ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো দীপ্ত। কিন্তু এই সময়ে তো মিঠির কোথাও যাওয়ার কথা নয়? একটু অবাক হলো। আর কোথাও গেলেও ওকে না
জানিয়ে তো যাবে না? কি এমন হলো? এসব ভাবতে ভাবতে ফ্রিজ থেকে জলের বটল টা আনতে গিয়ে চোখে পড়ল ওই yellow স্টিকি নোট। নোট টা নিয়ে
দেখলো তাতে লেখা। ” ভালো থেকো দীপ। আমি আসি” আর নিচে আজকের ডেট লেখা।
**************
মাথাটা ঘুরে গেলো যেন। সোফায় বসে পরলো দীপ্ত। একটাই প্রশ্ন উঠে এলো ওর মনে।
“মিঠি কোথায় তুমি?”
কিছুটা সময় পেরোলে দীপ্ত উঠে এসে ফোন টা নিল। ডায়াল করলো কয়েকটা নং। কিন্ত এর কোনোটাতেই সে মিঠিকে পাবে না সেটা জানতো। মিঠির
বাড়িতেও মিঠি যাবে না। মিঠির কোনো বন্ধু তেমন নেই। মিঠি বলতো ওর একমাত্র বন্ধু নাকি দীপ নিজেই। সত্যি তো সেই মিঠিই কিন্তু কিছুদিন ধরে একদম
পালটে গেছিল। কেমন জানি চুপচাপ থাকতো। পাহাড়িয়া ঝর্নার মত সারাদিন বয়ে চলা মেয়ে যেন অফিস থেকে দীপ্ত ফেরার পরেও নিজের একটা অন্য
পৃথিবী তৈরি করেছিল। বাড়ি ফিরে নিজের চা, জলখাবার হাতের কাছে পেয়েছে। বাকি সময় টিভি আর মোবাইল নিয়ে কাটিয়েছে। তখন তো সত্যি মনে
হয়নি মিঠির নীরবতা এক আসন্ন ঝড়ের সংকেত হতে পারে? আজ বুঝতে পারছে এই নীরবতা তাকে পাগল করে দেবে। কোথায় যাবে? কী করবে কিছুই
জানেনা দীপ্ত। হ্যাঁ মিঠিকে ঘিরে তার সমস্ত স্বপ্ন ছিল।একটা একটা করে সেই স্বপ্নের রাজপ্রাসাদের ইমারত তৈরি করতে ব্যাস্ত ছিল দীপ্ত। এখন মনে হয়
কখন যেন ওদের দুজনের স্বপ্ন ধীরেধীরে ওর একার হয়ে উঠেছিল কী?
***********
সব কিছুই ঠিক ছিল যেমনটা থাকার কথা। দুজন ভালো লাগার মানুষ। বহুবছরের একসাথে থাকা, আরো অনেকগুলো বছর একসাথে থাকার পরিকল্পনা
আর প্রতিশ্রুতি। পরিকল্পনা আস্তে আস্তে জমা হচ্ছিল bank account আর প্রতিশ্রুতি গুলো কেমন জানি ধীরে ধীরে নিজের কাছেই কমজোরি শোনাচ্ছিল
কি?
প্রতিনিয়ত চলতে থাকলো এই টানাপোড়েন, দীপ্ত ব্যাস্ত নিজের মিটিং, প্রেজেন্টেশন আর দেশেবিদেশে ট্যুর নিয়ে। অবশ্য সেটাই তো জীবন যুদ্ধ। কিন্তু সেই
শত ব্যাস্ততার মাঝে এক চিলতে বৃষ্টির মত স্নিগ্ধতা ছিল তার মিঠি।
তিলোত্তমা কলকাতা, রোজ নতুন রং এ সেজে ওঠে। ভোরের সোনালী রঙ মেখে জেগে ওঠা শহরের চেয়েও আগে শুরু হয় দীপ্তর দিন। মাঝে মাঝে প্রেশার
টা একটু বেশি হয়ে যায়। মিঠি তো আগে কপট রাগ দেখিয়ে বলতো আমি একটা ব্যাগ প্যাক করেই রাখবো। তোমায় এয়ারপোর্টে গিয়ে দিয়ে আসবো। বাড়ি
ফেরার আর দরকার কি? সত্যি হল্ট স্টেশন এর মতো বাড়ি আসে সে মাঝে মাঝে। কিন্তু এতসব ব্যাস্ততার মাঝে ধীরেধীরে কি তবে পেরিয়ে এসেছে
অনেকটা পথ। না মিঠিকে জিজ্ঞেস করা হয়নি তো কোনোদিন, সে ক্লান্ত কিনা? মনের কি তবে ক্লান্তি আসেনা? অথচ সব তো মনে হয়েছে পারফেক্ট।
Jigsaw puzzle এর মতো প্রতিটা ব্লক নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে পেরেছে সে। আজ তবে কেন সব এলোমেলো?
***********
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল দীপ্ত। চোখ বুজে এলো ক্লান্তিতে। এখনই তো মিঠি এক কাপ চা নিয়ে পাশে এসে বসতো। চায়ের আমেজে
দূর হতো ক্লান্তি। মাঝে মাঝে গল্প করতো। বলে যেত নিজের কথা। সারাদিন কি ভাবে কাটলো তার? কত জমানো কথা। নিজের অফিস, বাড়ি, রাস্তাঘাটের
কত গল্প। আলতো হাতে মাথা টিপে দিতে দিতে ঝর্ণার মতো আগল খুলে দিত মিঠি। শুনতে শুনতে কতদিন ঘুমিয়ে পরতো।
কোথায় গেলে আজ তবে? কেন একবারো বললে না মনের কথা গুলো? কেন ঘুম থেকে ডেকে তুলে শোনালে না শেষ না হওয়া জমানো কথাগুলো? এতই
যদি ভালোবাসতে কেন অধিকার নিয়ে রাগ করলে না? কেন জড়িয়ে ধরে বললে না একদিন, আজ তোমার কাজ থাক, সারাদিন দুজনে শুধু গল্প করি এসো?
************
মাঝে মাঝে অবসর সময়ে লেখা লেখি করতো মিঠি। প্রথম প্রথম একমাত্র শ্রোতা হিসেবে প্রায় জোর করে শোনাতো সেইসব। পরে যখন দেখলো রীতিমত
হাই তুলে সে সব শুনছে ডায়রি লেখাই বন্ধ করেছিলো। কেন একবারো মনে হয়নি জিজ্ঞেস করার কথা।
“আজ নতুন কিছু লেখোনি মিঠি?” বরং কোথায় যেন মনে হয়েছিল এই বেশ ভালো আছি। বাড়ি ফিরে একটু Clash Of Clan is always better than a
poetry.
***********
হাতে ধরা স্টিকি নোটটার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল দীপ্ত। বারবার এক লেখা চোখের সামনে ভেসে রইল ” ভালো থেকো দীপ, আমি আসি” নিচে
আজকের ডেট দেওয়া।
হটাৎ যেন বিদ্যুৎ চমকে গেলো দীপ্তর মনে। আজকের এই ডেট। আচ্ছা আজকের দিনের স্পেশাল কি? আজকেই তো মিঠি আর ওর Love anniversary।
এক নিমেষে পিছিয়ে গেলো বেশ কিছু বছর। বিয়ের আগে ৮ বছর কোর্টশিপ করে বিয়ে করে ওরা। এই দিনটা তখন অদ্ভুত অনুভূতি আনতো দুজনের
মনেই। এখন মনে হয় সে সব ছেলেমানুষি ছিল। বিয়ের পর marriage anniversary তেই প্রতিবার কাছে থাকা হয়নি কাজের চাপে। এই ডেট টা তো কবে
ভুলে গেছে। তবে কি ইচ্ছে করেই আজকের দিনটা বেছে নিলো মিঠি।
দুজনেই দুজনকে পছন্দ করলেও কেও কাওকে প্রোপোজ করেনি। মিঠি এক বান্ধবীকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল দীপ্তকে তার মনের অনুভূতির কথা। সেই
নিয়ে আজো মজা করে দীপ্ত। তারপর আজকের দিনে প্রথম একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় দুজন দেখা করেছিল। দুজনেরই অল্প বয়স। ভাগ করে নিয়েছিলো
নিজেদের অনুভূতি। তারপর একসাথে কত পথ হাঁটার দিন ছিল। ছিল স্বপ্নের জাল বোনা। সব কিছুতে পাশে থেকেছে মিঠি। মাঝে মাঝে রাগ হলে বলতো
দেখো একদিন সব ছেড়ে চলে যাবো। হাঁসতে হাঁসতে জিজ্ঞেস করতো দীপ্ত। “কোথায় যাবে?” মিঠি বলতো “দিকশূন্যপুর”
তবে কি হারিয়ে গেছে তার মিঠি দিকশূন্যপুরে? না, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে সে।
***********
উফ এই সময়টা এত জ্যাম হয় এইদিকে। ভালো লাগে না। তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
সত্যি কি সময় পেরিয়ে যাচ্ছে? শহরের বুকে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ। অনেকবার পথ চলতি পেরিয়ে গেছে আনমনে। আজ যে তাকে সময়ের আগে
পৌঁছাতেই হবে। যদিও জানেনে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য?একরাশ ফাগুন হাওয়া না, একমুঠো হতাশা? কিন্তু পৌঁছাতেই হবে। দিকশূন্যপুরের রাস্তায়
হারিয়ে যেতে দেবেনা তার মিঠিকে।
**********
কোনোরকমে গাড়ি পার্ক করে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো দীপ্ত। রেস্তোরাঁর সকলে বেশ অবাক চোখে ফিরে তাকালো তার দিকে। উদভ্রান্তের মতো তার চোখ খুঁজে
চলেছে একটাই মুখ।
না ,নেই। তার মিঠি এখানে নেই। মনে হচ্ছে যেন কেও নেই তার সামনে, এক অপরিসীম অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ওর পৃথিবী……
এমন সময়ে হটাৎ….
_” আপনি কি Mr. Dipto Ray?
“আপনার জন্য ওপরের কেবিনে ম্যাডাম অপেক্ষা করছেন।” একজন waiter এর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলো দীপ্ত।
সত্যি কি তবে মিঠি আছে? অনেকদিন এখানে আসেনি তাই ওপরে extension হয়েছে লক্ষ্য করেনি দীপ্ত।
হুড়মুড় করে ওপরে উঠে এলো সে।
দীপ্তর গিফট করা একটা আসমানি নীল শাড়ি পরে বসে আছে তার মিঠি। না কোথাও যায়নি। আর কোনোদিন কোথাও যেতে দেবে না তাকে।
_”তাড়াতাড়ি এসো। এবার খাবার ওর্ডার না করলে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে আমায়।” মিষ্টি হেঁসে মিঠি বলে উঠলো।
স্টার্টারে one crispy chicken in mustard sauce, one stir fried tofu rice, one mixed schezwan noodles, অ্যান্ড two virgin mojito. বাকি লাগলে পরে
বলছি।
হ্যাপি Love Anniversary Dip.
হাল্কা হাওয়ায় তখন গান ভেসে আসছে।
………………………..
…………………………………….
…………………………………………….
…………………………………………………….
ডিনার সেরে বাড়ি ফিরলো ওরা। আরো একবার বিশ্বাস আর ভালোবাসা হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেলো কিছুটা পথ। ডিনার টেবিলে মেনুকার্ডের নিচে চাপা
রইলো waiter
এর জন্য দীপ্তর রেখে আসা tips.
আর তার সাথে দীপ্তর অজান্তে মিঠির রেখে আসা একটা ট্রেনের টিকিট। স্টেশনের নাম তাতে দিকশূন্যপুর কিনা জানা নেই ,তবে তাতে লেখা ছিল।
रिश्ते और रास्ते तब खत्म हो जाते हैं, जब पांव नहीं दिल थक जाते हैं!..