মধ্য দুপুর

মধ্য দুপুর

“আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আর আমি ভালোবাসি না”

দুপুরের শেষে বিকেলের কোনো এক পদ্যলতার মাঝে বসে আছে নিলয় আর রোজা। একটি বেঞ্চের দুই প্রান্তে বসে দুজন মানবী শান্ত আর নতুন পাতা গজা প্রকৃতির রুপ শোধনে ব্যস্ত তারা। দুজনের মাঝে নিরাবতার এক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। সেই নিরাবতাকে বিরতিতে রেখে নিলয় উপরের কথাটি বললো। রোজা কথাটা শোনা মাত্রই চমকে উঠল। অবাক করা চাহনি দিয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো…

– কিহ? (রোজা)
– হুমমম,,আমি আমার জীবনকে তোমার সাথে থেকে আর নষ্ট করতে পারবো না। (নিলয়)

রোজা কথাটা শুনেই আরো চমকে উঠল। কারন এমন কথা নিলয় কখনই বলেনি তাকে। আজ তাদের ৪ বছর সম্পর্কের পর প্রথমবার নিলয় বিষাক্তময় কথা বলছে। যা গ্রহন করতে রোজার কষ্ট হচ্ছে অনেক। তবুও সে বললো…

– নিলয় তুমি ঠিক আছো তো?
– হুমম ঠিক আছি।
– তাহলে এসব কি বলছো তুমি? তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি সব বাজে কথা বলছ?
– আমি যথেষ্ট ঠান্ডা মাথায় কথাটি বলছি। আর যা বলেছি সত্যিই বলেছি। (নিলয়)
– কি হয়েছে বাবু তোমার? এমন করছো কেন? আমাকে বলো আমার ভূলটা কোথায়, প্লীজ নিলয় বলো।
– আমি ব্রেকআপ চাচ্ছি। (নিলয়)
– আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না নিলয়। বড্ড ভালোবাসি তোমাকে।
– সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর বেশি প্যাচানোর দরকার মনে করছি না। আমি ব্রেকআপ চাই ব্যস।

কথাটি বলেই নিলয় আর দাঁড়ালো না। সোজা হন হন করে হেটে গেল। আর এ দিকে রোজা বসে নিলয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে পড়ছে নোনা অশ্রু। মাথাটা তার গোলাচ্ছে। কারন এই ভাবে নিলয় তাকে প্রথমবার হার্ট করেছে।

রোজা আর কিছু না ভেবে বাড়িতে চলে আসে। সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে রোজা অনেক কান্নাকাটি করে। রোজা জানে সে তার জীবন থেকে মুল্যবান কাউকে হারিয়েছে। হারিয়েছে কিছু আজীবন মনে রাখার মত স্মৃতির কাগজ। যা চাইলেও আর নিজের কাছে রাখা যাবে না। রোজা ফোন দেয় নিলয়ের কাছে কিন্তু নাম্বারটি বারবার অফ দেখায়।

এভাবেই কেটে যায় একটি মাস। রোজা এই একটি মাসে নিলয়ের নাম্বারে ফোন দেয় অগনিত। নিলয়ের বাসায় যেয়ে দেখে তালা ঝোলানো। রোজা তখন নিজেকে শক্ত করল। মনে মনে ভাবলো,,”যে চলে গেছে আমাকে ছেড়ে আমি কেনো তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না? অবশ্যই আমিও পারবো থাকতে। যে যাওয়ার সেই ঠিকই চলে যাবে”

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাসায় এসে সোজা ওর আব্বু আম্মুর রুমে যেয়ে বলে..
– কিছু বলবি মা?
– আব্বু তোমরা না বিয়ের কথা বলছিলে?
– হুমম ছেলেটা ডক্টর। খুব মানাবে তোদের।
– আচ্ছা আমি রাজি তোমরা ব্যবস্থা করো।

রোজা কথাটি রাগ করে বললেও কদিন পর সে দেখে তার বিয়ে সেই ডক্টর ছেলেটির সাথে। একসময় বিয়ে হয়ে যায় রোজার। বিয়ের পর সে সবসময় ভালো থাকার চেষ্টাতে যুদ্ধ করে চলতো। কিন্তু পারতো না। নিলয়ের স্মৃতিগুলো তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। প্রতিটা রাতেই অন্ধকারে বসে রোজা কাঁদতো নিলয়ের জন্য।

সবকিছুর পরও রোজা বিশ্বাস করে নিলয় একদিন ফিরে আসবে। ফিরে এসে ডাকবে তার নাম ধরে। কাছে ডেকে নিবে তার বাহুডোরে। কিন্তু সেসব কল্পনাতে বিদ্যমান।
.
রোজার বিয়ের দুই বছর পর একদিন রোজা আসে তার বাড়িতে বেড়াতে। কি মনে করে রোজা আরেকবার যায় নিলয়ের বাসায়। তখনি দেখে সে তাদের বাড়ির গেটটি খোলা। রোজা দৌড়ে যায়। সে মনে করে নিলয় সেখানেই আছে।
.
– কে তুমি মা? (নিলয়ের আম্মু)
– জ্বি আনটি আমার নাম রোজা। নিলয় কি বাসায় আছে?
– তোমার কি নাম বললে?
– রোজা। নিলয় আছে আনটি?

নিলয়ের আম্মু কোনো কথা বললো না। রোজার হাত ধরে নিয়ে গেল রুমে।
– বসো মা তুমি এখানে।
রোজা বসতেই নিলয়ের আম্মু ওর হাতে একটি কাগজ তুলে দেয়। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে..

“নিলয় আর নেই। দুই বছর আগে সে ক্যান্সারে মারা গেছে” তোমাকে কাগজটি দিতে বলেছিল”

কথাটি বলেই তিনি রুম থেকে বের হয়ে যায়। রোজা কথাটি শোনা মাত্রই যেন বোবা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হতে চাইছে না যেন। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটি খোলে। সেখানে লেখা কয়েকগুচ্ছ লাইন। রোজা পড়তে লাগলো…

“জান আমি জানি এই চিঠিটা তুমি যখন পাবে তখন আমি আর থাকবো না। আর তুমি তখনও আমার জন্য অপেক্ষাতে থাকবে। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। আমি জানি তোমার যায় হয়ে যাক তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তেমনি এখনো করছো তাই না? চেয়েছিলাম একসাথে দুজনে সারাটা জীবন পাশে থেকে কাটাবো। হাহাহা,,কিন্তু দেখো সেটা আর আমাদের নিয়তিতে নেই।

বাবু তুমি মন খারাপ করো না। আমি তোমাকে ইগনোর করেছি কেবল তোমাকে শক্ত করার জন্য, সামনে এগিয়ে যাও সেই জন্যে। যদি তোমাকে তখনি জানাতাম সবকিছু তাহলে আমার থেকে তুমিই বেশি কষ্ট পাইতা। নিজেকে কখনো দোষারোপ করো না পাগলি এসবের জন্য।

মনে করো আমি এখনো বেঁচে আছি তোমার হ্রদয়ের মাঝে। তোমার ভালোবাসা কখনই হারাবে না। নিজের উপর আশা ছেড়ো না। সবসময় হাসি খুশি থাকবে। আর তুমি তো জানোই আমি তোমার মিষ্টি হাসি মাথা মুখটা দেখতে কতটা ভালোবাসতাম। আমি সবসময় তোমার সাথে ছিলাম, আছি আর থাকবোও। হয়ত ধোয়াশার মাঝে এখন রয়েছি। তবে তোমার স্মৃতির মাঝে আমি বেঁচে থাকবো সারাজীবন। দোয়া রইলো আর আমার জন্যও দোয়া কইরো। ভালো থেকো রোজা।”
.

রোজা কাঁদতে কাঁদতে চিঠিটা পড়লো। পড়ার শেষে কয়েক টুপ পানি পড়ে গেছে। চিঠিটা আকড়ে ধরে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। বারবার তার মনে হতে লাগলো নিলয় তার আশে পাশে পাশেই আছে। সে হাটছে দিশাহীন অস্তিত্বের অন্তরালে। যেখানে কেবল রয়েছে স্মৃতির এক টুকরো সুখ। মধ্য দুপুরের দশ্যিপনা। বিড় বিড় করে রোজা বলে..

“ভালোবাসার কোনো রং নেই। নেই কোনো তার শেষ।
ভালোবাসা কেবল মিশে থাকে কাছের মানুষটার অন্তস্তুপে”

“………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত