দু বছর আগে একদিন

দু বছর আগে একদিন

‘ সমু কি সত্যিই কাল রাতে…?’
কথাটা বলতে বলতেই চুপ করে গেল আদিত্য। একটা হিমেল জড়তা যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে। হাতের মদের গ্লাসটায় সিপ্‌ দিতে গিয়েও পারছে না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল, এই নামি-দামী বার কাম রেস্টোর্যাগন্টের উষ্ণতা আচমকা হিমাঙ্কের নীচে নেমে গিয়েছে। অথবা গ্লাসে নয়, প্রতিটা রক্তকণিকার মধ্যে বাসা বেঁধেছে বরফের কুচি। একটু একটু করে গিলে নেবে সমস্ত মানবীয় উষ্ণতা। মৃতদেহের উদাসীন হিমশীতলতায় পরিবর্তিত করে দেবে ওকে।
‘হ্যাঁ। খবরটা ঠিক। আজ ভোরেই জানতে পেরেছি। মর্গেও গিয়েছিলাম।’
ওর ঠিক উল্টোদিকের মানুষটি গলগল করে একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দেয়। সে ও হিমশৈলের মত স্থির হয়ে বসে ছিল। বারের আলো-আঁধারিতে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। শুধু চওড়া কপালের ওপরে মসৃণ আলোটা সোনালি তৈলাক্ত আভা নিয়ে পিছলে পড়ছে। তার মুখভঙ্গী দেখা না গেলেও কপালের বিক্ষিপ্ত ভাঁজগুলো ও কন্ঠস্বরে অসন্তোষ প্রকট।
‘তোকে এক্সপেক্ট করেছিলাম আদি। তুই এলি না! সপ্তক সুইসাইড করল, তখনও …!’
‘ নিকুচি করেছে এক্সপেক্টেশনের!’ চাপা অথচ উত্তেজিত কন্ঠে উত্তর এল —‘দুবছর আগেই আমরা ঠিক করেছিলাম—কেউ কারোর সঙ্গে দেখা করব না। ভুলে গেলি?’
‘তবে এখানে এলি কেন শালা বোকাচোদা?’ সে ক্রুদ্ধস্বরে জানায়—‘ সপ্তক মরল, সমু মরল—তখন ভয়ের চোটে টিকিটিও দেখতে পাইনি তোর! এখন যে আমার সঙ্গে এই বারে বসে মাল খাচ্ছিস, ভয় করছে না!’
‘করছে বলেই তো এসেছি’। আদিত্যর কন্ঠস্বর একটু কাঁপল—‘প্রচন্ড ভয় করছে। নয়তো আসতাম না’।
আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। দুই বন্ধুর মুখে কোনও শব্দ নেই। হাতের গ্লাসের তরলের বরফ গলে গলে এখন চিলতে চিলতে ভাসছে। পাশে রাখা দামি ঝকঝকে প্লেটে সল্ট ও লেমন দেওয়া নরম বাদাম, কাবাব, স্যালাড, রোস্টেড ফুলকপি এবং ফিঙ্গার চিপ্‌স ঠান্ডা হয়ে মিইয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বারের নরম আলো তখন আরও একটু মোহময়ী। সমুদ্রের জলের মত নীলাভ আলো শান্ত আভায় ঘিরে রেখেছে চতুর্দিক। পরিবেশ নিখুঁত। এমনভাবেই দুবছর আগে একদিন ওরা বারে বসেছিল! তখন ওরা চারজন ছিল…!
‘তোর ভয় করছে না?’ আদিত্য বলে—‘ সপ্তক নিজের হাইরাইজ থেকেই লাফিয়ে পড়ল! সমু হাতের শিরা কাটল! এরপর তো আমাদের টার্ন! তাই না?’
‘কী বলছিস্‌ যা তা!’ উল্টোদিকের মানুষটি তীব্র প্রতিবাদ করে—‘এসব ভাঁট শোনার জন্য এখানে ডেকেছি তোকে আমি? ওদের অন্য কোনও সমস্যা ছিল—তাই…!’
প্রতিবাদটার মধ্যে একটুও ওজন ছিল না! তার অন্তঃসারশূন্যতা যেন আতঙ্কের শীতলতাকে আরও কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দেয়। না বলা কথাগুলোর মধ্যে একটা প্রশ্নের অনুরণন চলছে। সেটাকেই আঁকড়ে ধরে ফের বিড়বিড় করল আদিত্য—‘তাই ওরা সুইসাইড করেছে। কিন্তু সত্যিই কি সুইসাইড?’
‘মানে?’
বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরটা দিতে গিয়েও দিতে পারল না আদিত্য। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। যখন সপ্তক সুইসাইড করেছিল, তখনও ব্যাপারটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কিন্তু সমুর মৃত্যুর পর সত্যিই একটা মারাত্মক প্রশ্ন সাপের মত চোখের সামনে ফণা দোলাচ্ছে? দুটো মৃত্যুই কি নিতান্তই কো-ইনসিডেন্ট? মৃত্যুর মত জিনিস কি এতটা কাকতালীয় হতে পারে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। আবার কিছু প্রশ্ন করাও অসম্ভব! নয়তো সে জানতে চাইত—‘আমার মত তুইও কি কিছু জানতে পেরেছিস? তোকেও কি কেউ চিঠি লিখেছে! এমন চিঠি পেয়েছিস যা আমাদের কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তির হুমকি দিয়েছে? আমার মত তুইও কি আজকাল সেই মেয়েটাকে প্রায়ই দেখতে পাস? কেউ কি আজকাল তোকেও নিঃশব্দে ফলো করে?’
‘সপ্তক সুইসাইড করার আগে নোটে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। সমুও নাকি হাতের শিরা কাটার আগে চিঠিতে সেসব কথাই লিখে গিয়েছে!’ আদিত্য ফিস্‌ফিস্‌ করে বলল—‘ কী মনে হয়? গোটা ব্যাপারটাই কি কো-ইনসিডেন্স? না পেছনে আরও কিছু আছে? এমন কিছু, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না! ’
‘স্টপ্‌ দিস্‌ বুল শিট্‌’। অন্যদিকের মানুষটা রাগতস্বরে বলে—‘ সপ্তক আর সমুর অন্য কোনও মেন্টাল প্রবলেম ছিল। চাপটা কোনও কারণে নিতে পারেনি। ভাগ্যিস দুজনেই সুইসাইড নোটে আমাদের কথা কিছু বলেনি। বললে কী হত কে জানে! কিন্তু পুলিশ ঠিক তোর মতই ভাবছে। ভাবছে, এটা দু’বছর আগের ঘটনাটার জের! আজ দুপুরেই আবার আমাকে জেরা করেছে। তোকে কাল সকালে ডাকবে। তুই কিন্তু একই কথা বলবি। ঠিক যেমন আগে বলেছিলি—রিটা গোম্‌স্‌কে তুই চিনতি না, কখনও দেখিসনি—এবারও সেই একই বয়ান দিবি। নয়তো ক্লোজড কেসটা আবার রি-ওপেন হবে’।
আদিত্যর হাসি পেয়ে যায়। কেসটা আর রি-ওপেন হবে কী, এতদিনে হয়েও গিয়েছে! দুমাস আগে যখন সপ্তক হাইরাইজ থেকে লাফিয়ে পড়ল, তখনই তার সুইসাইড নোটটা পড়ে পুলিশ নড়েচড়ে বসে! দু’বছর আগে যে চারজনকে তারা গ্রেফতার করেছিল, তাদের মধ্যে প্রথমজন মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেই স্বীকার করে গিয়েছে নিজের কলঙ্কময় অপরাধ। মিডিয়া লাফিয়ে ওঠে। দু’বছর আগের কবর খুঁড়ে বের করতে শুরু করে অপরাধের কঙ্কাল। তবে কি যে চারজন প্রমাণের অভাবে সেদিন বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিল, তারা আদৌ ‘বেকসুর’ ছিল না! তবে কি আইনের অন্ধত্ব তাদের মধ্যে পচাগলা পাপের ক্ষত দেখতে পায়নি?
কিন্তু অন্য কেউ দেখতে পেয়েছিল। আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সেই অদৃশ্য শক্তি ছেড়ে দেবে না। আস্তে আস্তে একটা আতঙ্কের বলয়ে ঢুকে যাচ্ছে সে! সপ্তকের মৃত্যুর ঠিক দু মাস পরেই সমু! আবার মিডিয়া লাফিয়ে উঠবে! যেন ভারত-পাক ম্যাচে পাকিস্তানের উইকেট একটা একটা করে পড়ছে! অথবা অদৃষ্টের শাস্তি নেমে এসেছে চার দুষ্কৃতীর ওপরে! রিটা গোম্‌সের অপরাধীদের মধ্যে দুজন গিয়েছে। এরপর কে যাবে? চ্যানেলে চ্যানেলে ফুটেজ! এটা কি অনুশোচনা? না প্রতিশোধ? কে প্রতিশোধ নিচ্ছে? স্পর্শকাতর কেসটা আবার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে সবার। সবাই টান টান উত্তেজনায় প্রহর গুনবে—এরপর কে? কার পালা?
সে স্খলিত, অন্যমনস্ক স্বরে বলল—‘মেয়েটার নাম রিটা গোম্‌স্‌ ছিল। তাই না?’
‘তুই কি আমার কথা শুনছিস?’
আদিত্য সব শুনতে পাচ্ছিল। অনুভব করতে পারছিল আরও বেশি। আজকাল প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা দৃশ্য সে বেড়ালের মত তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে বড় বেশি স্পষ্ট বুঝতে পারে। যেমন বুঝতে পারছে, সপ্তক আর সমু এমনি এমনি আত্মহত্যা করেনি! নিতান্তই মনোবিকলনের জন্য শেষ চিঠিতে নিজের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করে যায়নি। কারণ ছিল! অনেক বড় কারণ! আদিত্য’র মনে পড়ে যায় সপ্তকের চিঠিতে লেখা কথাগুলো…–খবরের কাগজে বড় বড় করে ছাপা হয়েছিল তার শেষ স্বীকারোক্তি!
“… আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়! মৃত্যু এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এক নিঃসীম অতলান্ত খাদের শূন্যতা হাত বাড়িয়ে ডাকছে। এখনই লাফিয়ে পড়ব তার বুকে। কিন্তু মরতেও আমার ততটা ভয় করছে না, যতটা বাঁচতে করছে! অসম্ভব ভয়ে বেঁচে আছি! এই ভয় অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। প্রতি মুহূর্তে মরার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ক্ষনিকের মৃত্যুযন্ত্রণা অনেক ভালো।
বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কাউকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু সর্বক্ষণ বুঝতে পারছি, কেউ আমাকে দেখছে! কেউ আমাকে ফলো করছে সর্বক্ষণ। আমি তাকে দেখিনি। কিন্তু জানি সে কে! ছোটবেলায় নার্সারি রাইমসের একটা পাতায় একটা কবিতা পড়েছিলাম। কবিতাটা কী ছিল, মনে নেই। কিন্তু ছবিটা পরিষ্কার মনে আছে। একটি লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আর তার পিছু নিয়েছে এক বিকট দৈত্য! আজকাল পথে চলতেও ভুলে পেছনে তাকাই না! নিশ্চিত জানি সেই বিকট, বিরাট দৈত্যটাই আমার পেছনে আসছে। তার ছায়া টের পাই। ভয়ে দিশেহারা হয়ে দৌড়তে শুরু করি। প্রাণপণ দৌড়ই। ভীষণ ভয়ে দৌড়তে দৌড়তে পথ ভুল করে ফেলি! দম বন্ধ হয়ে আসে। পাগলের মত অলিগলিতে ছুটে বেড়াই। তবু সে আমার পিছন ছাড়ে না!
সেই মেয়েটাকেও এখন প্রায়ই দেখতে পাই! রিটা গোম্‌স্‌! পথে ঘাটে, যখন তখন, যেখানে সেখানে সে আচমকা এসে পড়ে আমার সামনে। চোখের ভুল নয়! কখনও প্রকাশ্য দিবালোকে—কখনও সন্ধের আলো-ছায়ায়, কখনও বা রাতের অন্ধকারে সে এসে দাঁড়ায়। তার দুচোখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে দেখেছি আমি! তার ওপর যে নৃশংস অত্যাচার করেছিলাম, তার শোধ নিতে চায় সে! ফিসফিস করে বলে—‘ তোমাকেও মরতে হবে…তোমাকেও মরতে হবে…তোমাকেও মরতে হবে…!
আমি শুনি। শুনতেই থাকি। মাথার ভিতরে সব কথা ছাপিয়ে শুধু বাজতে থাকে অমোঘ নির্দেশ—‘মরতে হবে…মরতে হবে…’! শুনতে শুনতে এখন বিশ্বাসও করি যে আমাকে মরতেই হবে! মরতেই হবে! বাঁচার পথ নেই। পালাবার উপায় নেই।
আবার বলছি, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়। আর হ্যাঁ, রিটা গোম্‌স্‌কে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি ছিল। আমিই রিটা গোম্‌সকে ধর্ষণ ও খুন করেছিলাম দু বছর আগে সেইদিন! আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি”।
‘আদি, তুই আমার কথা শুনছিস?’
উল্টোদিক থেকে অধৈর্য স্বর ভেসে আসে। অসহায়ের মত তার দিকে তাকায় আদিত্য। কীকরে ওকে বোঝাবে যে আজকাল সেই বিকট দানবের ছায়া সেও দেখতে পায়। সেই লোকটা তাকেও ফলো করছে! যেমন দেখতে পায় রিটা গোম্‌স্‌কে! কিন্তু বলা যায় না কাউকে। কেউ বিশ্বাস করবে না! কেউ না!
আদিত্য আপনমনেই বলল—‘আমি জানি, ওরা কেউ আত্মহত্যা করেনি…!’

২.
‘আদিত্য ব্যানার্জীকে ঠিকমতন ফলো করছিস তো?’
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে চিমসে কন্ঠস্বর—‘হ্যাঁ স্যার। একদম ফেভিকলের মত টুয়েন্টি ফোর সেভেন চিপ্‌কে আছি মালটার সঙ্গে। আজ সকালে পাখি থানায় এসেছিল না? সেখান থেকে বেরিয়ে স্ট্রেট অফিস গেছে’।
‘তুই কোথায়?’
‘ও ব্যাটার অফিসের পার্কিং লটে বসে মশা তাড়াচ্ছি স্যার’। ও প্রান্তে খুক্‌খুক্‌ হাসি—‘আর জেনানাপার্টি দেখছি। বিশ্বাস করবেন না স্যার। এক একটা কী ঝাক্কাস আইটেম! লোকটার চয়েস আছে। সব একেবারে লেটেস্ট মডেল!’
কড়া সুরে আদেশ হল—‘মেয়ে দেখতে গিয়ে যেন পাখি না ফস্কে যায়’।
‘হেঁ হেঁ হেঁ!’ বিগলিত হাসির সুরের সঙ্গে কয়েক ছিটে কথাও ভেসে আসে—‘কী যে বলেন স্যার! পাখি ফস্কালে আমার কড়কছাপ গান্ধীজীও যে ফস্কাবেন! তা কি হতে দিতে পারি? ইস্‌মাইল খব্‌রি তা হতে দেবে না। তবে একটা কথা স্যার…’।
‘কী?’
‘মালটা কাল রাতে হেবি টান্টু খেয়েছিল। শালার নেশায় পায়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বোধহয় সন্দেহ করেছে! বারবার পিছনে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছিল! আজ সকালেও লক্ষ্য করেছি, বারবার পেছনবাগে দেখছে। বোধহয় আঁচ করেছে যে ওকে কেউ ফলো করছে! কোনও কারণে ভয়ে একেবারে কেন্নোর মত সিঁটিয়েও আছে! কেসটা কী বলুন তো?’
‘কেস জেনে কাজ নেই’। ও প্রান্তে কড়া সুর—‘তুই তোর কাজটা করে যা। একদম চোখ কান খোলা রাখবি। পাখি কোথায় উড়ছে, কোথায় বসছে, কার বাটিতে কখন দানা খাচ্ছে, প্রত্যেকটা মিনিটের আপডেট চাই আমার। কোনওরকম সন্দেহজনক মুভমেন্ট দেখলেই ফোন করবি। বুঝেছিস?’
‘জি হুজুর!’
লাইনটা কেটে দিয়ে অফিসার সিন্‌হা গোলাপি ফাইলটা ফের তুলে নিলেন। এটাই রিটা গোম্‌স রেপ ও মার্ডার কেসের ফাইল। কোর্টের রায়টা তারও প্রহসন বলেই মনে হয়েছিল। রিটা গোম্‌সের দুর্ভাগা মা ও যমজ বোনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাসও ফেলেছিলেন। কিন্তু আবার যে এই কেস ফাইল খুলতে হবে, তাও এমন ভাবে, তা ভাবতে পারেননি!
রিটা গোম্‌স একেবারেই স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে নয়। চন্দননগরে এককামরার ভাড়াবাড়িতে থাকত ওরা। অল্প বয়েসে ওদের বাবা ক্যান্সারে মারা যায়। পিতৃহারা হয়ে পড়ার পর ষোলো বছরের রিটা, তার যমজ বোন মীনা এবং মা এমিলি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। রুটিটুকু তো দূর, বাড়িভাড়া দিতে না পারার ফলে মাথার ছাদও চলে যায়। এমিলির স্বাস্থ্য কখনই খুব ভালো থাকত না। তার ওপর হাঁপানির রোগ প্রায়ই কাবু করে ফেলত তাকে। ফলে রিটাই অগ্রণী হয়ে সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। সে সাহসে ভর করে কলকাতায় চলে এল। পার্কস্ট্রীটে একটা নামকরা হোটেলে বার-ডান্সারের চাকরি নিল রিটা। জানত, এই দুনিয়াটা সমাজের কাছে খুব সম্মানজনক নয়। তাই নিজের মা-বোনকে নিজের শহুরে জীবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে চন্দননগরের নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতেই রাখল। এমিলির চিকিৎসা ও মীনার পড়াশোনার দায়িত্ব নিশ্চুপে কাঁধে তুলে নিল সে।
এরপর কেটে গেল বারো বছর। রিটা নামজাদা নাচিয়ে হয়ে উঠেছে। দু হাতে রোজগার করছে। তার বোন মীনা কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া। রিটা যতটা উদ্দাম ও তেজি, সে ঠিক ততটাই শান্ত। অথচ তাকে জেরা করার সময়ই অফিসার সিনহা বুঝেছেন, ও মেয়ে সাধারণ নয়। বাইরে যত ঠান্ডা, ভিতরে ভিতরে তত জেদি। দিদির জীবনযাত্রাকে সে কীভাবে দেখত তা বোঝা মুশকিল। তবে রিটা হয়তো কাউকেই পাত্তা দিত না। কাউকে পাত্তা দেওয়ার মতন মেয়ে সে ছিল না। তার জীবনযাত্রা ছিল উদ্দাম। অনেক প্রেমিক ছিল তার। রিটার শিশুপুত্র ডেভিডও তেমন কোনও প্রেমিকেরই ঔরসজাত! এই মুহূর্তে অনাথ ছেলেটি তার মাসি মীনা’র সস্নেহ আশ্রয়ে রয়েছে।
অফিসারের মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, এই যে একের পর এক রিটা গোম্‌স্‌ রেপ ও মার্ডার কেসের দুজন সাসপেক্ট আত্মহত্যা করল, এর পেছনে ঐ মীনা গোম্‌সেরই হাত নেই তো? যদিও আপাতদৃষ্টিতে গোটা জিনিসটাই আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আর কোর্ট যতই ঐ চারজনকে ‘ক্লিনচিট’ দিক, কারোর বুঝতে বাকি ছিল না যে ওরাই সেদিন মদের নেশায় চুর হয়ে রাস্তা থেকে জোর করে গাড়িতে টেনে তুলে নিয়েছিল রিটাকে। রিটা গোম্‌সের শিশুপুত্র ডেভিড হাঁ করে দেখেছিল চারজন মাতাল, উন্মত্ত লোক তার মায়ের হাত পা ধরে জন্তুর মত টানাটানি করছে! মায়ের সেদিন কাজ ছিল না। ছেলেকে নিয়ে তাই বেড়াতে বেরিয়েছিল। সেদিন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল! তার ওপর দুর্ভাগ্যবশত মধ্যরাস্তায় ট্যাক্সি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওরা দুজন অন্য ট্যাক্সির অপেক্ষায় ছিল। রাস্তা শুনশান। শুধু খারাপ হয়ে যাওয়া ট্যাক্সির ড্রাইভারটাও ছিল অকুস্থলে। সে ও চারজন মাতাল, লম্পটের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। শিশুটিও যথাসম্ভব আঁচড়ে কামড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু অমানবীয়, আসুরিক শক্তির সামনে কোনও প্রতিরোধই কাজ করেনি। চারজন রিটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এবং নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে তাকে বারবার লাগাতার ধর্ষণ করার পর অবশেষে তার গলার নলি কেটে খুন করে!
রিটার শিশুপুত্রটি চারজনকে দেখেছিল ঠিকই, কিন্তু কোর্টে বিভ্রান্ত হয়ে যায়! তার সাক্ষ্যকে তাই প্রতিপক্ষ উড়িয়েই দেয়। আর ট্যাক্সির ড্রাইভারটা বুদ্ধিমানের মত গাড়ির নম্বরটা টুকে রেখেছিল। পুলিশের তাই অপরাধী অবধি পৌঁছতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু তবুও কোনও কাজের কাজ হল না। সপ্তকের বাবা নামকরা ব্যবসায়ী। অনেক রাঘব বোয়ালের সঙ্গে ওঠা বসা! বলাই বাহুল্য, গভীর জলের মাছ। অনেক টাকা ছড়িয়ে তিনি চারটি ছেলের মিথ্যে অথচ অকাট্য অ্যালিবাই তৈরি করেন। ফলস্বরূপ চারজন একদম ‘বেকসুর খালাস’!
এই ধরণের রায়ে খুশি হয়নি জনগণ। খুশি হয়নি মীনা ও এমিলি গোম্‌স্‌! বিশেষ করে মীনার অসন্তোষ মিডিয়ার সামনেই উগ্রমূর্তি ধারণ করে। ক্ষমতার উর্ধ্বে উঠে দিদিকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রাণপণ লড়েছিল ও। হেরে যাওয়ার হতাশায়, অন্ধ রাগে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই আঙুল তুলে বলেছিল—‘এই বিচার ন্যায়বিচার নয়! আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব। দিদিকে ন্যায় পাইয়েই ছাড়ব। উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
‘আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব। দিদিকে ন্যায় পাইয়েই ছাড়ব…’!
কথাগুলো যেন নতুনভাবে, নতুন অর্থে আবিষ্কার করলেন অফিসার সিন্‌হা! শেষ দেখে কীভাবে ছাড়তে পারে মীনা? যে দুজন আত্মহত্যা করেছে, তারা সুইসাইড নোটে পরিষ্কার লিখেছে—ওরা দুজনেই নাকি রিটা গোম্‌সকে দেখতে পেত! রিটা গোম্‌স্‌ যেন দুচোখে প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন নিয়ে ওদের মৃত্যুর প্রহর গুনছে! রাতে তো বটেই, এমনকি স্পষ্ট দিবালোকেও নাকি রিটা গোম্‌স্‌ আচমকা এসে হাজির হত ওদের সামনে…!
এই কথাগুলো আগে আত্মহত্যার আগের উন্মাদনা ও মনোবিকলনের স্বাভাবিক প্রলাপ ভেবেছিলেন তিনি। এবার তার কপালের ভাঁজ আরও চওড়া হল! সত্যিই কি তাই? না অন্যকিছু? প্রচন্ড অপরাধবোধ এবং বিবেকদংশন থেকে উদ্ভূত মানসিক ভ্রান্তিই কি তবে তৈরি করেছিল রিটা গোম্‌সের কাল্পনিক প্রতিকৃতি! না কেউ একজন ইচ্ছাকৃত ভাবেই ওদের প্রচন্ড ভয় দেখিয়ে, তিলে তিলে মানসিক যন্ত্রণায় মারার জন্য রিটা গোম্‌সের প্রতিচ্ছবি হয়ে এসে দাঁড়াত ওদের সামনে! আর এটা একমাত্র সেই মানুষটিই পারে, যে রিটার শুধু সহোদরাই নয়, একেবারে হুবহু তার প্রতিবিম্বও বটে—তারই যমজ বোন!
আচমকা মোবাইলের তীব্র শব্দে চিন্তাসূত্রটা ছিঁড়ে গেল। অফিসার আড়চোখে দেখলেন, ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ জয়রঞ্জন মিত্র ফোন করছেন।
‘ইয়েস ডক্টর’।
ডক্টর মিত্রের স্বভাবতই উত্তেজনাবিহীন ঠান্ডা কন্ঠস্বর ভেসে আসে—‘ডিটেইলড্‌ পোস্টমর্টেম হয়ে গিয়েছে অফিসার। আপনি একবার এলে ভালো হয়। আপনাকে রিপোর্ট করে তবে ফ্যামিলিকে বডি দিয়ে দিতে পারি’।
তীব্র কৌতুহল নিয়ে জানতে চান অফিসার—‘এনিথিং আনইউজুয়াল ডক্টর?’
‘নাঃ। প্লেইন সুইসাইড’। ডক্টর মিত্র জানালেন—‘হলফ করে বলতে পারি, ছেলেটি নিজের হাতের শিরা নিজেই কেটেছে। অন্য কেউ কাটলে উন্ড এরকম হত না। ছেলেটি ডান হাতি। ক্ষতও বাঁদিক থেকে ডানদিকে এসেছে। আর কোনও আঘাতের চিহ্ন বা জোর জবরদস্তির চিহ্ন নেই। সিম্প্‌ল্‌ কেস অব সুইসাইড। খুন হলে উন্ডের ডেপথ্‌ ডানদিক থেকে বাঁদিকের ডাইরেকশনে যেত। এক্ষেত্রে তা হয়নি’।
‘ডক্টর’। অফিসার একটু থেমে বলেন—‘আমি যদি কাউকে গান পয়েন্টে রেখে হাত কাটতে বলি, বা হাইরাইজ থেকে লাফিয়ে পড়তে বাধ্য করি, সেক্ষেত্রেও তো ফরেনসিক রিপোর্ট তাই বলবে যা আপনি বলছেন। অথবা যদি সম্মোহনবিদ্যার মাধ্যমে কাউকে নিজের প্রাণ নিতে বলা হয়—সেক্ষেত্রেও এই একই রিপোর্ট আসবে। কিন্তু সেটাকেও কি সিম্প্‌ল্‌ কেস অব সুইসাইড বলা চলে?’
‘একটু বেশিই ভাবছেন না অফিসার?’ ডঃ মিত্র হেসে ওঠেন—‘খুনের গন্ধ শুঁকে শুঁকে আপনার নাকটাই গেছে!’
‘না। ঠিক তা নয়’। তিনিও মৃদু হাসেন—‘ইউ নো ডক্টর, বেশ কিছু দিন আগে এই লোকগুলোই কোর্টে দাঁড়িয়ে নিজেদের অপরাধ অস্বীকার করেছিল। তারপর একগাদা মিথ্যে সাক্ষ্য ও সাক্ষী জোগাড় করে, মিথ্যে অ্যালিবাই তৈরি করে, নিজেদের ইনোসেন্ট প্রমাণ করে নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গিয়েছিল। সেরাতে পার্টি দিয়েছিল। শ্যাম্পেনের ফোয়ারা উড়িয়ে মহানন্দে ঘুমোতে চলে গিয়েছিল ওরা!’
‘হ্যাঁ!’ ডক্টর অবাক—‘তো? তাতে কী?’
‘সেরাতে আমার ঘুম হয়নি!’ অফিসারের কন্ঠস্বর গম্ভীর—‘সারারাত আমি জেগেছিলাম। বারবার ভাবছিলাম, এটা কীকরে সম্ভব হল! কী করে ভারতীয় আইন এত বড় ভুল করল! কী করে সংবিধান ব্যবস্থা হেরে গেল কয়েকটা জানোয়ারের কাছে! সারারাত জেগে শুধু উত্তর খুঁজে চলেছিলাম!’
উল্টোদিকে ডক্টর মিত্র নীরব। শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে!
‘আর গত কয়েকদিনও আমি রাতে ঘুমোতে পারিনি’। তিনি আস্তে আস্তে বললেন—‘শুধু ভেবে চলেছি, দু বছর আগের লম্পট, মিথ্যেবাদী, রেপিস্ট, মার্ডারারগুলো হঠাৎ করে রাজা হরিশ্চন্দ্রের বংশধর হয়ে গেল কী করে! কোন্‌ সুপ্রিম পাওয়ার ওদের এত বড় পরিবর্তন ঘটাল!’ বলতে বলতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে—‘যতক্ষণ না সেই সুপ্রিম পাওয়ারের খোঁজ পাচ্ছি, আমারও শান্তি নেই ডক্টর! আমি বিশ্বাস করি না, এদুটোর একটাও ‘সিম্প্‌ল কেস অব সুইসাইড’! না, অত সিম্প্‌ল নয় ডক্টর! অত সহজ নয়! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওরা কেউ আত্মহত্যা করেনি!’

৩.

‘তুই যে বলেছিলি প্রতিশোধ নিবি!’ এমিলি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের দিকে—‘নিয়েছিস? প্রভু জেসাসের নামে, মা মেরির নামে শপথ নিয়েছিলি তুই! প্রতিশোধ নিবি বলেছিলি না—অ্যাঁ? নিয়েছিস?’
‘নেব মা?’ মীনা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে—‘খুব তাড়াতাড়িই নেব’।
‘নিবি মানে?’ শান্ত হওয়ার বদলে তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন—‘এখনও নিস্‌নি? তার মানে ঐ বাস্টার্ডগুলো এখনও ফ্রি! এখনও ওরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে! দোজ্‌ ব্লাডি বাস্টার্ডস্‌…!’ বলতে বলতেই সজোরে কেঁদে উঠলেন—‘রিটাকে ওরা কুকুরের মত ছিঁড়ে খেয়েছিল! আমার ডেভিডের চোখের সামনে…আমার ডেভিডের মাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ওরা…!’
মীনা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। মা আজকাল কথায় কথায় উত্তেজিত হয়ে পড়েন। রিটার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকেই ক্রমাগত অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এমিলির আচরণ। আগে তবু রাতে ওষুধ খেয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু কোর্টের রায় বেরোনোর পর থেকে আর এক রাত্রিও ঘুমোননি তিনি। মীনা অনেকবার তাকে আপনমনে কথা বলতে শুনেছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই নিস্পৃহভাবে জানিয়েছেন—‘রিটার সঙ্গে কথা বলছিলাম। মেয়েটা ভালো নেই। একদম ভালো নেই…!’
ভয়ে, অব্যক্ত আশঙ্কায় রক্ত হিম হয়ে আসে মীনার। সে ভালো করে মায়ের মুখের হিজিবিজিকাটা বলিরেখাগুলোর দিকে তাকায়। বৃদ্ধ, নিষ্প্রভ হয়ে আসা ঘোলাটে চোখে, ঈষৎ বঙ্কিম ঠোঁটের ভাঁজে অস্বাভাবিকতা প্রকট। চোখের তারা দুটো অস্থির হয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে! চিরপরিচিত শান্ত মাকেই আর চিনতে পারেনি সে। চিরদিন অভাব, রোগ, দারিদ্র, হতাশার সঙ্গে যুদ্ধ করে আসা এমিলি কোনওদিনই মুখের শান্ত, পবিত্র হাসিটুকু হারিয়ে যেতে দেননি। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শান্ত থেকেছেন জেসাস অন্তপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষটি।
কিন্তু আজ সেই মানুষের কী পরিবর্তন! চিরকালের ক্ষমাশীল এমিলি আজ প্রতিশোধের কথা বলছেন! যে মা ছোটবেলায় তাদের দুই বোনকে প্রভু জেসাসের বাণী শুনিয়ে ক্ষমা করতে শেখাতেন, সেই মানুষই আজ প্রতিশোধ চাইছেন!
‘কী হল!’ এমিলির শীর্ণ কন্ঠের শিরা ফুলে ওঠে—‘আই ওয়ান্ট রিভেঞ্জ! তুই বলেছিলি প্রতিশোধ নিবি। আমি জানি, রিটার আত্মা রিভেঞ্জের জন্য অপেক্ষা করছে। ও আমাকে রোজ জিজ্ঞাসা করে। শি ওয়ান্টস রিভেঞ্জ…আই ওয়ান্ট…!’
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই প্রচন্ড কাশি ও হাঁফানি এসে বাকি শব্দগুলো গিলে নিল। মীনা তাড়াতাড়ি ভেতরের ঘরে ছুটে যায়। সেখানে এইমুহূর্তে রিটার শিশুপুত্র ডেভিড বিছানার ওপরে বসে ড্রয়িং করছে। মীনাকে আসতে দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল—‘হোয়াট হ্যাপেন্ড আন্টি?’
‘নাথিং ডিয়ার’।
কোনমতে উত্তরটা ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত হাতে মায়ের নেবুলাইজারটা খুঁজছে সে। নীল রঙের ইনহেলারটা বিছানার মাথার কাছের ড্রয়ারটাতেই রাখা ছিল। সেটা নিয়ে ফিরে আসতেই যাচ্ছিল মীনা। আচমকা কী যেন দেখে থমকে দাঁড়াল! ডেভিড ওসব কী আঁকছে!
সে সভয়ে জানতে চায়—‘কী আঁকছ ডেভিড?’
ডেভিড আঁকতে আঁকতেই উত্তর দেয়—‘ ডেমন্‌স্‌’।
‘ডেমন্‌স!’ মীনা বিস্মিত—‘হোয়াই?’
শিশুটির সরলরেখার মত সোজা উত্তর—‘বিকজ দে আর কার্সড!’
আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এল সে। এমিলি তখনও হাঁফাচ্ছেন। মীনা তার মুখে নেবুলাইজারটা গুঁজে দিতেই আলতো করে তার হাতের ওপর হাত রাখলেন। একটা উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে থম্‌কে গেল মীনা। এক ফোঁটা উষ্ণ জল তার হাতের ওপর পড়েছে! এমিলি কাঁদছেন!
নিজেকে এইরকম অবস্থায় বড় অসহায় লাগে তার। যেমন একটু আগেই অসহায় লাগছিল ডেভিডের সামনে! অসহায় লেগেছিল, যেদিন কোর্ট চারটে জানোয়ারকে ‘ইনোসেন্ট’ বলে ছেড়ে দিল! অসহায় লেগেছিল, যেদিন ডেভিড প্রশ্ন করেছিল—‘আন্টি, অ্যাম আই কার্সড?’
মীনা এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। স্তম্ভিত হয়ে বলে—‘নো ডিয়ার! কে বলেছে তোমাকে?’
‘আমার বন্ধুরা বলে!’ ডেভিড জানায়—‘আমার বাবা নেই। মাকেও নাকি আমি খেয়েছি! আমি নাকি সবাইকে খাবো। আই অ্যাম কার্সড। আই অ্যাম ডেমন!’
‘নো ডিয়ার!’ মীনা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল—‘ইউ আর অ্যান এঞ্জেল! তুমি ডেমন নও’।
‘তবে কেন কেউ আমার সাথে খেলা করে না?’ অভিমানে চোখ ভিজে যায় অবুঝ শিশুর—‘আমি একা কেন আন্টি?’
এই প্রশ্নের সামনে ভীষণ অসহায় মীনা! মিডিয়ার দৌলতে রিটা গোম্‌সের পেশার কথা জানতে কারোর বাকি নেই। প্রতিপক্ষের উকিল তো প্রায় সেটাকেই ট্রায়াম্ফ কার্ড বানিয়ে ফেলেছিলেন। যেহেতু রিটা বার-ডান্সার, তার একটি অবৈধ সন্তান রয়েছে, অতএব তার চরিত্রের মাথামুন্ডু কিছুই নেই! অতএব রিটা বহুভোগ্যা! বহুভোগ্যা নারীর আবার রেপ এবং মার্ডার কী! সে তো বারোয়ারি সম্পত্তি! একটা বার-ডান্সার কাম্‌ বেশ্যা মরেছে—বেশ হয়েছে। দুনিয়া থেকে একটা আপদ কমেছে।
একেই রিটা বার-ডান্সার– রেপ্‌ড ও মার্ডারড্‌! তার ওপর ডেভিডের পিতৃপরিচয় নেই। সমস্ত অপরাধ যেন ডেভিডের মৃতা মা-ই করেছে! কিন্তু তাকে শাস্তি দেওয়ার উপায় নেই। তাই সমস্ত শাস্তিটাই যেন উত্তরাধিকারসূত্রে ডেভিডের প্রাপ্য!
আজ সেই শাস্তির ফলেই ডেভিড ডেমনের ছবি আঁকে! আজ কোর্টের বিচারের ধাক্কায় মা বেসামাল। ঐ চারজনের শাস্তি হলে হয়তো মায়ের জ্বালাটা একটু জুড়োত!
‘তুই প্রতিশোধ নিবি…নিবি না?’
এমিলি শ্বাস টানতে টানতে বললেন—‘আই ওয়ান্ট রিভেঞ্জ!’
মায়ের হাতের ওপর হাত রাখে মীনা। পরম স্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বলে—‘ইয়েস মা। আই উইল…’।
সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ এল—‘ একটু ভুল হল! ওটা বোধহয় আর ফিউচার টেন্সের পর্যায়ে নেই। তাই না?’
মীনা বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েই দরজার দিকে তাকায়। অফিসার সিন্‌হা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন। মীনাকে তাকাতে দেখে বললেন—‘ভেতরে আসতে পারি?’
সে অফিসারের দিকে অনিমেষে তাকিয়ে থাকে। অফিসার সিনহাকে চেনে মীনা। ইনিই রিটার মার্ডারকেসের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। তার ভুরুতে একটু বিরক্তি ভাঁজ ফেলে যায়। তখন তো কিছুই করতে পারেনি লোকটা! নাকের সামনে দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে অপরাধীরা খালাস হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার কী করতে এসেছে?
‘আসুন’। বিরক্তিটাকে চেপে রেখেই ভদ্রতা বজায় রাখে সে।
জুতোর আওয়াজটাকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটু বেশি প্রকট করে ঘরে ঢুকলেন অফিসার। কোনরকম গৌরচন্দ্রিকা না করেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—‘রিভেঞ্জের ব্যাপারে যেন কী বলছিলেন আপনি?’
মীনা বিরক্তি সহকারে উত্তর দেয়—‘কেন এসেছেন সেটা বলবেন কি? নিশ্চয়ই দরজার বাইরে আড়ি পাতার জন্য নয়!’
‘সরি’। তিনি মৃদু হাসলেন—‘ওটা শোনার উদ্দেশ্য ছিল না। বাই চান্স শুনে ফেলেছি। যদিও কথাগুলো যথেষ্ট অর্থপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে আমার!’
‘মানে?’
অফিসার সিন্‌হা অনুমতি না নিয়েই মীনার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। বিস্মিত মীনার বিহ্বল দৃষ্টির সামনে আরাম করে সিগারেট ধরিয়েছেন। একটা লম্বা টান দিয়ে একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়লেন। সে ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। লোকটার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী? ফালতু ভণিতা না করে আসল কথায় এলেই তো পারে!
অফিসার যেন তার মনের কথাটাই বুঝে ফেলেছেন। ধীরে ধীরে বললেন—‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনার দিদির মার্ডার কেসের দুজন সাসপেক্ট অলরেডি আত্মহত্যা করেছেন। এবং সুইসাইড নোটে নিজেদের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছেন’।
মীনা অফিসারের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ঘাড় গুঁজে মাটির দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল—‘জানি। গত একমাস ধরেই খবরের কাগজে পড়ে চলেছি’।
‘ওহ, অফকোর্স!’ তিনি অম্লরসাক্ত হাসি হাসছেন—‘মিডিয়ার কাছে খবরটা এখন হটকেক! কী যেন হেডলাইন দিয়েছে? ‘দু বছর আগে একদিন’—তাই না?’
‘আপনি কি খবরের কাগজের খবর শোনাতে এসেছেন অফিসার?’ সে অধৈর্য—‘দেখুন, আমার এখনও অনেক কাজ আছে। বেশ রাত হয়েছে, অথচ এখনও ডিনারের বন্দোবস্ত হয়নি’।
‘নো…নো! নট্‌ অ্যাট অল্‌!’ অফিসার নড়েচড়ে বসেন—‘আপনি যখন সমস্ত খবরই জানেন তখন আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমার শুধু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই। সেগুলো পেলেই আমি এখান থেকে চলে যাবো’।
‘বলুন’। ক্লান্ত ভাবে উত্তর দেয় সে। যদিও এখন তার জিজ্ঞাসাবাদ ভালো লাগছে না। তবু খানিকটা বাধ্য হয়েই সম্মতি জানায়।
‘আপনি তো সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন!’ অফিসার হেসে ফেললেন—‘ভাবা যায় না! কী কম্বিনেশন! যমজ বোনের একজন বার-ডান্সার। অন্যজন সাইকোলজিস্ট!’
মীনার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে—‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন অফিসার, ঐ বার-ডান্সার বোনের পরিশ্রমের টাকাতেই আমার পড়াশোনা হয়েছে! রিটা বারে না নাচলে আমার পড়াশোনা হত না। এই সংসারটা থাকত না। বেঁচে থাকতে তাকে কেউ সম্মান দেয়নি, মৃত্যুর পর তাকে সম্মান তো দূর—ন্যায়টুকুও দিতে পারেননি আপনি! আর এখন তার পরিবারের সামনেই তার পেশার উল্লেখ করে হাসছেন! লজ্জা করে না? না ক্ষমতাশালী লোকদের জুতো চাটতে চাটতে সেটুকুও গিয়েছে!’
কর্ণমূল লাল হয়ে ওঠে অফিসারের। সামলে নিয়ে বললেন—‘সরি’।
মেয়েটার চোখ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে—‘ইউ মাস্ট বি’।
‘নাউ কাট দ্য ক্র্যাপ!’ তিনি বলেন—‘দুটো সুইসাইড নোটে একটা জিনিস কমন। দুজনেই মৃত্যুর আগে রিটা গোম্‌স্‌কে দেখতে পেয়েছিল। কীভাবে এটা সম্ভব আমায় বুঝিয়ে বলবেন?’
মীনা ভেতরের ইঙ্গিতটা না বোঝার মত বুদ্ধিহীন নয়। সে মৃদু হাসে—‘এই প্রশ্নটা আমায় না করে আমার মাকে করুন। উনিও রিটাকে দেখতে পান। আমি অবশ্য কখনও দেখিনি। আত্মা বা প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী নই বলেই হয়তো রিটা আমায় কখনও দেখা দেয়নি’।
‘অথবা রিটা কাউকেই দেখা দেয়নি’। সিগারেটটায় আবার লম্বা টান মেরে বললেন অফিসার—‘যিনি দেখা দিয়েছেন তিনি আত্মা নন্‌, মানুষ। অবিকল রিটার মতই দেখতে। হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ তিনি রিটার উম্বমেট! আইডেন্টিকাল টুইন!’
মীনা ভুরু কুঁচকে তাকায়—‘কী বলতে চান? আমি রিটা সেজে সবাইকে ভূতের ভয় দেখাচ্ছি! আর ওরা ভূতের ভয়ে কেউ হাইরাইজ থেকে লাফিয়ে পড়ছে, কেউ হাতের শিরা কাটছে! আর ইউ ইনসেন্‌ অফিসার? লোকদুটো কি বাচ্চা ছেলে যে ভূতের ভয় পাবে!
‘ঠিক!’ অফিসার বললেন—‘কিন্তু তারপরের পার্টও যে একটা আছে ম্যাডাম। একটা চিঠিতে লেখা আছে—‘মাথার ভিতরে সব কথা ছাপিয়ে শুধু বাজতে থাকে অমোঘ নির্দেশ—‘মরতে হবে…মরতে হবে…’! শুনতে শুনতে এখন বিশ্বাসও করি যে আমাকে মরতেই হবে! মরতেই হবে! বাঁচার পথ নেই। পালাবার উপায় নেই’। এই কথাগুলো একটু ফ্যামিলিয়ার মনে হয়?’
মীনা ক্লান্ত ভাবে বলে—‘যা বলার সোজাসুজি বলুন অফিসার। আমার আর এই আড়াই প্যাঁচের কথা ভালো লাগছে না!’
‘হি-প-নো-সি-স!’ অফিসার তার তীব্র দৃষ্টি মীনার চোখের ওপর ন্যস্ত করেছেন—‘ম্যাডাম, আপনার সম্পর্কে যতদূর জেনেছি, আপনি হিপনোসিস জানেন। একটা লোককে ভূতের ভয় দেখিয়ে আত্মহত্যা করানো যায় না ঠিকই, কিন্তু হিপনোসিসের মাধ্যমে করানো যায়। ম্যাজিশিয়ানরা যদি হিপনোটাইজ করে সর্বসমক্ষে একটা লোককে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারেন, তবে আপনার কাছে হিপনোটাইজ করে কাউকে হাইরাইজ থেকে লাফিয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া বা হাত কেটে ফেলার আদেশ দেওয়া তো ছেলেখেলা! চিঠি থেকে এটা স্পষ্ট যে ছেলেটির মাথায় মৃত্যুর কথা কেউ গেঁথে দিয়েছিল—যেটা প্রায় অমোঘ বাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর কাছে। আর এরকম মগজধোলাই একমাত্র হিপনোসিসেই সম্ভব!’
মীনা এই অভিনব থিওরি শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে বলে—‘আপনার কাছে কি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?’
‘এই মুহূর্তে নেই’।
সে বিরক্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল—‘তাহলে আপনি এখন আসুন। আপনার এই বোকা বোকা অদ্ভুতুড়ে থিওরি শোনার সময় আমার নেই। যখন আমায় ফাটকে ঢোকাবেন, তখন অনেক সময় থাকবে। তখন আপনার এই হিপনোসিস থিওরি শুনবো। আর পারলে দয়া করে ঐ বস্তা পচা থ্রিলারগুলো দেখা বন্ধ করুন। জাস্ট আ সাজেশন!’
উত্তরে অফিসার সিন্‌হা কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলেন। তার আগেই সশব্দে বেজে উঠল মোবাইল। স্ক্রিনে ভাসছে ইসমাইল খবরীর নাম! ও গত একমাস ধরে আদিত্য ব্যানার্জীর ওপরে নজর রাখছিল। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সন্দেহজনক কিছু দেখেনি। তেমন কোনও খবরও দিতে পারেনি। কিন্তু আজকে হঠাৎ এমন অসময়ে ফোন করছে কেন?
তিনি তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করেন—‘হ্যালো’।
‘হ্যাঁ হুজুর’। ও প্রান্তে ইসমাইলের উত্তেজিত কন্ঠস্বর—‘তাড়াতাড়ি চলে আসুন। বিরাট লোচা হয়ে গিয়েছে!’
‘কী হয়েছে?’ রুদ্ধশ্বাসে জানতে চান তিনি—‘ এনিথিং রঙ? পাখির খবর কী?’
‘পাখি গত তিনদিন ধরে বাড়িতেই ছিল’। ইসমাইল জানায়—‘কোত্থাও বেরোয়নি! আচমকা আজ রাতে, জাস্ট একটু আগে মালের দোকানে ঢুকল! শালা পুরো ভয়েই সিঁটিয়ে ছিল। কীসের যে এত ভয় বুঝি না! খালি দু পা এগোয়, আর পিছন বাগে দেখে! তারপরই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল স্যার!’
‘কী?’
‘লোকটার বাড়ি থেকে লিকার শপ বড়জোর পাঁচমিনিটের রাস্তা! কিন্তু মালটা যেন নিজের বাড়ির রাস্তাই ভুলে গেল! রাস্তায় নেমেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—‘রিটা গোম্‌স্‌! রিটা গোম্‌স্‌!’ তারপর মারল খিঁচে উলটো দিকে দৌড়! তখন হেভি ট্র্যাফিকের রাশ! লোকটা পুরো চোখ কান বুঁজে দৌড়চ্ছিল। ঐ রাশের মধ্যেই রাস্তা পার করতে গেল! আর একটা কালো বোলেরো এসে…!
অফিসার সিন্‌হা স্তম্ভিত! তার বাক্যস্ফূর্তি হয় না! কোনমতে জিজ্ঞাসা করেন—‘একদম গিয়েছে?’
‘না স্যার! এখনও জান আছে।’ ইসমাইল জানায়—‘তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন’।
অফিসার ফোনটা কেটে দিয়ে বজ্রাহতের মতন দাঁড়িয়ে থাকেন! তার অবস্থা দেখে যেন মজা পায় মীনা। মৃদু অথচ বঙ্কিম হেসে বলল—‘বোধহয় আরও একজন গেল। তাই না?’

৪.
আজকাল বৃষ্টির দিনে হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে আদিত্য’র ভীষণ ভয় করে!
এখনও তার বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি। তাই এইটুকু অন্তত বোঝে যে তার পাঁচবছরের শিশুকন্যা সোমঋতার মত একটা বাচ্চা মেয়ে অন্ধকারে ভয় পেতে পারে, কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের ভয় পাওয়া মোটেই উচিৎ নয়। বিশেষ করে অমন ম্যানিয়ার মত চেপে বসা ভয়। ভয়ের অনেকরকম মূর্তি আছে। অথচ আজ পর্যন্ত অমন দমবন্ধ করা শিরশিরে অসহ্য ভয়ের প্রতিচ্ছবি আর কখনও অনুভব করেনি সে। সবসময়ই মনে হয়, একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ কোনও অদৃশ্য কোণ থেকে তার ওপর নজর রাখছে! অন্ধকার ঘরের কোনও অন্তরালে চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনও শ্বাপদ! এক্ষুনিই হয়তো লাফিয়ে পড়বে!
বৃষ্টি হলে এখন মনে হয় যেন ভয়াবহ কোন আশঙ্কা ঝড়ের সাথে ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। সকালে বা বিকেলে আকাশে কিউমুলো নিম্বাসের পাল দানা বাঁধলেই তার মনে দুটো অনুভূতিই দাগ কাটে। অকৃত্রিম উদ্বেগ আর অসম্ভব ভয়! দু বছর আগের সেই দিনটা কি আবার ফিরে আসছে? প্রতিশোধ নেবে? সেদিনও তো এমন বৃষ্টি হয়েছিল! অবিকল এমনই দাপুটে বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাস্তার ওপরে! সপ্তকের জন্মদিন ছিল সেদিন। ঐ তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ওরা একটা নামি দামী বার-কাম-রেস্টোর্যাদন্টে আকন্ঠ পান-ভোজন করেছিল! রাতের বিছানা গরম করার জন্য দালালের সঙ্গে কথা বলে কলগার্লের বন্দোবস্তও করে রেখেছিল সপ্তক। এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল! ওরা সপ্তকের ফার্মহাউসের দিকে চলেও যাচ্ছিল! আচমকা মাঝপথে বৃষ্টিভেজা, উদ্ধত যৌবনা রিটা গোম্‌স্‌কে চোখে পড়ে গেল!
ঐ মুহূর্তের কথাটা ভাবলেই পাগলের মত দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে তার! সপ্তকের কথা শোনাটাই কাল হল! আজ রিটা গোম্‌স্‌ চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উদ্যত! সে কাউকে ক্ষমা করেনি। ক্ষমা করবেও না! ঐ ভয়ঙ্কর দৈত্যটাকে সে-ই লেলিয়ে দিয়েছে তাদের পেছনে! এখন আর কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না! ঐ দৈত্যটা সপ্তককে মেরেছে, সমুকে মেরেছে। এবার আদিত্য’র পালা!
তার মনে পড়ে গেল সেই কাগজটার কথা। সমু মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই জরুরি চিঠিপত্রের সঙ্গে অফিসে এসেছিল প্রথম মোটা খামটা। প্রেরকের নাম ছিল না! কিন্তু ভেতরের কাগজটার কথা ভোলা সম্ভব নয়! সেই বিখ্যাত ছবি! একটা মানুষ ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন এক ভয়ঙ্কর দৈত্য! লোকটা জানে যে বিকট দানবটা তার পেছনে রয়েছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার ছায়া। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকানোর সাহসটুকুও নেই!
সেই ভয়ঙ্কর ছবিটার নীচে বড় বড় করে লেখা—‘ নাউ, ইট্‌স্‌ কামিং ফর্‌ ইউ’।
কাগজটা দেখে তার রক্ত জল হয়ে গিয়েছিল! না, একথা সবাইকে বলতে পারেনি আদিত্য। এ কথা কাউকে বলার নয়। শুধু অনুভব করেছে। সপ্তক আর সমুর মতন সেও প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারছে, কেউ তাকে ফলো করছে। হয় রিটা গোম্‌স্‌–নয় সেই দৈত্যটা!
সে চুপিচুপি কাবার্ড থেকে সেই কাগজটা বের করে। আদিত্য অনেক কষ্টে কাগজটাকে লুকিয়ে রেখেছে কাবার্ডের ভেতরে। এই কাগজটাকে কারোর চোখে পড়তে দেওয়া যাবে না। রাখতে হবে লোকচক্ষুর একদম অন্তরালে! তার হাত ক্রমাগত কাঁপছে। তা সত্ত্বেও বারবার পড়ার চেষ্টা করে সেই একই লেখাগুলো। যেন বারবার পড়লে পালটে যাবে সমস্ত বর্ণ, অক্ষর ও শব্দগুলো! কবে থেকে পড়ে যাচ্ছে! তবু যেন ক্ষান্তি নেই, ক্লান্তি নেই!
‘চা দেব?’
স্ত্রী সোনালির কন্ঠে বিরক্ত হল আদিত্য। দ্রুত হাতে কাগজটা লুকিয়ে ফেলেছে! রাগতস্বরে বলল—‘এই নিয়ে তো তিনবার বললাম যে খাবো না! ইচ্ছে নেই! তারপরও বারবার জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
‘মানে?’ সোনালি অবাক—‘তিনবার কখন বললে? আমি তো জাস্ট এই প্রথমবারই জিজ্ঞাসা করলাম!’
‘আশ্চর্য!’ আদিত্য ঝাঁঝিয়ে ওঠে—‘এই তো মিনিট পাঁচেক আগেই পরপর তিনবার জানতে চাইলে! উত্তরও দিলাম। কী ভেবেছ তোমরা? আমি পাগল? যা খুশি বললেই হল? আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম…!’
সোনালি কোনও উত্তর না দিয়ে বিরক্তিসূচক ভঙ্গি করে চলে গেল। দিনকে দিন এই লোকটার স্বভাব তিরিক্ষি হয়ে উঠছে! কী হয়েছে কে জানে! কথায় কথায় মেজাজ, কথায় কথায় অশান্তি! নিজের বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করে। দোষের মধ্যে বাচ্চা মেয়েটা দুষ্টুমি করে টেবিলের ওপর থেকে কী যেন কাগজপত্র তুলে নিয়েছিল। তাতে কী সব ছবি-টবি আঁকা ছিল বলেই বাচ্চাটা পরম কৌতুহলে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু দেখামাত্রই ওর বাবা কথা নেই বার্তা নেই সপাটে এক চড় বসিয়ে দিল কচি মেয়েটার গালে! ছোট্ট ফুলের মত নরম মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে ঘুরে পড়ল টেবিলটারই ওপরে। ঠকাস্‌ করে মাথাটা গেল ঠুকে!
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সোনালি! কোনমতে মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল—‘তুমি কি মানুষ!’
‘না। আমি রাক্ষস!’ রাগে সর্বমুখ বিকৃত করে বলে আদিত্য—‘কেউ আসবে না আমার ঘরে। কেউ ছোঁবে না আমার জিনিস!’
সেদিন থেকেই রাগে, ক্ষোভে সম্পর্কের শেষ সূত্রটুকুও কেটে দিয়েছে সোনালি। রিটা গোম্‌সের কেসের পর থেকেই বিছানা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এখন শুধু এক ছাদের তলায় দুটো অপরিচিত লোক কোনমতে টিঁকে থাকে। বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে নেহাত এখনও আলাদা হতে পারেনি। নয়তো সম্পর্ককে লাথি মেরে কবেই চলে যেত সে।
সোনালির রাগত চলে যাওয়া চুপ করে দেখে আদিত্য। আজকাল আর কারোর রাগ, কারোর ক্ষোভ তার মনে দাগ কাটতে পারে না। মনটাই কেমন অসাড় হয়ে আসছে। শুধু মনে পড়ছে সেই বৃষ্টির রাত! অবিকল এমনই বৃষ্টি ছিল! এমনই জলের তোড়ে ঝাপ্সা হয়ে যাওয়া ধোঁয়া ধোঁয়া প্রেক্ষাপট! এমনই নীলচে উদাসীন, অথচ রহস্যময় রাত। যেন নীলাভ বাষ্পীয় ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে গিয়েছে আকাশ লক্ষ্য করে। গাড়িতে ওরা চারজন…জল কেটে ছুটে চলা গাড়ির আওয়াজ…টুপ টুপ…টুপুর টুপুর! মদের নেশায় উন্মত্ত বন্যতা…! …ছুটে চলা উদ্দাম ঘোড়ার মত ওরা কজন! কোনও বাধা নেই, বন্ধ নেই! কানে যেন ভেসে এল সপ্তকের স্খলিত কন্ঠস্বর—‘দিস্‌ ইজ্‌ লাইফ গুরু! সো এনজয় ইট! একটাই তো জীবন! চুটিয়ে মজা করো! মস্তি মারো! ফূর্তি করো! লে-ট্‌-স্‌ এ-ন্‌-জ-য়!’
মনে পড়ে যায় সেই সমস্বরে চিৎকার—‘চি-য়া-র্স! চি-য়া-র্স ফ-র লা-ই-ফ!’
চিৎকারটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠল আদিত্য! লাইফ! কোথায় লাইফ! এখন তো রোজ সকালে জীবন তাকে হিংস্র দাঁত নখ বের করে তাড়া করে! নিদ্রাহীন চোখ দুটো ভোরের আলোর দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে—কী হবে! বিনিদ্র রাতগুলো চরম উত্তেজনায় টিক টিক করতে করতে প্রহর গুণে প্রশ্ন রেখে যায়—কী হবে?…কী হবে? আদিত্য কি পাগল হয়ে যাবে? উন্মাদ হয়ে যাবে?
ভাবতে ভাবতেই নিজের পেছন দিকেই তাকিয়ে আঁৎকে উঠল সে! ও কি! ঠিক তার পেছনেই কে বসে আছে! লোডশেডিং হয়ে যাওয়ার দরুণ একটু আগেই এখানে মোমবাতি রেখে গিয়েছে সোনালি। সেই মোমবাতির আলোতেই কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা বিরাট ছায়া! ছায়াটা তার নিজেরই হওয়া উচিত। কিন্তু অত বড় ছায়া কি মানুষের হয়? হতে পারে? অসম্ভব! ও ছায়া তার নয়! আদিত্য দর্‌দর্‌ করে ঘামতে থাকে। আসলে ও ছায়া তার ছায়ারই ছদ্মবেশে সেই দৈত্যের! সেই দৈত্য, যে কিছুতেই পেছন ছাড়ে না…!
সে উন্মত্তের মত উঠে দাঁড়ায়। এখনই পালিয়ে যেতে হবে। চলে যেতে হবে এখান থেকে। নয়তো ঐ দৈত্যটা তাকে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গিলে খাবে! যেমন খেয়েছে সপ্তককে! যেমন সমুকে…!
চতুর্দিকে অন্ধকার। লোডশেডিং হওয়ার দরুণ লিফ্‌টও চলছে না! তবু আদিত্য থামল না! পাগলের মত ক্ষিপ্রগতিতে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। পেছনে কি ও এখনও তাড়া করছে? কে জানে! সে একবারও তাকায় না! পিছনে তাকালেই যদি কাউকে দেখতে পায়! যদি কেউ থাকে! তার হৃৎস্পন্দন এখন তুঙ্গে! হয়তো এখনই কোনও শিরা ফেটে যাবে…অথবা…!
‘আরে মিঃ ব্যানার্জী! কোথায় যাচ্ছেন? তাও এই বৃষ্টিতে!’
সিকিউরিটির প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই আদিত্য ছুটে চলল রাস্তার দিকে। আঃ, ঐ তো! রাস্তায় আলো জ্বলছে! কত আলো! জেনারেটরের দৌলতে বাজারগুলো একেবারে আলোয় ঝলমল করছে! আলোয় কত শান্তি! কী যে শান্তি।
আদিত্য ঠিক করতে পারছিল না কোথায় যাবে। একটু এলোমেলো ভাবে ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে চলেছিল। রাস্তায় এখন দমবন্ধ করা ভিড়। সে বেশ কয়েকবার পিছন ফিরে দেখল! কেউ আসছে কি? বলা যায় না,…যদি কেউ পিছু নিয়ে থাকে…! নাঃ, কেউ নেই। সবাই এখন কেনাকাটায় ব্যস্ত। কারোর তার দিকে ফিরে দেখার সময়ও নেই। অনেকদিন পর একটু স্বস্তি বোধ করল ও। জোরে শ্বাস টানল। গলার কাছটা একটু শুকনো শুকনো লাগছে! একটু মদ খাবে? একটু নেশা কি শান্তি দিতে পারে টান টান স্নায়ুকে? একটু ঘুম দিতে পারে?
বেশিদূর যেতে হল না। সামনেই লিকার শপ। এখনই পানাসক্তদের ভিড় লেগে গিয়েছে দোকানে। কোনমতে ভিড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেল সে। কাউন্টারে এক মহিলা মুখ নীচু করে ক্রেতাদের সামলাচ্ছেন। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলল—‘রয়্যাল স্ট্যাগ প্লিজ’।
‘ইয়েস?’
বলাই বাহুল্য ক্রেতাদের চেঁচামেচিতে ঠিকমতন শুনতে পাননি মহিলা। মুখ তুলে আদিত্যের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন—‘ইয়েস? বলুন?’
আদিত্য’র সারাদেহে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুত খেলে গেল! এ কি! এ কে! কোঁকড়া কোঁকড়া চুল! নীলাভ চোখ! সেই নির্মম চাউনি অদ্ভুত ব্যঙ্গে হাসছে! রিটা গোম্‌স্‌! এখানেও…! পালাতে হবে…! পালাতে হবে!
সে জানত না যে কোথায় পালাবে! এই পাপের হাত থেকে কোথায় পালানো যায় তার ধারণা ছিল না! অন্ধের মতন রাস্তায় নেমে ছুটে চলেছিল। চোখের সামনে তখন শুধুই রিটা গোম্‌স্‌!…আর কোথাও কেউ নেই…কিছু নেই…!
আচমকা একটা কালো বোলেরো…!

‘হ্যালো মিঃ ব্যানার্জী! আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
অসহ্য যন্ত্রণাটা একটু একটু করে টের পাচ্ছিল আদিত্য। তার থেকেও বেশি টের পাচ্ছিল দৈত্যটার উপস্থিতি! এককোণে তার ছায়াময় উপস্থিতি বেশ প্রকট। তাকে নিতে এসেছে। যেমন নিতে এসেছিল সমুকে। কিংবা সপ্তককে…!
‘মিঃ ব্যানার্জী?…’
একজন উর্দিপরা লোক তার সামনে। আদিত্য তবু যেন তাকে দেখতে পায় না। সে দেখছে রিটা গোম্‌সকে। রিটা হাসছে। যেন ইশারা করে বারবার বলছে—‘কবুল করো। কবুল করো। নয়তো অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই!’
‘আমি রিটাকে রে-প আর খু-ন করেছিলাম!’
কোনমতে টেনে টেনে কথাটা উচ্চারণ করল আদিত্য! তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদার শক্তি নেই। তবু শেষবারের মত ডুকরে কেঁদে উঠল সে। মর্মান্তিক কন্ঠে উচ্চারণ করল—‘রিটা গোম্‌সের অভিশাপ! কেউ রেহাই পায়নি…কেউ পাবে না…!’
‘মিঃ ব্যানার্জী!’
আদিত্যর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। তবু কোনমতে বলল—‘মেয়েটার এইডস্‌ ছিল! ওর বোন মীনা গোম্‌স্‌ রিটার মেডিক্যাল রিপোর্ট শুদ্ধ চিঠি লিখে জানিয়েছিল… দৈত্যের ছবির কাটিং পাঠিয়ে লিখেছিল ‘ইট্‌স্‌ কামিং ফর ইউ…’!’
‘মিঃ আদিত্য ব্যানার্জী!’ উর্দিধারী এগিয়ে এসেছেন—‘কী বলছেন?’
সে ফিস্‌ফিস্‌ করে–‘একটা দৈত্য আসছে… এইচ আই ভি আসছে…ইট্‌স্‌ কামিং ফর মি…ইট্‌স্‌ কামিং ফর্‌…!’
এবার শোনা গেল সোনালির কান্নাভেজা কন্ঠস্বর—‘কী বলছ তুমি?’
‘আমার এইডস হবে… সবার হবে… দুবছর আগের অভিশাপ…!’
তারপরই সব স্থির! সব শেষ!
আদিত্য’র নিথর হয়ে যাওয়া শরীরের দিকে স্তম্ভিত, বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিলেন অফিসার সিন্‌হা! তার মুখে একটা শব্দও ফুটছে না! এ কী অদ্ভুত প্রতিশোধ! আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে জানেন—রিটা গোম্‌সের কস্মিনকালেও এইড্‌স্‌ ছিল না। থাকলে ফরেনসিক রিপোর্টেই ডঃ মিত্র জানাতেন। কিন্তু এই হতভাগারা মীনা গোম্‌সের পাঠানো মেডিক্যাল রিপোর্টটাকেই আসল বলে ধরে নিয়েছে! এখন সব বুঝতে পারছেন তিনি! বুঝতে পারছেন, কোন্‌ দৈত্য ওদের তাড়া করছিল! কেন রিটা গোম্‌স্‌কে বারবার দেখছিল ওরা! অসম্ভব ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। প্রচন্ড আশঙ্কায় গুমরে মরতে মরতে হয়তো রোজই অদৃষ্টের কাছে মৃত্যুর প্রার্থনা করে চলেছে, তবু মৃত্যু নিজে থেকে আসেনি! প্রত্যেকটা দিন এক রিটা গোম্‌সের অভিশাপের তাড়া খেতে খেতে শেষপর্যন্ত আর পারেনি! নিজের হাতে জোর করে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে!

তিনি মাথার টুপিটা খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সপ্তকের বাবা যখন নকল সাক্ষী, নকল প্রমাণ প্ল্যান্ট করেছিলেন—তখনও তার কিছু করার ছিল না। এখন মীনা নকল মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। এখনও তার কী-ই বা করার আছে?

পার্থক্য একটাই! সে রাতে অফিসার সিন্‌হা ভালো করে ঘুমোতে পারেননি…।

আজ ঘুমোবেন!

…………………………………………………………(সমাপ্ত)……………………………………………………

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য · রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত