বেশি বয়সের পুরুষ মানুষ কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করলে যেসব সমস্যায় পড়ে, তার একটা হলো বউয়ের আবদার রক্ষা করা। বাচ্চু মিয়ার কথা ধরুন। তার বউ রাহেলা বলেছে, এবার ঈদে তাকে একটা জামদানী শাড়ি কিনে দিতে হবে। বিয়ের পর প্রথম ঈদ। এ সময় বউয়ের আবদার বড় স্পর্শকাতর। টানাপোড়েনের সংসারে বাপের মৃত্যুর পর সোমত্ত বোনের বিয়ে দিয়ে নিজে বিয়ে করতে করতে বাচ্চু মিয়ার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই হয়ে গেল। এই বয়সী লোককে মফঃস্বল শহরের কেউ মেয়ে দিতে চায় না। অগত্যা গ্রাম থেকে এক গরীব পরিবারের মেয়ে রাহেলাকে সে বিয়ে করে নিয়ে এল। রাহেলার বয়স ষোল সতেরোর বেশি নয়। তার চোখে মুখে শিশিরভেজা সদ্য ফোটা গোলাপের হাসি। গাঁও গেরামের গরীব ঘরের মেয়ে। বয়স যাই হোক, স্বামী পেয়েই সে খুশি। কিন্তু শশুর বাড়ি থেকে ছেলে কিছু না পাওয়ায় বাচ্চু মিয়ার মা নাখোশ। বুড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রাহেলাকে শাপ-শাপান্ত করে। তবু হাভাতে ঘরের মেয়ে রাহেলার মুখ থেকে হাসি যায় না। সে কলপাড়ে বসে থালা বাসন মাজে, রান্নাঘরে লাকড়ি তোলে, উঠোন ঝাড়ু দেয় আর ফিক ফিক করে হাসে। শাশুড়ি যে কি বলে, বেশিরভাগ কথাই সে বোঝে না।
তো এই নতুন বউ রাহেলা স্বামীর কাছে শাড়ির আবদার করেছে। তাও আবার জামদানী। কম দামের জামদানী শাড়িও তিন হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বাচ্চু মিয়া শাড়ির দোকানেই সেলসম্যানের কাজ করে। শাড়ির দাম তার মুখস্থ। বউয়ের আবদার শুনে তার বুক ধড়াস্ করে ওঠে। তার এক মাসের বেতন তিন হাজার টাকা। ঈদের সময় এক হাজার টাকা বোনাস। এর বাইরে তার আর কোন রোজগার নেই।
সারাদিন অসংখ্য শাড়ির ভাঁজ খুলে নিজের গায়ে জড়িয়ে খদ্দেরকে দেখাতে হয়। বাচ্চু মিয়ার অধিকাংশ খদ্দেরই মহিলা। তারা একেক সময় একেক আবদার করে। বলে, ‘আঁচলটা কেমন, দেখি!’ শাড়ির আঁচল নিজের বুকের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বাচ্চু মিয়াকে দেখাতে হয়। তার লজ্জা লজ্জা করে। কিন্তু উপায় কি? এটাই তার চাকরি। মহাজন এই কাজের জন্যই তাকেসহ দোকানের চারজন সেলসম্যানকে বেতন দেয়।
‘এই পাড়টা নীলের ওপর হলে ভালো হতো’ অথবা ‘আঁচলের কাজটা বডিতে হলে ভালো হতো’–খদ্দেরের এমন নানারকম ‘ভালো হতো’র জবাব হাসিমুখে দিতে হয়। একটুও রাগ করা যাবেনা। বয়স যতই হোক, কোন মহিলা খদ্দেরকে খালাম্মা, চাচিমা এসব সম্বোধন করা যাবেনা। বলতে হবে ‘আপা’ অথবা ‘ম্যাডাম’। মালিকের কড়া নির্দেশ। একটার জায়গায় বিশটা শাড়ি দেখতে চাইলেও দাঁত বের করে তা’ দেখাতে হবে। কখনোই বিরক্ত হওয়া যাবেনা। বেনারসি, জামদানী, কাতান, কাঞ্জিভরম, সিল্ক, তসর, টাঙ্গাইল, ছাপা-এমন কোন শাড়ি নেই, যা বাচ্চু মিয়ার গায়ে ওঠেনি। একজন মহিলা সারা জীবনেও এত শাড়ির স্পর্শ পায় না। পরিচিত লোকজন দোকানে এলে বা দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে গায়ে শাড়ি জড়ানো অবস্থায় বাচ্চু মিয়ার অস্বস্তি হয়। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঈদ বা পূজা পার্বণে এই অবস্থা চরমে ওঠে।
পনের বছর হলো এই দোকানে চাকরি করছে বাচ্চু মিয়া। কিন্তু কোন দিন সে যা করেনি, রাহেলাকে খুশি করতে গিয়ে এবার সে তাই করলো। ঈদের চারদিন আগে সে দোকান থেকে একখানা জামদানী শাড়ি চুরি করে ঘরে নিয়ে এল। কিন্তু রাহেলা চুরি করা শাড়ি পরবে না। তাকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারছেনা বাচ্চু মিয়া। হাসি খুশি রাহেলার চেহারা গম্ভীর। তার চোখ মুখ থেকে কিশোরী মেয়ের চপলতা উধাও। যেন এক মুহূর্তেই সে অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়ের পর তার এই চেহারা কখনো দেখেনি বাচ্চু মিয়া। সে বিব্রত মুখে বলে, ‘আচ্ছা নে, এবারকার মতো পর। আর কোনদিন আনবো না।’
রাহেলা চিৎকার করে বলে, ‘না, না। আপনি এক্ষুনি এই শাড়ি ফেরত দিয়ে আসেন। না হলে আমি পাড়ার সবাইকে বলে দেব।’
‘সর্বনাশ!’ বাচ্চু মিয়া বউয়ের মুখ চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলে, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই শাড়ি ফেরত দিতে গেলে আমি ধরা পড়ে যাবো। আমার চাকরি থাকবে না। সবাই আমাকে চোর বলে ঘৃণা করবে।’
‘আপনি তো চোরই। আমিও আপনাকে ঘেন্না করি।’
‘এসব তুই কি বলছিস?’ বাচ্চু মিয়া মহা বেকুব, ‘তোর শখ মেটানোর জন্য আমি এটা নিয়ে এলাম, আর তুই আমার সাথে এমন করছিস? ছিঃ ছিঃ, আগে জানলে এই কাজ করতাম না।’
রাহেলা কোন কথা শুনতে রাজি নয়। তার এক কথা, এই শাড়ি এক্ষুনি দোকানে ফেরত দিতে হবে। তা’ না হলে সে শাশুড়িসহ পাড়া-প্রতিবেশি সবাইকে বলে দেবে। ভীষণ বিপাকে পড়ে গেল বাচ্চু মিয়া। গিলে ফেলা সহজ, কিন্তু বমি করা কঠিন। এই শাড়ি দোকানে চুপি চুপি রেখে আসা সম্ভব নয়। ও কাজ করতে গেলে সে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে। অন্য দোকানে বিক্রি করতে গেলেও জানাজানি হয়ে যাবে। বাচ্চু মিয়া যে ‘গফুর এন্ড সন্স’ দোকানের কর্মচারী, তা’ বাজারের সবাই জানে। ভারি মুশকিল হয়ে গেল। এই শাড়ি এখন বাচ্চু মিয়ার গলার কাঁটা।
শেষে বউকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটা রাতের জন্য শাড়িটা ঘরে রাখার অনুমতি পেল বাচ্চু মিয়া। বউয়ের কঠিন শর্ত, কাল সকালে দোকানে যাবার সময় অবশ্যই শাড়িটা নিয়ে যেতে হবে। বউয়ের শর্ত মেনে আপাততঃ রেহাই পেল সে।
রাতে ঘুমের মধ্যে বাচ্চু মিয়া স্বপ্ন দেখলো। ঈদের পরদিন তার বউ জামদানী শাড়ি পরে সেজে গুজে স্বামীর সাথে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে। সেখানে গ্রামের মেয়েরা তার শাড়ি দেখে অবাক। এত দামি শাড়ি কিনে দিয়েছে তার স্বামী? রাহেলার কপাল বটে! ফেরেশতার মতো স্বামী পেয়েছে সে। শহরে বিয়ে হবার এই এক সুবিধা। শহরের ছেলেদের মন বড় হয়। গ্রামে স্বামীদের হাতে যত টাকাই থাক, বউকে তারা কখনো এত দামের শাড়ি কিনে দেবে না। তারা টাকা জমিয়ে জমিয়ে শুধু জমি কেনে।
শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চু মিয়া খুব সম্মান পেল। বাড়ির পোষা মোরগ জবাই করা হলো জামাইয়ের জন্য। রাহেলা জামদানী শাড়ি পরে মোড়া পেতে বসে রইল উঠোনে। তার মুখে স্বর্গের হাসি। ঘোমটা টানা প্রতিবেশি মহিলারা ভিড় করে দেখছে তাকে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে রাহেলার শাড়ির আঁচল হাত দিয়ে পরখ করে চোখ কপালে তুলে ফিরে যাচ্ছে। বাচ্চু মিয়ার শাশুড়ি রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। শশুর নিজ হাতে ডাব কেটে জামাইয়ের হাতে দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চু মিয়ার দশ বছর বয়সী পিচ্চি শ্যালক তার দুলাভাইয়ের জন্য ঝোপ ঝাড় খুঁজে কিছু বেতফল নিয়ে এসেছে। খোসা ছাড়িয়ে সেগুলো একটা মাটির সানকিতে জমা করছে সে।
রাহেলার ধাক্কাধাক্কিতে বাচ্চু মিয়ার সুখস্বপ্নের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল হয়ে গেছে। চাটাইয়ের বেড়ার ফাঁক গলে কাঁচা রোদ এসে ঢুকেছে ঘরে। ঘড়িতে সাতটা বাজে। আটটার মধ্যে দোকানে পৌঁছাতে হবে। দেরি হলে মহাজন রাগারাগি করে। খুব দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে প্রস্তুত হলো বাচ্চু মিয়া। রাহেলা তোষকের নিচ থেকে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো শাড়িটা এনে ওর হাতে দিয়ে গম্ভীর মুখে বললো, ‘এবার ঈদে আমাকে কোন শাড়ি দিতে হবেনা। আপনি এমন কাজ আর করবেন না।’ বাচ্চু মিয়া শাড়ি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলে ওর বৃদ্ধা মা কলতলা থেকে চেঁচিয়ে বললো, ‘তোর হাতে ওটা কি রে, বাচ্চু?’
‘কিছু না, মা।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে হন হন করে হেঁটে বাচ্চু মিয়া মোড় পর্যন্ত এসে দোকানের দিকে না গিয়ে অন্য রাস্তায় রওনা হলো। শাড়িটা কোথাও ফেলে দিতে হবে। শহরের বড় ড্রেনটা যেখানে গিয়ে খালের সাথে মিশেছে, সেখানে সবার অজান্তে এই কাজ সারতে হবে। মোড় থেকে মাইলখানেক হাঁটা রাস্তা। বাচ্চু মিয়া তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
পথে এক মুদি দোকানের সামনে জটলা দেখে থেমে গেল সে। ছেলে বুড়ো, নারী পুরুষ সবাই হট্টগোল করছে। মাঝবয়সী লুঙ্গি পরা খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা এক লোককে ঘিরে তাদের হৈ চৈ। বাচ্চু মিয়া ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে, লোকটির দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মুখে ভুষা কালি আর চুনের ছোপ ছোপ দাগ। গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো পুরনো জুতা স্যান্ডেলের মালা। তাকে এখন এই মহল্লার পথে পথে ঘোরানো হবে। মুদি দোকান থেকে দুধের প্যাকেট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় লোকটির এই শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন অতি উৎসাহী যুবক এক পাটি রাবারের জুতা হাতে লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাজ হলো, নতুন কেউ চোরটিকে দেখতে এলে তার হাতে রাবারের জুতা ধরিয়ে দিয়ে চোরের গালে মারার ব্যবস্থা করা। বাচ্চু মিয়াকেও জুতা দিয়ে মারতে বলা হলো। দু’একজন যারা বাচ্চু মিয়াকে চেনে, তারা হৈ হৈ করে উঠলো, ‘বাচ্চু ভাই, মারেন, মারেন।’
বাচ্চু মিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি করবে, সে বুঝতে পারছেনা। চার দিক থেকে সমস্বরে চিৎকার, ‘মারেন, মারেন।’ চোরের গালে এক ঘা জুতা মেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল বাচ্চু মিয়া। ‘আরও দুটা বাচ্চু ভাই, আরও দুটা। মোট তিনটা মারেন।’ বাচ্চু মিয়া আরো দুই ঘা মেরে জুতা ফেলে দিল। তারপর সে অতি দ্রুত ভিড় ঠেলে বেরিয়ে দিকভ্রান্তের মতো হাঁটা দিল খালের দিকে। তার বগলে কাগজে মোড়ানো জামদানী শাড়ি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেলে দিতে হবে এটা। নরম শাড়ি এখন তার বগলের নিচে কাঁটা হয়ে ফুটছে।
শহরের নালা ও খালের সংযোগস্থলে একটা ইটের ওপর পেশাব করার মতো করে বসে আশেপাশে কেউ আছে কি না দেখে নিল বাচ্চু মিয়া। না, তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে ওর। মাথাটা ভীষণ ভারি। মনে হচ্ছে, মাথার ভেতর লোহা লক্কড় ভরে বসে আছে সে।
আবর্জনাসহ নোংরা কালো পানি ড্রেন থেকে বেরিয়ে স্রোতের মতো মিশে যাচ্ছে খালের পানিতে। বিরামহীন কল কল শব্দ। আর একবার এদিক ওদিক দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শাড়িটা পানিতে ফেলে দিল বাচ্চু মিয়া। ‘আহ্!’
মিনিটখানেক চোখ বন্ধ করে বসে থেকে উঠে পড়লো সে। তারপর টলমলে পায়ে একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্প পোষ্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের পায়ের কালো স্যান্ডেল জোড়ার দিকে নজর গেল ওর। এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো সে। তারপর পা থেকে এক পাটি স্যান্ডেল খুলে আচমকা নিজের গালে ঠাস ঠাস করে তিন ঘা বসিয়ে দিল বাচ্চু মিয়া। স্কুলে যাওয়ার পথে একদল ছেলেমেয়ে ওর এই কাণ্ড দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা বোঝার চেষ্টা করছে লোকটা পাগল কি না! বাচ্চু মিয়া ওদেরকে চলে যাওয়ার জন্য ধমক দিতেই ওরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, ‘পাগল, পাগল!’ তারপর রাস্তায় পড়ে থাকা নুড়ি পাথর ও ঢিল তুলে ওরা ছুঁড়তে লাগলো বাচ্চু মিয়ার দিকে।
বাচ্চু মিয়া সত্যি সত্যিই পাগলের মতো দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল। ছেলেমেয়েরা পেছন থেকে ঢিল ছুঁড়ছে ওর দিকে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে বাচ্চু মিয়া। ‘এ্যাই, এ্যাই’ বলে চিৎকার করে সে সাবধান করছে বাচ্চাদের। কিন্তু তাতে ওদের উৎসাহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিপুল বিক্রমে ইট পাটকেল ছুঁড়ছে ওরা। এক পাটি স্যান্ডেল থেকে গেছে রাস্তায়। পাগলের মতো এক পাটি স্যান্ডেল পরে দু’হাতে মাথা ঢেকে দৌড়াচ্ছে বাচ্চু মিয়া।