শূন্যমাত্রিক

শূন্যমাত্রিক

বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম যাত্রী ছাউনিতে বসে। প্রায় আধঘন্টা হতে চললো, বাসের দেখা নেই। আমার পাশে বসে ছিলেন দুইজন ভদ্রমহিলা, একজন ভদ্রলোক, তার সন্তান এবং কলেজ পড়ুয়া দুটি ছেলে। বসে থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত হয়ে উঠে গেছে। আপাতত আমি একা। এই যে বাসের অপেক্ষায় এভাবে যাত্রী ছাউনিতে বসে থাকা, এটাকে এক ধরণের বিলাসিতা বলা যেতে পারে। ঢাকা শহরে বাসে উঠতে হলে প্রয়োজন পেশীশক্তি, দৌড়ের দক্ষতা, এবং সূক্ষ্ণ ইনটুইশন ক্ষমতা। দূর থেকে বাসের আগমন দেখে আগেভাগেই প্রস্তুত হয়ে সবাইকে পিছে ফেলে দৌড়িয়ে কোনমতে বাসের পাদানিতে পা রাখতে পারলে তবেই তাকে দক্ষ নাগরিক বলা যেতে পারে। আমিও এভাবেই বাসে উঠি। কিন্তু আজ আমার অত তাড়া নেই। সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়েছি। যাত্রী ছাউনিতে বসে বাদাম খেতে খেতে মানুষ দেখতে ভালো লাগছে। অবশ্য এখানে প্রায় সবাই একই রকম দেখতে। বাসে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, ঘামে জর্জর মানুষগুলো বাসায় ফিরলেই তবে তাদের প্রকৃত রূপ ফিরে পাবে। ঘরে ফেরাটা কী সুন্দর, কোমল; আর রাস্তায় তারা বদমেজাজী, ঝগড়াটে, খিস্তিবাজ ! তবে এদের মধ্যে একজনকে দেখে বেশ আলাদা লাগলো। তাকে লক্ষ্য করছি মিনিট পাঁচেক ধরে। জলপাই রঙের গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট আর বদখত ঢোলা একটা শার্ট পরা। মাথায় ক্রিকেট খেলোয়ারদের মত একটা ক্যাপ পরে আছে। কাঁধে একটা শান্তি নিকেতনী ব্যাগ। সেখান থেকে কী যেন একটা কাগজ বের করে বিলি করছে সবার কাছে। কাগজ দেয়ার সময় কী কী যেন বলছে, দুর থেকে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ মানুষই বিরক্ত হচ্ছে। কেউ কেউ বেশ গলা চড়িয়ে ধমক দিচ্ছে। কৌতুহলী কেউ কেউ অবশ্য কাগজ নিচ্ছে। তাদের বেশিরভাগই উঠতি তরুণ। কিছুক্ষণ পর সে বিশ্রাম নেবার জন্যে আমার পাশে এসে বসলো। আমি কিছুটা বিরক্তি কিছুটা আগ্রহ নিয়ে তার ঝোলাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বিলি করছে সে? আমার আগ্রহ ভরা চোখ তার দৃষ্টি এড়ুলো না। সে একগাল হেসে আমার উৎসুক দৃষ্টিকে দক্ষ ফিল্ডারের মত ক্যাচ করে নিলো!
-কী ভাইজান! আগ্রহা লাগে ভিতরে কি আছে দেখার জন্যে?
-তা তো কিছুটা লাগেই!
-এর ভিতর আছে টেলিফোন নাম্বার। হাজার হাজার টেলিফোন নাম্বার। আমি ফ্রি বিলি করি মানুষের কাছে। সমস্যা হইলো, মানুষ ফ্রি জিনিস নিতে চায় না। সন্দেহ করে। অবশ্য সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। খামোখা টেলিফোন নাম্বার বিলি করতে কেই বা কবে দেখছে!
-হু বুঝলাম। কিন্তু আপনি টেলিফোন নাম্বার বিলি করেন কেন? এতে আপনার লাভ কী? আর নাম্বারগুলোই বা কাদের?
-অনেক প্রশ্ন একসাথে কইরা ফেললেন। খাড়ান, জবাব দেওয়ার আগে গলাটা একটু ভিজায়া নেই।
সে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেতে লাগলো। বোঝাই যাচ্ছে খুব তৃষ্ণার্ত। পানি পান শেষ করে গল্প শুরু করলো আবার।
-একসময় আমার ফোনে কথা বলার খুব নেশা ছিলো। যে কোন খান থেকেই নাম্বার পাই না কেন, বাথরুমের দেয়ালে, স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে, টাকা-পয়সায়, পার্কের বেঞ্চিতে; আমি নাম্বারগুলা কালেক্ট করতাম। প্রতিটা নাম্বারেই একবার অন্তত মিসকল দিছি আমি। অনেকেই কলব্যাক করতো। ভুল করে মিসকল দিয়ে ফেলছি এই বলে লাইন কেটে দিতাম। তা সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন!
-অদ্ভুত তো! কেন এমন করতেন?
সে আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলতে থাকলো,
-তো এভাবে নাম্বার যোগাড় করতে করতে হাজারের ওপর হয়া গেলো। তখন ঠিক করলাম অনেক তো পেলাম, এখন দেয়ার পালা। আমি দ্বিগুণ উৎসাহে নাম্বার যোগাড় করতে লাগলাম। এবার আরো কম সময়ে ১০০০ নাম্বার পেয়ে গেলাম। এইগুলাই এখন মানুষের মাঝে বিলি করি।
-কিন্তু এসব করে আপনার লাভ কী বললেন না?
-লাভ কিছু না। আমার দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে। অনেকেই আমার দেয়া নাম্বারে ফোন-মিসকল দিতে যায়া প্রেম-বন্ধুত্ব পাতায়া ফেলে। এসব দেইখা আমি বড়ই আনন্দ পাই।
-দূর থেকে দেখা মানে? আপনি কি যাদেরকে নাম্বার দিচ্ছেন তাদের বেডরুমে ঢুকে পড়েন? অচেনা-অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনাই যেখানে ক্ষীণ সেখানে আপনি তাদের প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব দেইখা ফালান? কী আজগুবী কথা!
-হ, আজগুবীই বটে। অনেক কথা বললাম। যাই এখন। যাওয়ার আগে আপনাকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে যাই। এটা হয়তো আপনার কাছে খুব আজগুবী মনে নাও হইতে পারে।

লোকটা চলে গেলো। কতরকম মানুষ যে আছে এই ঢাকা শহরে! আলগোছে কাগজটা তুলে নেই আমি। একটা ফোন নাম্বার লেখা। নাম্বারটা কেন যেন আমার খুব পরিচিত মনে হয়। কার নাম্বার ছিলো যেন এটা? পকেটে রাখা ফোনটা তীক্ষ্ণ চিৎকারের সাথে ভাইব্রেট করছে। অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করার পর ও পাশ থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়। কান্নার শব্দ। একজন তরুণী কাঁদছে। কী যে হাহাকার সে কান্নায়! কী যে ব্যাকুল করা অশ্রূস্রোত! ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমায়। ঘটনাটির অস্বাভাবিকতা আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেললো না। বরং এটাই মনে হতে লাগলো যে, হঠাৎ করে কোন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসা এবং ওপাশ থেকে তরুণীর কান্নার শব্দ শোনা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বরে সে যেন আরো উৎসাহিত হলো কাঁদতে। তারপর হঠাৎ করেই কলটা কেটে গেলো। আমি তৎক্ষণাত তাকে কল করতে গিয়ে পূর্বানুমান অনুযায়ী ফোনটি বন্ধ পাই। কী মনে করে যেন পাগলাটে লোকটার দেয়া কাগজটার সাথে ফোন নাম্বারটা মিলিয়ে দিতে গিয়ে দেখি সব ঠিকই আছে, শুধু শেষের সংখ্যাটায় গরমিল। লোকটির প্রদেয় নাম্বারটিতে শেষ ডিজিট ৯, আর ক্রন্দসী মেয়েটার শেষের ডিজিট ৫। অদ্ভুত। সত্যিই অদ্ভুত। এই দিনটার কথা ভোলা যাবে না কখনও।

“মাঝরাত্তিরে চাঁদের কাস্তে/ ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে”

বারান্দায় বসে সুমনের গান শুনতে শুনতে রাতের আকাশের দিকে তাকাই। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ। চাঁদটাকেও কাস্তের মতো লাগছে দেখতে। গাছ-গাছালির শরীরে আবেদনময়ী নায়িকার মতো অল্প-স্বল্প জোছনার পোষাক। প্রকৃতিচারণে মগ্ন হয়ে কেমন যেন একটা ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। এই সময়ে ফোন এলো। অচেনা নাম্বার। আবারও সেই বুকে তুফান তোলা কান্না। আবারও আমার মনে হাজারো জিজ্ঞাসা। কিন্তু সে কোন প্রশ্নের জবাব দেয় না। কাঁদতেই থাকে অনবরত। কাঁদতেই থাকে। তার কান্নাটা আমার খুব পরিচিত লাগছে। এভাবে কে কাঁদতো? কাউকে কি আমি কাঁদিয়েছি এমন করে? মনের নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঘাঁই মারতে থাকে মাংসখেকো মাছেরা। মনে পড়ছে…মনে পড়ছে…
-তুমি কি জিনাত?
প্রশ্নটি করার সাথে সাথে লাইন কেটে গেলো। এরপর সে ফোন বন্ধ করে রাখবে, এ কথাটা জানা স্বত্তেও আমি ডায়াল করি আবার। বেশ কয়েকবার। নাহ! বুঝে গেছি আজ রাতে আর ফোন চালু হবে না। মাথায় একগাদা ধূসর স্মৃতি, আর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন জমে গিয়ে প্রচণ্ড ভারি করে তুলেছে ওটাকে। ঘুম দরকার। একটা লম্বা ঘুম। জানি না মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো মেরি-গো-রাউন্ড খেলে আমাকে ঘুমুতে দেবে কি না। জিনাতের কথা এতদিন কীভাবে ভুলে ছিলাম আমি! জিনাতের ধারণা ছিলো সেই আমার প্রথম প্রেম এবং সারাজীবন আমি তাকে সাথী করেই থাকবো। বড্ড পিউরিটান মনোভাবের গ্রাম্য মেয়ে ছিলো সে। অনেক সাধাসাধি করে তার হাত ধরতে পেরেছিলাম। আর চুমু? সে তো দূর অস্ত। মাঝে মাঝে যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, শ্যামলা, লাজুক মেয়েটির মুখে যেন হাজার মোমবাতি জ্বলে উঠতো। সে হয়ে উঠতো দ্যূতিময়। তার এই দ্যূতি সংরক্ষিত ছিলো শুধুমাত্র আমার জন্যে। কিন্তু হায়! সে আমাকে যা দিতে চেয়েছিলো তার কিছুই আমি নিতে পারি নি। আমি ক্রমশ কামুক এবং বেহায়া হয়ে উঠছিলাম। আমি তো আর শুধু হাত ধরার আমলের অবাস্তব বোকা বোকা নায়ক নই! আমার লকলকে লোলভরা লোলুপ লাল জিভ চাইতো ওকে চেটেপুটে খেয়ে শেষ করে দিতে। ওর দ্যূতি, আমার বিচ্যুতি। একদিন বিচ্যুতি পর্যায় থেকে আমি উড়ে গেলাম বৈপ্লবিক বিকৃতিতে। ওর ঠোঁটে, বুকে,গালে, পেটে পাগলের মত চুমু খেতে লাগলাম। ওকে প্রায় বিব্রস্ত করে ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যায়ে আর যাওয়া হলো না কারো আগমন ধ্বনি শুনে। যাওয়ার সময় আমি ওকে শাসিয়ে গেলাম, এই ঘটনা কাউকে বললে একেবারে খুন করে ফেলবো। তার চোখ ছিলো অশ্রূসজল। সে অল্প অল্প ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। জিনাতের সাথে এর পরেও আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। সে ছিলো বিবর্ণ, দীপ্তিহীন। আমি কয়েকবার তাকে স্যরি বলে সম্পর্কটা আবারও জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে পেয়েছিলাম তার নির্বাক দৃষ্টি, অশ্রূসিক্ত চোখ। একদিক দিয়ে ভালোই ছিলো সেটা। এরকম একটা সেকেলে, ন্যাকা মেয়ের সাথে সারাজীবন কাটানো চরম বোরিং হবে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এতদিন পর সে ফিরে এলো কী মনে করে? আর ফিরলোই যখন, খামোখা ফোন করে কাঁদার কী মানে! এটা এক ধরনের বাজে প্র্যাঙ্ক ছাড়া আর কিছু না। সেই ফোন নাম্বার বিলি করে বেড়ানো পাগলাটে লোকটার সাথে কী ফন্দী এঁটেছে কে জানে! অবশ্য জিনাতকে যতটা চিনি, সে এমন করার মেয়েই না। একবার কাউকে ছেড়ে গেলে সে কখনও তার কাছে ফিরে আসবে না। কী যে হচ্ছে আজ! জিনাতের কথা মনে করে মনটা খারাপ লাগছে। আরেকবার যদি ফোন করতো, তাহলে খুব করে ক্ষমা চেয়ে নিতাম।

ফোনটা বাজছে। রাত একটা বাজে। আবারও সেই ভূতুরে কল? কাঁপাকাঁপা হাতে কল রিসিভ করলাম আমি। ওপাশ থেকে মৃদু লয়ে কেঁদে চলেছে কেউ। আগের মত অত তীব্র না। যথারীতি লাইনটা কেটে দিলো কিছুক্ষণ পর। রিসিভড কলের লিস্টে দেখি, এইবার যে নাম্বারটি থেকে ফোন এসেছিলো, সেটার শেষে পাঁচ নয়, ছয়! কী হচ্ছে এসব? আমার মতিভ্রম হলো না কি! প্রথম প্রথম লোকটার অদ্ভুত আচরণকে পাগলাটে এবং খেয়ালীপনা মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন ব্যাপারটাকে মোটেও সামান্য বলে মনে হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটাকে একটা লজিক্যাল প্যাটার্নে ফেলতে গিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে যাই। লোকটার প্রস্থানের পর পরই মেয়েটার ফোন আসা, এ না হয় মানলাম। বারান্দায় প্রকৃতি দেখার সময় সে ফোন করেছিলো এটাও না হয় মানা গেলো। কিন্তু বিছানায় শুয়ে যখন জিনাতের কথা ভাবছিলাম, তার সাথে আমার কৃত অসদাচরণের কথা ভেবে যখন অনুতপ্ত হচ্ছিলাম তখন কেন জিনাতের ফোন আসবে? আর তখন কেন সে সেই সর্বগ্রাসী, এলোমেলো করে দেয়ার মতো ডুকড়ে ডুকড়ে কান্নার বদলে মৃদু লয়ে ফোঁপাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতেই হবে। এখন সেই রহস্যময় লোকটাকে জায়গা মত পেলে হয়!

আজও যাত্রী ছাউনিতে বসে আছি। বাসের অপেক্ষায় নয়। সেই লোকটার জন্যে। আজকে আসবে কি? সদ্য পরিচিত কারো সাথে এ্যাপয়নমেন্ট না করে অপেক্ষা করলে সেটা ফলপ্রসু হবার সম্ভাবনা খুব কম। তারপরেও অদম্য কৌতুহল আর রহস্যভেদী মন হাল ছাড়ে নি। এইসব হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা আর চমক কতটা কাকতালীয় অথবা কতটা অতিপ্রাকৃত, এমন চিন্তায় গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেলাম একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে। হ্যাঁ, সেই লোকটাই। এত তাড়াতাড়ি তার দেখা পেয়ে যাবো ভাবি নি। লোকটা হয়তো বা আগে থেকেই জানতো অথবা অনুমান করেছিলো যে আমি আবার ফিরে আসবো এখানে। তার সাথে কী বলে আলাপ শুরু করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নেয়ার পর থেকে কী সব ঘটছে এগুলো প্রথমেই বললে লোকটা পেয়ে বসবে আমাকে। হয়তো বা সুযোগ বুঝে মোটা অংকের টাকাও চেয়ে বসতে পারে। তাই আমি আমার অপ্রতিরোধ্য কৌতুহলকে শেকলবন্দি করে উদাস দৃষ্টিতে মানুষ আর বাস দেখার ভঙ্গি করলাম।
-গরমটা আজকে কী পড়ছে দেখসেন?
ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পান করে সে সুধোলো। যাক, এবার আর কথা বলতে সমস্যা হবে না। প্রাথমিক দ্বিধার ভাবটা কেটে গেছে।
-হু। এই অক্টোবর মাসেও এমন গরম! গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে সাবধানে থাকতে হবে।
মওকা মত জ্ঞান ঝাড়তে পেরে প্রসন্ন হয়ে ওঠে আমার মন। লোকটার কাছ থেকে উত্তর আশা করছিলাম, কিন্তু সে সিগারেট খেতেই মগ্ন।আমার কথা যেন কানেই নেয় নি। সন্ধ্যা নেমে আসছে। কতক্ষণ থাকে লোকটা ঠিক নেই। অগত্যা আমাকেই উপযাচক হতে হলো।
-আপনার নাম্বার বিলি করার কাজ কেমন চলছে?
-ভালো। গতকাল আমার উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হইছে। একজন তার কৃতকর্মের জন্যে বহুত আফসোস করছে, ভয়ও নাকি পাইছে।
-আপনি এত সব কীভাবে জানেন? কেন এসব করেন?
-কীভাবে জানি, সেইটা আপাতত গোপন থাক। কেন এসব করি, কইতে পারেন এইডা আমার একটা শখ।
-শখ, না? মোটেও এটা কোন সাধারণ শখ না। এর সাথে অনেক কিছু জড়িত। আপনি অনেক কিছু, প্রায় পুরোটাই আমার কাছ থেকে লুকোচ্ছেন।
-আমি কিছু লুকাইতেছি না ভাইজান। আমি প্রকাশ করতেছি, জাগায়া তুলতাছি। মনের অন্ধকার কোণে লুকায়া রাখা পাপকে আর কত পুইষা রাখবেন? আপনি তো মানুষ হিসেবে ঠিক অতটা খারাপ না!
এহ! আসছে আমার রবিনহুড! ক্লাশলেস, আনকালচার্ড একটা গ্রাম্য মেয়ের সাথে আমার সম্পর্কের ঘটকালি করতে চায়! এইসব লোককে বহুত চেনা আছে। খালি পারে উপদেশ দিতে, যেগুলোর ব্যবহরিক বাস্তবায়ন বলতে কিছু নেই। রেগেমেগে আমি লোকটার সাথে দুর্ব্যবহার করে বসলাম।
-আরে যান যান! আর উপদেশ দিতে হবে না। রাস্তা মাপেন। ঐ যে একটা ওভারব্রিজ দেখা যাচ্ছে, ঐটা দিয়ে পার হন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। দেখলেন, আমিও কেমন উপদেশ দিয়ে ফেললাম!
লোকটাকে প্রায় ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমি। এমন লাঞ্চনা স্বত্তেও লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে এক গাল হাসি হেসে বিদায় সম্ভাষন জানিয়ে চলে গেলো। তার আন্তরিক হাসি দেখে আমার কেমন যেন গা শিউরে উঠলো।

অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, আজ কোনরকম হাঙ্গামা-হুজ্জত না করেই বাসে উঠতে পারলাম। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়, একটা সিটও পেয়ে গেলাম। মতিঝিল থেকে মিরপুর, যেতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগবে। এই সময়ের মধ্যে আমি একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে দিতে পারবো। ঘুমটা খুব দরকার। গতরাতে ঘুমই হয় নি বলতে গেলে। ঘুমানোর আগের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা আমার খুব ভালো লাগে। আধো ঘুম, আধো জাগরণ। চোখ মেলতে পারি না, তবুও যেন কত কিছু দেখতে পাই! কত বিচিত্র শব্দ কানে আসে, আবার মিলিয়ে যায়। আমি দেখতে পাই পুকুরঘাটে কাপড় ধুচ্ছে একটি মেয়ে। একটু পরে সে নাইতে নামবে। একটি ছেলে একটু দূর থেকে গাছের ডালে বসে জাম খেতে খেতে সব দেখছে। হঠাৎ একটা বিশালাকার অজগর এসে মেয়েটিকে পেঁচিয়ে ধরলো। প্রবল সেই চাপ। মেয়েটি সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে এই নাগপাশ থেকে বের হতে। তার শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। সে কী মনে করে যেন গাছে বসা ছেলেটির দিকে তাকালো। আকুতি ভরা চোখের সেই অনুরোধ ফেরানো সম্ভব হলো না ছেলেটির পক্ষে। প্রাণের মায়া ভুলে, হাতে একটি খুরপি নিয়েই সে দৌড়োলো সর্পবধের জন্যে। কিন্তু কাছাকাছি এসে গেলেই এক আচানক কাণ্ড ঘটে গেলো ! সাপ নেই, মেয়েটিও নেই! মেয়েটি ততক্ষণে একটা শাপলা ফুলে পরিনত হয়েছে। হাজা-মজা পুকুরটা যেন নতুন রূপে আবির্ভূত হলো এবার। আর ফুটতে লাগলো অজস্র শাপলা ফুল। এর মধ্যে মেয়েটি কোথায়? ছেলেটি জানে এত শত শাপলা ফুলের মধ্যে তার কাঙ্খিত ফুলটা সে ঠিকই খুঁজে নিতে পারবে।
কন্ডাকটরের ভাড়া নেবার তাগাদায় ঘুম ভেঙে গেলেও আমার মেজাজ খারাপ হয় না। স্বপ্নের রেশটা রয়ে গেছে এখনও। মনে পড়ে। মনে পড়ে অপ্রয়োজনীয় ভেবে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দেয়া স্মৃতির ভগ্নাংশ। তারা আজ পূর্ণ সংখ্যা হয়ে আমার ভালোবাসার সমীকরণে ধ্রুবক হয়ে থাকতে চায়। মনে পড়ে, জিনাতকে আমি বলেছিলাম, “তোমার নামটা তেমন সুন্দর না। তোমাকে আমি নতুন একটা নাম দেবো।” কী নাম দেয়া যায়! এই ভেবে যখন আমার গলদঘর্ম অবস্থা, তখনই পুকুরে ফুটে থাকা থোকা থোকা শাপলা ফুলের দিকে নজর এলো। এরপর থেকে আমি ওকে শাপলা বলেই ডাকতাম। আজ অবচেতন মনের কুটিল ষড়যন্ত্রে স্বপ্ন পরবর্তী অসাম্যবস্থায় জিনাত বা শাপলা বারবার ফিরে আসছে।এখন অপেক্ষা করছি সেই ফোন কলের। জানি, সে আসবেই। আর শেষ ডিজিটটা ছয় এর পরিবর্তে সাত হবে। প্রায় সাথে সাথেই ফোন এলো। শেষের ডিজিটটা সূত্র মেনে সাত! লাকি সেভেন। খুব কি লাকি হবে? এবার কি সে আমার সাথে কথা বলবে? কাঁদাবে না তো?
নাহ। সে কাঁদছে না। কোন কথাও বলছে না। নীরবতার নীড়ে দীর্ঘশ্বাসের প্রলয় যেন আর হানা না দেয় এ জন্যে আমি সচেষ্ট থাকবো। কথা দিই তাকে। হিরন্ময় নীরবতার মৌতাতে সুরভিত হয়ে যায় চারিপাশ। আমি ক্রমশ তার কাছে আসছি। হোক না সে কোন কান্নারত বিলাপকারী গ্রাম্য তরুণী, অথবা বাকহীন,মমতাময়ী, প্রেমপিপাসু যুবতী, আমি তাকে কাছে টেনে নিতে প্রস্তুত।
-শাপলা! কথা বলো প্লিজ! আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না। আমি অনুতপ্ত আমার কর্মের জন্যে। তুমি শুধু আর একবার বলো, আমি…
লাইনটা কেটে গেলো আবার!

খুব এলোমেলো লাগছে। আমাকে নিয়ে সেই বেঢপ শার্ট পরিহিত লোকটা আর জিনাত মিলে কোন খেলা খেলছে কে জানে! ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত হোক বা আধিভৌতিক, এর থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আমি ব্যাচেলর হলেও ঘর, মেঝে, বারান্দা টিপটপ রাখি সবসময়। অথচ, এই দুইদিনের দুর্বিপাকে পড়ে কিছুই করা হচ্ছে না ঠিকমত। ঠিকমত খাওয়া নেই। বিছানার চাদর এলোমেলো। ঘরে ঝাঁট দেয়া নেই। এঁটো পড়ে আছে থালা-বাসন। শাপলা যদি আর একবার আমাকে সুযোগ দিতো! পাশের ঘর থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করি। শাপলা/জিনাতের ফোন। না, এবার কোন ক্রন্দন বা দীর্ঘশ্বাস নয়। ক্লান্ত কণ্ঠে একজন যুবতী বললো, “ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কইরো। স্বাইস্থই সম্পদ। বিছানা বালিস পরিষ্কার কইরো। রাখি”। শাপলা…আমার শাপলা! এতদিন পরে তাকে খুঁজে পেলাম অবশেষে! তড়িঘড়ি করে ফোন নাম্বারটা দেখি। হ্যাঁ! এইতো! শেষ ডিজিট আট। আমার মনে পড়ে যায়, শাপলার ফোন নাম্বার আর সেই পাগলাটে লোকটার ফোন নাম্বার একই ছিলো। আমাকে ৫-৬-৭-৮ এভাবে একেকটা স্তর পেরিয়ে তার প্রকৃত নাম্বারের কাছে যেতে হবে। শেষ ডিজিটে নয় বসিয়ে ডায়াল করতে থাকি। রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ ধরছে না। মাত্র চারবার রিং হলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে, অনন্তকাল ধরে তা বেজেই চলছে। ছয়বারের সময় তাকে পাওয়া গেলো।
-হ্যালো! কেমন আছো তুমি রেজা?
-শাপলা, তুমি ফিরে এসো আমার কাছে। আমার অনেক কষ্ট হয়, অনেক অনুশোচনা হয়। আমি আর নিতে পারছি না। আমাকে রক্ষা কর প্লিজ!
-তোমার এই অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব না, আপাতত। পরীক্ষার আরেকটু বাকি আছে।
-বলো, বলো! যত কঠিন পরীক্ষাই হোক না কেন, আমি উত্তীর্ণ হবোই। আমাকে হতেই হবে।
মৃদু হাসলো শাপলা।
-থাক, থাক বীরপুরুষ! ধীরে। অতি ধীরে। অত ব্যস্ত হইয়ো না। সময়ে সব জানতে পারবা। তুমি এখন ঘরদোর টিপটপ কর, আর অল্প কিছু হইলেও ভাত খাও। এখন রাখি, কেমন?

ঘর গোছানো, আর রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরীক্ষার আর কী বাকি আছে জানার ব্যাপক কৌতুহল। কাজে মন বসছে না। একটা পিরিচ ভেঙে গেছে। ফিল্টারের পানি পড়ে ঘরের অবস্থা করুণ। গ্যাসের চুলো বন্ধ করতে ভুলে গেছি। এর মধ্যেই অতি আকাঙ্খিত ফোনটা এলো। সময় কি হয়ে এসেছে? বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। সেই একই নাম্বার। শুধু শেষ ডিজিটটা শূন্য। আমার চারিপাশ দুলতে থাকে। মনে হয় বাসাটা যেন একটা ক্ষুদ্র ক্যানোপি, প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছে। চোখ বন্ধ করে ভাবি, এসব কিছু না। এদিকে ফোনটা বেজেই চলেছে। বিস্ময়াভিভূত চোখে খেয়াল করলাম, এবার শেষ দুটো সংখ্যা শূন্য! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকি। দেখি, কল আসা অবস্থাতেই শূন্যগুলো দখল করে নিচ্ছে মূল নাম্বারকে। তিনটা, চারটা, পাঁচটা এভাবে এগারোটা ডিজিটের প্রতিটিই শূন্য হয়ে যায়। এর মানে কী? আমি ব্যর্থ? এত কষ্ট, এত দুর্ভোগ পোহানোর পরেও আমি ব্যর্থ? আমার ভীষণ হালকা লাগে। মনে হয় অপরিসীম শূন্যতা গ্রাস করছে আমাকে। এ এক অনির্বচনীয়, অপ্রকাশযোগ্য অনুভূতি। চারিদিকে কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। ভেসে আসছে জিনাতের সুতীক্ষ্ণ হাসি। ভেসে আসছে ফোন নাম্বার বিলি করে বেড়ানো লোকটার ক্যানভাসারিং। চারিদিকে প্রলয় নৃত্য। সবকিছু কাঁপছে। বিছানা-বালিস থেকে
শুরু করে ফ্যান, টিউবলাইট, চেয়ার, টেবিল, টেবিল ল্যাম্প, কম্পিউটার। আমি মাথা চেপে ধরে মেঝেতে গুঁজে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করি। তা কি সম্ভব? এই প্রচণ্ড দুলুনি, আর বিভৎস চিৎকারে নরক নেমে এসেছে আমার ঘরে। আমি পাগলের মত দিকবিদিক ছুটতে থাকি। আমি বুঝতে পারি, আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে শূন্য জন, আমাকে ভালোবাসে শূন্যজন, আমার চটকদার কবিতার পাঠক শূন্যজন, আমাকে নিয়ে ভাবে শূন্যজন। শূন্য অনুভূতিরা একসাথে হয়ে আমাকে অভিশাপ দিতে এসেছে। তারা আর আমার ভেতরে অবস্থান করতে রাজি না। বিদ্রোহ, ক্যাপ্টেন! থামাও! নোঙর ফেলো!
কোনমতে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখা পাই সেই পাগলাটে লোকটার। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। এপাড়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। সাঁইসাঁই করে বেগে চলা গাড়িগুলোর ফাঁক গলে কোনভাবেই আসতে পারছে না। আমি তাকে এই পাশ থেকেই জিজ্ঞাসা করি,
-এই যে! ও ভাই! শুনতে পাচ্ছেন আমাকে? আমি তো ভয়াবহ সমস্যায় পড়ে গেছি! কেয়ামত নেমে এসেছে আমার ঘরে। অদ্ভুত নাম্বার থেকে কল আসছে। আপনি কি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারেন?
গালভরা হাসি হেসে লোকটা কী মনে করে যেন দৌড় দিয়ে রাস্তা পাড় হবার চেষ্টা করলো। ট্রাকটা হার্ড ব্রেক কষেও বাঁচাতে পারলো না লোকটাকে।

এর পরে আর কখনও জিনাতের ফোন আসে নি। শুনেছি সে নাকি দুবাইয়ে তার স্বামীর সাথে মহাসুখে দিনানিপাত করছে। আর আমি? সেই বাস স্টপেজের যাত্রী ছাউনিতে এখনও বসে থাকি অকারণে। শূন্যমাত্রিক জীবনের অভিশাপ বুকে নিয়ে নিরন্তর অপেক্ষায় কাটে আমার জীবন। ফিসফিসিয়ে কারা যেন শোনায় শূন্যের আলাপন।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত