সচরাচর সাদা শার্ট পরে বের হওয়া হয় না। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে পরি। আজ যেমন বৃষ্টির বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তাই আমার খুব প্রিয় একটা সাদা শার্ট পরেছি। বৃষ্টি আর আমার প্রায় সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক। আমরা একই অফিসে চাকরি করি। হঠাৎ ওর ফ্যামিলি থেকে বিয়ের চাপ দেওয়ায় ও আমার কথা বলে দিয়েছে। সেই হিসেবে আজকে আমার বিয়ে-সংক্রান্ত ইন্টারভিউ বলা যেতে পারে।
বৃষ্টির বাবা, মোতালেব সাহেবের অফিস নিউ ইস্কাটনে, একটি স্বনামধন্য গার্মেন্টসের মালিক তিনি। আমাকে সময় দিয়েছেন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। ঢাকার যানজটের নিয়ম মেনে সাড়ে চারটাতেই একটা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। এবং যথারীতি মৌচাকের সামনে এসেই পড়েছি জ্যামে! তবে খুব একটা চিন্তা নেই, হাতে যথেষ্ট সময় আছে। আমি ঠোঁট গোল করে শিস বাজানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।
হঠাৎ পিচিক করে একটা শব্দ হলো! তরল এবং গরম কিছু একটা আমার কাঁধ বেয়ে বুকের দিকে নামছে অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি, জায়গাটা টকটকে লাল হয়ে আছে! গুলি খেয়েছি ভেবে ‘আ আ আ আ’ করে চিৎকার দিয়ে রিকশার সিটে হাত-পা ছড়িয়ে দিলাম। রিকশাওয়ালা চমকে উঠে পেছনে তাকিয়েই ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আহ্হা রে, পিক ফালায়া কী অবস্থা করছে!’
রিকশাওয়ালার কথা শুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিনিবাসের ভেতর থেকেই কেউ এই কাজ করেছে, বুঝতে পারলাম। একদিকে প্রিয় শার্টে পানের পিক লাগার ক্ষোভ, অন্যদিকে বৃষ্টির বাবার সঙ্গে কীভাবে এই অবস্থায় দেখা করব সেই টেনশন—দুইয়ে মিলে আমার ভেতরের কবি নজরুল জেগে উঠল। আমি দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ‘কোন বেকুব রে!’ বলে রিকশা থেকে লাফ দিলাম। লাফ দেওয়ার সময় ক্যাচ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি রিকশাওয়ালার সিটের খোঁচা লেগে আমার প্যান্টের হাঁটু বরাবর সুন্দর করে ছিঁড়ে গেছে। রিকশাওয়ালার দিকে কটমট করে তাকালাম, বললাম, ‘দাঁড়া, আসতেছি, আগে পিকের ঘটনা শেষ করি, তারপর তোর বারোটা বাজাব।’ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বাসে উঠলাম। বাসের ভেতরে তেমন একটা ভিড় নেই। তবে যারা আছে, তারা আমার পিক লাগা অংশের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি গলা চড়িয়ে বললাম, ‘এই বাস থেকে কেউ একজন আমার গায়ে পানের পিক ফেলেছেন। কে ফেলেছেন, ভালোয় ভালোয় বলেন। না হলে অন্য ব্যবস্থা নেব।’
গালের ডান পাশে বিশাল কাটা দাগ খচিত ভয়ংকর-দর্শন এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। তার পানের রসে লাল হয়ে থাকা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘কী ব্যবস্থা নিবি, আয়, নিয়া যা।’ আমি চুপসে গেলাম। কিন্তু গাল কাটা লোকটা মোটেও চুপসাল না। সে সিট ছেড়ে উঠে এসে আমার অন্য পাশেও পিচিক করে পানের পিক ফেলল। তারপর মুখ দিয়ে পিকের ফোয়ারা ছুটিয়ে বলল, ‘কিরে, তোর ব্যবস্থার কত দূর?’
আমি মাথা নিচু করে কাঁপতে কাঁপতে বাস থেকে নেমে পড়লাম। বাপ রে বাপ, একটু হলে জানটাই চলে গিয়েছিল! বুকের ধুঁকপুকানি কাটতে না কাটতেই দেখি বৃষ্টির বাবার অফিসের সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সোয়া ছয়টা। আমার শরীর তখনো ভয়ে কাঁপছে, কেমন যেন ঘোরের মধ্য চলে গেছি।
রিকশা থেকেনেমে কখন কীভাবে বৃষ্টির বাবার রুমে ঢুকে পড়েছি, নিজেও জানি না। ভদ্রলোক বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারার অধিকারী। তবে এ মুহূর্তে তিনি মুগ্ধ নয়নে আমার শার্টের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘অসাধারণ, অসাধারণ ডিজাইন! তোমার রুচি আছে বলতে হবে। সাদা-লালের এমন দুর্দান্ত কম্বিনেশন আমি আমার জীবনে কখনো দেখিনি।’ হঠাৎ তাঁর চোখ গেল আমার প্যান্টের ছেঁড়া অংশের দিকে, মুখটা খুশিতে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘ইনোভেটিভ, দারুণ ইনোভেটিভ! ফরমাল প্যান্টের ডিজাইনের ইতিহাসে এ এক সাহসী পদক্ষেপ। আমার মেয়ে সত্যিই সঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়েছে…’
সুত্রঃ রস+আলো