মেয়েটা এমন কেন !

মেয়েটা এমন কেন !

-কই ? কি হল ? কিনে দাও । দাওওওও ।
দুই তিন বছরের মেয়ে যদি এমন করে কিছু কিনে দেওয়ার বায়না করে তাহলে মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু কোন এইচএসসি পড়া মেয়ে যদি এমন বাচ্চা দের মত আহ্লাদ করে করে তাহলে তাকে থাপড়ইতে ইচ্ছা করে ।আমার এখন তাইফাকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু দিতে পারছি না । তাইফা আবার বলল
-কই দাও
-দেখো বাইরের জিনিস খেতে হবে না । এগুলো আনহাইজেনিক ।
-হোক আমি খাবো ।
-না ।
-খাবো ।
-না ।
-খাবো ।
আমি কঠিন চোখে তাইফার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম । কিন্তু সেদিনে তাইফা বিন্দু মাত্র খেয়াল না দিয়ে আবারও সেই কথা বলতে লাগলো । সে ফুচকা খাবেই ।

আমি বললাম-আইসক্রিম কিনে দিতে পারি । কিন্তু ফুচকা না ।
তাইফা কিছুক্ষন কি যেন ভাবলো । তারপর বলল-আচ্ছা ঠিক আছে । কিন্তু পরের বার কিন্তু ফুচকা খাওয়াতে হবে ।

মেয়েদের কে নিয়ে বের হওয়া দুনিয়ার সব থেকে প্যারাময় একটা কাজ । কিন্তু এই কাজটাই করতে হচ্ছে কদিন থেকে । কোন প্রকার অজুহাত দিয়ে কাটানো যাচ্ছে না ।কোন রকমে বাড়িতে কাটালেই এই বদ মেয়েকে কিছুতেই পেছ ছাড়ানো যাচ্ছে না । ঢাকায় আসার পর থেকে সব সময় ফয়সাল এখানে নিয়ে চল ওখানে নিয়ে চল । আরে আমি কি বাস ড্রাইভার নাকি যে এখানে ওখানে নিয়ে যাবো । তাইফা এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে । দিয়ে কাউকে কিছু না বলে একা একা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এসেছে খালার বাসায় । এই মেয়ের এতো সাহস আমি নিজ চোখে না দেখলে ঠিক বিশ্বাস করতাম না ।

অবশ্য তাইফার খালা মানে রুনু আন্টির মুখে তাইফার কথা আগে থেকেই শুনেছি । মেয়ের কার্যকলাপের কথা আমার কম বেশি জানতাম । মেয়েটার গল্প শুনে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল মনে কিন্তু সেই ইচ্ছা যে এমন ভাবে পূরন হবে ভাবি নি ।

তাইফার খালার সাথে আমার আম্মার আবার গলায় গলায় ভাব । পাশি পাশি ফ্ল্যাটে থাকার কারনে দুজনে একে অন্যের জানের বান্ধবী । যতই মেয়ে ডানপিটে হোক ঢাকা শহরে একা একা একটা মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে কেউ নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না যদি সেই মেয়েটি নতুন হয় । তাই আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে তাইফাকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখানোর । আমি এখন সেই দায়িত্বই পালন করছি ।
তাইফার জন্য একটা কোন আইসক্রিম কিনে আনলাম ।
-তোমার টা কই ?
-আমি খাবো না ।
-কেন ?
-এমনি । তুমি খাও ।
তাইফা আইসক্রিম খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি এতো বোকা কেন বল তো ?
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আসলে মেয়েটা কি বলতে চাচ্ছে । এই তিন দিনে এই একটা প্রশ্নই তাইফা আমাকে অন্তত বিশ বার করেছে । কেন করেছে কে জানে ? আমি প্রত্যেকবারই বলেছি আমি জানি না । এখনও তাই বললাম । তাইফা প্রত্যেকবার আমার মুখের কথা শুন হেসেছে, এবারো হাসলো । বলল
-নাও । আইস ক্রিম খাও ।
-তুমি খাও ।
-আহা । একটা বাইট নিলে কিছু হবে না ।
-আরে খাবো না ।
-আচ্ছা আমার এটো খাবে না ? যাও আমিও খাবো না ।
এই কথা বলতে বলতে অর্ধেক আইসক্রিম টাই তাইফা ফেলে দিল রাস্তার উপর । আমি অবা হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । এই মেয়ের মাথায় আসলেই সমস্যা আছে । আমার এমন একটা ব্যাবহার করছে যেন আমি তার অনেক কিছু হই । আমার উপর হঠাৎ করেই এমন জোর কেন কাটাচ্ছে । আশ্চর্য । এই মেয়ের সমস্যা কি ?আইসক্রিম ফেলার পর আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলো । আমার সাথে কথা বলবে না । উল্টো দিকে তাকিয়েই বলল
-তোমার সাথে কথা নাই । যাও ভাগো ।
কি আর করবো আবার একটা আইসক্রিমনিয়ে এলাম । আগে এক কামড় খেয়ে ওকে দিলাম । বলল
-এই যে আইসক্রিম খেলাম । এবার নাও ।
-না নিবো না ।
-আরে কি আশ্চার্য নাও । আমি তো খাচ্ছি । তাই না ? নাও ।
-প্রথমবার কেন নিলে না ?
-ভুল হয়েছে । ঠিক আছে । নাও । আর এমন হবে না ।
এবার তাইফার মুখে হাসি ফুটলো সে আমার কাছ থেকে আইসক্রিম নিল ।
আবার সেই প্রশ্নটা করলো-এই বল না, তুমি এটো বোকা কেন ?
-আমি বোকাই ।
-সুইট বোকা । তোমার গার্লফ্রেন্ডের কপাল ভাল অনেক ।
-কেন ?
-কারন আছে ।
এই ভাবেই দিন চলতে লাগলো । আমার অবশ্য আর কোন কাজ নেই । ভার্সিতে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস থাকে । বাকি চার দিন বাসাতেই থাকি । বাইরে বের হওয়াটা ঠিক পছন্দ না । ঘরে বসে সময় কাটে । এখন তাইফার সাথে সময় কাটে ।

যেদিন আমি বাইরে যাই না সারাটা দিন আমার সাথে । মনে হয় ওর খালার বাড়ি থেকে আমাদের বাসাতেই ও বেশি থাকছে । আমার সাথে আড্ডা মারছে আরও ভাল করে বললে আমাকে বিরক্ত করছে । আম্মার সাথে হাসাহাসি করছে । আম্মা কে খালামনি খালা মনি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে । আম্মা কম যান না । আম্মা এরই ভিতর ওকে তুই বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছে ।আমি দেখছি আর অবাক হচ্ছি ।

প্রথম দিনও খানিকটা অবাক হয়েছিলাম । ঘরে বসে মুভি দেখছিলাম কোথা থেকে একটা অপরিচিত মেয়ে আমার রুমে এসে বলল
-এই তোমার নাম ফয়সাল না ?
আমি প্রথমে কিছু বলতেই পারলাম না । কোথা থেকে কোন মেয়ে আমার ঘরে এসে আমার নাম এমন ভাবে জিজ্ঞেস করবে এটা আমি কোন দিন ভাবতেই পারি নি । আমি কিছু বলছি না দেখে মেয়েটি বলল
-শুনো, বিকেল বেলা ফ্রি থাকবা । আমাকে টিএসসি তে নিয়ে যাবা । মনে থাকবে ।
-তুমি কে ?
আমার এই কথা শুনে মেয়েটি আমাকে একটা ভেংচি কেটে চলে গেল ।আমি বোকার মত বসে থাকলাম কিছুক্ষন । পরে মা এসে সব কিছু বলে গেল । মেজাজ টা একটু খারাপ হল কারন মেয়েটা আমর থেকে প্রায় তিনচার বছরের জুনিয়র অথচ আমাকে কত সহজেই না তুমি করে বলছে । তাই উপর আমার এক দিনেইকেবল একটা হুকুম হুকুম ভাব দেখাচ্ছে । মানে কি ?

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো । একটা সময় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমারও তাইফার সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগে । আমি নিজেই ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি । কখন আসবে কখন আমাকে বিরক্ত করবে, আমার মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে । বলবে
এই টা তুমি কি রাখছো মোবাইলে ?
এই টা কর ছবি ?
এই মেয়েটা কেন ?
এই ছেলেটা কেন ?
এই টা লক কেন ?
এই টা এমন কেন ?

রাতের বেলা মাঝে মাঝেই তইফা আমাকে ফোন করে ছাদের নিয়ে যায় । রেলিংয়ের উপরে বসে কত গল্প করি আমরা । কত রকমের কথা । কত অদ্ভুড রকমের কথাই না মেয়েটা জানে । তারপর এই দিকে দিনে ঢাকা শহরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমরা এক সাথে ঘুরে বেড়াই নাই । কিন্তু সব কিছুর একটা শেষ আছে । দেখতে দেখতে তাইফার যাওয়ার দিন চলে এল । ইন্টার পরেরই ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হয় তাইফারও দরকার । তাই তাকে ফিরতে হবে । ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে কেমন একটা লাগলো যেন ।

যাওয়ার দিনও তাইফাকে স্টেশনে পৌছে দিতে আমিই গেলাম । ও আর কাউকে আসতে দেয় নি । বলেছে আমি তোমাদের বাসায় এসেছি একা বিদায় নেবোও এখান থেকে । কারও স্টেশনে আসতে হবে না ।
আম্মা তো কেঁদেকেটে অস্বস্থির ।ট্রেনে ওকে সিটে বসিয়ে দিয়ে ওর পাশেই বসলাম । এই প্রথম বারের মত দেখলাম ওর মুখ টা কেমন একটু গম্ভীর ।
-কি হল ?
-কি হবে ?
-মুখ এমন বাঁদরের মত করে রেখেছ কেন ?
-বাঁদর ?
-হুম । মহিলা বাঁদর । গম্ভীর হলে তোমাকে তেমনই লাগে ।
-মার খাবা । বলে দিলাম ।
এই বলে তাইফা অন্য দিকে তাকালো । আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটা চোখের পানি আটকানোর জন্য অন্য দিকে তাকালো । বুকের ভেতর টা হঠাৎই আবার কেমন করে উঠলো । সেই অনুভুতিই আমি কিছুতেই প্রকাশ করতে পারলাম না । কিছু বলতে যাবো তখনই ট্রেনের হুইসেল দিয়ে দিল । ট্রেন ছেড়ে দিবে । এখনই নেমে পড়া উচিৎ ।
আমি বললাম -যাই কেমন ?
-তুমি এসো আমাদের ওখানে । কেমন ?
-হুম । আসবো ।
-আসবে তো ?
-হুম ।

আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম । দরজার কাছ পর্যন্ত তাইফা এল । আমি দরজা দিয়ে নেমে যখনই ওর দিকে ফিরে চাইলাম তখনই দেখি ওর চোখে পানি । এই প্রথম বারের মত ওর চোখে পানি দেখে সত্যি সত্যি বুকের ভেতর টা একটা মোচড় দিয়ে উঠলো । মনে কিছু না ভেবে ট্রেন থেকে ওকে নামিয়ে নিয়ে আসি । বলি তোমার যাওয়ার দরকার নেই । আমরা রাতের বেলা ছাদের বসে গল্প করবো, সারা দিন রোদের ভিতর টো টো করে ঘুরে বেড়াবো । তুমি যেও না ।

ট্রেন ততক্ষনে চলতে শুরু করে দিয়েছে । আমি একটু পিছিয়ে পরেছি । দাড়িয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি ট্রেনটা একটু একটু করে তাইফা কে আমার কাছ থেকে দুরে নিয়ে যাচ্ছে । আমি যেমন ওর দিকে তাকিয়ে আছি ও তেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এক ভাবে । একটু হেসে হাত নাড়ার চেষ্টা করলাম । কিন্তু মুখ দিয়ে হাসি আসলো না ।

একটু পরেই তাইফা গেটের কাছ থেকে ভিতরে চলে গেল । আমার মন টা একটু খারাপ হল । ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত মানে যতক্ষন দেখা যায় ততক্ষন তাইফা গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকবে ।তবুও ফাকা গেট টার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুটা সময় । ট্রেন টা বেশ দুরেই চলে গেছে । আমি পেছন ফিরে হাটা শুরু করলাম । ঠিক তখনই আমার কেন জানি মনে হল পিছন ফিয়ে তাকাতে । আমি পেছনে ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে দেখলাম তাইফা আবার গেটের কাছে এসেছে । তবে এবার ওর কাধে ব্যাগ ।
আামর ভিতর হঠাৎই একটা ভাবনা সৃষ্টি হল ।
ও কি করতে যাচ্ছে ?
নেমে পড়বে নাকি ?
বোকা মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে ?
ট্রেন ততক্ষনে চলছে ভালই গতিতে । আর কিছক্ষনের ভিতরেই স্টেসনের প্লাটফর্ম পার হয়ে যাবে ।
আরে কি করতে যাচ্ছে মেয়েটা ?
আমি তাইফা বলে চিৎকার দেওয়ার আগেই তাইফা ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে আশ্চর্য দক্ষতায় প্লাটফর্মের উপর দাড়িয়ে পড়লো । আমরা যেভাবে ঢাকার চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়ি ঠিক তেমনই । আমার মতই অনেকেই তাইফার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন ।
আমি দৌড়ে গেলাম ওর কাছে । বলল
-এটা কি ছিল ?
-দেখলা না ?
-তুমি কি পাগল নাকি ?
-হুম । কোন সমস্যা ?
-তোমাকে না থাপড়ানো দরকার । এভাবে কেউ লাফ দেয় ? যদি কিছু হত ?
তাইফা সুন্দর করে হেসে বলল
-আরে কি হবে ? মনে নেই আমরা কত বার চলন্ত বাস থেকে এভাবে নেমে পরেছি ।
-তুমি কেন নেমে পড়লে ?
-কেন জানি তোমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইলো না । তুমি তো আর বলবা না থেকে যেতে তাই গাধার মত আমি নিজেই নেমে পড়লাম ।
আমি আসলেই কোন কথা বলতে পারলাম না । কেবল তাইফার দিকে তাকিয়ে রইলাম ।এই মেয়েটা এমন কেন !

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত