আকাশটা হালকা মেঘলা, তবে সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোর জন্যে তেমনটা বোঝা যাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার হাটা শুরু করল। উদ্দেশ্য কমলাপুর
ষ্টেশনের আফজাল চাচার দোকান। ওখানে গিয়া এক কাপ চা খেয়ে আবার হাটা শুরু করবে শিবু। এখন রাত ১২ টা বাজে। ঘড়ি ধরে ঠিক ১টা বাজে দোকান বন্ধ করে
আফজাল। এই লোকটার এই একটা রুটিন দেখে অবাক হয় শিবু। সকাল ৮ টায় দোকান খুলবে আর রাত ১ টায় বন্ধ করবে। ৮ টার ৫ মিনিট আগে কেউ যদি বলে কাকু
আপনার দোকান থেকে ৫শ টাকার সদায় কিনমু তাও দিবে না আবার রাত ১ টার পর কেউ হাজার টাকার সদায় কিনতে চাইলেও দিবে না। খুব কঠিন রুটিনের লোক
হলেও তার মন টা খুব নরম।
,
-এই যে মিষ্টার শিবু এই দিকে আসেন। (পুলিশ ইকবাল)
-ইকবাল সাহেব যে। (শিবু)
-হ্যা, তা এত রাতে কই যাচ্ছেন?
-কোথায় যাব তা তো নিদিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, তবে আগে আফজাল চাচার দোকানে ফ্রী চা খেতে যাব।
-ঘড়ীর দিকে দেখছেন কয়টা বাজে?
-হাতে ঘড়ি নাই দেখব কি করে। আপনিই বলেন?
-এখন ১২:২০ বাজে, আর ৪০ মিনিট পর আফজাল চাচার দোকান বন্ধ করবে।
-হ্যা এই জন্যেই তো তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছি।
-আচ্ছা সাবধানে যাবেন। আর হ্যা দেশের অবস্থা ভাল না একটু সতর্ক থাকবেন।
-আচ্ছা
,
হাটার গতি একটু বাড়িয়ে দিয়ে হাটা শুরু করল শিবু। যে করে হোক ১ টার আগে আফজাল চাচার দোকানে তার পৌছাতেই হবে। যে ভাবে হাটা শুরু করছে তাতে ১৫
মিনিট আগেই পৌঁছাবে। পুলিশ ইকবালের সাথে শিবুর পরিচয় অনেক দিনের। আফজাল চাচার দোকানে বসেই তাদের পরিচয় হয়। প্রায় তাদের দুই জনের দেখা হয়।
ইকবাল সাহেব একটু অন্য ধরনের লোক। বয়স্ক পুলিশ গুলা ইয়াং ছেলেদের দেখলে তুই তুকারি করে কথা বলে কিন্তু ইকবাল সাহেব তার বিপরীত। সবাই কে আপনি
করে কথা বলবে। বড়দের সন্মান আর ছোটদের খুব আদর করে। যা অন্য পুলিশদের ভিতরে খুব কম। অন্য সব পুলিশ ষ্টেশনের বাবুদের দুই চোখে দেখতে পারে না
কিন্তু ইকবাল সাহেব সে রকম না। মাঝে মাঝে নিজের টিফিন বাবুদের দিয়ে দেয় আর নিজে একটা রুটি আর চা খেয়ে সারা বেলা পার করে দেয়।
,
-কি আফজাল সাহেব কেমন আছেন?
-আরে শিবু সাহেব যে অনেক দিন পর।
-হ্যা অনেক দিন পর।
-চা খাইবা নি?
-হ্যা চা খাওয়ার জন্যেই তো আসলাম। এক কাপ চা চিনি আর দুধ বাড়িয়ে দিয়া বানান তো ।
-আচ্ছা আপনি বসেন। আমি বানাচ্ছি।
-তা আপনার বাড়ি ওয়ালি কেমন আছে?
-হুম ভালই আছে।
-হুম ভালই রাখেন। এই সময় কিন্তু ভারী কাজ করতে দেয়া যাবে না বুঝছেন আর ভাল ভাল খাবার খাওয়াবেন।
-আচ্ছা। এই নেন চা।
-আহা কি স্বাদ। আপনার চায়ের মত স্বাদ আর কোথাও পাই নি।
,
মুচকি হেসে দোকান বন্ধ করার জন্যে সব কিছু গোছাতে শুরু করল আফজাল সাহেব। চা খাওয়া শেষ করে আফজাল সাহেবের কাছে বিদায় নিয়ে আবার হাটা শুরু
করল। হঠাৎ তার পকেট থেকে একটা সু পরিচিত গান বেজে উঠল “এই পথ যদি শেষ না হয় তাহলে কেমন হবে বলতো ” এটা ছিল শিবুর মোবাইলের রিংটোন। পকেট
থেকে মোবাইল বের করে দেখে তিথির ফোন।
-হ্যালো।(শিবু)
-কই তুমি? (তিথি)
-এই তো কমলাপুর আছি।
-সারাক্ষন কি রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরলে হবে নাকি কিছু একটা করবা।
-চেষ্টায় আছি।
-আচ্ছা শুনো কাল টিএসসির মোড়ে দেখা করবা।
-আচ্ছা তাই করব।
,
তিথি কেবল মাত্র মাস্টার্স কমপ্লিট করছে। শিবুর সাথে তার খুব মিল। এক কথায় শিবুকে পছন্দ করে। শিবুকে বললেও সে না করে দেয়। কিন্তু মেয়েটা যত বার শিবুর
সাথে দেখা করতে চায়, শিবু না করে দেয়। হয়ত শিবুও মেয়েটাকে পছন্দ করে কিন্তু বলে না। এর কারন হয়ত অর্থ। অর্থ যেমন ধ্বংসের মূল তেমন সুখের স্বর্ন সিড়ি।
অর্থ ছাড়া এই যুগে কিছু করা যায় না আর শিবু সেই দিক থেকে অনেক পিছিয়ে তাই হয়ত তিথিকে এড়িয়ে চলে।
-কি শিবু মিয়া হাটা হাটি হচ্ছে বুঝি?
-হ্যা রাতে একা একা হাটতে ভালই লাগে।
-হ্যা তা তোমাকে দেখলেই বুঝা যায়।
-তা দিন কাল কেমন চলছে?
-আমাদের আর দিন কাল, আজ একটা খদ্দর পেলাম না, কি যে খাব। অনেক রাত হয়েছে আর কাউকে পাব বলে মনে হয় না।
-রাত তো অনেক হয়েছে। আর পাবে বলে আমার ও মনে হয় না। একটা কাজ করো?
– কি কাজ?
-এই নাও ১শ টাকা। বাজার করে খেয়ে নিও।
-নিব কিন্তু একটা শর্ত আছে।
-আবার কি শর্ত?
-পরে কিন্তু টাকা ফেরৎ নিতে হবে।
-আচ্ছা দিয়া দিও পরে আজ বাসায় চলে যাও।
,
কমলাপুর আর টিএসছির প্রত্যেকটা মানুষ থেকে শুরু করে কুত্তাও শিবুকে চিনে মনে হয়। মেয়েটা কাজ পেলে পেটে ভাত যায়, না পেলে নাই। মাঝে মাঝে শিবুর সাথে
তার দেখা হয়, আর কথাও হয়। তাদের একটা নীতি আছে সবাইকে তুই তুকারি করে কিন্তু এই মেয়েটা শিবুকে কখনো তুই করে সম্বোধন করে না। শিবুও তুমি করে
ডাকে, কখনো তার পেশা নিয়ে কথা বলে না। যে যার মত থাকে। তবে শিবু সব সময় সবার সাহায্য করার চেষ্টা করে। হাটতে হাটতে মেসে এসে পৌঁছালে। দারোয়ান চাচা
নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাকে নাকি পাহাড়া দেয়ার জন্যে রাখা হয়েছে এখন দেখি তাকে পাহাড়া দেয়ার জন্যে একজন রাখতে হবে। ওনাকে না ডেকে দেয়াল টপকিয়ে
ভিতরে গেলো শিবু। আজ নতুন না প্রায় সময় এমন করে ভিতরে যায়। এর জন্যে কয়েকবার বকাও খেয়েছে কিন্তু কি আর করার কারো এত সাধের ঘুম ভাঙতে কার মন
চায়। তাই না ডেকে ভিতরে চলে যায়।, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর ৪ টা বাজে। তাই আর অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়ল।
,
ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখল তিথির ফোন..
-কি এখনো ঘুমাচ্ছো নিশ্চয়?
-হ্যা ঘুমাচ্ছি। কখন আসবে।
-১০ টায় আসব। তুমি কিন্তু একটুও লেট করবা না।
-আচ্ছা করব না।
-হুম এখন উঠো তারপর ফ্রেশ হয়ে বের হও।
-আচ্ছা।
,
ফোন কেটে দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল শিবু
ছুটির দিনেও শান্তি মত ঘুমােতে পারব না, খালি ফোনের উপরে ফোন। ধুর আর ভাল লাগে না। বিছানা ছেরে ফ্রেশ হয়ে কালো শার্ট টা গায়ে দিয়ে রুমে টাঙানো বিশাল
আকৃতির ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ৯ টা বাজে। এখন রওনা দিল টিএসছির দিকে। গেটে এসে দেখে রাতের চাচাই গেটে আছে। সাধারণত রাতে যে থাকে, দিনে তার থাকার
কথা না কিন্তু ওনি কেনো।
,
-চাচা কেমন আছেন? (শিবু)
-ভাল বাবা। তুমি? (দারোয়ান)
-এই তো আছি। তা চাচা আজ বাসায় যান নি?
-না বাবা এখন যার ডিউটি তার মা নাকি অসুস্থ তাই আমি করতেছি।
-ও আচ্ছা। তা চাচা রাতে যে ভাবে ঘুমান আপনাকে দেখাশুনার জন্যে আরেক জন লোক দরকার।
,
শিবুর কথা শুনে দারোয়ান চাচা চুপ করে আছেন। কি উত্তর দিবে বুঝতেছে না। দারোয়ান চাচার উত্তরের অপেক্ষা না করে গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো। মেস থেকে ৫
মিনিট হেটে গেলেই মেইন রোড। রোডে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে শিবু। আজকে গাড়িতে ততটা ভিড় নেই। গাড়িতে উঠে একটা মেয়ে পাশে সিট পেলো। কিছু না ভেবে
বসে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন পর লক্ষ করল মেয়েটা কান্না করছে। নিঃশব্দ কান্না কিন্তু চোখ দিয়ে বন্যে বয়ে যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে চোখের জল মুছছেন, অন্য হাত দিয়ে
মোবাইল টিপছে। মনে হয় বয়ফ্রেন্ডের সাথে সাময়িক ব্রেকআপ হয়ে ফেসবুক থেকে ব্লক দিয়েছে তাই কান্না করছে। কি অদ্ভুত তাই না, আজ কাল ব্রেকআপ হলেই
ব্লক করে দেয়। ফোন নাম্বার ব্লক লিষ্টে, ফেসবুকে ব্লক। বাহ বর্তমান রিলেশনগুলা ব্লকময় খালি ব্লক আর ব্লক। টিএসছিতে এসে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে সোজা তিথির
দেয়া লোকেশনে পৌঁছে গেলো শিবু।
,
-আজকেও ২৫ মিনিট লেট। (তিথি)
-কি করব বল এত জ্যামের মধ্যে দেরি হয়ে গেছে।(শিবু)
-হুম বুঝছি।
-কি জন্যে ডেকেছো।
-আব্বু আমার জন্যে ছেলে দেখেছে। বাইরে থাকে। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। কি করব এখন।
-রাজি হয়ে যাও। বাবা মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।
-কিন্তু শিবু আমি তো তোমাকে ভালবাসি।
-ভুলে যাও আমাকে আর আমি তো তোমাকে ভালবাসি না। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।
-তার মানে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো।
-হ্যা। তুমি তোমার বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করো।
,
তিথির কোন কথা না শুনে আবার হাটা শুরু করল শিবু। তাকিয়ে আছে তিথি, তার মুখে যেন কোন কথা বের হচ্ছে না, শিবু এভাবে ফিরিয়ে দিবে কখনো কল্পনাও করতে
পারে নি। কিন্তু কি আর করার অর্থ যেখানে নেই ভালবাসা সেখানে মূল্যহীন। তাই শিবু আর তিথির ভালবাসা অসমাপ্ত থেকে গেলো।