— এভাবে বসে আছো কেন?(শুভ্র)
—-এমনি।কিছু লাগবে তোমার?
—-না।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।বসে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম।চৈত্রের মাঝামাঝি সময়। বৃষ্টি হলে আমি কেমন যেন আন মনে হয়ে যাই। হয়তো বৃষ্টি মনের কষ্ট ছুঁয়ে দিতে পারে।শুভ্রের কথায় ধ্যান ভাঙল।
ওহ আমার পরিচয় দিতে ভুলে গেছি।
আমি মেঘলা।শুভ্র আমার বিয়ে করা জামাই। হিহিহি আজিব লাগছে তাইনা? আমি এরকম ই। ডানা মেলে ইচ্ছে মত উড়া পাখি যেমন।তবে এখন অনেকটা ঘুটিয়ে গেছি। শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি না হয়ে প্রজাপতি থেকে শুয়োপোকা হয়ে যাচ্ছি।
*
*
—- এক কাপ কফি হলে ভাল হতো।(শুভ্র)
শুভ্র যে কখন আবার এসেছে টের পাইনি।ওনি আমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা।
–
–
–
–
কয়েক মাস আগে
আমার জীবনটা ছিল অন্যরকম।
পড়াশোনা শেষ করেছি।টিউশনি করতাম তিনটে।চাকরির জন্য এপ্লাই করছিলাম কয়েকটা।হয়েও যেন হচ্ছিলনা।পরিবারের বড় মেয়ে বা ছেলের ওপর সবার আশা থাকে।মাথায় তখন একটাই চিন্তা “চাকরি”। দু একটা সম্মন্ধও এসেছিল।তবে কনে দেখার পর সেগুলো আর আগায় নি।কেননা আমি শ্যাম বর্ণের এবং আমার জন্মগত কিছু সমস্যাও আছে। আমি জানতাম এমনটি হওয়ার। তাই বিয়ের স্বপ্ন দেখিনি।স্বপ্ন ভাঙগার চেয়ে স্বপ্ন না দেখাই উত্তম।সবসময় মাথায় আসত কিছু একটা করতে হবে।পরিবারের হাল ধরতে হবে।ভাই বোনের স্বপ্ন পূরন করতে হবে।
–
–
–
দুপুরের দিকে টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরব বলে যাত্রী ছাউনিতে বসে আছি।অনেকক্ষন যাবত বসে আছি বাস আসার কোনো নাম গন্ধই নেই।হঠাৎ চোখ পড়ল একজন বয়স্ক লোক রাস্তায় বসে কি যেন খুজছেন।উনি এমনভাবে রাস্তায় আছেন যেকোনও মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।রাস্তার এ পাশে আর মানুষ ও নেই।দুপুর বেলা যে যার কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত।
উনার কাছে গিয়ে জানতে পারলাম তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পেরুতে গিয়ে চশমাটা পড়ে গেছে।আর উনি চশমা ছাড়া এক কদম ও চলতে পারেননা।
চারপাশ খুজতেই দেখলাম তিন থেকে চার হাত দূরে পড়ে আছে চশমা টা।ঐ যে চশমাটা……
এইযা একটা সিএনজি হুট করে এসে দিল চশমাটার বারটা বাজিয়ে।তাও ওটা কুড়িয়ে আনলাম।
—– আঙ্কেল চশমাটা আর চশমা নেই।একে ফ্রেম বলা যেতে পারে।
—— কাচ ভেঙ্গে গেছে নাকি মা?
—– জ্বি।
—–ও।
লোকটার মুখে হতাশার ছাপ ফুটে ওঠল।আমি আবার দয়ার সাগর কাউকে বিপদে দেখে চোখ বুজে চলে যেতে পারিনা।
—— আঙ্কেল আপনার বাসা কোথায়?
—-উনি ঠিকানাটা বললেন।বাজার করতে আর ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন এটাও বললেন।
চশমা সারিয়ে বাজার করে বাড়ি পৌছিয়ে দেওয়ার মত সময় আমার হাতে নেই।টিউশনি আছে আবার বিকেলে।হাতে আছে ঘন্টা তিনেক।বাজার করে বাড়ি পৌছাই দেওয়া যায়।চশমা টা উনার বাড়ির লোকেরা ঠিক করাবে নাহয়।
উনাকে নিয়ে প্রথমে গেলাম ফার্মেসিতে।মায়ের ওষুধ কিনলাম আর উনাকে প্রেসক্রিপশন দিতে বললাম।উনার ওষুধও কিনা হল।তারপর গেলাম বাজারে।উনার কথামত বাজার করলাম।
একটা রিক্সা নিয়ে উনার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
—-তুমি অনেক কষ্ট করলে মা।আমার জন্য তোমার অনেক সময় নষ্ট হল।
—- আরে না আঙ্কেল। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই কাজ করত।
— আমাদের সব কাজ আমার ছেলেই করত।ওর চাকরি হয়ে যাওয়াতে ঢাকা চলে গেছে।তাই আমাকেই বের হতে হয়।
—- আপনার আর ছেলে মেয়ে নেই?
—- আছে।এক মেয়ে।কলেজে পড়ে।তোমার বাসা কোথায় মা?
— উত্তর দিলাম।
— কে কে আছে বাসায়?
— মা বাবা,একটা ভাই আর একটি বোন আছে।
—- তুমি কি কর মা?
— এইতো আঙ্কেল পড়াশোনা শেষ করছি,চাকরি খুজতেছি,কিছু টিউশনি করাই।
— খুব ভাল।ধৈর্য ধর দেখবে চাকরি হয়ে যাবে।
— জ্বি।
উনাকে বাড়িতে পৌছাই দিলাম।উনার স্ত্রীর সাথে পরিচিত হলাম।নাস্তা করিয়ে তবেই ছাড়লেন।
আমি আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
–
–
–
–
এক সন্ধ্যায় বাবা আমাকে জানায় কাল টিউশনিতে না যেতে।পাত্রপক্ষ নাকি দেখতে আসবে।শুধু বললাম কি দরকার বাবা শুধু টাকা খরচ করার।বাবা কিছু না বলেই চলে গেল।
–
–
পরদিন পাত্রপক্ষের সামনে যখন নেওয়া হল তখন তো আমি অবাক।এতো সেই আঙ্কেল।আমাকে আরও অবাক করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
–
–
নির্ধারিত দিনে বিয়ে হয়ে গেল।বিয়ের রাতেই বুঝতে পারলাম আমাকে আমার বরের পছন্দ হয় নাই।সেই থেকেই এক ছাদের নিচে হাজার মাইল দুরত্ব সৃষ্টি হতে থাকল।কিন্তু আমার শ্বশুর শ্বাশুরি ননদ আমাকে খুব ভালবাসে।বিয়ের এক মাসের মাথায় আমাকে উনার সাথে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।এখানে এসে আমি ভীষণ একা হয়ে যাই।উনি সকালে অফিসে যান আর সন্ধ্যা ৭ টায় ফিরেন।আর ফিরলেই বা কি প্রয়োজন ছাড়া তো টু শব্দ ও করেন না।
–
–
–
খাবার দিয়েছি টেবিলে খেতে আসুন।
— হুম।
— আমার কিছু টাকা লাগবে।কিছু শপিং আছে একটু।
—-আমার ড্রয়ার থেকে নিয়ে নিবেন যখন লাগে।
—- হুম।
এই হচ্ছে আমাদের কথাবার্তা।আচ্ছা উনি কেন এমন করে।বিয়ের আগে বললেই হতো আমাকে পছন্দ না।এভাবে কি জীবন চলে? আমি যে একটু একটু করে উনারে ভালবেসে ফেলেছি।
–
–
–
—-হ্যালো।
—- হুম বল।(শুভ্র)
—-বলছিলাম আমার সাথে কি একটু মার্কেটে যেতে পারবেন।টুকটাক বাসার জিনিস কেনার আছে আর একা যেতে সাহস পাচ্ছিনা।
—- তুমি কচি খুকি না যে ভয় পাচ্ছ।এরকম আধিক্যেতা আমার একদম পছন্দ না।
বলেই ফোনটা রেখে দিল।মনটা খারাপ হয়ে গেল।ভেবেছিলাম অনিচ্ছা সত্তেও উনি আমার সাথে কিছুটা সময় থাকতেন।দূর কি ভাবলাম আর কি হল।অগত্যা রেডি হয়ে বের হলাম।
কেনাকাটা শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
একটা রিক্সাও পাচ্ছিনা।মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল ধ্যাত।
অবশেষে পাইলাম একখানা রিক্সা।তখন প্রায় ৭টা বেজে গেছে।এই সময় রিক্সায় চড়তে খুব ভাল লাগে।ইস উনি যদি আসতো।গাম্বাট একটা।আসলে কি এমন হত।
হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগে।তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে যাই।
–
–
–
–
চোখ খুলে দেখি উনি আমার পাশে বসা।বুঝতে পারলাম এটা হসপিটাল কেননা আর যাই হোক আমার বিছানা এত নরম না।।মা বাবা ও এসেছে।ডক্টরের সাথে কথা বলতে বাবা আর উনি চলে যান।
–
–
–
—- মা আমি এখানে কেমনে আসলাম আর তোমরা ঢাকায় আসলা কখন?
—- শুভ্র ফোন করে জানাল তুই এক্সিডেন্ট করছিস।রাতের ট্রেনে আসছি।
—-হুহ উনি জানল কেমনে।যেতে বললাম তখন তো আধিক্যেতা বলে ছিল।হুহ।(বিড়বিড় করে বললাম)
–
–
–
হসপিটালে আরও দুদিন থাকতে হল।ডক্টরের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমার কোমরের হাড়ে চোট লেগেছে।এক মাস সম্পূর্ণ বেড রেষ্ট নিতে হবে।
মা বাবা আরও ১০ দিন ছিল।উনারা চলে যাওয়ার পর উনি অফিস থেকে ছুটি নেয়।আমার সেবা করেন সারাদিন।পাঠকগন এখন বুঝছেন তো কেন বলছি বিয়ে করা জামাই।হিহিহিহি।
–
–
–
আজ আমি পুরোপুরি সুস্থ। শুভ্র একটু বাইরে গেছে।ওর নাকি কি দরকার।
–
–
–
—- মেঘলা,একটু ছাদে আসবা?
—-হুম আসতেছি।
—- এই প্যাকেট টা খুলে তারপর এসো আমি অপেক্ষা করতেছি।
—আচ্ছা।
প্যাকেট টা খুললাম।একটা শাড়ি আর একটা চিরকুট।তাতে লিখা ” শাড়িটা পড় আর কাজল দিবা চোখে,আমি কফি নিয়ে অপেক্ষা করতেছি”
চিরকুট টা পড়ে কিছুটা অবাক হলাম।শাড়িটা পড়ে কাজল দিয়ে ছাদে গেলাম।
ওমা এখানেতো উনি নেই।তবে অজস্র জোনাকি পোকা উড়ছে।এতো আমার স্বপ্নের পৃথিবী।
” হেপি বার্থডে মেঘলা”
পেছনে তাকিয়ে দেখি শুভ্র দাড়িয়ে আর হাতে একটা কেক। আমি নিজেই ভুলে গেছিলাম আজ আমার জন্মদিন যে।
—- মেনি মেনি হেপি রির্টান অফ দা ডে।
— থ্যাংক ইউ।
—- মাই প্লেজার মেম।এখন জলদি কেক টা কাটো তো।
কেক কেটে ওরে খাওয়ালাম।স্বপ্ন
ের মত লাগছে সব।
—- এইযে মেম আপনার কফি।এতক্ষণে হয়তো ঠান্ডা হয়ে গেছে।
—- চলবে।নো প্রব।
— মেঘলা আজকে তোমাকে কিছু কথা না বললেই নয়।
—- বল।
—- ঐদিন বাসায় ফিরে যখন দেখলাম তুমি ফিরনি মনে মনে চিন্তা হতে লাগল।ফোন দিলাম ফোন অফ।তাও মনকে সান্তনা দিলাম জ্যামে আটকেছো হয়তো।ফোনে চার্জ নেই।যখন দেখলাম ৮:৩০ বেজে গেছে তখন খুব ভয় পেয়ে গেলাম।তোমাকে হারানোর ভয়।নিজেকে দোষী মনে হতে লাগল।তোমার সাথে গেলে কি এমন হত।তোমাকে খুজতে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম।এ গলি ও গলি,অনেক জায়গায় খুজলাম কিন্তু পেলাম না।রাস্তায় বসে কাঁদতে শুরু করলাম।কি করব ভেবেই পাচ্ছিলামনা।
রাত ১০:৩০ এ একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে।জানায় সে হসপিটাল থেকে বলছে।একজন মহিলা এক্সিডেন্ট করছেন।উনার পার্সে একটা কাগজে আমার ঠিকানা আর নাম্বার পেয়েছে।বুঝতে বাকি রইলনা ঐ মহিলা কে?ছুটতে লাগলাম ঐ হসপিটালের ঠিকানায়।গিয়ে দেখি তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েগেছে।কিছুনা ভেবে তোমার বাবাকে কল দিয়ে জানালাম।ঐদিন টের পেয়েছি তোমাকে কতটা চাই আমার।আরও খারাপ লাগতো এই ভেবে যে এতদিন তোমায় অবহেলা করেছি।তুমি যে দুদিন হসপিটালে ছিলে বাসায় আসলে তোমায় খুব বেশি মিস করতাম।তারপর তোমাকে বাসায় আনা হল।আস্তে আস্তে তুমি সুস্থ হতে লাগলে।ততদিনে তুমি আমার মাঝে রাজত্ব শুরু করেছো।আমি তোমাকে ভালবাসি মেঘলা। তুমি কি আমার অপরাজিতা হবে?
—- কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছিলাম না।শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
—-দেখি তোমার পা টা দেখি?
—- পায়ে তো কোনো প্রব নেই এখন।পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি।
—- আমার মনে হয় আর কোনো কাজ নেই তোমার সেবা করা ছাড়া।পা আমার হাটুর ওপর রাখো।
— হুম।
ও আমার পায়ে একটা কাচের নূপুর পরিয়ে দিল।এইটাই আমার জীবনের সেরা দিন।শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।কখনও হারাতে দেবনা।ভালবাসি ভীষণ ভালবাসি।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা