‘শেষটায় তোর থেকেও আমায় এত বড় বড় উপদেশ শুনতে হবে পাপান? তুই আমাকে শেখাবি কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল? ছোটবেলায় যখন তোর নিউমোনিয়া হলো, এই দিদুনই টানা দেড়মাস তোকে কোলে নিয়ে বসেছিল, রাতদিন এক করে। রাতের পর রাত বিছানায় মাথা পর্যন্ত ঠেকায়নি। তখন কোথায় ছিলো রে তোর এত বড় বড় জ্ঞান? …কোথায় ছিলি তুই? …ওই দিদুন না থাকলে তোকে বাঁচাতে পারতাম না রে আমি। আজ তুই উপদেশ দিচ্ছিস যে দিদুনের মামুবাড়িতেই থাকা ভালো? এ বাড়িতে আসার দরকার নেই? …বাড়িটা তোদের বলে? …চাট্টি ইট কাঠ দিয়েই বাড়ি তৈরী হয় রে? আর আমার প্রাণপাত পরিশ্রম? তার দাম নেই? ..সকাল পাঁচটায় উঠি, রাত বারোটার আগে চোখ বোজার সময় সুযোগ দিস না, ক’ পয়সা দাম দিস রে তার জন্য তোরা? ..বিলেত আমেরিকা হলে তোদের বাপ জ্যাঠাদের মাইনের আর্ধেকের বেশি বেরিয়ে যেত রে কাজের লোকের পেছনে, তবে তোরা বুঝতিস কত ধানে কত চাল।’
‘আহ মামমাম, তুমি বড্ড মাথা গরম কর আজকাল…’
‘মাথাগরম? কি ভাবিস তোরা বলতো আমায়? সারাদিন মুখ বুজে কাজ করে যাই, আর সংসারের কোনও ক্ষেত্রে একটা আমার মতামত থাকবে না?….সারাদিন যে চরকিনাচন নাচি, তা তোদের কাছে টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে গেছে, না? সকালে তোর লাগে রুটি, তোর বোনের দুধ কর্নফ্লেক্স, তোর বাবা জ্যাঠার লুচি পরোটা, তোর ঠাকুমার দই চিঁড়ে কলা, তোর বাবা মুসুর ডাল খাবে পেঁয়াজ ছাড়া, তোদের ভাইবোনের পেঁয়াজ চাইই চাই, তোর জ্যাঠার চিনি ছাড়া তককারি তো তোর ঠাকুমার সবজির স্যুপ, তোর জন্য মাছের মাথার ঘন্ট, তো তোর বোনের জন্য জিরেফোড়ন-এর চচ্চড়ি, তোর বাবার গা মাখা ঝাল, তো তোর ঠাকুমার জন্য পাতলা ট্যালট্যালে ঝোল। আরে কোনওদিন করা তো দূরের কথা, শুধু মনে রেখে দেখা দেখি কেমন পারিস? কোনওদিন মনে রাখতে পারবি এত কিছু ফরমাস?..আমি কিন্তু রেখেছি রে, ২০ বছর ধরে তোদের খেয়াল রাখছি, আর তার বিনিময়ে একটা কিছু চাইতে পারবো না, তোদের এই লাহিড়ী বাড়ির কাছে?’
‘দেখ মামমাম, বি র্যাশানাল, একটা প্যারালাইসিস রুগি, যে এপাশ থেকে ঘুরতেও পারে না, তাকে তুমি কোথায় রাখবে?’
‘সেটা আমি বুঝবো। সিঁড়ির তলার ঘরটা পরিষ্কার করে নেব, সেখানে রাখবো, সেবাযত্ন আমি করব, তোদের কি অসুবিধা?’
‘একটা বিছানায় শোয়া রুগি, যে সারাদিন বিছানায় হেগেমুতে একসা করবে, তাকে তুমি কি করে সামলাবে?’
‘ও, বিছানায় হাগু তুই বা তোর বোন কোনওদিন করিসনি, তাই না? এমনি এমনিই বড় হয়ে গেছিস?’
‘উফফ মা, ইউ আর জাস্ট ইনকরিজিবল। দিদুন মেয়ের বাড়িতে পড়ে থাকবেই বা কেন?..এটা কি জেনারেলি সোসাইটিতে হয়?..এটা তো বড়মামু ছোটমামুরই রেসপন্সিবিলিটি।’
‘বাহ রে, মাত্র ১৮ বছরে কত কথা শিখে গেছিস রে তুই পাপান। সোসাইটি, রেনপন্সিবিলিটি কত্ত কি! ..তোর ঠাকুমা বলল, মা আমার কাছে থাকলে পাড়ার লোকেই বা কি বলবে? এতে তো আমাদেরই প্রেস্টিজ যাবে বউমা …তোর জ্যাঠা, তোর বাবা তো শুনেই রেগে আগুন হয়ে গেলো। সেই একই কথা কেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তুইও বলে দিলি। কিন্তু তুই যে আমার অংশ রে পাপান, আমার ভালোবাসা, ঘাম, রক্ত দিয়ে দলাপাকানো মণ্ড ছিলি একটা। তুইও আমায় বুঝবি না?
‘তোর বোন যখন পেটে, আমায় ধরল জন্ডিসে, উঠতে বসতে মাথা ঘোরে। কিচ্ছুটি দাঁতে কাটতে পারতাম না, তোর তখন চার বছর ..কোত্থেকে কি করব? সংসার সামলাবো না তোকে?..চোখে অন্ধকার দেখি তখন, মা এসে বুকে করে নিয়ে গেলো, ঠিক দেড় বছর মার কাছে ছিলুম রে, মামন হলো, তুই স্কুলে গেলি, সওওব সামলেছিল মা বুক দিয়ে। আমি সুস্থ হলাম ধীরে ধীরে, তখন কোথায় ছিলো রে তোদের এই রেসপন্সিবিলিটির ঘনঘটা?..মামন হয়েছিল দেড় কেজির ..বিড়ালছানার মতো সাইজ। ওই মেয়েকে তেলেজলে ঠাণ্ডাগরম সামলে বড় করা কি সোজা কথা?..একটা বছর ধরে দিদুনই ওকে সামলেছিলো। মেয়েকে বুকের দুধটুকু খাওয়ানো ছাড়া আর কিচ্ছুটি করতে দিতো না। তখন বড়বৌদি সবে এসেছে। মা দাপটে সংসার সামলাতো। বৌদি ট্যাঁ ফোঁ করারও সাহস পেত না। দিব্বি আরামে কাটিয়েছিলাম রে তখন, সে আরাম আর সারাজীবনে পেলুম কোথায়?’
অথচ এমন তছনছ হওয়ার তো কথা ছিলো না তো। বাবা দু’ ঘন্টার নোটিশে চলে গেলো। কেউ ভাবতেও পারিনি যে অমন জ্লজ্ব্যান্ত মানুষটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকার ও সময় দেবে না। পরের দিন সকালে যখন খবর এলো …তখন খাট সাজানো হচ্ছে …তারপর থেকেই মাও গেলো পাল্টে। ছোড়দা তড়িঘড়ি বিয়ে করে বউ এনে বাড়িতে তুললো। যে বউ বিয়ের ছমাসের মধ্যে ছেলের জন্ম দেয়, সে বউ সেনগুপ্ত বাড়ির যোগ্য বউ হয় কি? মা একটা কথাও বলেনি। দাদাদের হাতে চলে গেলো কাপড়ের ব্যবসা, আর বড়বৌদির হাতে সংসার, বড়বাজারের ওই গোটা দোকান দুভাগ হয়ে গেলো। কর্মচারীগুলো কেঁদে পড়েছিল মার পায়ের কাছে। মা সাতদিন ধরে অন্নজল ত্যাগ করেছিলো। দাদারা একবার ক্ষমা পর্যন্ত চাইলো না। আর ঠিক তখনই কি মার স্ট্রোক? কলঘরে পড়ে গিয়ে অচেতন হয়ে রইলো সারাদুপুর কেউ জানতেও পারেনি পর্যন্ত, কাজের দিদি এসে আবিষ্কার করে মায়ের ল্যাজেগোবরে দেহ। তুমি নিশ্চয়ই আমায় ডেকেছিলে, তাই না মা? আর আকন্ঠ সংসারে ডুবে থাকা এক মেয়ে সে ডাক শুনতেই পাইনি। এ অপরাধ কি ক্ষমার যোগ্য বলো?
তবে বড়দা অনেক করেছিল, ভালো হসপিটালে রাখা, বাড়িতে এসেও দুবেলা আয়া নার্স ..কোনও কার্পণ্য করেনি। অপরাধবোধে কি? হবেও বা ……তারপর সময়ের চাকা ঘুরলো। দাদার মেয়েরা বড় হলো, সংসারে চাপ বাড়লো, আর বাড়লো মায়ের অবহেলা …নার্স থেকে আয়া হলো, দুটো আয়া থেকে একটা, তারপর সেও গেলো। বুড়ি শান্তাপিসী সারাদিনে সময় করে একবার আসে, চান করে খাইয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আর ওই দাপুটে মানুষটা মরা মাছের মতো চোখে তাকিয়ে থাকে দিনভোর। বৌদিরা নাক কুঁচকে চলে যায়। হায় রে মা! …আর কেন? এবার তো তুমি যাও!
অথচ এই মা, কি অসম্ভব টিপটপ রাখতো নিজেকে। ছোটবেলায় মনে আছে, গা ধুয়ে কুঁচি করে পাড়ভাঙ্গা শাড়ি পরতো। পাউডার আর সুগন্ধিতে ম ম করতো মা। কতবার যে মায়ের বুকে মুখ গুঁজতাম ওই গন্ধ নেবো বলে। মা এই দুর্গন্ধের মধ্যে তুমি কিভাবে বেঁচে আছো বল দেখি?..দোহাই এবার তুমি যাও।
যেদিন মা কে এবাড়িতে আনার চেষ্টা পুরোতরে শেষ হলো, সেদিনই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাসুরের ওষুধের বাক্স থেকে কয়েক মাসে ধীরে ধীরে চুরি করলাম দু পাতা ঘুমের ওষুধ …শাশুড়ির হাতেপায়ে ধরে একদিনের ছুটি মঞ্জুর করলাম, যত্ন করে রাঁধলাম কুমড়ো শাক, ট্যাংরা মাছের ঝাল, আর টোপাকুলের অম্বল। কি চমৎকার রান্নার হাত ছিলো মার। সামান্য কচু ঘেঁচু দিয়ে বানিয়ে ফেলতো অমৃত। সে অমৃতের স্বাদই নিতাম প্রাণভরে, কোনওদিন মায়ের মতো হতে পারলাম আর কই!
মায়ের জন্মদিন ছিলো পয়লা ফাল্গুন। বাবা মজা করে বলতেন, আমার ফাল্গুনী বউ। ঘর আলো করা বউ। তেমনই এক ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে গেলাম মার ঘরে। যত্ন করে স্নান করিয়ে মাখিয়ে দিলাম সুগন্ধি ল্যাভেন্ডার। কিছু কি মনে পড়ে মা? ..পুরোনো কিছু স্মৃতি?..কিচ্ছু কি বাকি নেই আর? সারা ঘর ভরিয়ে দিলাম সুগন্ধি আতরে। এবার খেয়ে নাও মা। যত্ন করে বানানো এই পদে শুধু স্বাদ মসলা নয়, তোমার মেয়েও রইলো এক টুকরো …তার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে।