মায়ার ঘোর

মায়ার ঘোর

কিছুতেই মন বসছেনা। ২৪ টা বছর যেখানে কাটালাম সেখান থেকে
চলে আসলে মন কি আর ভালো থাকে। বাবা বাসা বদলে ফেলেছে। আমি জন্ম নিয়েছি যে বাড়িতে সেই বাড়িটা ছেড়ে আসতে খুব খারাপ লেগেছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেই বাড়িটা ঘিরে। তবুও কিছু করার নেই। ছেলেদের এসব বিষয়কে সহজেই মানতে হয়। নতুন বাসায় নিজের রুম সাজাচ্ছি। এমন সময় মা ডাক দেয়।
– আকাশ
— জ্বি মা।
– কিরে আজ দোকানে যাবিনা।
— না মা। আগে রুমটা গুছিয়ে নিই।
আমি রুমটা গুছিয়ে নিলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ল্যাপটপে ছবি দেখছি। মন এখনো কিছু টা খারাপ হয়েই আছে। মা আবার এসে বলল
– কি রে এভাবে পড়ে থাকলে হবে। যা বাইরে থেকে ঘুরে আয়।
ঠিকই বলেছে মা। নতুন জায়গায় এসেছি। এদিক ওদিক ঘুরে আশেপাশের পরিবেশটা বুঝে উঠাই ভালো। তাই বিকেলে বের হলাম। একা একা হাঁটছি। আশপাশের পরিবেশ টা বেশ সুন্দর।খোলা মেলা একটা জায়গায় বসে পড়লাম। অনেক মানুষ এখানে বোরিং টাইম পাস করতে আসে।হঠাত একটা কিছু দেখে চমকে গেলাম। একটা মেয়ে অন্য কিছু নয়। একা একা।আমার মত আলাদা ভাবে বসে আছে। কি জানি আমার মত মন খারাপ কি না। কখনো কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকাইনি। প্রেম তো দুরের কথা কোন মেয়ে বন্ধুও নেই আমার। অবশ্য কয়েকটা বাল্যপ্রেমের কাহিনী এখনো মনে আছে। মনে পড়লে হাসি খুব পায়। বড় হবার পর পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আর এখন একটা দোকান নিয়ে পড়ে আছি। তাই আমার আর প্রেম হয়ে
ওঠেনি। যাই হোক মেয়েটাকে কাছে থেকে দেখার জন্য ওর অল্প দুরে গিয়ে
বসলাম। ও বুঝতে পারেনি আমি যে ওকে ফলো করছি।মেয়েটা কালো একটা
সেলোয়ার কামিজ পড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স ১৮ এর মত ধরি নিজে নিজে। মাথাটা একটু তুলতেই মেয়েটার চোখে পানি দেখলাম। কিন্তু মেয়েটা কাঁদছে কেন। এই সময় বয়ফ্রেন্ডরা ছ্যাঁকা দিলেই এই বয়সের মেয়েরা কাঁদে। হয়ত একারনেই কাঁদছে। প্রায় ২০ মিনিট পর মেয়েটা চলে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। রাতে মেয়েটার কথা ভীষণ মনে পড়েছিল। অনেক বন্ধু বলেছে আমাকে মায়া অদ্ভুত একটা জিনিস। মায়ায় পড়লে আর রক্ষা নাই। মায়ার ঘোর থেকে বের হয়ে আসা পুরোপুরি অসম্ভব না হলেও কিছুটা কাছাকাছি।
.
পরদিন বিকেলে আবার সেই জায়গায় যাই। মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছি আগের জায়গায়ই বসে আছে। আমিও ওর কাছাকাছি গিয়ে বসি। ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছেনা। যদি মায়ায় পড়ে যাই। চোখ বন্ধ করে আছি যাতে ওর দিকে তাকাতে না হয়। কিন্তু পারলাম না। অবশেষ চোখটা খুলেই ফেললাম। মায়াজাল কাকে বলে এখন ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছি। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। মেয়েটা আজ কাঁদছেনা। শুধু একমনে আকাশ দেখছে। আমি ওর আরো একটু কাছে গিয়ে বসি যাতে সে খেয়াল করতে
পারে আমাকে। তবে ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মন ভীষণ খারাপ। হয়তবা ওর বয়ফ্রেন্ডের কারনে। ভাবতে খারাপ লাগে ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। কেমন জানি জেলাস ফিল করি। বুঝতে পারি মায়াজালে আটকে গেছি আমি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি আর ও আকাশের দিকে আছে। খুব জেলাস ফিল হয় আমার। আমার নামও আকাশ। ও আমার দিকে তাকাতে পারেনা? হঠাৎ মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। আমি দেখতে পাই ওর চোখে ভীষণ নিঃসঙ্গতার ছাপ রয়েছে। মেয়েটা চোখ নামিয়ে ফেলে।বুঝতে পেরেছে বোধ হয় যে আমি কে ফলো করছি। তারপর মাঝে মাঝে চোখাচুখি হই। আমি স্বাভাবিক থাকি।কিন্তু ও আমার দিকে তাকালেই হার্টবিট বেড়ে যায়।
.
এভাবে কয়েক দিন যায়। আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। মেয়েটাও খানিকটা
বুঝতে পারে তার প্রতি আমার দুর্বলতা। কিন্তু ওকে আজ পর্যন্ত হাসতে
দেখিনি। ওর মনে হয়ত ভীষণ কষ্টের দাগ রয়েছে যা ওকে হাসতে নিষেধ করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ ওর সাথে কথা বলব। যেভাবেই হোক কথা বলবই।
.
বিকেলে আবার যাই সেখানে। এই জায়গাটা অনেক ভালো জায়গা। মন
খারাপ হয়ে থাকা মানুষদের মন ভালো করে দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। মেয়েটার থেকে অল্প দুরে গিয়ে বসি। ও বুঝতে পেরেছে আমি এসেছি। একবার তাকিয়েছিল তারপর আর কোন খবর নেই। আকাশের দিকে
তাকিয়েই আছে। আমি আরো একটু কাছে গিয়ে বসি।ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম
– আমার নামও কিন্তু আকাশ।
মেয়েটার যেন টনক নড়ে ওঠে। চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়।কিছু বলেনা।আমি আবার বলি
– আমার নামও আকাশ। মাঝে মাঝে একটু আমার দিকে তাকালেই তো হয়।
সারাক্ষণ ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি আকাশ এখানে আছি কেন?
কথাটা শুনে মেয়েটা মুচকি একটা হাসি দেয়।এই প্রথম ওর হাসি দেখলাম।
থাক ওর হাসির প্রশংসা করবনা। তবে বুঝতে পারি মায়ার ঘোরে পড়েছি
কঠিন ভাবে। মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়ে বলে
— যে আকাশ নির্বাক এবং বিশাল সে আকাশ আমার ভালো লাগে।
– ওই আকাশের মত হয়ত বিশাল হতে পারবনা।তবে নির্বাক হতে পারব।
তারপরও আমার দিকে তাকালেই হবে। নির্বাক আকাশ হয়ে থাকব না হয়।
মেয়েটা আবার হেসে ওঠে। আড়চোখে তাকায় আমার দিকে। তারপর আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে
— ওই আকাশ তো আমার মন ভালো করে দিতে পারে।
– যদি আমিও পারি।
— ওই আকাশ তো বৃষ্টি দিতে পারে।
– আমিও কেঁদে বৃষ্টি ঝরাতে পারি।
— ওই আকাশ তো রাতে আমায় চাঁদের জোছনা দেয়।
আমার আর কোন উত্তর থাকেনা।কোন উত্তর দিতে পারিনা।আমি আকাশের
কাছে তো চাঁদ নেই যে ওকে জোছনা দেব।আমি নির্বাক হয়ে আছি।উত্তর না
পেয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। আমি এবার চোখ নামিয়ে ফেলি। খানিকটা লজ্জায় পড়ে যাই। তবু আমতা আমতা করে বলি
– স্যরি আমি আকাশকে আল্লাহ চাঁদ দেয়নি তাই জোছনা দিতে পারব না।
ওর দিকে তাকাতে পারিনা। মনটা খারাপ হয়ে যায় আমার। ওই আকাশের
উপর রাগ হয়।শালার বেটা এদিক দিয়ে আমার উপরে উঠে গেল। আমার ইতস্ততা দেখে মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসে। এ কেমন মায়ায় পড়লাম রে বাবা। শেষ পর্যন্ত ওই আকাশের কাছে হেরে গেলাম। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলি
– ঠিক আছে আমার দিকে তাকাতে হবেনা।আমি ওই আকাশের কাছে
হেরে গেলাম।আসলেই, আমার কাছে তো চাঁদ নেই তাই জোছনা দিতে
পারবনা। ওই আকাশটাই ভালো। জোছনা দিতে পারবে।
মেয়েটা আবার মুচকি হাসে। কি জ্বালায় পড়লাম। এই হাসির মায়াটা খুব ভয়ঙ্কর। তাই আমি চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই। মেয়েটা তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আসার সময় শুধুই এটুকু বলে আসি
– আমি আকাশ যেদিন জোছনা ছড়াতে পারব সেদিন তাকালে হবে।
.
সেদিন থেকে আমি মেয়েটার থেকে একটু দুরে দুরে থাকি। মেয়েটা প্রায়ই আমার দিকে তাকায়।বুঝতে পারিনা কি করা উচিত আমার। খানিকটা দিধাদ্বন্দে আছি।কথা বলব না কি না বলব এই নিয়ে টেনশনে আছি।টেনশন
করতে করতেই মেয়েটার কাছে চলে গেছি কখন বুঝতেই পারিনি। মেয়েটার কাছে গিয়ে বলেই ফেললাম
– আমি কি এখনো জোছনা ছড়াতে পেরেছি?
— কেন?
– এই যে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন।আপনার সাথে তো আমার
এই কথাই রইল যে যতদিন না আমি জোছনা ছড়াতে পারব ততদিন আপনি
আমার দিকে তাকাবেন না।
— ও। আপনার দিকে তাকানো কি নিষেধ আছে নাকি?
– না।
— তাহলে?
– কিছুনা। আপনার নাম জানা যাবে?
— নীলিমা।
– ওয়াও, তাহলে তো ভালোই মিলেছে।
— মানে।?
– মানে আমি আকাশ আর আপনি নীলিমা। আর আকাশের বুকেই নীলিমা থাকে।
নীলিমা কিছু বলেনা। মুচকি একটা হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। আমি চেয়ে আছি তার দিকে অপলকে। হঠাৎ নীলিমা আবার বলল
— কি দেখছেন?
– নীলিমা দেখি।
আবার সেই হাসি। কোথায় যে যাই আমি। এত মিষ্টি হাসি কোথায় যে পায়
মেয়েটা আল্লাহই জানে।তারপর নীলিমা চলে যায়। আমি চেয়ে আছি ওর দিকে।হেলে দুলে হাঁটছে সে। একটা বারও আমার দিকে তাকায়নি।
মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাবলাম সিনেমার নায়িকারা যেভাবে যাওয়ার সময় নায়কের দিকে তাকায় সেভাবে নীলিমা আমার দিকে তাকাবে। কিন্তু
না । নীলিমা তাকায়নি। সিনেমা আর বাস্তব তো এক না এই ভেবে মন টাকে ভালো করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।তারপর বাড়ি ফিরে যাই আমি।
.
রাতে ভাবতে শুরু করলাম। নীলিমাকে আমার ভালো লাগে। ওকে বলব
ভাবছি। কিন্তু সাহস হচ্ছেনা। বলব নাকি না বলব এই নিয়ে ব্যাপক টেনশনে পড়ে গেলাম। বলেই ফেলব ভাবছি। দেখা যাক কি হয়।
.
পরদিন বিকেলে আবার যাই সেই খোলা জায়গায়। নীলিমা এখনো আসেনি।
অপেক্ষা করছি আর ওকে কি বলব তা মনে মনে প্র্যাকটিস করছি। এক সময়
নীলিমা আসে। আগের সেই আনমনা ভাবটা এখনো যায়নি। আমি এসেছি
কি না তা দেখার জন্য চারপাশে একবার তাকায়। অবশেষে সে আমায় দেখতে পায়। আমি নীলিমার কাছে গিয়ে বসি। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আমার দিকে তাকাল। মনটা এখনো খারাপ আছে ওর। তাই বললাম
– নীলিমা মন খারাপ করে তো কালিমা হয়ে গেছে। কি হয়েছে জানা যাবে কি?
— কিছুনা। এমনি ভালো লাগছেনা। আকাশের খবর কি?
– আকাশে ভয়ের মেঘ জমেছে। কখন যে বাঁজ পড়ে আল্লাহই জানে।
— মানে কি?
– বলব তো। আগে একটু স্বাভাবিক হই
— কেন এখন কি অস্বাভাবিক আছেন নাকি?
– কিছুটা।
— ও।
মনে মনে আবার চিন্তা করলাম বলব কি বলবনা। একটু আগে ওকে বলেছি বলব।এখন না বললে কেমন দেখায়? তাই বলে দেব ফাইনালি।
– একটা কথা বলব? আমার নিজের কথা।
— হুম বলুন।
– সেদিন আকাশের মন খারাপ ছিল। জায়গা পরিবর্তন করলে যা হয় আর কি। আকাশ ঘুরতে বের হয় মন ভালো করার জন্য। এখানে এসে থমকে যায় আকাশ। কিছু একটা দেখে সে। অন্য কিছু নয়। অচেনা নীলিমাকে দেখতে পায়। যা আকাশের বুকে আগে ছিলনা। প্রতিদিনই এই অচেনা নীলিমা
আকাশের বুকে এলোমেলো ভাবে উড়ে বেড়ায়।অন্য সব নীলিমা থেকে
এই নীলিমা একদম আলাদা। কেমন যেন শান্ত।তবুও আকাশের এই নীলিমাকে দেখতে ভালো লাগে। ওর কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে। যখন নীলিমা আকাশের দিকে তাকায় তখন আকাশের হার্টবিট বেড়ে যায়। কেন এমন হয় সেটা আকাশ নিজেও জানেনা। শুধু এতটুকু বুঝতে পারে আকাশ
নীলিমার মায়ার ঘোরে বন্দী হয়েছে।এখন চাইলেই এই ঘোর থেকে আকাশ বের হয়ে আসতে পারবেনা। তাই আকাশ একটা কিছু চায়।আর সেটা হচ্ছে সেই অচেনা নীলিমাকে স্থায়ী ভাবে আকাশের বুকে উড়াতে। এলোমেলো ভাবে নয়। অনেকটা গুছিয়ে। যেখানে নীলিমা শুধুই আকাশের জন্য উড়বে। আকাশকে নীলিমার নীল রঙে রাঙিয়ে দিতে। সেই সুযোগটা পাওয়া যাবে কি?
কথা গুলো আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম। আমার বলা শেষ তাই মাথা তুলে নীলিমার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়াতে একটুও বিব্রত হয়নি। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগে। পরে বুঝতে পারি ও কিছু একটা চিন্তা করছে। আমি ওকে বিরক্ত করলাম না। ও ভাবুক। ভাবার সময়টা ওকে দেয়া উচিত। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষন। তাই ওর চিন্তায় বাধা দিলাম। বললাম
– শুনছেন?
নীলিমা চমকে উঠে। আমার দিকে তাকিয়ে এবার বিব্রত হল। চোখ নামিয়ে নিল। নিচু গলায় বলল
— বলুন।
– সুযোগ পাওয়া যাবে কি?
— এর আগে আপনাকে কিছু সত্য শুনতে হবে।
– বলুন।
— নীলিমা আকাশকে কিছুই দিতে পারবেনা। কারন নীলিমার কাছে আকাশকে দেয়ার মত কিছুই নাই। নীলিমার রঙে এখন আর নীল ছড়ায়না।
কালো রঙ ছড়ায়। কারন নীলিমা আগে অন্য কারো ছিল। নীলিমা বিবাহিত।
বাবা মাকে না জানিয়ে নীলিমা বিয়ে করে। অন্য কারো আকাশে সে উড়েছে। কিন্তু সে নীলিমার সাথে প্রতারণা করে। নীলিমার সব কিছু কেড়ে নিয়ে সেই প্রতারক মানুষটি নীলিমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই নীলিমার কাছে অন্য কাউকে কিছু দেয়ার জন্য আর কিছু বাকি নেই। যার কারনে নীলিমা এখন এলোমেলো ভাবে উড়ে। নীলিমার মন খারাপ থাকে। তাই নীলিমা অন্য কাউকে সুযোগ দিয়ে অন্য কারো জীবন নষ্ট করতে চায়না। অন্য কোন আকাশে উড়তে চায়না। কারন নীলিমা এখন পুরোপুরি নিঃস্ব।
এটুকুতেই নীলিমার বলা শেষ হয়। এসব শুনে আমার মাথায় যেন বাঁজ পড়ে।
কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম। কারন কথা গুলো বলার সময় নীলিমা একটুও মন খারাপ করেনি। উল্টো হাসতে হাসতে বলেছে সে কথাগুলো। তখন আমার মনে হল মায়ের মুখে শোনা একটি কথা। মা বলেছিল অতি দুঃখেও হাসতে জানে এমন মানুষ অনেক আছে। সেদিন বিশ্বাস না হলেও এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। আমি নীরব হয়ে আছি। একসময় আমার মনে আসে আমি কেন অন্য কারো স্ত্রী কে ভালো বাসব। কেন আমি অন্যের এলোমেলো জীবন ঠিক করব। তাহলে আমার নিজের জীবনই এলোমেলো হয়ে যাবে। চুপ করে বসে এসব ভাবছি। কীভাবে আমি এখন এখান থেকে যাব সেটাই ভাবছি। নীলিমা আমার মুখপানে চেয়ে আছে। আমি মোবাইলটা কানে নিয়ে ফেইক ভাবে কথা বলতে বলতে চলে আসলাম। আসার সময় নীলিমার দিকে আড়চোখে তাকালাম। দেখলাম তার মুখে ধিক্কারের হাসি।
.
রাতে আর ঘুম আসছেনা। বারবার শুধু নীলিমার কথা মনে পড়ে। ওর সেই
হাসির কথা মনে পড়ে। কিছুতেই ওকে মন থেকে মুছতে পারছিনা। তাই
সিদ্ধান্ত নিলাম ওই জায়গায় আর যাবনা। আমি সত্যিই ওখানে আর যাইনি।এভাবে ২ দিন কেটে গেল। কিন্তু এখনো আমি নীলিমাকে ভুলতে পারছিনা। বললাম না মায়ার ঘোরে পড়েছি আমি। আর এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে যে এই মায়াজাল আমি কিছুতেই ছিন্ন করতে পারব না। এই মায়ার ঘোরেই আমাকে পড়ে থাকতে হবে। চিন্তা করতে করতে আমি প্রায় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু কোন ফলাফল পাইনি। অবশেষে বুঝতে পারি নীলিমা যেমনই হোক ওকে আমার চাই। ওর কিছু থাক আর না থাক আমার ওকে প্রয়োজন। পরদিন বিকেলে আমি ওখানে যাই। নীলিমাকে দেখলাম চুপচাপ বসে আছে। আমি একটু একটু করে ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।ওর কাছে গিয়ে বসলাম। কথা বলার মত কোন ভাষা খুজে পাচ্ছিনা। এমন সময় নীলিমা বলে
— সেটাই স্বাভাবিক। এই সব শুনে যে কেউ এরকমই করবে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিনা। অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এখন কোন কিছু বললেই নীলিমা ভাববে আমি নিজের পক্ষে সাফাই গাইছি। তবুও চুপ করে
থাকার চেয়ে কিছু একটা বলা ভাল। এসব ভাবছি। এমন সময় নীলিমা আবার বলল
— লজ্জা পেতে হবেনা। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একই কাজ করত।
নীলিমা আমার নীরবতার সুযোগ নিয়ে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। এবার আমাকে কিছু একটা অবশ্যই বলতে হবে। আমি বললাম
– দেখ নীলিমা,তুমি ভুল ভাবছ। আমি এই দুই দিন নিজেকে সময় দিয়েছি ভাবার জন্য আমি আসলে কি চাই। নিজেকে ঠিক মত বুঝে উঠার জন্য আমি এই দুই দিন আসিনি। যদি তোমার প্রতি অনুভূতি শুধুমাত্র ভাল লাগা হত তাহলে আমি আজ আসতামনা। তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। আর এই ভালবাসাই আমাকে তোমার কাছে আসতে বাধ্য করেছে। তুমি যদি তারপরেও আমায় ভুল বুঝো তাহলে তো আমার কিছুই করার থাকল না। তবে যেটা সত্যি সেটাই বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার জীবনে তোমাকে খুব প্রয়োজন। আর আমি কোন স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ভালোবাসছিনা যে তোমার কিছু থাকতে হবে। তোমার কিছু থাক আর না থাক আমি তোমাকে ভালোবাসি।
একটানা কথাগুলো বলে শেষ করলাম। নীলিমার চোখে খুশির ছাপ দেখতে পেলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— ও।
– আমার প্রতি তোমার অনুভুতি কি জানতে পারি।?
— আমার কোন অনুভুতি নেই। যা ছিল সব মরে গেছে। তাই আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারবনা।
– ঠিক আছে। কিন্তু কাউকে ভালবাসার সুযোগ তো দিবা?
নীলিমা একটু হাসল। বুঝলাম এই হাসি সম্মতির হাসি।
.
তারপর থেকে শুরু হয় কে নিয়ে আমার নতুন জীবন। ওর কিছু নেই তো কি হয়েছে। আমি তো আছি। এটাই যথেষ্ট। ওর মন খারাপ থাকলে আমি ভালো করার চেষ্ট করি। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে খেয়াল করে দেখি ওর মন ভীষন খারাপ থাকে। আমার কিছুটা রাগ হয়। আমি আছি তারপরও সে তার পূর্ব প্রেমিককে ভুলতে পারেনি। এটা আমার একদম ভাল লাগেনা। মাঝে মাঝে আমার কাঁধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরে দেখি আমার কাঁধের দিকের শার্টের কাপড়টা ভেজা। তার মানে ও নিঃশব্দে কেঁদেছে। এবার আর তার উপর রাগ হয়না। আমার উপর রাগ হয়। কারন আমি থাকতে সে অন্য কারো কথা মনে করবে কেন। তাকে এই সুযোগ কেন দেয়া
হবে। তারপর থেকে আমি নীলিমার প্রতিটা হাঁচির খবরও আমি রাখতাম। আমার অস্তিত্ব নীলিমাকে ছাড়া অসম্পুর্ণ। আমি ভালবাসা দিয়ে ওর চারপাশে
দেয়াল গড়ে তুলি।যাতে কোন কিছুই ওকে স্পর্শ করতে না পারে। আর দেয়ালের ভেতরে আমি। ওর কাছে হিরো হলেও আমি হব ভিলেন হলেও
আমিই হব।একদিন নীলিমাকে আমি সরাসরি প্রশ্ন করি
– আচ্ছা নীলিমা, তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাসতে পারোনি?
— দেখ আকাশ, তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি।
– ওকে স্যরি, ঠিক আছে যেদিন আমি তোমার মনে ভালবাসার অনুভুতি
জাগাতে পারব সেদিন বলবে তো?
নীলিমা খুব খুশি হয়ে বলে
— ঠিক আছে।
আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি যাতে সে আমায় একটু ভালোবাসে। অনেক চেষ্টা করি।
.
এভাবেই কেটে যায় একটি বছর। কিন্তু নীলিমার আচার আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। একজন প্রতারিত বিবাহিতা মেয়ের আচরন কেমন হবে তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। কিন্তু নীলিমাকে দেখে বোঝাই যায়না সে বিবাহিতা ছিল। আমার মনে হয় নীলিমার অন্য কোন সমস্যা আছে। তবুও আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনা। কারন ও ভাববে আমি ওকে সন্দেহ করছি। সন্দেহ যে একেবারেই করছিনা তা কিন্তু নয়। কিছুটা হলেও সন্দেহ করতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু ওকে বুঝতে দিইনা। ওর বাবা মায়ের কথা
জিজ্ঞেস করি।
– আচ্ছা তোমার পরিবারে কে কে আছে?
নীলিমা কোন কথা না বলে মন খারাপ করে বসে আছে। আমি আবার বললাম
– কি হল? বল।
— কেন?
– আরে মাকে তোমার কথা বলেছি। তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হবেনা?
নীলিমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। এমন করে আগে কখনো তাকায়নি। তারপর মুখ নিচু করে বলছে
— একটা কথা বলব?
– বল।
— একটা বার জড়িয়ে ধরি?
– কাকে?
— আকাশকে।
আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে যাই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি
পেরেছি। নীলিমার মনে ভালবাসা জাগাতে পেরেছি। ওকে জড়িয়ে ধরে
আমার বুকে চেপে রাখি। কিন্তু কিছুক্ষন পর সে আমায় ছেড়ে দেয়। আবার মন রাপ করে বসে রইল। জিজ্ঞেস করলাম
– কি হল?
নীলিমা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। হঠাৎ তার এই কান্নায় আমি চমকে যাই। তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম
– কাঁদছ কেন? কি হল বলবে তো?
নীলিমা কান্না থামিয়ে বলে
— আমার বাবা মা নেই। প্রায় ৫ বছর আগে এক্সিডেণ্ট এ মারা যায়। সেই থেকে খালার বাসায় থাকি। খালার পরিবারে আমার এত গুরুত্ব নেই।
– তাহলে কি তোমার খালার কাছে প্রস্তাব পাঠাব।
— পাঠাতে পারো।
– তোমার খালা রাজি না হলে?
— হয়ে যাবে।
.
তারপর আর কি। মাকে তো আগেই বলেছি নীলিমার কথা। কিন্তু ওর আগের বিয়ের কথা বলিনি। বললে মা জীবনেও রাজি হতনা। বাবা মা গেল নীলিমার খালার বাসায়। ওখানে কোন সমস্যা হয়না। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে যায়। শুধু একটা জিনিসই অন্যরকম লাগল। নীলিমা বলল ওর বাবা মা আরো ৫ বছর আগে মারা গেছে। কিন্তু ওর খালা বলল মাত্র দেড় বছর আগে।আমার আর নীলিমার পরিচয়েরও দেড় বছর চলছে। এটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না। কারন নীলিমা আমায় একটা শর্ত দিয়ে বসে আছে। শর্তটা কিছুটা এরকম। বিয়ের আগে তার সাথে কোন যোগাযোগ করা যাবেনা। না ফোন, না দেখা, না কথা। কি জ্বালায় পড়লাম রে বাবা। কি আর করা। হাতে হারিকেন নিয়ে অপেক্ষা করছি আমার বিয়ের জন্য।
.
অবশেষে এল সেই বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত দিন। সারাদিনের এত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও নীলিমার সাথে দেখা করতে চাইলাম। কিন্তু ও করলনা। জানিনা কোন ভুতে পাইছে ওরে। তারপর এল আমার বাসর রাত। ইচ্ছে করেই দেরিতে ঢুকলাম। ও যে বিবাহিতা ছিল সেটা নিয়ে একটু একটু দুঃখ রয়ে গেছে মনে। কিন্তু এত বড় সত্যি যে আমার সামনে অপেক্ষা করবে আমি কখনো কল্পনাও করিনি। আমি ঘরে ঢুকলাম। নীলিমা আমায় দেখে খাট থেকে নামল। আমি তো ভেবেছি আমায় সালাম করার জন্য নেমেছে। কিন্তু না। সে মেঝে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করব তার আগেই নীলিমা বলছে
— আজ আমাদের খুশির দিন। আর এই দিনটির জন্য আমি একটু একটু করে তোমার জন্য ভালবাসা সাজিয়ে রেখেছি।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। নীলিমা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে
— আকাশ তোমাকে আমি বলেছিলাম যে, ৫ বছর আগে আমার বাবা মা
মারা গেছে। সেটা মিথ্যা ছিল। বাবা মায়ের এক্সিডেন্ট হয় প্রায় দেড় বছরের মত হবে। তোমার সাথে দেখা হবার অল্প কিছু দিন আগে। বাবা মা মারা যাবার পর আমি খালার বাসায় থাকি। তোমাকে তো বললামই সেই পরিবারে আমার তেমন কদর নেই। ঘরে বসে বসে আমি বোর হয়ে যেতাম। তাই মাঝে মাঝে বিকেল বেলায় ঐ খোলা জায়গায় গিয়ে বসতাম। সেখানেই তো তোমার সাথে দেখা হয়। তুমি যখন আমাকে তোমার অনুভুতি জানালে তখন খুব সহজে মানতে পারিনি। তাই তোমায় পরীক্ষা করার জন্য বলেছি আমি বিবাহিতা। এটা ছিল মিথ্যা। দেখলাম এটা শুনে তুমি আমায় ভালোবাস নাকি
চলে যাও। কিন্তু তুমি চলে যাওনি। অবশেষে আমি বুঝতে পারি। তুমি আমায় সত্যি সত্যিই ভালোবাসো। তাই আমাকে ছেড়ে যাওনি। আমাকে আগলে আগলে রেখেছ। আমি কিন্তু তোমায় তখন ভালবাসতাম কিন্তু প্রকাশ করিনি। মন খারাপ করে থাকতাম যাতে তুমি বুঝতে পারো আমি আসলেই বিবাহিতা।কিন্তু তুমি তখনও আমায় ছেড়ে যাওনি। তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমায় ঘিরে রেখেছ। কিন্তু বাবা মায়ের কথা মনে পড়লে খুব কান্না পেত। আর তুমি আমার কান্না দেখে ভাবতে আমি বুঝি আমার পূর্ব প্রেমিকের কথা ভেবে কাঁদছি। আসলে তা না। বাবা মায়ের জন্যেই কাঁদতাম। ছোটবেলা থেকে
বাবা মায়ের আদরে আদরে বড় হয়েছি। আমার জন্য ওদের ভালবাসার কমতি ছিলনা। কিন্তু ওরা চলে যাবার পর আমি নিঃস্ব হয়ে পড়ি। তখন আল্লাহ আমার কাছে তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে। আর এত ভালবাসা আমার কপালে লিখেছে। আমি এর জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি। আর তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমায় এত ভালবাসা উপহার দেয়ার জন্য। সেই থেকে একটু একটু করে তোমার জন্য ভালবাসা সাজিয়ে রাখি।কারন আমার প্রথম অনুভূতি তুমি। তুমি আমার স্বামী। আজ তোমার ভালবাসার প্রতিদান দেব। সেই প্রতিদান যদি আমার জীবন দিয়ে দিতে হয় আমি তাই দেব। তবু প্লীজ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার সাথে মিথ্যা
বলেছি আমি। বিশাল অগ্নীপরীক্ষায় ফেলেছি তোমায়। রাগ করোনা প্লীজ।
.
এটুকুতেই ওর শেষ করল। আমার চোখ চিকচিক করছে। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ও আমার বুকে মুখ লুকায়। আমায় জিজ্ঞেস করে
— আচ্ছা এতকিছু জানার পরেও আমায় বিয়ে করলে কেন?
– মায়ার ঘোরে পড়েছি তাই।
তারপর দুজনেই চুপ। হঠাৎ করেই ও আমায় ছেড়ে দেয়। বলে
— এই তুমি আবার বাইরে যাও। তারপর আবার ঘরে ঢুকবা তারপর তোমায় সালাম করব। তারপর তুমি কোলে করে আমায় খাটে নিয়ে যাবে। আমি ঘোমটা দিয়ে বসে থাকব। তুমি ঘোমটা তুলবা আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাব। তারপর…….
ওকে আর বলতে দিলাম না। আমি ওর মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলি
– ইশশশ……চুপ। তারপরের টা আমি জানি।
ও লজ্জায় লাল হয়ে বলল
— ঠিক আছে এবার বাইরে যাও।
কি আর করব। আবার বাইরে যাচ্ছি। এবার স্বামীর মুড নিয়ে ঢুকতে হবে বউয়ের ঘরে। সবাই দোয়া করবেন।(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত