“হোঁটো সে হোঁট মিলে না ভালে/চাহে মিলে না বাঁহে বাঁহো সে…”
আলতো পায়ে আবার হাঁটতে শুরু করে নীলাঞ্জন। আশেপাশের লোকগুলো চূড়ান্ত ব্যস্ত। আচমকা কানের সামনে এসে কেউ বলে ওঠে ‘excuse me’। তড়িঘড়ি রাস্তা ছেড়ে দেয় নীলাঞ্জন। ব্যস্ত সড়ক দিয়ে হুশহাশ করে ছুটে যাচ্ছে একের পর এক দামী গাড়ী। সিগন্যালের সামনে দাঁড়ানো ট্র্যাফিক পুলিশটার পেছনে মানুষের ঢল। কতক্ষণে সব হুড়মুড়িয়ে এপারে আসবে। একই অবস্থা এপারেও। প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো করে ব্যস্ত। শুধু ব্যস্ততা নেই নীলাঞ্জনের। একটা অলস ভঙ্গি ফুটে ওঠে ওর প্রতিটা পদক্ষেপে। আসলে যাদের যাওয়ার জায়গা থাকেনা কোথাও, তারা হয়তো এমনটাই হয়। সবকিছু থেকে উদাসীন, আশপাশের দুনিয়াদারিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। ওরও তো একদিন ব্যস্ততা ছিলো! প্রতিটা মূহুর্তে কাউকে নিয়ে ভাবনা ছিলো। নিজের সময় থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে নিয়ে একসাথে কাটানো খুশিয়াল মূহুর্তগুলো জমিয়ে রাখার তীব্র একটা ইচ্ছে ঘিরে রাখতো সারাক্ষণ।
“সাব! চড়না হ্যায় ঘোড়ে পে?” প্রায় মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা লোকটাকে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়েই যায় নীলাঞ্জন। “চলিয়ে না সাব! এক রাউন্ড বিশ রুপাইয়া। উঁহা উপর্ গুম্ফা সে ঘুমকে ওয়াপাস ইঁহা ছোড় দুঙ্গা।” চারপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় নীলাঞ্জন। ঠাহর করার চেষ্টা করে এইমূহুর্তে ঠিক কোথায় আছে। এই এক মস্ত মুশকিল হয়েছে ওর আজকাল। শরীরটা এক জায়গায় আর ওদিকে মনটা অন্য কোথাও। এই নিয়ে অফিসেও বিস্তর সমস্যায় পরতে হয়েছে। কাজে ভুল হয়ে যায়। এই সেদিন যেমন গেছিলো বিকেলের দিকে মলে টুকিটাকি মাসকাবারি বাজার করতে হঠাৎ সব কেমন ধোঁয়াশা হয়ে গেলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো টুয়েলভ বী-র লাস্ট বেঞ্চে। ওর ঠিক দুটো বেঞ্চ আগেই দুপাশে বেণী কলকল করে হাসছে। চোখের তারায় সম্মোহনের ঝিলিক। মাঝেমাঝেই ওপরের পাটির গজদাঁত উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় মিনিট খানেক বাদে ওকে ঐভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শপ অ্যাটেন্ড্যান্ট ছেলেটি এসে উদ্ধার করেছিলো। সে যাত্রায় কোনওমতে বেঁচে গেছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো আশেপাশের চোখগুলো ওকে অবাক দৃষ্টিতে মাপছে। আজকেও একই অবস্থা। তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় নীলাঞ্জন। “চলিয়ে না সাব! ঠিক হ্যায় পন্ধরা রুপাইয়া দিজিয়ে!” মাফলারটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে বড় বড় পা ফেলতে থাকে ও। আসলে ছেলেটাকে বোঝাতে পারবে না যে নীলাঞ্জনের কোথাও যাওয়ার জায়গাই নেই। যে মানুষটা নিজের অস্তিত্বর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত তার কোথাও যেতে নেই। একছুট্টে গিয়ে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে সামনের বড় খাদটায়। আচ্ছা কেমন হবে যখন ওর শরীরটা শূণ্যে ভেসে থাকবে? ছোটবেলায় একবার প্যান্ডেল থেকে পড়ে গেছিলো। মাটিতে পড়ার ঠিক আগের মূহুর্ত অব্দি নিজেকে ভারহীন মনে হচ্ছিলো! এখনও কি তাই হবে? সমস্ত ভার এক লহমায় কেউ শুষে নেবে ব্লটিং পেপারের মতো? জমে থাকা অসহ্য কষ্টগুলো এক ধাক্কায় নেই হয়ে যাবে? নীলাঞ্জন জানে না। শুধু জানে এভাবে ওর চলে যেতে নেই। ঐ স্পষ্ট বড় বড় চোখদুটো যতদিন ওর বুকের ভেতর বেঁচে আছে এক টুকরো নীলাঞ্জন ততদিন আটকা পড়ে আছে এই দুনিয়ায়। যে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে কখনও এক অষ্টাদশ বলে উঠতো, “কিচ্ছু চাইনা জানিস যদি সারা জীবন এইভাবে শুধু তোর চোখের গভীরে নিজেকে বারবার খুঁজে পাই! বিশ্বাস কর!” খিলখিল হাসিতে ঝঙ্কার তুলে রিনরিনে স্বর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিতে দিতে আলতো করে বলতো “পাগল!” এখনও কি সে পাগল বলে কাউকে? নাকি মনে রেখেছে নীলাঞ্জনের বেয়াড়া আবদার? “এই নামে কাউকে ডাকবি না কোনও দিনও না! একসাথে না থাকলেও না! এই নামটা আমার জন্য থাক!” একটা ক্লান্ত হাসি খেলে যায় ঠোঁটের কোণে। সত্যিই একসাথে থাকা হলো না। নাকি এখনও কোথাও একটা জড়িয়ে থাকা ভালোবাসা দু-পারেই ছুঁয়ে আছে? তার বুকের ভেতরেও মাঝেমাঝেই ঝড় তোলে এক অষ্টাদশের আদল? সেও স্বপ্ন দেখে একদিন অনেকটা দূর পেরিয়ে এসে বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে জামার বোতাম আঙ্গুল দিয়ে নেড়েচেড়ে বলে উঠবে, “এতদিনে বুঝি মনে পড়লো? সময় হলো ঘরে ফেরার?” ঘরে ফিরতেই তো চায় নীলাঞ্জন। শুধু ফিরে যাওয়ার রাস্তাটা আজও হাতড়ে বেড়াচ্ছে। হাওয়ার দাপটে শনশন আওয়াজ, নাকি ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে চায় ওরা? কান পেতে থাকে নীলাঞ্জন। কেউ যেন গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে, “হর কিসিকো নেহি মিলতা/ইঁহা প্যায়ার জিন্দেগি মেঁ…” খিলখিল হাসির শব্দ আর চুড়ির রিনরিন ছুঁয়ে যায় নীলাঞ্জনের শরীর। দমকা হাওয়ার ঝাপটে ভেঙ্গে পড়ার ঠিক আগের মূহুর্তে আবার টের পায় চারপাশ কেমন ধূসর হয়ে আসছে। মনখারাপের চাদর সরিয়ে উঁকি দেয় একজোড়া কালো গভীর চোখ। যার দিকে তাকিয়ে বলা যায়….