অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। ঘড়ি দেখলাম। সন্ধ্যা সাতটা বাজে প্রায়। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যখন কমলকে ফোন করতে যাব, ঠিক তখনই দেখলাম কমল অফিস থেকে বের হয়ে আসছে। ওর সাথে কোনো কথা না বাড়িয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত রিকশা নিয়ে নিলাম। বর্ষাকাল যাই যাই করছে। সন্ধ্যার আকাশে হালকাভাবে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। কমল মূঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছি।
রিকশা এসে থামল হাসপাতালের সামনে। আমি ভাড়া দিতে গিয়েআবিষ্কারকরলাম, টাকা বের করতে যেয়ে আমার পার্স থেকে ঝনঝন করে গড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু কয়েন। কমল ব্যস্ত ভঙ্গিতে কয়েন তুলছে। কমলের কয়েন তোলার ব্যস্ততা দেখে কেন যেন আমার ওর প্রতি থাকা বিরক্তিভাব কমে গেল।
হাসপাতালে দীপার মাকে দেখতে এসেছি। দীপা, আমাদের বান্ধবী। গত দুদিন ধরে আন্টি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন। আমি বা কমল কেউই নানা সমস্যার কারণে হাসপাতালে আসতে পারি নি। আজ তাই দুজন একসাথে চলে এসেছি। হাসপাতালের সিঙ্গেল বেডে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে শুয়ে আছে দীপার মা। স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে উনাকে। বেডের পাশে চেয়ারে বসে নার্সের সাথে কথা বলছে দীপা। শ্যাওলা সবুজ তাঁতের জামা পরে আছে মেয়েটা, চোখে মুখে গত দু’দিনের ঝড় ঝঞ্জারছাপ স্পষ্ট। আমাদেরকে দেখেই দীপার ক্লান্ত চোখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আমি দীপাকে দেখে মুখ টিপে হাসি যেন এখুনি ওর সাথে খুব মজার কোন বিষয় নিয়ে গল্প শুরু করব, তারপর আন্টির দিতে তাকিয়ে একটা লম্বা সালাম ঠুকে বলি, এখন শরীর কেমন আন্টি? দীপার মা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়েন। তারপর চোখের ইশারায় আমাদেরকে বসতে বলেন। বেডের পাশে বসার চেয়ার মাত্র একটা, সেখানে দীপা বসে আছে। আমি কোনরকমে বেডের উপর পায়ের কাছে বসে পড়ি। দীপা উঠে গিয়ে কমলকে বসতে দিয়ে অভিযোগের সুরে বলে, আম্মার শরীর মোটেও ভাল নেই। একদম বিশ্বাস করিস না। এই ভদ্র মহিলা কিচ্ছু খায় না। অল্প একটু খাবার খাওয়াতেও আমার জান পানি হয়ে যায়। এমন করলে চলে? মেয়ের কথা শুনে দীপার মা বাচ্চাদের মত সরলভাবে হেসে ফেলেন।
কমল এক গাল হেসে বলে, আন্টি এত শুকাইসে কেমনে বুঝতে পারসি। আন্টি ভাগের সব খাবার দাবার তুই খেয়ে ফেলিস। এই জন্যেই আন্টি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন আর তুই মোটা হচ্ছিস।
– আম্মার ব্যাপারে সাফাই গাইবি না কমল। আম্মা কোন কথা শুনে না। ওষুধও খেতে চায় না ঠিক মতো।
– খেতে না চাইলে খাবে না। জোর করবি কেন তুই? মানুষের ওপর জোর করা ঠিক না। নিশ্চইয় সব বিস্বাদ খাবার আন্টিকে খেতে দেস, তাই উনি খান না।
– তুই কোন কথা বলবি না কমল। রোগী দেখতে আসছিস নাকি রোগীর বারোটা বাজাতে আসছিস?
– তোর তেরটা বাজাতে আসছি।
– চুপ থাক কোন কথা বলবি না।
– আমি চুপ থাকলে তুইও চুপ থাকবি। আন্টির খাবার খাবি না, ঠিক আছে? প্রমিস কর? কী হল প্যাঁচার মত চেহারা করে আছিস কেন? এমন চেহারা করে হাসপাতালে থাকলে রোগীরা তো ভয়ে পালিয়ে যাবে।
কমলের কথার তোড়ে দীপা আর কিছু বলতে পারে না। আমি দেখতে পাই রাগে ওর গাল কেমন লালচে হয়ে আসছে। দীপার মা বেডে শুয়ে কমল আর দীপার ঝগড়া শুনে মৃদু মৃদু হাসছেন। আমি কাছে গিয়ে আন্টির কপালে আলতো করে হাত রেখে নরম স্বরে বললাম, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করেন না কেন আপনি? এমন অবুঝ হলে চলবে? আপনি বোঝেন না আংকেল দেশে নাই, আপনার কোন ছেলে নাই। দীপাকে একা একা আপনার জন্যে ছোটাছুটি করতে হয়। আপনার কিছু হলে ওর কী হবে? এখন থেকে আর ছেলেমানুষি করবেন না। ঠিকমত খাবেন, আচ্ছা?
আন্টি মাথা নাড়েন। কমল আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয়।
-আপনার কী খেতে ইচ্ছে করে বলেন আন্টি। চকলেট খাবেন? জুস? চিপস? চাইনিজ? সী-ফুড? নুডলস? নান্নার বিরিয়ানি? একবার শুধু বলেন আমি নিয়ে এসব।
আন্টি হেসে ফেলে প্রায় না শোনা যাওয়া কন্ঠে বলেন, কিছু লাগবে না।
-আহহা, বলেন না, কী খেতে মন চায়? দীপাকে বললে তো ও নিজেই সব খাবার খেয়ে শেষ করে ফেলবে। আপনাকে কিছুই দিবে না। আমাকে বলুন আপনার কী খেতে মন চায়? আর যদি কিছুই খেতে মন না চায় তাহলে জলদি সুস্থ হয়ে যান, তারপর আমাদেরকে বাসায় দাওয়াত করেন। কারণ আমাদের আপনার হাতের রান্না খেতে অনেক ইচ্ছা করে।
দীপার মা কমলের কথা শুনে মাথা নেড়ে সায় দেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দীপাকে দেখি। কমলের আর আন্টির কথোপকথন ও কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনছে। ওকে দেখে কে বলবে এই ওই একটু আগে কমলের ওপর এতটা ক্ষেপে গিয়েছিল!
দীপা আবার নার্সের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই কমল নিচু স্বরে আমাকে বলে, আন্টি তো এখনও দেখি ম্যালা সুন্দরী, দোস্ত। এতদিন পর আন্টিকে দেখলাম, এখনও দেখে দীপার বড় বোন বলে মনে হয়।
– সব ঠিক থাকলে দীপার বড়বোনের মত দেখতে লাগা মানুষটা তোর শ্বাশুড়িও হতে পারত। বুঝলি?
কমল গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মত করে আমাকে বলে, – হুমম… দীপা যেমন আমার হতে হতে না হওয়া প্রেমিকা ঠিক তেমনই এইটাও মনে হয় আমার হতে হতে না হওয়া সম্পর্ক।
-তুই আসলেই একটা শয়তান।
-তুই এইটা এতদিনে জানলি?
-নাহ, আগেই জানতাম। আজকে আবারও নিশ্চিত হলাম।
দীপার মা সম্ভবত টয়লেটে যাবেন, নার্স স্যালাইনের প্যাক হাতে তুলে নেয়। আমি, কমল, দীপা একই সাথে আন্টিকে ধরতে এগিয়ে যাই। দুর্বল শরীর নিয়ে আন্টি টলতে টলতে মাথা নাড়েন। বুঝিয়ে দেন, তোমাদের কে আসতে হবে না। আমি নিজেই পারব। আমরা তিনটা মানুষ চুপচাপ হাসপাতালের একটি শূন্য বেডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। দীপা ক্লান্ত স্বরে বলে, পৃথিবীতে মায়েরা না থাকলে সবচেয়ে ভাল হত বুঝলি? মা এমনই এক মানুষ যার একটা কিছু হলে যে কারও দুনিয়া ভেঙে পড়ে। আর যে মায়ের কিছুদিন পর পর অসুখ করে তার মেয়ের তো দুনিয়া ভেঙে খান খান হতে থাকে আর হতেই থাকে।
আমি এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে দীপার হাত ধরে রাখি। দীপা আবারও বলে ওঠে, কোন কথা শুনেন না উনি জানিস? সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করে, ঠিকমত খাবার, ওষুধ কিচ্ছু খায় না। মাঝে মাঝে মা’র ওপর এত রাগ লাগে, মনে হয় চারপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলি। কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকালেই রাগ উবে যায়। আমি রাগলে আমার দিকে এমন অনুনয় নিয়ে তাকায় যে কিচ্ছু বলতে পারি না আমি। দিন দিন কেমন শিশুদের মত হয়ে যাচ্ছে মা। আমার আর ভাল লাগে না রে……
দীপার কথা শুনে আমি আমার মায়ের চেহারা কল্পনা করি। আসলেও তো, দিন দিন কেমন শিশু হয়ে যাচ্ছে আমার আম্মুও। এই তো সেদিন দেখি দু’পায়ে দু’রঙের স্যান্ডেল পরে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে আম্মু। তাঁর কোন খেয়ালই নেই এই ব্যাপারে। ছোটবেলায় ঠিক এমন করে আমি দু’রঙের জুতা পরে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতাম। আর একই রঙের জুতা কোন দিন পরে ফেললেও বাঁ পায়ের জুতা ডান পায়ে আর ডান পায়ের জুতা বা পায়ে পরতাম। বাবা মায়েদের বয়স হলে কী তাঁরা সত্যি সত্যি দিন দিন শিশু হয়ে যান নাকি?
দীপার মা ফিরে এসেছেন। দীপার কানে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। দীপা তারপরেই আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, চল তোদেরকে একটু নাস্তা খাওয়াতে নিয়ে যাই। আমি চোখ পাকিয়ে বলে উঠি, উঁহু, কিচ্ছু খাব না আমরা। আপনি এত কিছু নিয়ে ভাবছেন কেন আন্টি? আমার কথা শুনে দীপার মা যেন আমাকে চোখের ইশারায় বলে দেন, তোমরা দীপাকে নিয়ে একটু বাইরে গিয়ে কিছু খাও। দীপার কিছুটা মন হালকা করা দরকার। আমার মেয়েটা বড় কষ্ট করছে।
আন্টির গালে আলতো করে হাত রেখে আমি বলে আসি, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। এরপর কোন একদিন আপনি, দীপা আর আমি একই রঙের শাড়ি পরে খুব করে সেজে ফটোসেশন করব। কমল আজ বলেছে, আপনাকে দেখতে আমাদের বড় বোনের মত লাগে। ভদ্রমহিলা আমার কথা শুনে আবারও হাসেন। শিশুর মত সরল, নিষ্পাপ হাসি।
আমরা তিনজন মিলে গোটা তিনেক সবজি রোল খাই, দু একটা সামুচা আর নেসক্যাফের কফি। অগোছালো কিছু গল্প চলে আমাদের মাঝে। কমল অযথাই একটু পর পর দীপাকে ক্ষেপিয়ে তোলে। দীপার মুখ বার বার রাগে লালচে হয়ে ওঠে। কমল তখন দীপাকে আরেক কাপ কফির বিল দিতে বলে। দীপা গালাগালি করতে করতেই পার্স থেকে টাকা বের করে কমলের জন্যে কফি আনতে যায়। আমরা হঠাৎই পুরানো কথা ভেবে তিনজন হো হো করে হেসে উঠি। আমরা ভুলে যাই আমরা কোন হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কোন মন খারাপের সময়ে বাস করছি।
খুব কম কিছু মানুষই জানে যে বছরখানেক আগে, কমলের সাথে দীপার বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে খুব সম্ভবত প্রেমের দিকে মোড় নিচ্ছিল। আমরা যারা ওদের কাছাকাছি থাকা বন্ধুরা আছি, তারা সবাই সেটা টের পাচ্ছিলাম। টের পাচ্ছিলাম কমল আর দীপার মাঝে আলাদা একটা সুর তৈরি হচ্ছে। বন্ধুত্বের চেয়ের বেশ গভীর সে সুর। আর কেমন যেন এক অন্যরকম এক ছন্দ আছে তাতে। তারপর কী যে হল, মাসকয়েক পর হঠাৎ দেখলাম ছন্দপতন ঘটেছে। সুর বদলে গেছে। কারণটা আজও আমাদের জানা নেই। দীপার চোখে আমি কমলের জন্যে মায়া দেখতে পাই। কমলের বুদ্ধিমান দৃষ্টি আমাদের চোখকে সব সময় ফাঁকি দিয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ধরা পরে যায়। সেই দৃষ্টিতে আমি দীপার জন্যে ভালোবাসা খুঁজে পাই। তারপরেও কেন ওরা একসাথে থাকেনি তা আমাদের অজানা। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ ভালবাসতে পারে না। কিছু মানুষ ভালবাসতে পারে কিছু ভালোবাসার মানুষ পায় না। আর কিছু মানুষ সবকিছু পেয়েও কিছুই ধরে রাখতে পারে না।
দীপা ফিরে যায় ওর মায়ের কাছে। দীপার শ্যাওলা সবুজ জামা ক্রমেই হাসপাতালের আবছা করিডোরে হারিয়ে যায়। পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও কমল হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আর আমি ধানমন্ডির রাস্তায় রিকশায় একা বসে হু হু করা বাতাসের স্পর্শ ছুঁয়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকি, বছরখানেক আগে এক শীতের সকালে আমরা সব বন্ধুরা মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ক্লান্ত হয়ে যখন সবাই বাসে করে ঢাকা উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম তখন দীপা কমলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কমলও খুব সন্তর্পণে দীপার মাথাটা আলতো করে ধরে দীপাকে আগলে রেখেছিল, যেন বাসের ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম না ভেঙে যায়। তারপর একসময় কমল নিজেও দীপাকে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ওদেরকে দেখে তখন কত অদ্ভুত মায়াই না লাগছিল আমাদের…