ভার্সিটির গেইটের একটু সামনে চায়ের দোকানে বসে এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি করছে তারেক – হাতে আধা খাওয়া একটা ময়লা চায়ের কাপ৷ পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে সময়টা দেখে নেয় ও – 9:30 বাজে ৷ মুখে চাপা উত্তেজনার হাসি নিয়ে ফোনটা আবার পকেটে রেখে দেয় ৷ আধা ঘন্টা থেকে কারো জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু ওর মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই, উল্টা চাপা উত্তেজনা ৷
ও জানে, কখন মানুষটা আসবে – ঠিক ০৯ টা বেজে ৪৩ মিনিটে ৷ একটা সাদা রং এর কালো গ্লাস ওয়ালা প্রাইভেটকার এই গেইটটার ঠিক একটু সামনে গিয়ে আস্তে আস্তে থামবে, অনেক চেষ্টা করেও ও কখনও গাড়ির ড্রাইভারকে দেখতে পারে নি ৷
এরপর বামপাশের দরজাটা খুলে একটা সুভ্র হাত বের হয়ে আসবে – হাতের কব্জি থেকে অর্ধেকটা পর্যন্ত ঢাকা দামি একটা ঘড়ি, তিনটা ব্রেসলেট, আর তিনটি চুড়ি দিয়ে ৷ এরপর কুনুই এর একটু নিচ থেকেই উঠে গেছে জামার হাতা ৷
এরপর আস্তে আস্তে প্রথমে বাম পা টি মাটিতে নামবে, এরপর ডান ৷ নামার পর গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসে মানুষটি গেইট দিয়ে ঢুকে যাবে ৷
এই একটা ঘটনা প্রতিদিনই নতুন করে দেখে ও, নতুন করে অবাক হয়, নতুন করে ভালবাসে ৷ মাঝে মাঝে নিজেকে জিজ্ঞেস করে এখানে এতো মনযোগ দিয়ে দেখার কি আছে?
এরপর আবার নিজে নিজেই বলে, এর থেকে সুন্দর কিছু কি আদৌ হতে পারে ?
আর ঠিক সাথে সাথেই চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে পিছনে পিছনে সেও ঢুকে যায় ৷
প্রতিদিন অপেক্ষা করার সময় ভাবে দেখবে যে ঢুকার সময় কয়টা বাজে, ওর ধারণা এই সময়টুকুও প্রতিদিন একই হবে ৷ কিন্তু ওই হাত বের হওয়ার পর থেকে আর কোনোদিকে খেয়াল থাকে না ওর, তাই আজো দেখা হয়নি ৷
প্রায় দুই মাস থেকে একটাই রুটিন ফলো করছে ও ৷ একটা মানুষের কাছে কেউ যতটা স্পেশাল হলে এতো সুক্ষ্মভাবে বিষয়গুলো লক্ষ করা যায়, তারেকের কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি স্পেশাল অনীলা ৷
ও যতবার মেয়েটির কথা ভাবে ততবার অবাক হয়, ততবেশি অপরিচিত মনে হয় ৷ ওর কাছে মনে হয় মেয়েটা ধোঁয়ার মতো, দূর থেকে দেখতেই ভাল লাগে – ছুয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হলেও দেওয়া যায় না ৷ হাত বাড়াতে গেলে যে অস্তিত্বটাই বিলীন হয়ে যাবে, যে হাতটা একটু স্পর্শের আশায় এগিয়ে ছিল সেটা কেবল অল্পের জন্য না ছুতে না পারার কষ্টে হয়তো গুটিয়ে নেওয়া ভুলে যাবে ৷ শত সহস্র বছর পর কোনো প্রত্নতত্ববিদ আবিষ্কার করবে এক হাত বাড়িয়ে রাখা একটা কঙ্কাল ৷ সবাই কেবল হাত বাড়ানোটা দেখবে, কারো মনে কখনই আসবে না এর পিছনের আকাঙ্খাটা ৷ অপেক্ষার শেষ হবে কোনো এক ল্যাবরেটরিতে গিয়ে টুকরো টুকরো হবার পর – তবে সেই অল্পের জন্য ছুয়ে দিতে না পারার কষ্টটা কিন্তু তখনও শেষ হয়ে যাবে না ৷ জ্বালানীর কাজ করে আখাঙ্খাটাকে আরো বাড়াতেই থাকবে…
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তারেক, হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে ৷ একদম সাধারণ চেহাড়া, সাধারণ সবকিছু ৷ ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকে ৷ পুরো কলেজে পরিচিত কেউ নেই অথবা ও কখনও পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করে নি ৷ প্রথমদিকে একদিন যখন লেইট হয়ে গেছে ভেবে দৌড়াতে দৌড়াতে গেইট দিয়ে ঢুকছিল তখনই হঠাৎ ঘটনাটি ওর চোখে পড়ে ৷ এরপর থেকে প্রতিদিন ফলো করছে একটাই জিনিস ৷
ও শুধু একপলকে তাকিয়েই থাকে, এর থেকে বেশি কিছু ভাবতে পারে না ৷ ভাবতে গেলেই বুকটা জোড়ে জোড়ে লাফাতে থাকে যেন এর ভিতরের জায়গাটা হৃদপিন্ডের জন্য পর্যাপ্ত নয় ৷ আসলেই তো, এত বিশাল বিশাল অনুভূতি রাখার জন্য ছোট্ট এই হৃৎপিন্ডটা পর্যাপ্ত হয় কি করে? বলতে পারবেন পাঠক ?
এই তো গাড়িটা দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিনের মতো আজকেও গেট দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে মেয়েটা ৷ তারেকও তাড়াতাড়ি করে কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে পেছন পেছন ঢুকে যায় ৷
এবার প্রচন্ড রকমের শীত পড়েছে, কুচকে পড়া চেক শার্টটার ওপর একটা ছাই রঙের হুডি পড়া ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে হাটতে থাকে ক্লাসের দিকে ৷ যদিও ঘরে একটি মোটা জ্যাকেট আছে, কিন্তু বেমানান লাগবে বলে আর পড়া হয় না সেটা ৷
ক্লাসে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, পুরো ক্লাস ফাকা ৷ শুধুমাত্র বইপোকা টাইপ কয়েকজন সামনের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ৷ কি একটা রাজনৈতিক কারণে যেন ক্লাস বন্ধ, সে জানে না কিছু ৷ কারো সাথে যোগাযোগ না থাকলে যা হয় আরকি ৷
অনীলা প্রতিদিনের মতোই একদম ডানপাশের তৃতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু ও পারে না প্রতিদিনের মতো মাঝের সাড়ির লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসতে ৷ কারণ এরকম ফাঁকা ক্লাসে কারো দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা যায় না, দৃষ্টিকটু লাগে ৷ তার ওপর আজ সাদা রঙের একটা জামা পড়েছে মেয়েটা ৷ যেখান থেকে চোখ ফেরানো প্রায় অসম্ভব – ওর পক্ষে তো নয় ই ৷ সাদা রংটা ওর জঘন্য লাগে, কিন্তু ও বুঝতে পারছে – ঠিক এই মুহূর্ত থেকে ওর কাছে সাদার চেয়ে প্রিয় কোনো রং নেই ৷ ও চাইছে না কারো জন্য নিজের পছন্দ এভাবে পরিবর্তন হয়ে যাক, কিন্তু ও জানে ঠিক ঠিক ওর ভিতরের পুরোটা এখন সাদা দখল করে নিবে ৷ তারপর হয়তো সাদা রংটা ওর থেকে বের হয়ে পুরো পৃথিবীটাকেই সাদা চাদরে ঢেকে দিবে ৷ তারপর কি চুনের মতো সাদা পৃথিবীটা চুনের মতোই শুষ্ক হয়ে ফেটে যাবে? নাকি তুষারের মতো সুভ্রতা ছড়াবে? ও ভাবতে পারে না আর, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে ৷ কাল থেকেই কিছুটা জ্বরজ্বর ভাব ছিল ওর ৷ বিরক্ত একটা ভাব নিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে যায়, এটাও পুরোপুরি ফাঁকা ৷ বিরাট আকারের হলরুম গুলো পুরোপুরি ফাঁকা থাকলে কিছুটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় – তার ওপর এটা ছিল লাইব্রেরী ৷ ভৌতিকতা মনে আসলেও সেটা পাত্তা না দিয়ে সময় কাটানোর জন্য ও একটা বই হাতে নেয়, ময়লা মলাটে হলুদ রং এর উপর কালো কালিতে লেখা – “হিমুর হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম “৷
ওর প্রিয় বইগুলোর একটি, কোণার দিকে কুচকে যাওয়া একটি পাতা সোজা করে আবার আগের যায়গায় রেখে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে৷ সবকিছু বিরক্ত লাগছে ওর, কিন্তু কিজন্য তা জানে না ৷
এমন সময় বাইরে তাকাতেই বিরক্তিটা আরো বেড়ে যায় – বৃষ্টি পড়ছে ৷ কিছুটা অবাক হয়ে ভাবে, এই শীতের মাঝেও বৃষ্টি? প্রকৃতি কি হিসেবে গোলমাল করছে?
ভাবনা আগায় না আর, মাথা ব্যাথাও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ৷ টেবিলের ওপর হাত রেখে তার উপরই চোখ বুজে পড়ে থাকে ও ৷
– তারেক.. এই তারেক, তুমি কি ঘুমাচ্ছো ?
হুরমুর করে জেগে উঠতে গিয়ে খেয়াল হয় ওর যে মাথাটা নাড়ানো যাচ্ছে না ব্যাথায়, ভার ভার লাগছে অনেক ৷ কতক্ষন পড়েছিল এভাবে কে জানে? ধাতস্থ হতে সময় নেয় একটু ৷ এরপর কন্ঠের মালিকের দিকে তাকাতেই সমস্ত ঘুম উবে যায় ৷ আনমনেই মুখ থেকে বের হয়ে আসে, “অ–নী—লা—-“৷
সেটা শেষ হওয়ার আগেই অনীলা বলে উঠে,
– দেখো না, আজ সব ক্লাস অফ ৷ আমাদের ড্রাইভার ও চলে গেছে গাড়ি নিয়ে ৷ এখন এই বৃষ্টির মাঝে বাসায় যাই কি করে? তোমার ফোনটা একটু দিতে পারবা? আমারটা গাড়ি থেকে নেওয়া হয় নি ভুলে…
ব্যাস, এইটুক ই যথেষ্ট ছিল ওর সবকিছু এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য ৷ তাড়াতাড়়ি করে পকেট হাতড়িয়ে দেখে ফোন নেই ৷ ও কিছুটা বিব্রত হয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে,
– স্যরি, ফোনটা পাচ্ছি না ৷ চায়ের দোকানে ফেলে আসছি মনে হয় ভুলে ৷ আচ্ছা, নিয়ে আসছি এক্ষুনি…
এই শীতের বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা দেয় ও ৷ খেয়াল থাকে না মাথাব্যাথা বা জ্বরের কথা ৷ ওর মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা, অনীলা ওর কাছে সাহায্য চেয়েছে ৷
দৌড়ে চায়ের দোকানের কাছে গিয়ে দাড়াতেই পানের পিক ফেলে লাল দাত বের করে হাসে মনির মিয়া ৷
– কি মিঞা? মোবাইল ফালায়া থয়া গেসো গা?
এরপর তালা নষ্ট ড্রয়ারটা খুলে বের করে দেয় – নোকিয়া এক্সপ্রেস মিউজিক ৷ সাইডের বাটনগুলা উঠে এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে..
হাতে পেয়েই আবার উল্টা দৌড় দেয় তারেক, ওর জন্য অনীলা অপেক্ষা করছে ৷ ধন্যবাদ দেওয়ার কথাটাও মনে থাকে না ৷
পিছন থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মনির মিয়া ৷ একটু আগে তাড়াহুড়ু করে দৌড় দেওয়ায় মোবাইলটা পড়ে গিয়েছিল ৷ উনি সেটাকে তুলে এনে রেখে দিয়েছিলেন ৷ ছেলেটার প্রতি কেমন জানি মায়া কাজ করে তার, যদিও “চা দেন”, “মামা, টাকাটা..” এগুলা বাদে কখনও কথা হয় নি ওর সাথে – তবুও ৷ এই যে, ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাও না দেখিয়ে চলে গেছে এটা একবার ও তার মাথায় আসে নি ৷ মনটা শান্তিতে ভরে উঠে অনেকদিন পর ৷ মনে হয় যেন অনেক বড় কোনো ভাল কাজ করেছেন ৷ যদিও উনি কখনও তেমন খারাপ কিছু করেন না, তবুও সব সময় মনে হয় কেউ যেন রেগে আছে তার উপর, ভয়ে কারো সাথে চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলেন না ৷
ছেলেটার চোখের দিকে লুকিয়ে তাকিয়েছিলেন কয়েকবার, কার জন্য যেন গভীর ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে ৷ ভয় লাগে নি কখনও ৷ এজন্যই হয়তো এই মায়াটা জন্ম নিয়েছে ৷
অর্ধেকটা পথ আসতেই মনে হয় দোকনদারকে ধন্যবাদটুকুও দেওয়া হয় নি ৷ আচ্ছা, পরে দেওয়া যাবে – ভেবে আবার দৌড়ায় ৷
লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখে অনীলা দরজার সামনেই বসা ৷ ওকে দেখে উঠে পড়ে ৷ তারপর কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
– কি দরকার ছিল এই বৃষ্টিতে যাওয়ার? পিছন থেকে ডাকলাম কতবার ৷ আমি ফোন করেছি আরেকজনের থেকে নিয়ে ৷ তবুও ধন্যবাদ তোমাকে – ঐ যে গাড়ি চলে এসেছে ৷ আমি যাই, হ্যা?
এটুকু বলেই হাঁটা দেয়, পিছনে তারেক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ৷
নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপদার্থ মনে হয় ওর ৷ ফোনটাও ঠিকমতো রাখতে পারে না? অজানা একটা অভিমান বাসা বাঁধে মনের এক কোণে ৷ কি হতো ওর জন্য একটু অপেক্ষা করলে?
সাথে সাথে আবার মনে হয় ওর জন্য অপেক্ষা করবে কেন, হয়তো অনেক জরুরি ছিল ফোন করা ৷ অভিমানটা আরো গাঢ় হয় ৷ এরপর ফোনটা পকেটে রাখতে গিয়ে মনে পড়ে ওর ব্যালান্স শূণ্য ৷ কি লজ্জ্বায়ই না পড়তে হতো একটুর জন্য ৷ নিজেকে বোঝায় – ভালোই হয়েছে ৷ অভিমান টা তবু সরে যায় না ৷ বুক ফেটে কান্না আসতে চায় ৷ সামলে নেয় ও নিজেকে, ছেলেদের কাঁদতে হয় না ৷ এরকম ফালতু ইমোশনের জন্য তো নয় ই ৷ মাথা ব্যাথাটা আবার চারগুন হয়ে ঝেকে বসে ৷ শীতে কাঁপছে শরীর – জ্বর কত তা আন্দাজ করতে পারছে না ৷ আগের জায়গায় গিয়ে আবার বসে পড়ে আগের মতো ৷ জ্বরটা একটু না কমলে মেসে ফেরা যাবে না…
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা