রোজার ঈদের অনেক আগে থেকেই বাঙালির সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনায় একটা তেজি ভাব এসে যায়। নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা দাম চাঁদে পৌঁছে দেওয়ার ছক আঁকেন, অনিত্যপণ্যের সওদাগরেরা সৃষ্টিশীল ফাঁদ পাতেন সুবোধ-নির্বোধ—সব মক্কেলের জন্য। অসাধু চাকরিজীবীরা সৃষ্টিশীল উপায় খোঁজেন কাজ ফাঁকি দেওয়ার, করতল তৈলাক্ত করার—অর্থাৎ বেতন-ভাতার বাইরে আসা চিকন-মোটা নানা খাম হস্তগত করার—নানা কৌশলের। ট্রেন-লঞ্চের আসন দালালেরা, পুরোনো বাস মেরামত করে আর রং লাগিয়ে রাস্তায় নামানোর কারিগরেরা, এমনকি হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়রাও সৃষ্টিশীল উপার্জনের তালাশে নামে। আমাদের মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় ‘ইফতার কাভারেজ’–এর সৃষ্টিশীল ক্রেজ।
ঈদের সৃষ্টিশীল উদ্যাপনে যাঁরা শামিল হন, তাঁদের মধ্যে রন্ধন এবং নাটক-শিল্পীদের সঙ্গে আছেন লেখকেরাও। এঁদের কাজ শুরু হয় ঈদের অনেক আগে। যত আগে, তত এগিয়ে থাকা।
আমার দুর্ভাগ্য, আমাকে ঈদে দুটি উপন্যাস লিখতে বলা হয়েছে, তবে রোজা শুরু হওয়ার ঠিক আগে। আমি বুঝলাম, বড় দুই লেখক—অথবা এক লেখক, অনেকে যেহেতু এক ঈদে চার-পাঁচটা উপন্যাস নামিয়ে দেন—হয়তো শেষ মুহূর্তে জানিয়েছেন, তাঁরা লিখতে অপারগ। আমার হাতে সময় কম। অথচ সুযোগটা হাত থেকে ছাড়া যাবে না। কী করা যায় ভাবতে গিয়ে এক সম্পাদকের উপদেশ মাথায় রাখলাম। তিনি বলেছেন ঈদে পড়ার মতো উপন্যাস লিখতে।
ঈদে মানুষ কী পড়ে? আদৌ যদি পড়ে? বাস্তবের কষ্ট-দুঃখের গল্প? ব্যাংক ডাকাতি, গুম-খুনের বয়ান? অভাব–অনটন, আবগারি শুল্কের আর সঞ্চয়পত্রের কাঁচিকাটার কাহিনি? নিশ্চয় নয়। মানুষ চায় স্বপ্ন দেখতে, জীবনটাকে সুন্দর দেখতে। মানুষ আশাবাদী হতে চায়। ঈদের খুশিটা জিইয়ে রাখতে চায়।
আমি দুটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার জোগাড় করলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। কিছু চরিত্র সৃষ্টি করলাম। তাদের মুখে দুই দলের ইশতেহার গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত জুড়ে দিলাম।
দারুণ আশাবাদী দুই উপন্যাস দাঁড়িয়ে গেল। সম্পাদকদের পাঠানোর আগে শেষবার পড়ে আমি নিজেই বিমোহিত হয়ে গেলাম। ঈদে বাড়ি যেতে যেতে যাঁরা দুটি উপন্যাস পড়বেন, তাঁরা এক সোনার বাংলার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাড়ি পৌঁছাবেন। উপন্যাস দুটি তাঁদের হাতে ঈদের চাঁদটাই তুলে দেবে।
দুই সম্পাদকই চোখে অশ্রু নিয়ে আমাকে বলেছেন, এ রকম উপন্যাস তাঁরা জীবনে পড়েননি। উপন্যাস, অর্থাৎ ফিকশন, মোটেও ফ্যাক্ট নয়—তারপরও কী বিশ্বাসজাগানিয়া।
২.
উপন্যাস শেষ করে আনন্দিত মনে জিরাচ্ছি, আরেক তরুণ সম্পাদক ফোন করে বললেন, একটা গল্প চাই। গল্পটা ঈদ-রঙ্গ নিয়ে।
আমি রাজি হলাম, কিন্তু ঈদের রঙ্গটা কী? ঈদের রং আছে জানি, তবে রঙ্গ?
আছে। যেমন রমজানে ইফতার রঙ্গ হয়, সেগুলোর নাম ইফতার পার্টি। সাহ্রি-রঙ্গ হয়, যেগুলোর মঞ্চ ঢাকার দামি পাড়াগুলোর দামি রেস্টুরেন্ট। আমার মোবাইল ফোনে বার্তা এসেছে, আসুন, এক দামে দুটি সাহ্রি খেয়ে যান। একজন কী করে দুই সাহ্রি খায়? রঙ্গটা বুঝলাম, সঙ্গে স্ত্রী নিয়ে যেতে হবে।
বেচারা ব্যাচেলররা।
দামটা কত? তিন হাজার।
রমজানে শপিং–রঙ্গ হয়। এবার অবশ্য সোনার দোকানে একটা কুফা চলছে, কিন্তু বাকি সব পণ্যশালায় চিরচেনা সেই ধন্য ধন্য রব। এই ধ্বনি অবশ্য ধন এবং ধনীদের জন্যই। তবে রবাহূত হয়ে অল্প ধনীরাও যাবেন, অধনীরাও। আমাদের অর্থমন্ত্রী এবার এক লাখ টাকার মালিকদের ‘সম্পদশালী’ বলে সম্মানিত করায় তাঁরাও হাত খুলে খরচ করবেন।
শপিং–রঙ্গের একটা ভালো দিক আছে। এবং সেটা তাদের জন্য, যারা প্রয়োজন থেকে বেশি স্বাস্থ্যবান, বিশেষ করে ভুঁড়ির দিক থেকে। তাঁরা যদি স্ত্রীদের পেছন পেছন গাউছিয়া মার্কেটে শপিংয়ে ঢুকে পড়েন, তাহলে এক ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা পর বেরিয়ে দেখবেন, ভুঁড়ি উধাও। রীতিমতো চিকন। চিকন বনিয়া বেরোলে চিকনগুনিয়াও কুপোকাত করতে পারবে না।
না, ঈদ–রঙ্গ বাদ দিয়ে আমি একটু ভিন্ন চিন্তা করি। আরেকটা ফিকশন নিয়ে লিখলে কেমন হয়? ছেলেবেলায় এক দিদিমা গল্প শোনাতেন রাজপুত্র আর রাজকন্যার, এবং ‘অতঃপর তাহারা চিরদিন সুখে-শান্তিতে থাকিতে লাগিল।’
কিন্তু এই টেলিভিশন, স্মার্টফোন আর ফেসবুকের যুগে চিরদিন চিরসুখে থাকা কি সম্ভব?
সম্ভব যে, তা আমার এক ছাত্রকে দেখে মনে হলো।
ছাত্রের নাম শরিফ। এক মাস আগে আমার পাশের দালানে একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে। ফ্ল্যাটের ভাড়া মাসে এক লাখ। অথচ সে যে সরকারি অফিসে কাজ করে, তাতে বেতন-ভাতা মিলিয়ে যা আসে, তাতে ওই ভাড়ার টাকাও মেটে না। আমি অবশ্য অবাক হইনি। কিছু সরকারি কাজে ভাগ্য হাতের মুঠোয় পোষা পাখির মতো বসে থাকে।
শরিফ আমাকে ইফতারে দাওয়াত দিল। আমার স্ত্রী চিকুন-দুনিয়ায় পড়ে আছেন। আমি একাই গেলাম। শরিফ তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তিন্নি একটু বেশি স্বাস্থ্যবান, কিন্তু খুব সপ্রতিভ মেয়ে। আমাকে বুঝিয়ে দিল, তারা কত যে সুখী। শুনে আমার বুক ভরে গেল।
‘এবার হয়েছে কি, স্যার,’ তিন্নি বলল, ‘আমি না ওর জন্য একটা স্যুট আনিয়েছি। দুবাই থেকে। সেটা একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখব বলে ঠিক করলাম। একটা আলমারির ওপর রাখা স্যামসোনাইটে…’
‘স্যুটকেসে?’
‘জি, স্যার। কিন্তু রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা প্যাকেট। খুলে দেখি একটা শাড়ি। কী দারুণ সেই শাড়ি। একটু ভাবুন, স্যার। সে-ও শাড়ি কিনে ভেবেছে, লুকিয়ে রাখবে। তারও মাথায় এসেছে ওই স্যামসোনাইট।’
আমার চোখে পানি চলে এল। তাই তো, প্রাণের মিল না হলে, প্রেমের চিরদিনের চিরসুখের মন্ত্রটা হৃদয়ে না গেঁথে গেলে এমনটি হয়?
‘এরপর কী করলে?’
‘আমি ওর স্যুটটা একটা আমেরিকান ট্যুরিস্টারে ঢুকিয়ে শাড়িটা লুকিয়ে ফেললাম।’
‘লুকিয়ে ফেললে?’
‘জি, স্যার। ওর যা ভুলো মন। হয়তো যেদিন দেবে, স্যামসোনাইট খুলে দেখে তার মনে হবে, হয়তো শাড়ি সে কেনেইনি।’
‘অর্থাৎ আরেকটা শাড়ি পাওয়া হবে?’
‘শুধু শাড়ি না স্যার। অনেক কিছু।’
তিন্নির মুখজুড়ে আনন্দ। ঈদের অগ্রিম রং।
ইফতারি খেতে বসে তাদের দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। দুজনেরই একটু বেপরোয়া ভাব।
মেয়েটি ছোট। সাত বছরের মতো বয়স। সে একটা খেজুর হাতে নিয়ে একটা মাছিকে মারার চেষ্টা করছিল। একসময় মাছিটাকে সে ঠিকই মারল। টেবিলে পিষে। তিন্নি আঁতকে উঠল। তাড়াতাড়ি মেয়ের হাত ধুতে বেসিনে নিয়ে গেল। হাত ধোয়ার পর টেবিলে বসে মেয়েটি বলল, ‘হাত দিয়ে তো মাছিটা পিষিনি।’
‘তাহলে কী দিয়ে?’
মুখে পুরা খেজুরটা দেখিয়ে সে এক গাল হাসল।
শরিফ বলল, ‘আমার ছেলেটা পড়াশোনায় একেবারে গোল্লা, স্যার। এবার স্কুল থেকে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে আসার পর সেটা দেখতে চাইলাম। সে বলল, রিপোর্ট কার্ডটা সে এক বন্ধুকে দিয়েছে। যাতে তার বাবা-মাকে সে চরম একটা ভয় দেখাতে পারে, ওকে একটু বোঝান, স্যার।’
আমি ছেলেটাকে বললাম, ‘পড়াশোনাটা করো না কেন? পরীক্ষায় ভালো করতে হবে তো।’
সে গম্ভীরভাবে আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পরীক্ষায় ভালো করেছ?’ তৃপ্তি নিয়ে বললাম, ‘সারা জীবন সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছি।’ সে আরও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তোমার আইফোন আছে? আইপ্যাড আছে, ইউনিক টর্নাডো ড্রোন আছে?’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘না।’
একটুখানি হাসল, ছেলেটার চিকন হাসি, ‘তাহলে? পরীক্ষায় ভালো করে কী লাভ হলো?’
শরিফের ঘর থেকে বেরোবার সময় মনে হলো, রাজপুত্র-রাজকন্যাদের প্রেম আসলেই আমাদের বোধগম্যির বাইরের।
৩.
পরের গল্পটা শরিফই আমাকে বলল। ঈদের পনেরো দিন পর।
তিন্নির চিকনম্যানিয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ডায়েটিং করে সে অসুখ বাঁধিয়েছে। শরিফের বাবা–মা থাকেন গ্রামে, মহিপালে। তার ছোট ভাই থাকে চাটগাঁতে। অবস্থা ভালো নয় ভাইটার, তারপরও বাবা-মাকে এবার রোজায় চাটগাঁ নিয়ে গেছে। শরিফের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব, ভাইটার সঙ্গে আরও। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক মধুর। প্রতিবারের মতো এবারও শ্বশুরালয়ে ঈদ করার সিদ্ধান্ত ছিল। আরও সিদ্ধান্ত ছিল বিমানে যাওয়ার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছেলে-মেয়ে গোঁ ধরল, তারা ট্রেনে যাবে। অনড় সিদ্ধান্ত।
ঈদের অগ্রিম বুকিং শেষ। শরিফের মতো ছেলেও আসন কিনতে পারল না। ফলে ঈদের তিন দিন আগে সকলে মিলে কমলাপুরে হাজির হলো। ভরসা দালাল। ভালো পয়সা পেয়ে দালাল ভালো আসন দিয়েছে। কিন্তু সময় নেই। দ্রুত উঠতে হবে। তড়িঘড়ি করে শরিফের পরিবার ট্রেনে উঠে পড়ল। ভয়ানক ব্যস্ততায় সময় কেটেছে শরিফ আর তিন্নির। ইফতার আর সাহ্রি পার্টি। শপিং আর শপিং—দম ফেলার সময় ছিল না। ফলে যেমন শরিফ তেমনি তিন্নিও—দুজনেই মহা রণক্লান্ত। সিটে বসেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে পড়ে, গাড়ি ছাড়তে পড়লও।
শরিফের ঘুম ভাঙল ঘণ্টা তিনেক পর। তিন্নি আগেই জেগেছে, তবে ঘুমমাখা চোখে ছেলেমেয়েকে দেখছে।
বেশ ভালোই চলছে গাড়ি। গাদাগাদি ভিড়, শরিফের উঁচু শ্রেণির কামরাতেও দুজন অতিরিক্ত যাত্রী। তারা চাটগাঁর ভাষায় কথা বলছে। শরিফ অবাক হলো। ঈদে চাটগাঁর মানুষও তাহলে রাজশাহী যায়।
ট্রেন লাকসাম স্টেশনে থামল।
লাকসাম? শরিফের চুল দাঁড়িয়ে গেল।
বেশিক্ষণ লাগল না তার বুঝতে। দালালের হাতে এই আসনগুলো ছিল চাটগাঁর ট্রেনের। প্রতি আসনে দু-হাজার টাকা লাভ পেয়ে সেগুলোই গছিয়ে দিয়েছে। সে তাড়া দিয়ে, আড়াল দিয়ে তাদের ট্রেনে তুলে উধাও হয়ে গেছে।
শরিফও বোকার মতো কাউকে না জিজ্ঞেস করেই রওনা দিয়েছে।
তিন্নি শরিফকে প্রায় ফেলেই দেবে ট্রেন থেকে। বলল, চল, এখানে নেমে নোয়া ভাড়া করে রাজশাহী যাব।
ছেলে বলল, তারা যেতে পারে, কিন্তু সে দাদার কাছে যাবে। দাদা চাটগাঁ আছেন। তার সঙ্গে আইফোনে কথা হয়।
শরিফ স্তম্ভিত হলো। নিজের ফোন বের করে ছোট ভাইকে ফোন করল।
৪.
চাটগাঁ নেমে একপ্রস্ত বাগ্যুদ্ধ হয়ে গেল শরিফ-তিন্নির। শুনে মনে হলো রূপকথা যাঁরা বানাতেন, তাঁরা রাজপুত্র-রাজকন্যার বাগ্যুদ্ধ কখনো দেখেননি।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
শরিফ বলল, টিকিট গোলমালে যা লাভ হলো, ভাইটাকে সে ফিরে পেল। বাবা-মাকে ফিরে পেল।
ছেলেটা দাদার কাছে রয়ে গেল। সে বলল, সে মহিপাল যাবে। তারপর ঢাকা। তবে মহিপালে সে থেকেও যেতে পারে। দাদাকে সে ভালোবাসে। তিন্নি রাগ করে সাত দিন প্রায় কিছুই খেল না। ঈদের দিনও না। তাতে দারুণ হলো—তার ওজন কমে গেল।
তাই দেখে সে খুশি হয়ে চিকনম্যানিয়ায় চলে গেল। আসার আগে শ্বশুর-শাশুড়িকে বাবা–মায়ের জন্য কেনা উপহার সব দিয়ে দিল। দেবর ও জার হাতে দামি সব পারফিউম আর গয়নাপত্র তুলে দিল। সে শরিফকে বলল, জিমের পেছনে কত টাকাই তো ঢাললাম, এক কেজি ওজন কমেনি। অথচ চাটগাঁ এসে…
শরিফ জানাল, তিন্নির ভেতর একটা পরিবর্তন এসেছে। সে এখন বই-টই পড়ে। ঘরেই থাকে। জিনিসপত্রে আগ্রহ নেই। অবাক, কীভাবে, সে বলতে পারে না। তবে একদিন তার বাবার সঙ্গে সে হাঁটতে বেরিয়েছিল।
অতঃপর তারা চিরদিন চিরসুখে থাকিতে লাগিল?
সংগৃহীতঃ প্রথমআলো রস রচনা।