দিন গুলো কেমন অলস হয়ে গেছে। সময় যেন কাটে না। বড় একা একা লাগে নিজেকে এই ব্যাস্ত জগৎটার মাঝে। মনের মধ্যে খেয়াল আসে এই বুঝি আছি এই বুঝি নেই। আজ আমার দিকে ফিরে তাকানোর কারো সময় নেই। অথচ আমিও তো তাদের মতই ছিলাম। অন্যকে দোষ দিয়ে কি হবে। সবই বয়সের দোষ। বয়স তো আর দেখতে দেখতে কম হল না। সামনের আশ্বিনে আটাত্তর এ পরবে। একটা সময় ছিল যখন আমিও চঞ্চল ছিলাম। দুরন্তপনায় মেতে উঠতাম। বারান্দায় রেকি চেয়ারটায় বসে যখন বিকেলে চা খাই তখন দূরে ছোট ছোট ছেলেদের দেখতে পাই। কখনও মারা মারি আবার কখনও ছুটাছুটি করছে। তাদের দেখলে আবার সেই শৈশবে ফিরে যেতে মন চায়। মাঝে মাঝে ভাবনা আসে মানুষ কেন জন্মে কেন বড় হয়। আর কেনইবা সময়ের তাগিদে অচল হয়ে পরে। কোন উত্তর খুজে পাইনা। কত ভাবনা কত কথার ফাক দিয়ে কোন এক সময়ে ঠিক রেণুকার কথা মাথায় চলে আসে। রেণুকা গত হয়েছে একুশ বছর হল। ছেলে মেয়ে গুলো আর দেশে থাকতে চায়নি। মেয়ে তার স্বামী সন্তান নিয়ে থাকে নিউজিল্যান্ডে। আর ছেলেটা থাকে কানাডায়। আমাকে অবশ্য নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু নিজ দেশ ছাড়তে মন চায় না। একবার তো জোড় করে নিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু ঐ সব সাদা চামড়ার লোকেদের মুখের ইংরেজি ভাষা বোধগম্য নয় বলে চলে এসেছি। এখন শুধু রেণুকার স্মৃতি আর নিয়ম মাফিক চলা ফেরা এতেই চলছে জীবন। তবে আজ মনটা কেমন জানি চঞ্চল হয়ে উঠছে। মন চাইছে ভেঙ্গে ফেলতে এই নিয়ম। নিয়মের বাইরে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। জগদীশকে ডাকার সাথে সাথে গামছা ঘাড়ে রামু চলে আসল। বলল,
>বড় সাহেব ডাকলেন… (রামু)
-উফফ রামু তোকে না কত বার বলেছি বড় সাহেব বড় সাহেব বলবি না। সাহেব ওসব ইংরেজদের মানায়। আমাকে দাদা বলিশ। (আমি)
>আচ্ছা দাদা। এখন বলেন চা দেব আপনাকে…
-না আজ আর চা টা খাব না। শোন আমি আজ একটু বাইরে যাব। বুঝলি তুই বাড়িতে থাক…
>সে কি গো দাদা। আপনার শরীরের এই অবস্থা আর আপনি বাইরে যাবেন। ডাক্তার না বলেছে আপনাকে বিশ্রাম নিতে আর আপনি বাইরে যাবেন…
-আরে রাখ তো তোর ডাক্তার। ঐ রকম আট দশটা ডাক্তারকে আমি আমার পকেটে রাখি।
>বড় সাহেব যাবেন না কিন্তু বাইরে…
-এই চুপ একটা কথা বলবি না। আমাকে কি তোর কথামত চলতে হবে নাকি…
>কি বড় সাহেব, যদি ছোট দাদাবাবু শোনে এই কথা তবে…
-শোন যদি জয় এই কথা শোনে তবে তোর চাকরি নট করে দিব হুম। আমি বেরুলাম…
বলেই সামনের আম বাগানটার দিকে পা বাড়ালাম। আর রামু আমাকে পিছন থেকে অনুসরণ করবে তারও ব্যবস্থা করে দিলাম। যত বার বাইরে গিয়েছি ততবার রামু আমার পিছন পিছন এসেছি। তবে কখনও আমার সামনে আসে নি। বিকেলে এই বাগানটায় বেশ কয়েকজন বৃদ্ধকে দেখা যায়। কিন্তু সব চেয়ে বেশি দেখা যায় যুবোক যুবতীদের। আর কেন সেটা তো সবারই জানা। আমি ঐ বয়সে এমনটাই ছিলাম। আম বাগানে বসেছিলাম। কোথা থেকে যেন একটা মেয়ে এসে আমার বসা বেঞ্চটাতে বসল। একটু অবাক হয়েছিলাম। ঐ সময়ে মেয়েরা ঘরের বাইরে বের হত না। অথচ মেয়েটা আমার পাশে এসে বসেছে। তারপর পরিচয় আর শেষে জীবন সঙ্গী হল সেই মেয়েটা। তারপর সংসার আর ক্যান্সার নামক রাক্ষস তাকে ছিনিয়ে নিল আমার কাছ থেকে। আজও সেই বেঞ্চটাতে এসে বসলাম। তবে আগের মত আর নেই। এখন আরো উন্নত। আর গাছ গুলো বেশ মোটা হয়েছে। চারিদিকটা দেখছি। গল্প করার মত কেউ নেই। দূরে রামু দাড়িয়ে আছে। ভাবছি রামুকে ডাকবো। কিন্তু হঠ্যাতি সেই দিনের মত কেউ একজন পাশে এসে বসল। ভূল বসতো বলে ফেললাম,
-রেণু আমি কতক্ষণ থেকে বসে আছি তোমার জন্য আর তোমার আসার এখন সময় হল… (আমি)
পাশে বসে থাকা মেয়েটি আমার আপাদমস্তক দেখে বলল,
>এখনও যৌবন ধরে রেখেছেন… (মেয়েটি)
কথা শুনে মেয়েটার দিকে ভাল ভাবে তাকালাম। আমার ভুল হয়েছে বুঝতে পারলাম মেয়েটা রেণুকা নয়। তবে তাকে মেয়ে বলা কতটা যৌক্তিক সেটাও বুঝতে পারছি না। বয়স মোটা মুটি ষাট বছর তো হবেই। চামড়া গুলোয় ভাজ পরেছে তবে স্বাস্থ্যবতী। যার জন্য মনে হচ্ছে পঞ্চাশ বছর বয়স তার। আধা পাকা চুল তার। চোখে চশমা শাড়ী পরিহিতা। যদিও এই বয়সে মহিলাদের দেখা ধর্মসঙ্গত নয় তবুও চোখ চলে যায়। মনে মনে ঢেউ খেলছে মাথায় যদিও বা চুলের অভাব তবুও রুপালি চুলগুলো হাত দিয়ে একবার ঠিক করে নিলাম। মহিলাটি মনে মনে হাসছে। আমারও যে হাসি পাচ্ছে না তা নয়। তবে লজ্জাও লাগছে। লজ্জা কাটিয়ে বললাম,
-আপনি কিন্তু রসিকতা করলেন আমার সাথে… (আমি)
>রসিকতা সেও আমি যাহ আমি রসিকতা করতে পারি নাকি…
-তাছাড়া আবার কি…আমার চামড়া ঝুলে পরেছে দাঁত গেছে পড়ে। আরো দুটো নড়বরে খুটির মত দাড়িয়ে আছে… আর আমি কিনা…
>তাতে কি হয়েছে মনটা তো আর কুচকে যায়নি। মনে মনে কত কথা আসে যায় তার কি খোজ রাখেন কখনও…
-সে খোজ রেখে কি হবে। একাকিত্বের মাঝে সব কথা বাসি হয়ে গেছে।
>আচ্ছা তাই।
-হুম। আপনার কখনও একাকিত্ব বোধ হয় না…
>না কখনই না।
-কিন্তু কেন…
>এই যে আপনি আছেন।
-মানে
>উফফ আপনি বড্ড মানে মানে করেন
-না বুঝলে বলবো না…
>আপনি নিশ্চই হেড মাস্টার ছিলেন…
-সেটা কি করে বুঝলেন…
>আপনার কথা শুনলেই বোঝা যায়। বড্ড মানে মানে করা লোক মশাই আপনি।
-রেগে গেলেন…
>না আমি রাগ করি না। আর রাগ করলেই বা কি আপনি তো আর রাগ ভাঙ্গাবেন না…
-কেন আমাকেই ভাঙ্গাতে হবে কেন…
>বাদ দেন। আপনাকে তো কখনও দেখিনি এখানে…
-হুম আমিও তো আপনাকে দেখিনি।
>ওও আপনি কি এখানে নতুন…
-না সাতাশ বছর ধরে আছি। আগে আসতাম কিন্তু এখন আর আসি না।
>কেন…
-সঙ্গীহীন ভাবে চলতে ইচ্ছে করে না।
>ওহ্ তাতে কি হয়েছে এখানে আসলেই তো রোজ সঙ্গী পাওয়া যায়…
-একাকিত্বে অভাস হয়ে গেছে। তাই আর সঙ্গী খোজে না মন। সে কথা যাক এবার আপনার সর্ম্পকে বলুন…
>আমার আর কি বলব
-কি আবার আপনার স্বামী সন্তান নাতি নাতনি…
>হা হা হা
-হাসছেন যে,
>স্বামী মারা গেছে বিয়ের দিন। লোকে অপয়া বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাপের বাড়িতেও ঠাই হয়নি। তারপর এই শহরে এসেছি। আর আত্ননির্ভশীল হয়েছি।
-ওও… আর বিয়ে করেন নি…
>হা হা আপনার মত কাউকে পাইনি তো তাই আর বিয়ে করা হয়নি…
-এবার সত্যিই হাসি পাচ্ছে আমার…
>তবে হাসুন
-হুম। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে আপনি কিন্তু এখনও অনেক সুন্দর…
>আগে দেখেছিলেন আমায়…
-না মানে এখন যেরকম সু্ন্দর। আগে নিশ্চই সুন্দর ছিলেন… এই বয়সেও আপনাকে কোন যুবক ছেলে দেখে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
>তা আপনি দেবেন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব…
-কবে মিষ্টি নিয়ে যাবো…
>আপনার যেদিন ইচ্ছা…
-যদি এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে যাই…
>এই বয়সেও এত রোমান্টিকতা…
-এবার কিন্তু লজ্জায় ফেললেন…
>হয়েছে হয়েছে…তাই যদি হতাম তাহলে এক কাপ চা অন্তত অফার করতে পারতেন…
-ও এই কথা। চলেন চ খেয়ে আসি…
>চলেন…
-আপনি কিন্তু আমার মনে ঝড় তুলে দিলেন
>আচ্ছা তাই…
-হুম
>তা কিসের ঝড় বালু ঝড় না ঘূর্ণি ঝড়…
-প্রেমের ঝড়
>হা হা তাই…
-হুম
>আপনার রেণুকা যদি জানে…
-আপনার মাঝে খুজে নিব তাকে…
>বাব্বা ভালই কথা জানেন।
-চলেন দুজনে হারিয়ে যাই অজানায়…
>বুড়ো বয়সে ভীমরতী।
-তা না হয় একটু হল
চা খেতে খেতে অনেক কথাই হল। র্সূয লাল হলে তিনি চলে গেলেন এক রাশ হাসি নিয়ে। আমিও মনে মনে হাসলাম। ফিরে আসার পথে সেই আম গাছটার সামনে দাড়িয়ে পরলাম। যেখানটায় লেখা আছে আমার আর রেণুকার নাম। লেখাটা তখন ছোট লিখেছিলাম। কিন্তু এখন বড় হয়ে গেছে। মনে মনে সেই সব দিনের স্মৃতি জেগে উঠছে। সত্যিই মহিলাটি অদ্ভত। সব সময় রসিকতায় মেতে থাকে। কিন্তু আমার জীবন তো তার মতন নয়। জানিনা আবার কবে হবে তার সাথে দেখা। চার পাশ জুড়ে শুধু নিঃসঙ্গতা।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা