কখনও কোনওরকম বিপাকে পড়ে যদি আপনার মনে হয় এইসব ঘটনা শুধু আপনার সাথেই কেন ঘটে থাকে, তাহলে আজকের পর থেকে একবার করে আমার এই অমূল্য অভিজ্ঞতার কথাটাও ভেবে নেবেন। আপনার দুঃখের ভার তাতে কতকটা লাঘব হলেও হতে পারে, অন্তত আমার ধারণা তো সেইরকম।
–
আমি ছুটির দিনে বাড়ীর কাজ যে একেবারেই করি না, এ ধরণের রটনা আসলে বিরোধীপক্ষের অপপ্রচার। উদাহরণ স্বরূপ এই তো, দেখুন না, গতকাল রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে গৃহিণীর নিত্যকর্মের খানিকটা অংশ নিজের হাতে করে দিয়ে কাজ এগিয়ে দিয়ে কিছু ব্রাউনী পয়েন্ট রোজগারের ধান্দায় ছিলাম। তিনি চোখের বালি দেখুন, আমি টেবিল খালি করি, এই আর কি! নিত্যকর্ম মানে খাবার টেবিল থেকে অতিরিক্ত ভাত, ডাল, তরকারী ইত্যাদি উঠিয়ে নিয়ে সেগুলোকে ছোট ছোট টাপারওয়্যারের বাটীতে ঠেসে রাখা। এই পদ্ধতিতে যে হাঁড়ি, কড়াই, প্যান ইত্যাদি খালি হলো, তাদের সিঙ্কে নামিয়ে জলে ভিজিয়ে রেখে দেওয়া। অবশ্য, ওদিকে আর বেশী এগোনো উচিৎ হবে না, ওগুলো মেজে রাখতে গেলে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, এত কষ্ট করে জমানো যাবতীয় গুডউইল নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং ওদিকে না গিয়ে ভাবলাম এবার বরং বাটীগুলোকে ঠান্ডা মেশিনে তুলে রাখি।
–
রেফ্রিজারেটারের দরজার নীচের পাল্লাটা খুলতেই চিত্তির। দেখি ক্রিস্পার ট্রেতে ফুলকপি বাঁধাকপির ফাঁকে ফাঁকে মেট্রো তৈরীর সময়কার মনোহরদাস তড়াগের মতো খানিকটা তলানী জল। ওপরের সব কটা বাসন কোসনের ওপরেই শীতের সকালের মতো ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু। তড়াক করে ওপরের ডীপ ফ্রিজের দরজাটা খুলতেই দেখা পেলাম একটু আঁশটে গন্ধ সমেত আধা শুকনো এক আরল সাগর। ফ্রীজের আলো জ্বলছে, টেম্পারেচার কন্ট্রোল প্যানেলেও আলো আছে, মানে কোনও বিদ্যুৎ সরবরাহ জনিত বিভ্রাট আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রেফ্রিজারেটরটা হঠাৎ জবাব দিয়ে দিয়েছে। কেন, কি বৃত্তান্ত, এইসব জিজ্ঞেস করবেন না। আমি এঞ্জিনীয়ার নই, তাই কারণটা আমার জানা নেই।
–
অবশ্য আপনারা জিজ্ঞাসা না করলেও, সকলকে তো আর আমি আটকাতে পারি না। আমার এক অস্ফুট কাতরোক্তিতে বিভাগীয় প্রধান টিভি ছেড়ে উঠে এসেছিলেন। ব্যাপার স্যাপার দেখে সরাসরি জিগ্যেস করলেন, “এটা তুমি কী করেছ?” আমি সবিনয়ে জানালাম আমি কিছু করি নি। তিনি হয়তো এই রকম উত্তরই আশা করেছিলেন, পাত্তা না দিয়ে বললেন, “তাহলে এরকমটা হলো কি করে?” আপনাদের যেমন বলেছিলাম, ওঁকেও সেইরকম ভাবেই বললাম, “আমি এঞ্জিনীয়ার নই, তাই সঠিক কারণটা আমার জানা নেই।’’ অবশ্য, এঞ্জিনীয়ার হলেও যে খুব একটা তফাৎ হতো তা তো মনে হয় না। কারণ আমার স্বচক্ষে দেখা আছে, এঞ্জিনীয়ারদের বাড়ীর ফ্রিজও খারাপ হয়, এবং সেই অবস্থায় তাঁরাও নিজেরা বেশী কারিগরী বিদ্যে না ফলিয়ে তাঁদের ফ্রিজ বানানেওয়ালা কোম্পানীর কল সেন্টারেই সোজাসুজি ফোন করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এঞ্জিনীয়ারের প্রসঙ্গ তোলাটা একটা অনিচ্ছাকৃত ফাউল হয়ে গেলো। আমার ছোট শ্যালক বিশাল হোমড়া চোমড়া এঞ্জিনীয়ার। গৃহিণী তাই ব্যাপারটা আগ বাড়িয়ে নিজের গায়ে টেনে নিলেন। ধ্যাতানি দেওয়ার সুরে বললেন, “বাজে না বকে ফোন লাগাও !”
–
তাই লাগালাম। তাড়াহুড়োতে হাতের কাছে যে মোবাইলটা ছিলো, সেটা দিয়েই নম্বর টিপলাম কোম্পানীর কল সেন্টারের। প্রথম চেষ্টাতেই ফোন বাজলো, একবার বেজে উঠেই থামলো এবং এক যান্ত্রিক ঘোষিকা হিন্দীতে আমাকে তাঁদের উপভোক্তা সহায়তা কেন্দ্রে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন আমি হিন্দী, ইংরিজী, উর্দু, গুরমুখী ইত্যাদির মধ্যে কোন ভাষায় সহায়তার কথা শোনা পছন্দ করবো। আমার ইংরিজী পছন্দ জানতে পেরে তিনি পরবর্তী প্রশ্ন করলেন ইংরিজীতে। জানতে চাইলেন আমি এয়ার কন্ডিশনার বা রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন কিম্বা ভিডিও প্লেয়ার, ক্যামেরা না মোবাইল ফোন … কি জাতীয় যন্ত্রের জন্যে সহায়তা চাইছি ? বোতাম টিপে টিপে, ধাপে ধাপে এগিয়ে মিনিট খানেক পরে তেনাকে বোঝানো গেলো আমার উদ্দিষ্ট যন্ত্রটি একটি ফ্রিজ, আমি সেই যন্ত্রটি কেনার জন্যে নয়, সারানোর ব্যাপারে আগ্রহী এবং যান্ত্রিক ভাবে নয়, আমি কোন সহায়কের সাথে নিজে কথা বলে সাহায্য পাবার ব্যাপারেই উৎসাহী। তিনি সব শুনে টুনে নিয়ে কথা থামাতেই শুরু হলো বেশ হাল্কা পাশ্চাত্য ধাঁচের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। বাজনাটা শুনতে নিতান্ত মন্দ নয়, কিন্তু আমি তেমন আপ্যায়িত হয়ে শুনতে পারছিলাম না, অবস্থাবিশেষে। কারণ, আমার অন্য কানের পাশে বাজছে অন্য বাজনা, গৃহিণী জানতে চাইছেন “ওরা কি ওঠালো ফোন?” এবং আমার মাথা নাড়া নেতিবাচক উত্তর পেয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করছেন, “এমা, কেন?” ওরা কেন এখনও ফোন ওঠাচ্ছে না, এই তথ্য আমার কাছে ততটাই অজানা, যতটা অজানা ছিলো ফ্রিজ খারাপ হওয়ার কারণটা।
–
আধ মিনিট ধরে সেই বাজনা বাজিয়ে আবার ঘোষিকা ফিরে এলেন, এবং এলেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ফেরফিরতে হিন্দীভাষিনী হয়ে। জানালেন ওই সেন্টারের সমস্ত কর্মী এখন অন্য উপভোক্তাদের সাথে কথোপকথনে ব্যাস্ত আছেন। আমি অপেক্ষমানেদের কাতারে আছি। আমার নম্বর ছয়, এবং আমার অপেক্ষা করার সময় সীমা আন্দাজে বারো মিনিট! হাত নেড়ে অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকলাম, তিনি ফ্রিজের পেছন দিকে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন, আমার মুখে সব শুনে ভ্রুকুটি করে বললেন, “কথা বলতেই যদি বারো মিনিট সময় নেয়, তাহলে সারাবে কতদিনে? তুমি আলিফকে ফোন করো।”
–
নামটা আলিফ নয়, আতিফ, কিন্তু তাঁকে ফোন লাগিয়ে কি হবে? আতিফ ভাই তো এই কোম্পানীর এয়ার কন্ডিশনার সারান! সেই সূত্রেই আমার সাথে আলাপ তাঁর, কিন্তু ফ্রিজ আর এসি কি এক হলো? তবে যেহেতু দুটোই ঠান্ডা করার যন্ত্র, এবং যেহেতু সেই যুক্তিকে কাটার মতো কোনও জোগাড়যন্ত্র আমার কাছে ছিলো না, তাই আতিফকে ফোন করতেই হলো। এক কানে বাজনা, অন্য কানে আতিফ ভাই, সামনে রুষ্টা এবং চিন্তিতা গৃহিণী, তাঁর পেছনে ভাসমান (?) ফ্রিজ, ফ্রিজের ভেতর ঠাসা সেদিনেরই বাজার করা আনাজপত্র, সাথে আধখানা রুই মাছ আর একটা ঝোলো মুরগীর দেহাবশেষ (ব্রয়লার মানে তো ঝোল বানানোর উপযুক্ত, তাই না?) … আমার অবস্থাটা অনুধাবন করুন একবার!!!
–
আতিফ ভাই অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি। ধীর স্থিরও বটেন। বললেন, “আপনি কোম্পানীতেই খবর দিন। আমি ফ্রিজের কাজ করি না। আমার কোন সহকর্মী করে তাও জানি না। আর আমার চেনাজানার মধ্যে আছে একজন লোক যে এই কাজ করে, কিন্তু আপনাকে আমি তার কথা বলতে পারি না। সে প্রাইভেটে কাজ করে, আপনার ওয়ারেন্টি থাকবে না ওকে দিয়ে করালে।” বললাম, “ওয়ারেন্টি মাথায় থাক। আমার অবস্থা এখন কাহিল। কোম্পানী থেকে হয়ে গেলে তো ভালোই হবে, কিন্তু নেহাত যদি ওই পথে সুবিধে না হয়, মানে এই যে, দেখুন না, আমি অন্য কানে কোম্পানীকে ফোন লাগিয়েই রেখেছি আর প্রায় মিনিট দশেক ধরে গানবাজনা শুনছি… তা আপনি তাঁর নম্বরটা মেসেজ করে দেবেন একটু…” আতিফের প্রাণে দয়া মায়া আছে, তিনি দিলেন সেই প্রার্থিত নম্বরটি… সেই টেকনিশিয়ান ভদ্রলোকের নাম রাজ… রাজ আরিয়া, অর্থাৎ রাজ আর্য্য…। আচ্ছা, দেখা যাক, এই কোম্পানীকে দিয়ে ব্যাপারটা মিটলে ভালো, নইলে এঁকে নিয়ে পড়া যাবে।
–
অন্য কানে বাজনা বেজেই চলেছে, যেন আবহমান কাল ধরে, থামাথামির নামই নেই… বেশ অনেকক্ষণ পরে তেনাদের দয়া হলো, বাজনা থামিয়ে ঘোষিকা জানালেন আমার সাথে কোম্পানীর সহায়কের যা কথা হবে, সেটা তাঁরা রেকর্ড করে রাখবেন, তাঁদের সহায়কদের শিক্ষাদান এবং সহায়তার মান বজায় রাখার জন্যে। আমার গলা রেকর্ড আর ক’জন সেধে এসে করতে চায়…! আমি আবার আপ্যায়িত হলাম। তারও খানিকটা পরে, মোটামুটি ফ্রিজ ঘটিত অঘটনের ঘটনাটা আবিষ্কারের থেকে প্রায় পৌণে ঘন্টা সময় জলাঞ্জলি দেবার পর কোম্পানী নিয়োজিত সহায়কের গলা ভেসে এলো ইথার তরঙ্গ বেয়ে। “শুভসন্ধ্যা, দাবিন্দর চাড্ডা মহোদয়, অমুক কোম্পানীর তরফ থেকে আমি অভিজিৎ কথা বলছি। বলুন, আমরা আপনার কি সহায়তা করতে পারি?”
–
সত্যি বলতে কি, এইবার আমি বমকে গেলাম! মানে আমি এমন চমকে গেলাম যে আমার বাক্যি হরে গেলো। চাড্ডা পদবীটা আমার মোটেই ভালো লাগে না একটা কারণে, সেটা অন্য কোনওদিন খোলসা করবো। যতদূর মনে পড়ে, আমার নিজের নামের পদবী হিসাবে চাড্ডার ওপর আমার কোনও দাবী নেই, কোনওদিন ছিলো বলেও জানতাম না। কিন্তু সাথে দাবিন্দর থাকলে ব্যাপারটা আরো কেমন গুলিয়ে যায়। আমি তো আমিই, কিন্তু এই দাবিন্দর চাড্ডা ভদ্রলোকটি কে? এই অভিজিৎ-ই হয়তো সাপ দেখতে ব্যাঙ দেখছে তার কম্পিউটারে। একটু ঘনিষ্ঠ জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি।
–
বিনীত ভাবে বললাম, “আজ্ঞে, আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি দাবিন্দর কিম্বা অন্য কোনওরকম চাড্ডাই নই। আমার নাম পিনাকী চক্রবর্তী। আদি নিবাস কলকাতা, অধুনা নয়ডাবাসী…” আর এগোনোর আগেই অভিজিৎ হই হই করে উঠলো, ‘‘নয়ডা? নয়ডা কোথায়? নয়ডা আবার এর মধ্যে কোত্থেকে এলো? না, না, আপনি থাকেন তো দিল্লীর পশ্চিম বিহারে, জায়গাটা ঠিক এইখানে…’’ আমার আপত্তিকে নস্যাৎ করে সাংঘাতিক রকম বিশ্বাসযোগ্য কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল একটা পশ্চিম বিহারী ঠিকানা সে আমাকে শুনিয়ে দিলো।
–
আমি আবার চেষ্টা করলাম, ‘‘ভাই অভিজিৎ, আমি দিল্লীর পশ্চিম বিহার চিনিনা, কোনওদিন যাইনি সে পাড়ায়। আমার কাছে পশ্চিম বিহার মানে বিহারের আরা, ছাপড়া, চম্পারণ…’’ অভিজিৎ বললো, ‘‘স্যার, আমাদের এখন খুব ব্যাস্ত সময় চলছে। আপনি যদি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি বলেন আপনার ফ্রিজে ঠিক কি ধরণের গণ্ডগোল হচ্ছে, তাহলে আমি আপনাকে হয়তো সাহায্য করতে পারি। নাহলে…’’ বলে সে এমন ভাব দেখালো যেন ফোনের লাইনটা এক্ষুণি কেটে দেবে। যাব্বাবা! এ তো দেখি সবাই ধ্যাতায় আমাকে। নিজের গিন্নি, কোম্পানীর সহায়ক, এদের সকলের বকা খেতে খেতে আমি তো তখন অসহায়, নিরুপায়, ইত্যাদি ইত্যাদি… পশ্চিম বিহার, চাড্ডা, এইসব অদরকারী প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়ে রেখে ঝটপট কাজের কথায় এলাম। বললাম, ‘‘আমার ফ্রিজ চলছে না, শুধু এইটুকুই গণ্ডগোল। জলে ভরে গেছে সে। আর খানিকক্ষণ বাদে সেই জল ফ্রিজ ছাড়িয়ে আমার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবে, এরকম সম্ভাবনা খুব প্রবল।’’
–
অভিজিৎ আমাকে দিয়ে ফ্রিজের সুইচ চালু করিয়ে, বন্ধ করিয়ে, আমার কাছ থেকে কিছু চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে, আমাকে বললো, ‘‘আপনার ফ্রিজে গ্যাসের অভাব ঘটে নি। যা হয়েছে সেটা খুব সম্ভবত রিলের প্রবলেম। না হলে থারমোস্ট্যাটটা গিয়েছে। অথবা সেন্সর কাজ করছে না। আপনি, স্যার, ছয় ঘন্টা ফ্রিজের দরজা খুলে সুইচ অফ করে রেখে দিন। কালকে সকালে আবার চালু করবেন। চালু করার সময় এই রকম সেটিং রাখবেন… আর, তখনও যদি চালু না হয়, তবে আমাদেরকে আবার জানাবেন। আমরা ঠিক করে দেব। আচ্ছা স্যার, আপনার ফ্রিজের সিরিয়াল নাম্বারটা একবার ভেরিফাই করে দেবেন। আমার খাতায় যা আছে, সেটা হলো এই…’’ দেড় গজ লম্বা একটা এবিসিডি ১২৩৪ সঙ্কলিত নম্বর পড়ে শোনালো সে। আমি বললাম, ‘‘দাঁড়াও বাপু, এই নম্বরটা ফ্রিজের কোথায় লেখা থাকবে?সে বললো, ফ্রিজের বাইরের দিকের যে কোনও এক পাশের গায়ে, স্টিকারে লেখা থাকে। আমি দেখলাম আছে সেইরকম চার পাঁচটা স্টিকার, ফ্রিজের একপাশে, পায়ের কাছ ঘেঁষে। টর্চ এনে, মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে সেই নম্বর পড়তে পড়তে অভিজিতকে বললাম, ‘‘আবার বলো তো হে ছোকরা তোমার নম্বরটা।’’ সে বললো, ‘‘আমার না, আপনার ফ্রিজের নম্বরটা হলো এই…’’ আমি মাঝরাস্তাতেই হাঁকপাঁক করে আপত্তি তুললাম, ‘‘না হে, নম্বর মিলছে না…।’’
–
এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথমবার তাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখলাম। সে বললো, ‘‘আচ্ছা, মডেল নাম্বারটা দেখুন তো … এই আছে কি না?’’ আমি বললাম, ‘‘না।’’ সে এবার খুব গম্ভীরভাবে বললো, ‘‘বেশ, আপনি তাহলে পড়ে শোনান তো আপনার ফ্রিজের মডেল আর সিরিয়াল… এই দুখানা নম্বর!’’ আমি পড়ে পড়ে শোনাতে লাগলাম তাকে… শেষ সংখ্যাটা পড়া শেষ হতেইসে বলে উঠলো, ‘‘আচ্ছা, আপনার নাম কি পিনাকী চক্রবর্তী ? আপনি কি নয়ডায় অমুক কোম্পানীর সরকারী আবাসনে থাকেন?’’একেই ইংরিজীতে বলে চোখ থেকে পেনী খসে পড়া। অ্যান্ড দেন দ্য পেনী ফেল ফ্রম হিজ আইজ!
–
চোখের থেকে পেনী খসে পড়ার জন্যেই হোক বা অন্য যাই কারণে হোক না কেন, অভিজিৎ দেখলাম বেশ বিরক্ত আমার ওপর।কিছুটা রুক্ষভাবেই ভাবে এবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘আপনি আপনার রেজিস্টারড মোবাইল থেকে ফোন করছেন না কেন?’’ আমি বললাম, ‘‘তোমার কাছে যে নম্বরটা লেখা আছে, আমি এখন আর ওই মোবাইল নম্বরটা ব্যবহার করি না, সরকারী আবাসনেও আর থাকি না। দুটোর কারণই এক। আমি চাকরী থেকে অবসর নিয়েছি। আমার এই ফোন নম্বরটা আমি সদ্য সদ্য হাতে পেয়েছি, হয়তো এটা পশ্চিম বিহারী কোন চাড্ডার কাছে থেকে থাকবে এর আগে, আর সেই চাড্ডাও নিশ্চয়ই আমারই মতো ভুলভাল ফ্রিজ কিনে পস্তাচ্ছে। যদিও আমি এটা আন্দাজে বলছি, সত্যি মিথ্যে আমার জানা নেই। তবে তুমি বাপু তোমার জ্ঞাতার্থে একটু লিখে রাখো কোথাও, আমার বর্তমান বাড়ির ঠিকানা হল এই…’’
–
এখনকার সমাচার বুলেটিন এই রকম – আজ সারাদিন ধরে অভিজিতের পাঠানো ইঞ্জিনীয়ার এসে পৌছাতে পারে নি। বিকেলের দিকে রাজ আর্য্যকে ফোন করে দিয়েছিলাম। দেখলাম রাজ কার্যে বেশ চৌকশ… সন্ধ্যের একটু পরে ফ্রিজ চালু হয়ে গেলো। তরি তরকারী, মায় মাছ মাংসের পর্যন্ত কিছু হয় নি। এমনকি দুধটাও কাটে নি জ্বাল দেওয়ার সময়ে। দিল্লী অঞ্চলে শীত তার মানে এসে গেছে।
–
শেষ হয়ে গেছিলো আমার কথা, কিন্তু শেষ লাইনটা আবার পড়তে গিয়ে একটা কথা মনে পড়লো। আমি ২০১২ সালে পশ্চিম সাইবেরিয়া গেছিলাম।যেখানে গেছিলাম সে জায়গাটা প্রায় আর্কটিক সার্কেলের ওপর। ওখানে বাড়ীঘরগুলোতে ডবল ডবল জানালা থাকে কাঁচের। এক সেট বাইরে, এক সেট ভেতরে। মাঝে বেশ হাত খানেকের ফারাক। ওই গ্যাপটা ইন্স্যুলেটরের কাজ করে। বাইরে -৩৫° সেলসিয়াস হলেও ভেতরে আরামদায়ক +১৫° সেঃ রাখা চলতে পারে। দুই জানালার মাঝখানের থাকটাতে ০°থেকে -৫° মতো থাকে তাপমান। তা এমন জায়গাতেও লোকে ফ্রিজ ব্যবহার করে শীতকালে। তবে সুইচ বন্ধ করে ফ্রিজের ভেতর গরম রান্না রাখে, অনেকটা সাহেবদের হটকেসের ধাঁচে। শাকপাতা গুলো রাখে ঘরের ভেতরে, জানলার গায়ে। রান্নাবান্না তরি তরকারী রাখে দুই জানালার মাঝের থাকে। আর মাছ মাংস রাখার জায়গা বাইরের জানালার বাইরে। একটু হয়তো অসুবিধে হয় বরফের স্তুপের নীচে মাছটা কোথায় আর মাংসটা কোথায় রাখা আছে সেটা খুঁজতে। কিন্তু বুদ্ধিমানেরা রঙিন ফিতে লাগিয়ে রাখেন প্যাকেটের গায়ের থেকে জানালার ওপরের স্নো-শেড পর্যন্ত। ফিতের রঙেই সব রহস্যের সমাধান হয়। তবে সেগুলোকে বের করে আনতে হয় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে। ঝঞ্ঝাট মনে করলেই ঝঞ্ঝাট, কিন্তু এটাও ভেবে দেখুন, মাসের পর মাস মাছ মাংস স্টোর করা থাকে, কিচ্ছুটি খারাপ হয় না।
–
সাইবেরিয়ায় নাকি এমন একটা ম্যামথের আস্ত দেহ পাওয়া গেছে পার্মাফ্রস্টের বরফের নিচ থেকে, যার পেটের মধ্যে থেকে তার সদ্য খাওয়া কিন্তু হজম হওয়ার আগেই জমে যাওয়া ঘাস পাতা এবং ঘাসের ফুল সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ঘাসের বীজগুলো তুলে নিয়ে লাগালে ১২,০০০ বছর আগেকার দুব্বোঘাস আবার গজাবে!!!
–
পরিভাষায়, “ক্ষী ক্ষারবার!!!”
গল্পের বিষয়:
অন্যান্য