-আফা যাইবেন না গাড়ি তো ছাইড়া দিমু।
-আরেকটু দাঁড়াও ভাই ;আমার হয়েগেছে।রসগোল্লা বাকি শুধু নিতে।
-আফা মেলাক্ষণ তো দাঁড়াইলাম ;বাসের সবাই চিল্লাচিল্লি করতাছে।
-যাও ভাই ;আমার কেনা শেষ।
.
-কথা হচ্ছিলো বাস হেল্পার আর নাদিয়া সুলতানা তাহমিনা। ইনি হচ্ছেন এ শহরের নাম করা ডাক্তার। নাম বললে এক নামে সবাই চেনে। যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি।গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। অনেক বছর পর আজ বাড়ি যাচ্ছেন তিনি। গ্রাম থেকে পালিয়ে ছিলেন তিনি ;নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য। আজ প্রায় পনের বছর পর গ্রামে যাচ্ছেন। সাজ পোশাক ঠিক গ্রামের মেয়ের মতো। এই পোশাকে ইনাকে চেনা খুব মুশকিল।
.
-পনেরও বছর আগে
.
-গফুর মিঞা তুমি এ কি করছ?
-কি করতাছি মাস্টার সাব?
-আবার বলছ কি করছ ;মেয়েটাকে দিয়ে জমিতে কাজ করাচ্ছো কেনো?
-কি করুম কন;টেকা পয়সা নাই যে কামলা নিয়া কাম করামু!
-তাই বলে ;মেয়েটাকে দিয়ে জমিতে কাজ করাবে। জানো মেয়েটা লেখা পড়ায় কত ভাল!
-গরীবের আবার লেখা-পড়া মাস্টার সাব।
-লেখা-পড়া গরীব ধনী দেখে হয়না। লেখা-পড়া করতে হলে মেধার প্রয়োজন। আর তোমার মেয়ে নাদিয়ার মেধা তো অনেক ভাল।
-আর মেধা। দুই দিন পর বিয়া দিয়া দিমু ;মেধা দিয়ে কি হইবো?
-বিয়ে দিবে মানে?
-মানে হইলো ঘটককে কইছি পাত্র দেখতে বিয়া দিয়ে দিমু।
-গফুর মিঞা এটা কিন্তু ঠিক না।নাদিয়ার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আর তুমি তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?
-মাস্টার সাব ;যতেষ্ট বয়স হয়েছে ;মেয়ে মানুষগো এতো ঘরে রাখতে নেয়। বেশি লেখা পড়ার দরকার নেই।
-কি বলেছে এসব।আজকাল মেয়েদের লেখা-পড়া করানো প্রত্যেক পিতা-মাতার কর্তব্য।
-মাস্টার সাব আমাকে কর্তব্য শিখিয়া লাভ নাই।আপনি আপনার কামে যান;আমার কামে অসুবিধা কইরেন না।
-গফুর মিঞা তোমার বুদ্বি কবে হবে ;আল্লাহ জানেন।
-আমার বুদ্বি ঠিকেই আছে। আপনার বুদ্বি ঠিক করেন।
-তোমার সাথে কিছুই বলার নেই;গফুর মিঞা।
-হ;যান কিছুই কইতে হইবোনা।
.
-কার লগে কথা কইতেছিলা?
-আর বইলোনা;মাস্টারে আমার জ্ঞান দেয়। আমার বুঝি জ্ঞান কম আছে।
-মাস্টার খালি এক লাইন বেশি বুঝে!
-ঘটক তোমারে না একটা কাম দিছিলাম ;তা হেই কামডার কি খবর?
-খবর ভালোই ;পাত্র এক্কান পাইছি!
-পাত্র কি করে, বাড়ি কোন গ্রামে, বাপের নাম কি?
-আরে মিঞা আস্তে কও।এতো প্রশ্ন একলগে করলে ‘কোনডার জবাব দেম।
-আচ্ছা কও আস্তে আস্তেই।
-পাত্রের বাপের নাম ইদ্দিস ;পাশের গ্রামেই বাড়ি ।
-পাত্র কি কাম করে?
-পাত্র কৃষি কাম করে ;আর বাজারে দোকানদারী করে।
-আমার নাদিয়ার লগে মানাইবো তো?
-কি যে কও গফুর মিঞা ;পাত্রেরও বয়স কম; খুব ভালা মানাইবো।
-আচ্ছা তাইলে তুমি সব ঠিক কর ঘটক।
-আচ্ছা ঠিক আছে ;আমি পাত্রের বাপের লগে পাকা কথা সেরে ফেলমু।
.
পাশে দাঁড়িয়ে সব কথায় শোনছিলো নাদিয়া। নাদিয়া লেখা পড়ায় খুবি ভালো। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাসের মধ্যে ফাস্ট হয়।প্রাইমারিতে বৃত্তি পেয়েছিল। এখন ক্লাস নাইনে পড়ে ;সেখানেও অনেক ভালো। নাদিয়ার ইচ্ছা লেখা পড়া করা।কিন্তু এখন দেখছে সেই স্বপ্ন ভঙ্গের পথে।
.
মনভার করে বাড়ি ফিরে নাদিয়া।
-কি হইছেরে মা (নাদিয়ার মা) মন মরা কেন তোর।
-আম্মা, বাজান আমার বিয়া ঠিক করতাছে। কিন্তু আম্মা আমি পড়বার চাই।তুমি বাজানরে একটু বুঝাও না।
-তোর বাজান কি আমার কথা হুনবো? দেখস না আমার কোন কথায় হুনেনা।
-কিন্তু আম্মা ;আমার যে স্বপ্ন অদদআমি ডাক্তার হমু। ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করুম।
-আমি কিছুই জানিনা ;তুই তোর স্যারের কাছে গিয়া দেখ ;কিছু করতে পারে কিনা।
-আম্মা; বাজান স্যারের কথাও হুনবোনা। বাজানের লগে স্যারের কথা কাটাকাটি হইছে।
-তবুও গিয়া দেখ ;স্যারে কিছু করতে পারে কিনা। কিন্তু সাবধান তোর বাপে যেনো না জানে
-আচ্ছা দেহি ;স্যারের কাছে গিয়া স্যার কি কয়!
.
-কিরে নাদিয়া কাঁদছিস কেনো?
-স্যার বাজান আমার বিয়া দিয়া দিবো ;আপনি তো হুনছিলেন।
-হ্যাঁ
-স্যার;বাজান সত্যি সত্যি আমার বিয়া ঠিক কইরা ফেলছে। কিন্তু স্যার আমি তো পড়তে চাই;আমার স্বপ্ন যে ডাক্তার হমু। আমি স্বপ্নে দেখেছি ;আমি ডাক্তার হইছি আর গ্রামের মানুষের সেবা করছি। আমার স্বপ্ন কি পূরণ হবেনা?
-আল্লাহ জানেন। তুই কাঁন্না থামা। দেখি কি করতে পারি ;একটু দাঁড়া।
-স্যার আমি পড়তে চাই!
-এই নে ;এখানে আমার বন্ধুর ঠিকানা দেওয়া;তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী যাবি;তোর সব খরচ আমি বহন করবো। কিন্তু সাবধান কেই যেনো না জানে।
-আচ্ছা স্যার।
-তুই কাল ভোরে পালাবি ;বাসে সোজা ঢাকা ঠিকানা অনুযায়ী।
-আচ্ছা।
.
.
-আফা নামবেন না;সবাই তো বাস থাইকা নাইমা গেছে। কিশোরগঞ্জ এসে গেছে বাস।
-ও দুঃখিত ;বুঝতে পারিনি।
-আফা একটা কথা জিগামু, কিছু মনে না নিলে!
-কি?
-আফা ;ঢাকা থেকে বাসে উঠার পর থেকেই দেখছি ;সারা রাস্তা আপনি কি যেনো ভেবে ভেবে এসেছেন। কিশোরগঞ্জ আসার পরও ভাবছেন। কি ভাবছেন এতো সব।
-কিছুনা ভাই ;আমি যাই ভালো থেকে ।
.
১৫ বছর পর নাদিয়া আবারও কিশোরগঞ্জ উদ্দেশ্য তার বাপের বাড়ি। সেদিন ঘর থেকে মাস্টারের কথা অনুযায়ী বাড়ি থেকে ঠিকি পালিয়ে ছিলো। তবে ভাগ্য খারাপ বলে ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলে।
-তবে তার ভাগ্যটা হয়তো এতোটা খারাপ ছিলোনা। তাই কোন এক ভদ্র লোকের সাথে পরিচয় হয়। ভদ্র লোকটির নাম ফিরোজ চৌধুরী। কোন সন্তান নেয়। বড় বিজনেস ম্যান ;সবসময় হাসি খুশি থাকেন, কোন দুঃখ নেয় জীবনে।।কিন্তু মনের মধ্যে শুধু একটাই দুঃখ থাকতো তার কোন সন্তান নেই। আল্লাহ যেন সন্তান তাদের ভাগ্যে লেখেনি। ভাগ্যক্রমে ফিরোজ চৌধুরী নাদিয়াকে পেয়ে যায়।নাদিয়ার মুখে সব শোনে ;নাদিয়াকে আপন করে নেয়। নাদিয়া পেয়ে যায়;তার মাথার উপর ঠাই।আর ফিরোজ চৌধুরী সন্তানের দুঃখ ভুলে যায়।
তারপর নাদিয়া ফিরোজ চৌধুরীর কাছেই বড় হয়। নিজের স্বপ্ন পূরণ করে ডাক্তার হয়। আর ফিরোজ চৌধুরীও নিজের সন্তানের দুঃখ ভুলে যাই।
.
-আসসালামু আলাইকুম। (পথের মধ্যে দেখা হয়েগেলো স্যারের সাথে)
-কে তুমি মা;চেনাচেনা লাগছে?
-স্যার আমাকে চিনতে পারছেন না;আমি নাদিয়া!
-নাদিয়া?
-গফুর মিঞার মেয়ে।
-এই কথা বলতেই নাদিয়া দেখলো স্যারের চোখে পানি টলমল করছে। পানিকে আটকাতে পারলেন না স্যার।চোখ বেয়ে নেমে পড়লো।
-কোথায় হারিয়ে ছিলি তুই? তুই পালিয়ে গেলি তোর বাবা আমাকে দুষে। আমার উপর দুষ দেয় সমস্যা ছিলোনা।কিন্তু যখন শোনলাম তুই আমার বন্ধু সবুরের বাসায় যাস নি।তখন যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তোর বাবা গ্রামের মানুষ নিয়ে আমার নামে মামলা করলো। আমি নাকি তোকে কোথাও বিক্রি করে দিছি। পুলিশে আমাকে ধরলো।আদালতে নিলো ;আমার চাকরী চলে যাই ;সেই সাথে পাঁচ বছরের জেল হয়। আমার সংসারটা ভেঙে পড়ে। জেল থেকে বের হয়ে আজও সেই অপবাদ নিয়ে ঘুরছি। কোন মতো সংসার টেনে হেচড়ে চালাচ্ছি।
-নাদিয়া কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তার চোখ দিয়েও অবিরাম পানি ঝড়ছে। কিছু বলার মতো ভাষা পাচ্ছেনা। তা জন্যই স্যারের জীবনে এই অপবাদ কষ্ট নেমে এসেছে!
.
-কিরে তুই কাঁদছিস কেনো?
-স্যার আমাকে মাপ করে দেন। আমার জন্যেই আপনার এমন অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে ;জেলে যেতে হয়েছে।
-এসব কিছুই না;এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো। এখন বল তোর খবর কি?
-স্যার আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। আমি ডাক্তারি পাস করেছি।(তারপর সব ঘটনা খুলে বললো।)
-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সহায় ছিলো। বাড়ি যাবিনা।তোর বাবা এখনো তোর জন্যে কাঁদে।এমন কোন দিন নাই যে না কেঁদেছে।
-স্যারের কথা শোনে চোখ দিয়ে জলের ধারা যেনো আরও বেড়ে গেলো। যে বাপ কখনোই কাঁদেনি,এতটুকু ভালো ভাবে আদর করেনি । তিনিও পনের বছর ধরে কাঁদছে । কাঁন্নাই বুকটা ফেটে যাচ্ছে নাদিয়ার।
-আর কাঁদিস না; চল বাড়ি চল। তোর বাবার চোখের পানি মুছবি তো তুই।তোকে দেখলে বিষণ খুশি হবে।
.
অবশেষে পনেরও বছর পর নাদিয়া তার মা বাবার সাথে দেখা করলো। বাবার চোখের পানি যেনো থামতেই চাইনি। এতো বছর পর ফিরে পাওয়া।এই চোখের পানি দুঃখের নয়। অতি সুঃখেও মানুষের চোখে অবিরাম পানি ঝড়ে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা