শুক্লপক্ষের পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত চাঁদের বাধভাংগা উচ্ছাসে বিশ্বচরাচর দিগন্তবিস্তৃত জোৎস্নায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। কেওড়া গাছের কচি পাতায় পাতায় বুনো ফুলের গন্ধ মাখানো দুধসাদা জোৎস্নাদের আলো ছায়ার খেলা।গাছের শাখা প্রশাখা,ফাঁক ফোকর, আশেপাশের ঝোপঝাড়, বনের ভেতরের পায়ে চলা পথ সারা শরীরে ফুটফুটে জোৎস্না মেখে কি এক প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে আছে। দুই একটা রাত জাগা পাখির পাখা ঝাপড়ানো সেই সাথে বহুদূর থেকে ভেসে আসা বানরের হুশিয়ারী ডাক মৌটুসির চেনা পৃথিবীটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে।একি বাস্তব নাকি ঘুমের অতলে তলিয়ে গিয়ে দু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখা অলীক কোন সপ্ন ! স্বর্ণ চাঁপার তীব্র সুগন্ধে বাতাস ভারী।এখন শীতের শুরু,স্বর্ণ চাঁপাদের ফোটার সময় শেষ, তবু হয়তো দুই একটা ফুল চিরাচরিত অভ্যাস কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঘন পাতার ফাঁকে লুকিয়ে আছে,বিশ্বসংসার ভুলিয়ে দেয়া মনমাতানো গন্ধে বিভোর করে রাখে মৌটুসি আর জয় কে।
হঠাৎ কাছেপিঠের ই কোন এক গাছের গর্ত থেকে আসা বনমোরগের ভয়ার্ত চিৎকার আর পাখা ঝাপড়ানোয় কেওড়ার পাতায় জমা জোৎস্নায় ফাটল ধরে। মৌটুসি আরো একটু সরে আসে জয়ের দিকে।
বাহারি রঙা ল্যানটানার ঝোপের পাশ থেকে চাঁদের দিকে চেয়ে একই সাথে গলা মিলিয়ে ডেকে ওঠা কয়েকটা শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক ওদের শরীরে কাঁপন ধরায়।
জংগলে গাছের ডালে এক রাত কাটানোর আইডিয়া মৌটুসির মাথা থেকেই আসে। জয় আর জয় এর বাবা মানে মৌটুসির বড় মামার তীব্র আপত্তি ও আটকাতে পারেনি তাকে। বাধ্য হয়ে জয় কেও সাথে আসতে হয়। মৌটুসির বড় মামা বাগেরহাটে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের একটা ফরেস্ট ক্যাম্পের একজন বনরক্ষী। অফিস থেকে চারদিনের ছুটি নিয়ে শুধুমাত্র এক রাত বনের ভৌতিক আর রহস্যময় জোৎস্না দেখার আশায় ঢাকা থেকে সরাসরি এখানে এসে হাজির হয়েছে এই নবদম্পতি। তাই ঝোপালো একটা গাছের উঁচু ডাল তাদের আজ রাতের আস্তানা।
পরিকল্পনাটা মৌটুসির হলেও এখন তার ই ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। রাতের প্রথম প্রহর,ভয়ানক রাত তো সামনে পড়ে আছে। আর তাছাড়া রক্তচোষা মশার উৎপাত তো আছেই।গাছ থেকে নেমে এক দৌড়ে মামার ক্যাম্পে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমন করে এক হাত দিয়ে গাছ আর অন্য হাত দিয়ে শক্ত ভাবে জয়ের পাতলা সোয়েটারের কোনা ধরে রাখে।যদিও কোমরে বাধা দড়ি বেশ শক্ত করেই এটে আছে গাছের ডালের সাথে। কতরকম যুক্তি ই না মামা দেখিয়েছে। জংলী মশার কথা নাহয় বাদ কিন্তু রাতের যেকোন মুহুর্তে তাদের বসে থাকা ডালেই উঠতে পারে বিষধর সাপ কিংবা বুনো চিতা।অথবা যদি মধ্যরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে হয়! মৌটুসি মামাকে আশ্বস্ত করেছে কোনভাবেই ভোরের আগে নিচে নামবে না তারা।একে ভাগ্নি তার উপরে একমাত্র পুত্রবধু তাই মামাকে আবদার মেনে নিতেই হয়। তাই সে নিজে এবং তার সহকর্মীরা বিকেলে এসে তাদের গোলপাতার ছাউনি আর কাঠ দিয়ে নির্মিত একটা পরিত্যক্ত পাহারা ঘরের পাশে এই গাছে তাদের থাকার বন্দবস্ত করে ফিরে যায়। গাছের ডালের সাথে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেধে ঝুলিয়ে দিয়ে যায়।এদিকটাতে কখনই কোন হিংস্র প্রানীর দেখা মেলেনি আর জায়গাটা ফরেস্ট ক্যাম্প থেকে খুব বেশি দুরেও নয়। দু চারটা বন মোরগ,গুই সাপ,বড় বড় কুনো ব্যাঙ,শেয়াল, পথ ভোলা চিত্রা হরিন আর হরেক রকম পাখি ছাড়া এদিকটাতে আর তেমন কিছু চোখে পড়েনা। তবু বিপদের আভাস পেলেই যেন ক্যাম্পে ফোন করা হয় বলে মৌটুসিদের বারবার সাবধান করা হয়। খুব একটা ভেতরে না হওয়ায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এর ও কোন সমস্যা নেই। আর তাছাড়া বনরক্ষীরা রাতে কয়েকবার টহল দেবে জানে ওরা। তাই মামাকেও সাবধান করে দেয় কোনভাবে যাতে তাদের বিরক্ত করা না হয় বলে।
রাতে চিংড়ি দিয়ে লাউশাক, পারশে আর গজার মাছের ঝোল,স্থানীয় বাজার থেকে আনা মোরগের ঝাল ঝাল ভুনা মাংস,মুসুরের ঘন ডাল আর লাল লাল মোটা চালের ভাত দিয়ে ফরেস্ট ক্যাম্পেই খাওয়া দাওয়া সেরে গাছে চড়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে মৌটুসি আর জয়।রাতজাগা দুই একটা টি টি পাখির টি ই টি ই ডাক শুনতে শুনতে সুন্দরি কিংবা গরান গাছের শ্বাসমূল সতর্ক চোখে এড়িয়ে চলে।গাছগাছালি জুড়ে জোৎস্নার নরম আভা,বুনো পথ আর বনের বুনো গন্ধেও চাঁদের নরম ছোঁয়া এসে লাগে।এমন নরম আলোর বন্যায় ও যে পদে পদে মৃত্যু ওৎ পেতে আছে তা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা। ভেজা ভেজা মাটির এখানে সেখানে অযত্ন অবহেলায় বেড়ে ওঠা নানান ধরনের বুনো লতা ঝোপঝাড় কিংবা বড় কোন গাছের শরীর জড়িয়ে উঠে গেছে উপরদিকে।জোৎস্নার আলো ছায়ার খেলায় লতাগুলো কেমন গা ছমছমে আর ভৌতিক হয়ে ওঠে।এ পাতার সাথে ও পাতার ফিসফিসানি শুনতে শুনতে এগিয়ে চলে ওরা।
টর্চ লাইট জ্বেলে গন্তব্য পর্যন্ত ওদের পৌছে দিতে সংগি হয় দুজন বনরক্ষী।
এই কয়েকদিন আগেও বনের বাঘ লোকালয়ে বেরিয়ে কয়েকজনকে আহত করে। ফরেস্ট ক্যাম্পের সামনের এই ভোলা নদী পেরিয়েই বাঘ ওপাড়ে গিয়ে হাযির হয়। মামার এতটা উৎকন্ঠিত হওয়ার কারন যে এই মানুষ খেকো বাঘ সেটা মৌটুসিও বোঝে কিন্তু এ যাত্রায় বাঘ দেখার কোন আগ্রহ নেই কারন তার ভয় বাঘ দেখেই সে হয়তো ভয়ে পাকা টসটসে বোটা ছেড়া ফলের মতই টুপ করে নিচে পড়ে যাবে। ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই এ পড়ে এসেছে রাতের জংগল, সে এক অন্যরকম ব্যাপার। জয়ের হাজার বার নিষেধ সে অমান্য করে এখানে এসেছে তার কারন মৌটুসি জানে তার সমস্ত পাগলামীর পেছনে জয়ের সুক্ষ্ম প্রশ্রয় থাকে। তাই শৈশব থেকে লালিত সপ্নপূরনে কোন বাধাই তাকে আজ আটকাতে পারেনা।
পাশের পশুর গাছের মগডাল থেকে একটা পেঁচা ভৌতিক স্বরে ডেকে ওঠে,আর তারপর ই শোনা যায় ইদুরের কিচকিচ আর হুটোপটির শব্দ।বনের অনেক ভেতর থেকে আসে হরিনের আতংকিত চিৎকার। তারপর অনেকক্ষন আর কোন শব্দ পাওয়া যায়না। অটুট নিস্তব্ধতা নেমে আসে বাঘেদের অভয়ারণ্যে ।মাঝে মাঝে থেমে থেমে ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না।জংগলের ভেতর থেকে একটা ভেজা ভেজা ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপটা মারে। শরীর শিরশির করে ওঠে ওদের। জয়ের কাধে মাথা রেখে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মৌটুসি। হঠাৎ জয়ের আলতো হাতের ধাক্কায় মুহুর্তে তন্দ্রাভাব কেটে যায়। ঠোটে আঙুল রেখে শব্দ করতে নিষেধ করে নিচের দিকে আঙুল তাক করে জয়। ওটা কি! অমন আয়েশি ভংগিতে ঝরা পাতার উপর বুকে হেটে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে…ভালোভাবে দেখার জন্য একবার টর্চ লাইট জ্বেলেই বন্ধ করে দেয়। হ্যা ময়াল সাপ ই তো।মোটুসি না চিনলেও বাবার সাথে জংগলে ঘুরে বেড়ানো জয় ঠিকই চেনে। শহুরে মেয়ে মৌটুসি অবাক চোখ মেলে দেখে। নাদুস নুদুস সাপটার চলার পথের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ঝোপঝাড়ের পেছন থেকে ব্যাঙ এর ত্বরিত লাফঝাঁপের শব্দ হয়। গোলপাতার ফাঁকে চাঁদ তখন অনেকটা হেলে পড়েছে।ডালপালার ভেতর দুই একটা জোনাকিপোকা যেন তারাদের প্রতিনিধি হয়ে জ্বলে নেভে। আকাশ ভরা তারাদের রহস্যময়ী হাতছানি আর ঝিরঝিরে মৃদুমন্দ হিমেল বাতাসে কাঁটা দিয়ে ওঠে মৌটুসির শরীর,মন।
মৌটুসিদের বসে থাকা গাছের সামনে বেশ খানিকটা মাঠের মত খোলা জমিন। লবণাক্ত মাটি লতাগুল্ম, আগাছা,পরগাছা আর বিভিন্ন ধরনের ঝরা পাতায় ছাওয়া।চোরকাঁটা ও রয়েছে প্রচুর।এদিকটাতে হয়তো হরিনের আনাগোনা নেই তাই হরিনের প্রিয় খাবার ঝরে পড়া গাওয়া গাছের পাতা জায়গায় জায়গায় স্তুপ হয়ে আছে,জোৎস্না ভেজা শিশির পড়ে ঘাসে জমা পাতার স্তুপ চিকমিক করে ওঠে।হঠাৎ শুকনা ডালপালা,ঝোপঝাড় মাড়িয়ে চলা ছুটন্ত পায়ের আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায়। প্রানভয়ে ভীত বন্য শুকর ছানা জংগলের এক পাশ থেকে বেরিয়ে আরো গভীরে ঢুকে যায়। আর তার পেছনে কালো একটা বড় ছায়া এক লাফে পেরোয় খোলা জায়গাটা।চিতা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।নাকি সেই মানুষখেকো বাঘ? মৌটুসি ভয়ে জড়সড়ভাবে জয়ের কাধে হেলান দিয়ে বসে থাকে।এত সব বুনো গন্ধ ছাপিয়েও জয়ের নাকে এসে লাগে মৌটুসির এলোমেলো চুলের পাগল করা সুবাস।বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে একাত্ম হয়ে ছাতিম ফুলের বুনো মাতাল গন্ধ মাখা বনে কি এক নেশায় বুদ হয়ে যায়।
ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়ে যায় ওরা। ইট পাথরের রুক্ষ শুষ্ক শহরে মনের অলিগলির কত কথাই তো রেফ্রিজারেটরে তোলা থাকে,এমন নির্মল পরিবেশে তা অবলীলায় বেরিয়ে আসে। নিজেদের কত হীনতা,কত দীনতার উপাখ্যান মেলে ধরে একে অন্যের কাছে।কত চাওয়া,কত না পাওয়ার গল্পে গল্পে রাতের বয়স বাড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তরুন শিক্ষকের প্রেমে পড়া,শরীর মন সব উজাড় করে দিয়েও তাকে না পাওয়ার লাঞ্ছনার কাহিনী একের পর এক শব্দের মালা গেঁথে গেঁথে ফিসফিস করে বলে চলে মৌটুসি।বলতে বলতে কখনওবা চোখের জলে ভেসে যায়,কখনওবা নৈরাশ্যের হাহাকার ধ্বনি ওঠে।জানা ঘটনাও বিমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে কান পেতে শোনে জয়।পরম মমতায়,স্নেহে,ভালবাসায় স্ত্রী কে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখে।পশুদের জীবনের এ অভায়রন্যে এসে মানুষ আর পশুর জীবন যাপনের মিল আরো সুস্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে জয়ের। পশুর মত এক জীবনের পুরোটাই কি কেটে যাবে খাবারের সন্ধানে?পুরুষের কাছে যে খাবার কখনওবা নারীরূপে কদর্যতার চূড়ান্ত হয়ে আসে।হায় জীবন!বুনো বাতাসের কানাকানিতে সভ্যতার হাহাকার ধ্বনি বাজে।
চাঁদের উপর ঘন কালো মেঘের ছায়া পড়ে। বৃষ্টি আসবে মনে হয়,কি যে হলো প্রকৃতির,নিয়ম কানুন সব পালটে গেছে। বছরের এ সময়টা বৃষ্টি বাদলার দিন নয়।বৃষ্টি হলে বেশ দুর্ভোগ এ পড়তে হবে।সাপের গর্তে পানি ঢোকে, দিগ্বিদিক ছুটে চলা সাপের রাজ্যে জংগলে থাকা বিপদজনক জানা আছে জয়ের। তাই এ মুহূর্তে গাছ থেকে নেমে পড়ে পাশের ঐ টং পাহারা ঘরে আশ্রয় নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।ওখানেও যে বৃষ্টিবাদলার হাত থেকে পুরপুরি রক্ষা পাওয়া যাবে তাও নয়। তবু গাছ থেকে অতি দ্রুত নেমে পড়ে বনরক্ষীদের ঘরে গিয়ে ওঠে। ঘরে আগে থেকেই সাপ খোপ বসে আছে কিনা কে জানে। তাই লাইটের আলো ফেলে আগে ঘরের পুরোটা দেখে নেয়।বাদবাকি নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে মশার গুঞ্জন আর ঝিকিমিকি জোনাকির রাজ্যে ।বৌয়ের পাগলামির প্রশ্রয় দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রানটাই না চলে যায়।
হঠাৎ জোৎস্না রাত মেঘের ঘন কালো আধারে ঢেকে যায়। ভোর হতে এখনো অনেক বাকি। মৌটুসি মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়।পুরু মেঘে ঢাকা রাতের মিশমিশে কালোয় কিছুই চোখে পড়ে না।
টর্চ লাইট জ্বেলে বাবার দেয়া ব্যাগের চেইন খুলে একেবারে নিচে পায় ভাজ করা দুই প্রস্থ বর্ষাতি, খুশির বাণ ডেকে যায় জয়ের মনে।টং ঘরটা পরিত্যক্ত হওয়ায় ছাউনির অবস্থা জীর্ণশীর্ণ।বৃষ্টির পানি অবাধে মাথার উপর পড়বে।তাই বর্ষাতি দুটো দ্রুত হাতে বের করে একজন আরেকজনের সাহায্য নিয়ে পরে ফেলে,এখন বৃষ্টি হলেও অন্তত কাক ভেজা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর তাছাড়া রাতের শেষ প্রহরে শীতকালের বরফ ঠান্ডা বৃষ্টিজলে ভেজার শখ বা ইচ্ছে কোনটাই দুজনের নেই।তারউপরে মৌটুসির আছে অল্পতেই জ্বরে পড়ার স্বভাব।তাই এই ঘন কালো অন্ধকারে বর্ষাতি পড়ে একেবারে তৈরি হয়ে দুজন দুজনের হাত ধরে বসে চলে শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা।
অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে যায় দ্রুতই।বনের গভীর থেকে দ্রুত এগিয়ে আসে কানফাটানো তীব্র শো শো আওয়াজ। ঝমঝমিয়ে নামে বৃষ্টি আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে চলে মেঘের চাপা স্বরের গর্জন।বৃষ্টির শব্দে ব্যাঙ এর বেসুরো গলার গান ও চাপা পরে যায়।এতো সেই টিনের চালের রিমঝিম বৃষ্টি না, এ একেবারে নদীতে বাণ ডাকা বৃষ্টি তবে সাথে বাতাসের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে।দিনের বেলায় ই জংগলে বৃষ্টি মানেই আতংক জয়ের কাছে,অথচ এই হালকা শীতের রাতের বৃষ্টি ও এখন পরম পাওয়া হয়ে ধরা দেয়।একেই বোধহয় কবিরা বলে ভালোবাসার নিজস্ব আলো,প্রিয় মানুষটি কাছে থাকার শক্তি।এমন বৃষ্টি ভেজা রাতে বাঘ মামা শিকারে বেরোবে বলে মনে হয়না।ঝরে পড়া শিশিরকেও এড়িয়ে চলা বাঘ যে বৃষ্টি তে কোথাও নিজের মাথা গোঁজায় ই ব্যস্ত থাকবে সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত থাকে জয়। তাই আধারের ভয় কাটাতে উচ্চস্বরে দুজন গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে।
অন্ধকারে বসে অবিরাম বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে ভোরের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর আপাতত কিছুই করার নেই।এখন ক্যাম্পে ফিরে গেলে জংগলে ভোরের প্রথম সূর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতে হবে,রাত কাটানোর আনন্দটাই তাহলে অপূর্ন থেকে যাবে।ভাগ্য সহায় হলে ভোরের আগেই হয়তো বৃষ্টি থেমে যেতে পারে।
হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির রুপালী ঝিলিক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনা।বৃষ্টির পুরু দুর্ভেদ্য দেয়াল চোখের সামনে। কতক্ষন বৃষ্টি বন্দি হয়ে থাকতে হবে তাও জানা নেই।অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে,চোখে মুখে আর জংলী মশার কামড় খেতে হচ্ছেনা।বৃষ্টির ভয়ে কোথায় পালালো কে জানে!
ঝমঝমিয়ে নামা বৃষ্টির পানির ঝাপটায় এক হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে মৌটুসি।মনে পড়ে গভীর বনে এমনই বৃষ্টি ঝলসানো এক রাত কাটানোর সপ্ন বুনতো তারা দুজন।বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে সবে মাত্র যোগ দেয়া আদনান ফারুক।হাসি আর আনন্দে দুই বছর যে কিভাবে কেটে গিয়েছিলো দুজনার মুহূর্তের জন্য ও টের পায়নি।ভবিষ্যৎ এর জাল বুনতে বিভোর মৌটুসি বুঝতেই পারেনি কখন নিজেরই বোনা জালে ও নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। সমস্ত কিছু অস্বীকার করে আদনান ফারুক যখন চরম আঘাত হেনে চলে গিয়েছিলো,তখন শৈশব থেকে পুষে রাখা ভালবাসা দিয়ে বিজয়ের নিশান ওড়াতে ওড়াতে সহপাঠি,বন্ধু জয় ই ওকে বেদনা,লাঞ্ছনার দিন গুলো থেকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো আলোর পথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করে।
ভোর হয়ে এসেছে। বৃষ্টি ও থেমে গেছে।আকাশ পরিষ্কার। মেঘের ছিটেফোঁটাও কোথাও লেগে নেই।পূব দিকের আকাশে ছোপ ছোপ লালে মেশানো কমলা রঙ।হালকা কুয়াশা মেশানো ভোরের সূর্য দুহাতে আঁধার সরাতে ব্যস্ত,যেকোন মুহূর্তে মুখ বের করে বিজয়ী হাসিতে হেসে উঠবে।
ব্যাস্ত শহরে শীতের প্রথম সকাল আসে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে,বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে,জানালার রং বেরং পর্দার কোল বেয়ে সিঁদেল চোরের মত চুপিসারে।কখনওবা বারান্দায় টবে লাগানো অতি যত্নের ইনকা গাঁদা কিংবা চন্দ্রমল্লিকার পাতায় এক ফালি উষ্ণ রোদ হয়ে।সে এক বাস্তব শহরের অতি বাস্তব সকাল।অবাস্তব কল্পনার ঝুঁকি সেখানে নেয়াও বারন।অথচ এখানে সকাল আসে সারা পৃথিবীকে জানান দিয়ে,ভাট ফুলের সাদার মাঝে বেগুনীর বন্ধুত্বে,প্রজাপতির পাখনায় রঙ বেরঙ আলোকচ্ছটায়,বুনো ফুলের গন্ধের পাগলামীতে কিংবা বেত ঝাড়ের পেছনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অতর্কিত উপস্থিতিতে। এখানকার এই পরিবেশ,প্রকৃতির এমন মুহূর্তকাল থমকে গিয়ে দুষ্ট হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ কিছুই বাস্তব বলে মনে হয়না। এত সত্য,এত নির্মম,এত বাস্তব জগতেও যে চাইলেই খুঁজে পাওয়া যায় সিন্ধু ঈগল কিংবা গোলাপি শালিকের ডানায় ওড়া সপ্নের কোন এক আশ্চর্য জগত জানাই ছিলোনা ওদের।
গাছের ফাঁক ফোকরে,মগ ডালে কিংবা পাতায় পাতায় হাজারো রকম পাখির ওড়াওড়ি আর কিচিরমিচির এ সুখসপ্নের এক সপ্নিল আবেশ তৈরী হয়।শুকনা পাতায় ঝরঝর শব্দ তুলে গায়ে নরম রোদ মেখে এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে বেড়ায় কাঠবিড়ালি। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে খসে পড়ে রাতের জমে থাকা বৃষ্টি ।পাতারা বৃষ্টি ভেজা ভোরের প্রথম রোদ লেগে ঝিকমিকিয়ে ওঠে।দোয়েল,টুনটুনি,ডাহুক,খঞ্জনা,বুলবুলি,মাছরাঙা,ফিঙে আরো কত চেনা অচেনা পাখির গানে গানে বনে উৎসব আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।ভোরের প্রথম আলোয় বনমুরগী তার ছানাপোনা নিয়ে চিরায়ত দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রস্তুত হয়।মৌটুসির মনেও এক চিলতে উষ্ণ কোমল রোদ এসে পড়ে,অতীতের দুঃসহ স্মৃতি পাতলা কুয়াশার চাদর হয়ে সিঁদুরে মৌটুসি পাখির রঙিন পাখনায় ভর করে উড়ে উড়ে যায় আরো গভীর বনের দিকে।জয়ের প্রতি ভালবাসায় এই প্রথমবারের মত মৌটুসির মন শিহরিত হয়।দুচোখের তারায় নতুন জীবনের হাজারো সপ্ন এসে ভীড় করে।
ক্যাম্পে ফিরে সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে বিকেলে ভোলা নদীর পাড়ে ঝাউ গাছের তলে বসে উষ্ণ গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দুজন রাতের বাসেই গন্তব্যে পৌছে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দেয়ার কথা ভাবে।আবার সেই একি একঘেয়ে শহুরে জীবন,শহরের একই সুরে সুর মেলানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা । জেলেদের পোতা নদীর পাড়ের শুকনো ডালে বসা খয়রাপাখা মাছরাঙ্গার শিকারি চোখে এ পড়ন্তবেলা জীবন অনেক বেশি জীবন্ত আর বাস্তব হয়ে ওঠে।নদীর চরে এক জেলের জাল থেকে বাগদা চিংড়ীর পোনা ছাড়ানো দেখতে দেখতে গতকালের রাত কে ঘুমের ঘোরের সপ্ন বলে মনে হয় যাকে সভ্য সমাজের হাওয়াও সংগোপনে এড়িয়ে চলে।ফুলে ভরা ধুন্দুল গাছের ডাল থেকে উড়ে যাওয়া একটা ভীমরাজের কর্কশ চিৎকারে চমকে গিয়ে মৌটুসি ভাবে চেনা এ পৃথিবীতে মনের সমস্ত ক্লেশ দূর করে দেয়া একটা বুনো রাত আর ভোর নাহয় জীবনের অচেনা কোন অধ্যায় এর অলীক কোন গল্প হয়েই থাকুক।
চেনা পৃথিবীর চেনা এ লগ্ন থেকেই নাহয় শুরু হোক অলীক সুখের দিকে তাদের ভালোবাসার পদচারনা।