মনসুর মিয়া এরকম একটা দু’নম্বরি করলো! দু’নম্বরি না বলে বেইমানি বলা ভালো। ব্যবসায় অবশ্য দুটোই চলে। মনসুর মিয়া তো তার টেস্ট সম্পর্কে সম্যক অবগত… তবুও এমন একটা দড়কচা গছিয়ে দিলো! অবশ্য নিজেরই ভুল; আজ খুব হুড়োহুড়ির মধ্যে কেনা, পরখ করে দেখার সময় ছিল না, রাত দশটা বেজে গেছে, বাড়িঅলা খাবার পানির মটর নিশ্চয় ঠিক সময়েই ছেড়েছে, ভদ্রলোক যেরকম ট্যানটেনা, মাসে একবার দেখা হলেও সেটা অসহ্য তাতে আবার ফাও একবার সাক্ষাৎ! ফলে দ্রুত পলিথিনে ভরে সিঁড়ি ভাঙে সাদেক।
–
কোথাও একটা কিন্তু আছে। স্বাদটা ঠিক দেশি দেশি লাগছে না, চিবোতে হচ্ছে বেশি বেশি, এ কচি তো নয়-ই। অফিসের রেজাউল সেদিন পাকিস্তানি এক পদের কথা বলছিল দেখতে না কি একদম দেশি, এটা কি তবে সেই? বাগে আনতে একটু কষ্ট হচ্ছে। রোয়াগুলো বেশ শক্ত, অবশ্য দেশিগুলোর রোয়া এর চেয়েও শক্ত-পোক্ত। তাতে কি! এর গন্ধটাও কেমন বিটকেলে। সাদেকের মেজাজটা খাপ্পা হলো মনসুইজ্জার ওপর। নেহায়েত গলির মুখের দোকান, ভাবতো বেচারার আর ক’টাই বা বিক্রি! কিন্তু এমন ধারা খাওয়ার পর আর ব্যাটাকে বরদাস্ত করা চলে না। সামনের সপ্তাহ থেকে বাজারেই যেতে হবে। বড়লোকের বাজার এবং ছোটলোকের বাজার, দু’ধরনের বাজারে গিয়েই দেখতে হবে।
–
সারি সারি দুই সুতার লোহার খাঁচায় কী যে সুন্দর লাগছে শাদা-খয়েরি-বাদামিরঙা ব্রয়লার মুরগিগুলো। সবচে’ সুন্দর ছয়-সাতশো গ্রামের কচিগুলো। কিউট কিউট। দেড়-দু’কেজিরগুলো কেমন বদখত দেখতে। বড়লোকের বাজার বলেই হয়তো একটু সাফ-সুতরো। দেশি মুরগির খোঁজ করতে গিয়ে গোটা বাজার ঘুরে মাত্র দুটো দোকান পাওয়া গেল। অবশ্য ওই দুটো দোকানেও ব্রয়লার পাওয়া যাচ্ছে। দেশিগুলো কিন্তু লোহার খাঁচায় থাকার সম্মান জোটাতে পারেনি, ওগুলো গাদাগাদি করে আছে দরমা’র বানানো ঢাউস খাঁচায়। দেশি খাঁচায়ও বেশ কয়েকটা ডেগা কুড়া (আম্মা বলেন) চোখে পড়লো।
–
বাজারে কয়েকবার চক্কর মেরে একটা সাড়ে ছয়শো গ্রামের ব্রয়লার আর ডেগা কুড়া কিনে ছাল ছাড়াতে দিল পাশের মুরগি কাটার জায়গাটায়। হালকা ভিড় সেখানে। চোখে চোখে রাখতে হবে মুরগি কাটুরে চ্যাংড়াটাকে। হারামিগুলো প্রায়ই এরটা ওরটা গুলিয়ে ফেলে। বড়লোকের বাজার হিসেবে দাম কি দশ-বিশ টাকা বেশি নিল, ছোটলোকের বাজারে গিয়ে একদিন যাচাই করে আসতে হবে। সাদেক দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো চ্যাংড়াটার ক্ষিপ্র হাতের মুনশিয়ানা। খুব একাগ্র চিত্তে, নির্বিকার ভঙ্গিতে একটার পর একটা ছাল ছাড়িয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। আস্ত চামড়াটা ছাড়াতে মাত্র দুটো টান! দুই রানের মাঝখানে কষে ধরে উল্টিয়ে পিঠ থেকে টান মেরে চামড়ার একটা অংশ ছিঁড়ে সেটা দু’দিকে টান মারলে গলা আর পা গলিয়ে বেরিয়ে আসছে চামড়াটা। কাটা মুরগিসমেত পলিথিনটা হাতে ধরতেই তাজা মাংসের উষ্ণতায় শিউরে উঠল সাদেক।
–
একা মানুষ বলে ঘরে ফ্রিজ নেই যে রেখে রেখে খাবে। ফলে দুটোকে দুই পদে রান্না করতে হবে। রান্না বিষয়ে সাদেকের কোনও কালেই ক্লান্তি ছিল না। এখনও নেই। ফলে গলাটলা বাদে মুরগি দুটো আট পিস আট পিস ষোলো পিসে কেটে আধঘণ্টার মধ্যেই তাকে রান্নাঘরে রাঁধুনি মুরগির মশলায় মাংস কষানিরত অবস্থায় দেখা গেল। রান্নার মাঝ পর্যায়ে এমন একটা ঘোর লাগা সুবাস ছড়াল যে সাদেকের জিহ্বা-মুখ লালায় ভরে উঠল তৎক্ষণাৎ। খেতে তোফা হয়েছে মুরগি দু’টো। সাধে কি কচি খোঁজা! ব্রয়লারটার ঝালফ্রাই আর দেশিটা আলু দিয়ে ঝোল। রান থেকে মাংস ছাড়াবার আগে গোটা রানটা সাদেক বেশ কয়েকবার ললিপপের মতো করে চুষে নেয়। জিভের ডগা দিয়ে আলগোছে ওপর-নিচে-বৃত্তাকার হালকা চেটে নেয় মসৃণ রানটা। লালাসিক্ত রানটায় যখন আর একবিন্দু রসও অবশিষ্ট থাকে না, তখন দাঁতের হালকা নিখুঁত কারুকাজে সে হাড় থেকে মাংস খুলে আনে। ইশ, কী তুলতুলে! জিভে গালে নরম মাংসের দলা নিয়ে আবেশে চোখ বুঁজে আসে ওর। চিবুতে ভুলে যায় কিছুটা সময়। নাহ্, এই তুলোর মতো নরম মাংস চিবিয়ে খাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। সুতরাং জিভ দিয়ে নেড়েচেড়ে একটু একটু করে মাংসের রোয়া খোলাটা সাব্যস্ত করে সে তা-ই শুরু করলো। ব্রয়লার বলেই এমন নরমসরম। দেশিটা ট্রাই করে দেখা যায়। হুমমমম… একটু আড়ষ্ট-আঁটোসাটো, কিন্তু একবার কায়দা করে নিলে দেশিও কম কীসে! ব্রয়লারের চেয়ে এককাঠি সরেসই বলা যায়। ব্রয়লারগুলোর রোয়া যেমন একটু ভারি দেশিগুলোর তেমন নয়, কেমন মাখনের মতো গলে গলে যায়, নাটি বিস্কুটের মতো টুকরো টুকরো হয়ে আসে। দুইপদের দুটো রান সাবড়ে এবার সে মন দিল হাড় চিবোনোয়।
–
আগেও দেখেছে সে, ফার্মের মুরগির হাড়ে কেমন একটা গন্ধ হয়। ঠিক জুৎ লাগে না চিবোতে।শুধু হাড়ের মাথায় লেগে থাকা নরম-শাদা এনজাইমগুলো খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলে দিতে হয় বাকিটা। কিন্তু দেশির হাড় এককথায় অসাধারণ। ভাঙতেই তো কী আনন্দ! কট্কট্ করে শব্দ হয় আর ভেতরের মজ্জাগুলোও মোম মোম। হাড় চিবোনো শেষে কড়াই থেকে একপিস তেকোনা বুক তুলে নিলো সে, আজকের কাটাটা একদম মাপমতো হয়েছে। তেকোনা খ-টার আগায় নরম হাড়অলা মাংসটা ছাড়িয়ে একটু নিচের দিকে এসে ত্রিভুজের দুবাহুর মতো ছড়িয়ে গেছে দুদিকে। কিছুক্ষণ সেই নরম আগাটা নিয়ে সে খেললো। বলাবাহুল্য জিভ দিয়েই, অনেকটা ইন্দুর-বিলাই খেলার মতো, মাংসটা দাঁতে কাটবে কি কাটবে না… এইরকম। খেলা শেষে সে মনোযোগী হলো দু’দিকে ছড়ানো অমৃতের দিকে। বেশ সময় নিয়ে সে একে একে চুষে নিল বাহু দুটো। খেতে খেতেই তার মনে হলো, কীসব ছাইপাশ এনজিও করি, তারচে’ বরং মুরগিকাটার কাজ নিলেই তো ফতে। সারাদিন এমন নরম-কচি মুরগি, ছাল ছাড়ানোর পরও কেমন তিরতির করে কাঁপতে থাকে আর কী টাটকা গরম। উফ্! ভাবতে ভাবতেই একটা বড়সড় ঢেঁকুর উঠে আসে তলপেট থেকে।
–
এভাবেই চলতে থাকে সাদেকের ডেগা কুড়ার রসাস্বাদন, সপ্তাহান্তে। মাঝে মাঝেই মুরগি কেনা ছাড়াও সে বড়লোকের বাজার আর ছোটলোকের বাজারগুলোতে ঢুঁ মারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়চারি করে, গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুরগির খাঁচার সামনে। রুপালি আর হলুদ নাক-পা অলা কচি কচি মুরগিগুলোর দিক থেকে তার চোখ সরে না। কখনো দাঁড়ায় মুরগি কাটার জায়গাটার সামনে। চকচকে চোখে সে কাটাকুটি করা ছেলেগুলোকে দেখে। আবার একই বাজারে ঘনঘন আসা-যাওয়ায় সন্দেহ তৈরি হতে পারে ভেবে সে শহরের এ-মাথা ও-মাথার বাজারগুলোতেও চক্কর মারে, ক্লান্তিহীন।
–
একরাতে সে সেই স্বপ্ন্টা দেখে। স্বপ্নে সে যা দেখে তার ছিরিছাদ এইরকম : একটা ছোটখাটো ইনডোর স্টেডিয়াম, সম্ভবত কাবাডি বা ভলিবল খেলার। চারদিক থেকে চারটি কড়া ফ্লাড লাইটের আলোয় চকচক করছে, দ্রিমিক দ্রাম দ্রুম শব্দে বাজছে হাজার ওয়াটের শব্দযন্ত্র। একপাশে মঞ্চে নাচছে একঝাঁক আইটেম গার্ল, মুরগির বেশ ধরে। তাদের উন্মুক্ত বাহুর ঠিকরোলো আভা সাদেকের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে যেন! স্টেডিয়ামের ফাঁকা মাঠে অসংখ্য শাদা-খয়েরি-বাদামি-বহুরঙা কচি মুরগি। ওরা সব চিঁ চিঁ করে খলবল করছে, হঠাৎ কী হলো… সাদেক ঠিক খ্যাপাটে রকস্টারের মতো দু’হাত-দু’পা চারদিকে ছড়িয়ে ওদের ওপর পিঠ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আহ্… ওদের তুলতুলে নরম শরীর যেন মখমলি বিছানার আদর। সাদেকের চোখে ফ্লাড লাইটের তীব্র আলো পড়ায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ভাষা। মুরগিগুলো থেকে থেকে মেক্সিকান ওয়েভ তোলার চেষ্টা করছে যদিও, শেষটায় পেরে উঠছে না। এইরকম।
গল্পের বিষয়:
অন্যান্য