ভার্সিটিতে তো সবারই প্রিয় বন্ধু থাকে!আমারও ছিলো।
নাম হাসিব।
যাকে বিশ্বাস করা যেতো,শেষ বিকেলের আড্ডা শেষে পরম নির্ভরতায় যার কাঁধে হাত রেখে বলা যেতো,
– আমাকে মেসে দিয়ে আয়,সন্ধ্যা হয়ে গেছে! একা যেতে পারবো না।
.
সে অদ্ভুতভাবে রাগ দেখাতো,চোখ রাঙানী দিয়ে বলতো,
-কে তোকে সন্ধ্যা অবধি থাকতে বলে রে?কাল থেকে আর আসবি না।
.
আমি যেমন ঘরে থাকতে পারবো না তেমনি আমাকে ছাড়া হাসিবও থাকতে পারতো না। তাইতো পরদিন বিকাল হতেই ফোনের উপর ফোন দিয়েই নিয়ে আসতো।
.
ধীরে ধীরে আমার মনে হাসিবের জন্যে আলাদা একটা জায়গা তৈরী হতে লাগলো! বন্ধুত্বটা প্রেমে পরিণত হতে যাচ্ছে এটা বেশ বুঝতে পারলাম।
দুজনের ভালো লাগাটা এক সময় ভালোবাসায় রূপ লাভ করে।
.
কিন্তু হাসিব ছিলো আমার এক বছরের ছোট। আমি ২য়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাই আর হাসিব প্রথমবার। প্রেমের কাছে কোনো বাঁধাই বাঁধা না সেটা হাসিব বারবারই বুঝাতো।
.
হাসিবের সাথে কাটানো সব থেকে ভালো সময় হলো একসাথে বৃষ্টিতে ভিজা। আমি শান্ত স্বভাবের মেয়ে হলেও বৃষ্টিতে ভিজতে নামলে আমার দূরন্তপানা,পানি
তে লাফালাফি এগুলো হাসিবকে অবাক করে দিতো।
বাজ পড়াটা হাসিবের খুব ভয়ের ছিলো।তাই বৃষ্টিতে খুব একটা ভিজতে দিতো না। খুব মিষ্টি করে বলতো,
-আর ভিজতে হবে না।এবার উঠে পড়ো লক্ষিটি!ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। তখন আর তোমার কবিতা শুনতে পারবো না।
.
ভোরবেলাতে হাঁটতে যাওয়াটা একটা সময় দুজনেরই নেশা হয়ে উঠেছিলো। পদ্মার পাড়ে গিয়ে সূর্যোদয় দেখাই লাগবে দুজনের।
এতোসব কিছু সবার চোখের অলক্ষেই ঘটতে থাকে! সবাই জানতো আমরা ভালো বন্ধু মাত্র।
.
আমার জীবনের খুব ভালো দিনগুলির মধ্যে একটা দিন ছিলো ,যেদিন আমি প্রথম হাসিবের বাসায় গেলাম।
ছোটবেলা বাবা,মাকে হারিয়েছি,আপুর বাসাতে বড় হয়েছি। আপু,দুলাভাই আর টুনি ছাড়া আর কারো সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়ে উঠেনি আমার।
হাসিব তার পরিবারের সবার কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিলো। বাবা,মা তার দুই আপুরা আমাকে আপন করে নিয়েছিলো।
আমি বাবা,মার আদর পেয়েছিলাম খুব।
হাসিবের মেজু আপুর বিয়েতে আর ঢাকাতে বড় আপুর বাসাতে বেড়াতে যাওয়াগুলোও খুব ভালো দিন ছিলো আমার।
.
সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন আর গর্ভধারিনী বই দুটি ছিলো হাসিবের দেয়া প্রথম উপহার।
হাসিব জানতো আমি খুব ভীতু!তাই সাহস দিতো সবসময়। বলতো,
-জয়ীতার মতো হও,দিপাবলির মতো হও,সাহসী হও,প্রতিবাদী হও।
.
জয়ীতাকেই ভালো লাগতো!কতো সাহস মেয়েটার তাই ভাবতাম। বইয়ের শেষ অংশটা খুব বেশিই পড়তাম। ভালো লাগতো। বইটা মাথার কাছে রেখে ঘুমাতাম,স্বপ্ন দেখতাম।
দিনগুলো ভালোই কাটছিলো।
.
তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। হাসিব অনেকদিন ধরেই বলছিলো আমার আপুকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাতে। সেদিন খুব সাহস করেই আপুকে কথাগুলো বলছিলাম!
আপু খুব হেসেছিলো সেদিন! বলেছিলো,
খুব বড় হয়ে গেছিস,নিজের ভালোটা বুঝতে শিখে গেছিস!আর জানিয়েই কি লাভ তোর। তিনবছর তো প্রেম করে কাটিয়ে দিলি,এখন আর জানানোর কি আছে?
………..
……….
আজ পাঁচবছর চলছে আমি আমেরিকাতে আছি। নিজের একটা ছোট সংসার আর আমার বাচ্চাদের নিয়ে ভালো আছি।
আমি জানি হাসিবও ভালো আছে। গতবছর ও বিয়ে করছে।
যেই ছেলেটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো,গত পাঁচ বছরে সেই ভালোবাসা ঘৃণায় রূপ নিয়েছে। আমি নাকি হাসিবকে ঠকিয়ছি,বিয়ে করে আমেরিকাতে চলে এসেছি।
কিন্তু সত্যি কথাগুলো হাসিবের কাছে অজানা।
এই পাঁচ বছরে অনেকবার চেয়েছি হাসিবকে সব সত্যি বলে দেই।
কতশতবার ওর নাম্বারে কল করার চেষ্টা করেছি,কত চিঠি যে লিখেছি, তা সবকিছুই হাসিবের অজানা।
…….
আজ রাতটা নির্ঘুমই কেটে গেলো। হাসিবকে একটা চিঠি লেখা দরকার.. ডায়েরীটা বের করলাম। হাসিবের দেয়া উপহার ছিলো এটা।
…….
হাসিব,
আজ অনেকদিন পরে লিখছি। আজকাল বাচ্চাদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি তাই আগের মতো লেখার সময় পাচ্ছি না।
.
তুমি হয়তো ভার্সিটির র্যাগ দিনের কথাটা এখনো মনে রেখেছো। সেদিন তোমাকে বলেছিলাম,
.
-এতোদিনের ভালোবাসা সব ছিলো মিথ্যে আর অভিনয়। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর বিয়ের পর আমি আমেরিকা চলে যাবো। তোমার মতো বেকার ছেলেকে নিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবা বোকামী।
.
তারপর থেকেই আমরা আলাদা। জানি একটা দিনও তুমি ভালো ছিলে না।
না,আমিও ছিলাম না।
.
সত্যিই অভিনয় করেছি ভুলার জন্যে।
পারিনি এখনো আর পারবোও না।
.
আপুর থেকেই জেনেছিলাম,আমি কখনো মা হতে পারবো না। তুমি তোমার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। অনেক কিছু আশা তাদের। আমি চাইনি কাউকে ঠকাতে। তাই নিজেই দূরে সরে গিয়ছি।। আমেরিকা চলে এসেছি তবে বিয়ে করে নয়! এখানের একটা এতিমখানাতে কাজ করি এখন। এখানের বাচ্চারা আমাকে মা বলে। আমি গর্ভধারীনি না হলেও মা হতে পেরেছি! আমি সমরেশের গল্পের জয়ীতা বা দিপাবলি নয় আমি তোমার গল্পের ইমু
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা