বিশাল এক পাহাড়ি বন। সেই বনের একটা পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ানো পাশাপাশি দুটি বড় বড় মহুয়াগাছ। বোশেখ মাস। গাছ দুটিতে ফুল ফুটেছে অনেক। মহুয়া ফুলের কী মিষ্টি গন্ধ যে ছড়াচ্ছে চারপাশে! মৌমাছির গুঞ্জন। মধুখেকো পাখিদের লাফালাফি-হুড়োহুড়ি। লাল-সাদা-হলুদ প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি।
পাহাড় বেয়ে উঠে এল একটি প্রকাণ্ড কালো ভালুক। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে খেতে শুরু করল ঝরে পড়া মহুয়া ফুল। না, এগুলো কেমন যেন পুরোনো হয়ে গেছে! তাকাল ওপরের দিকে। তারপরে চড়ে বসল একটি মহুয়া গাছের মাঝামাঝি জায়গায়। হাত বাড়িয়ে ডাল-ফুল টেনে এনে মুখের কাছে ধরে কামড়ে খেতে শুরু করল টাটকা মধুগন্ধি ফুলগুলো। টানাটানিতে টুপটাপ করে কিছু ফুল ঝরে পড়ল গাছতলায়।
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে চমৎকার একটা ঝরনা নেমে গেছে নিচের দিকে। টাটকা জল। ঝরনাটি যেন মিষ্টি-সুরেলা গান গেয়েই চলেছে অনবরত।
একটি ময়ূর তার সাতটি ছানা নিয়ে পান করল ওই ঝরনার জল। তারপর পাহাড় বেয়ে উঠে এল মহুয়া তলায়। কী মজা! কত ফুল কত ফুল, বলে যেন খুশিতে ডেকে উঠল ময়ূরটি। আনন্দে মেলে দিল পেখম, কয়েক পাক ঘুরল নেচে নেচে। ছানাগুলো পিচ্চি পিচ্চি। দেখতে অনেকটাই পোষা মুরগির ছানার মতো। ওরা সমানে খেয়ে চলেছে মহুয়া ফুল। উপত্যকা থেকে বৈশাখী বাতাস যেন পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে ঝড়ের বেগে। মহুয়া গাছের ডাল-পাতায় শব্দ বাজছে, ময়ূরটি তাই মাথার ওপরের ভালুকটার অবস্থান বুঝতে পারেনি। বাতাসে ফুল ঝরছে তো ঝরছেই। ময়ূরটিও এবার খেতে শুরু করল।
এই ব্যাটা ময়ূর! ভালুকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, সাহস তো তোর কম নয়! আমার গাছের মহুয়া ফুল তুই খাচ্ছিস কোন সাহসে, অ্যা?
ময়ূর ওপরে তাকিয়ে অত বড় কালো ভালুকটিকে দেখে আর ওর গনগনে হলুদ চোখ ও লকলকে পান্না রঙের জিব দেখে ভয় একটু পেল বটে, সাহস বজায় রাখল। বলল, এই বনের সব গাছ এই বনের সব প্রাণীর। ব্যাটা কালো ভূত, গাছে বসে গিলছিস, গেল, তলার দিকে নজর দিবি না কিন্তু!
ভালুকটা এবার রাগে গো গো করতে করতে পাঁচ-সাত ফুট নিচের একটা ডালে নেমে বসল চেয়ারে বসার কায়দায়; বলল, বেয়াদব ময়ূর! সরে না গেলে কিন্তু লাফিয়ে পড়ব তোদের ঘাড়ে। জানিস তো ওজন আমার ২০০ কেজি! চাপা খেয়ে একেবারে ব্যাঙ-চ্যাপ্টা হয়ে যাবি কিন্তু!
ওই ভারী শরীর নিয়ে অত ওপর থেকে লাফ দেওয়ার সাহসই তো নেই তোর, বলল ময়ূরটি, লাফ দিলে তলায় পড়ে তোর হাড্ডিগুড্ডি-মাংস সব তালগোল পাকিয়ে যাবে।
আমি গাছে চড়ে ফুল পাড়ছি কষ্ট করে, আর তুই কিনা ছানাপোনাসহ সেই ফুল খাচ্ছিস? লজ্জা নেই তোর?
আরে কালো ভূত, বাতাসে ঝরে পড়ছে ফুল, তাই খাচ্ছি আমরা। বেশি কথা না বলে তুই গাছের ফুল খা, আমরা তলারটা খাই।
না, আমি গাছেরটাও খাব, তলারটাও খাব। শুধু তাই নয়, ওদিকের পাহাড়ের গুহায় আমার দুটো ছোট ছোট বাবু রয়েছে—মুখে করে ফুল নিয়ে যাব ওদের জন্যও।
ময়ূরটি এবার ভালুকটিকে ব্যঙ্গ করার জন্য পেখম মেলে ঘুরল দুপাক। তারপর বলল, আমার এই বাবুদের মা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সে বসে আছে ঝরনাটার পাশের একটা গাছে। আমরা তো পেট পুরে খাবই, নিয়ে যাব বাবুদের মায়ের জন্যও।
এভাবে ঝগড়াঝাঁটি চলার সুযোগ নিয়ে একটি চিতাবাঘ পা টিপে টিপে পাহাড় বেয়ে উঠে এল। যেই সে তাক করেছে ময়ূরটিকে, তখন ভালুক বলল, পালা পালা—উড়ে পালা। ছানাদের বল ছুটতে। না হলে কিন্তু…!
ময়ূরটি ঘাড় ফিরিয়েই লাফ দিতে উদ্যত চিতাবাঘটিকে দেখে ফেলল। ভয়ার্ত ‘পালা পালা বাছারা’ সতর্কসংকেত দিয়েই উড়াল দিয়ে নিচের ঝরনাটার দিকে নেমে গেল। ছানাগুলো চোখের নিমেষে কোথায় যে উধাও হলো! আর শিকার মিস হওয়ায় চিতাবাঘটি খেপে একেবারে আগুন হয়ে গেল। ওপরের দিকে তাকিয়ে চিত্কার দিয়ে বলল, ব্যাটা, মোটা মাথার কুমড়োপটাশ কালো ভালুক! ময়ূরকে সতর্ক করে দিয়ে তোর কী লাভ হলো, বল? তোর-আমার মধ্যে কী শত্রুতা বা দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ আছে যে তুই আমার মুখের গ্রাস উড়িয়ে দিলি? খিদেয় পেট আমার চোঁ চোঁ করছে। মাথা ঘুরছে।
ভালুকটা বলল, শত্রুতা-ফ্যাসাদ তো কিছু নেই। তুই খাস হরিণ-শূকর-বনমোরগ-শজারু-মথুরা আর বুনো খরগোশ। আর আমি তো বলতে গেলে নিরামিষভোজীই। ফুলের মধু, গাছের নরম শিকড়-কন্দ-উইপোকা-পিঁপড়ে হলো আমার মূল খাবার।
তাহলে কালো দত্যি, তুই আমার পেটে লাথি মারলি কেন, অ্যা? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। নেমে আয় ব্যাটা গাছতলায়। না হলে আমি কিন্তু উঠে আসব গাছে। জানিসই তো, গাছে চড়তে আমি তোর চেয়েও ওস্তাদ।
ভালুকটি শান্ত গলায় বলল, আমার কিন্তু ২০ খানা ৫ ইঞ্চি মাপের ছুরি আছে। তোর মাথা-বুক-ভুঁড়িতে টান দিলে খুন হয়ে যাবি!
চুপ ব্যাটা মাথা মোটা। আমারও আছে ২০ খানা নখ! লাফ দিতে পারি অনেক উঁচুতে। লাফ দিয়ে তোর পিঠে চেপে আজ আমি ঘোড়া দাবড়াব এই পাহাড়ি বনে।
ভালুক এবার দ্রুতবেগে গাছতলায় নেমে এসেই পেছনের দুপায়ে ভর করে ঠিক মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল। পাঁচ ইঞ্চি নখরগুলো বের করে নিজের বুকে গরিলার মতো থাপ্পড় মারতে লাগল। চিতাবাঘটিও মাটিতে বুক-পেট মিশিয়ে পজিশন নিয়ে লেজে পাক খাওয়াতে লাগল। এমন সময় সেই ময়ূরটি নিচের দিক থেকে ছুটে এল। ‘ভাগো ভাগো’ চিত্কারে বিপৎসংকেত দিয়ে নেমে গেল আবার উপত্যকার দিকে। বিপদ বুঝেই চিতাবাঘ ও ভালুক একই দিকে নেমে গেল ঢাল বেয়ে।
আসল ঘটনা হলো, ওদিকে একজন চোরা শিকারি বন্দুক হাতে উঠে আসছিল চিতাবাঘ বা ভালুক শিকার করতে। ময়ূরটি সাবধান না করে দিলে হয়তো কোনো বিপদ হয়ে যেত।