিমনির ইস্কুল করা শেষ হয় না। ব্যাংক অফ বরোদার সামনে ঐ শাড়ির দোকানটায় ঢোকা শেষ হয় না। লতিকা দেখেছে। জনপ্রিয় লন্ড্রীর সামনে দাঁড়িয়ে সুকুলের সাথে হেসে হেসে কথা বলা ফুরায় না। লতিকা দেখেছে। এইসব ইতরতা আমায় ভাল মানায়। আমি যে লতিকাকে জিজ্ঞেস করে করে জেনেছি তা কি আর বলতে পারি কাউকে, জানাতে পারি কী ঈর্ষা আমি করি মানুষের জঙ্গমতাকে! লোকে কতটা উজিয়ে গিয়ে অপরের সাথে মেশে, কতদূর দৌড়ে আর পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছেছিলাম শোভনদের গ্রামের বাড়িতে? (বাড়িটার নাম ছিল ‘কুসুমবাগ’।) দেশ স্বাধীন হলো, আমরা শীতের মাঠে উজাড় পানের বরজে পাকা পানপাতা ঝরতে দেখলাম, ঘন্টাধ্বনির মতন শূন্য দেশ, ঐ সার্কাসের হাতিটার গলার ঘন্টার মতো, যে মাঠে ফসল নাই- ঢাউস ঘুড্ডি নাই। তবু কত আশা। গ্রামে গিয়ে পড়ে রইলাম আমি আর শোভন। বহুমুখী ইস্কুল গড়বো, যৌথ খামার গড়বো, হাঁসের গুয়ে মাছপুকুরের মাছ পুষব। মৃত্তিকাপূজক হবো। এই মাটিতে কোথাও নিশ্চয়ই আমার দাদার শেষ শয়ান। তারপর আবার ফিরে এলাম শহরে। শোভন খুন হয়ে গেল একদিন। আমি পালালাম। পালিয়ে বাঁচতে পারলাম কই। ‘তোমার নেতা আমার নেতা’ নেই, চশমাদার নতুন নেতা এসেছে। ‘আপদাড়ি সাচ্চা, আপদাড়ি আচ্ছা’ হলো। সার্ক হলো। সাফগেমস হলো। দেশে দেশে কত খাওয়া-মাখা হলো। বই হলো একাট্টা হয়ে। মিঠুনের স্যাঙাতদের ভেতর একজন ছিল আমার রাঙাদা। বলেছি না? একদিন মণিপিসীরা বোরকা পরে রাতের অন্ধকারে ভারত পালিয়ে গিয়ে স্বাধীন হলো। আমিও, আর ক’টা দিন আগে যদি পালাতাম! আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, আমার দাদা মারা যায়নি। ক্ষোভে- শোকে জর্জর দাদা কি কোথাও আবার জীবন শুরু করেছে?

কাজরী খুব গম্ভীর মুখে বাড়ি ফেরে আজ, ফিরেই সোজা রান্নাঘরে। লতিকা সশব্দে সিরিয়াল দেখছে আর পায়ের হাজায় কি একটা ওষুধ মাখছে। লতিকার মেয়ে তারস্বরে নামতা পড়ছে। সর্ষের তেল গরম করে কাজরী এই রাজ্যের সবগুলো শুকনোলংকা ফোড়ন দিল বোধ করি, হাঁচতে হাঁচতে মরবার উপক্রম আমার। লতিকা এসে আমার ঘরের জানালাটা একটু ফাঁক করে দিয়ে গেল। ও ফিরে যাবার পর কাজরী ওকে বকলো কিছুক্ষণ, আজো বলরামকে খবর দেয়নি বলে। লতিকাও ঢের জবাব দিল, ওর বর সুরকি মিলের চাকরিটা হারাবার পর থেকে খুব মেজাজ হয়েছে লতিকার।

কোন বাড়িতে যেন খুব জোরে খবর শুনছে কেউ। মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে আমি খামগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। কার খেয়ালিপনা এমন? মশারির চাল পাখার হাওয়ায় ফুলে উঠেছে, ডোরাকাটা সুতোর মশারি, (আমার মায়ের ছিল এটা) সেদিকে তাকিয়ে মনে ভাবলাম, তোমার দিকে না পৌঁছনোর অপ্রাপনীয়তা নিয়েই আমার জীবন কাটাতে হবে।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত