শাহীনের সাথে ডির্ভোস হওয়ার আজ ৬ মাস পর শাহীন আমাকে ফোন দিলো, খুব অবাক হয়ে গেলাম, ডির্ভোস হওয়ার ৬ মাস পর আজ মানুষটা কি মনে করে আবার আমাকে ফোন দিলো। কিন্তু একটু আনন্দিত ও হলাম এই ভেবে যে – অনেকদিন পর আবার মানুষটার সাথে একটু কথা বলতে পারবো।
আচমকা হয়ে ফোনটা ধরলাম – হ্যালো
ও পাশ থেকে আওয়াজ আসলো – কেমন আছো?
কথাটি শুনে চোখ দুটো কেনো জানি ঝাপসা হয়ে গেলো। হৃদয়ের মাঝে সেই পুরনো স্মৃতিগুলো আবার উকি মারতে লাগলো, ভালোবেসে মানুষটাকে বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু কেনো জানি বিয়ের পর একটা বছর যেতে না যেতেই মানুষটা বদলে গেলো। আমার সাথে খারাপ আচরন করতে লাগলো, সামান্য ব্যাপার নিয়ে দিনরাত জগড়া করতে লাগলো, আমার সবকিছুই তার অপছন্দের তালিকার মাঝে স্থান পেলো, দিনরাত শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো – আমি ডির্ভোস চাই।
কথাটি এককেবারে বুকের মাঝখানে গিয়ে লাগতো, যেই মানুষটা একটা সময় আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতোনা আর আজ সেই মানুষটাই আমার কাছে ডির্ভোস চাচ্ছে? আমাকে সে এতটাই ভালোবাসতো যে আমার সামান্য খুশীতে তার পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে যেতো আর আমার চোখের সামান্য পানিতে তার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যেতো অথচ সেই মানুষটাই কিনা আমাকে আমাকে কাঁদাচ্ছে।
তবু ও সমস্ত ভাবনা, রাগ, অভিমানকে উপেক্ষা করে মানুষটার সাথে মানিয়ে নিয়ে আর ও ৬ টা মাস সংসার করলাম, কিন্তু তারপর আর পারলাম না কেননা এক হাতে যেমন কখনোই তালি বাজে না ঠিক তেমনি জোর করে ও সংসার করা যায় না। ওর অনাদর আর অবহেলা দিন- দিন ক্রমশ বাড়তে থাকে অবশেষে একদিন খুব বাজে ভাবে জগড়া করে অতপর আমাকে বলে – দয়া করে আমাকে মুক্তি দেও।
সেদিন কেনো জানি মনে হলো মানুষটার হৃদয় মাঝে আমার জন্য আর ভালোবাসা নেই এই হৃদয়টায় অন্য কেউকে স্থান দিয়েছে, কিন্তু কেনো জানি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।কারন এই মানুষটা একদিন আমাকে বলেছিলো – যুথি আমার শরীরটা হয়তো আমার কাছে আছে কিন্তু আমার হৃদয়টা শুধু তোমার জন্য।
আর আজ সেই মানুষটাই আমাকে বলে তাকে মুক্তি দিতে।
ডির্ভোস পেপারে সই করতে গিয়ে কেনো জানি বার – বার হাতটা কাপছিলো, অশ্রু গুলো অনায়াসে গড়িয়ে পড়লো, কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম মানুষটা এক নিমিষেই সই করে দিলো। অবাক হয়ে গেলাম, সময়ের সাথে- সাথে মানুষ এতটা বদলে যায় নাকি সময়ের সাথে মানুষগুলোকে আমরা একটু বেশি চিনে ফেলি। চলে আসলাম বাবার বাড়ি মানুষটাকে মুক্ত করে দিয়ে, কিন্তু আজ ৬ মাস পর আবার কি মনে করে ফোন দিলো?
– কি ব্যাপার আমার সাথে কি তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
– না তেমন কিছুনা আসলে অনেকদিন পর ফোন দিলে তো তাই খুব অবাক হলাম। তা কি মনে করে ফোন দিয়েছো?
– আসলে আজ তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে একটু আমার সাথে দেখা করতে আসবা।
কথাগুলো যেনো এক নিমিষে আমার মনের সমস্ত রাগ, অভিমানকে দূরে সরিয়ে আবার সেই পুরনো ভালোবাসাকে জাগ্রত করে, কেনো জানি মানুষটাকে না বলতে পারলাম না, কিছুক্ষণ ভেবে বললাম-আসবো কিন্তু কোথায়।
– ইসলামিয়া হসপিটালের তিনতলার ৬ নং কেবিনে।
বিস্মিত হয়ে গেলাম, হসপিটালে কেনো? তাহলে মানুষটার কি কিছু হয়েছে
– হসপিটালে কেনো?
– এলেই দেখতে পারবে আর হ্যা একদম লেট করবে না তোমার তো আবার স্বভাব সবসময় লেট করা।
কথাটা বলেই মানুষটা ফোনটা কেটে দিলো।
আর আমার পরানে তখন আনন্দের শিহরণ জাগলো – যাক তাহলে শাহীন আমাকে এখন ও ভালোবাসে তাইতো আমার সবথেকে বাজে স্বভাবটার কথা ওর মনে আছে। এই স্বভাবটার জন্য আমি যে প্রতিদিন ওর হাতে কত বকা শুনতাম তা বলে শেষ করা যাবে না। আর শুধু বকাই না ওর সাথে রিলেশন হওয়ার পর থেকে আমার প্রত্যেক জন্মদিনে ও শুধু আমাকে ঘড়িই গিফট করতো একটু সময়ের প্রতি যত্নবান হতে, কিন্তু কেনো জানি আমি আমার এই স্বভাবটাকে পরিবর্তন করতে পারলাম না।
কিন্তু আজকে লেট করা যাবে না, খুব তাড়াহুড়ার সহিতে ওর পছন্দের নীল শাড়িটি পড়লাম, চোখে একটু কাজল দিলাম, ঠোটটাকে রক্তজবা করে অতপর খোপায় এক গুচ্ছ ফুল লাগালাম , শাহীন সবসময় আমার এই সাজটাকে খুব পছন্দ করতো,তাই আজ আবার ওর পছন্দ মতো সাজলাম।
ও খুব পায়েস পছন্দ করে তাই ডির্ভোস হওয়ার পর ও প্রতিদিন আমি নিজ হাতে পায়েস রান্না করে রেখে দিতাম এই ভেবে যে – কোনো এক প্রয়োজনে হয়তো মানুষটি একদিন আমার নিকটে আসবে আর আমি তার পছন্দের খাবারটা তাকে দিয়ে বিনিময়ে তার মুখে একটু মলিনমাখা হাসি দেখবো। প্রতিদিনকার মতো আজ ও পায়েস রান্না করেছিলাম। অতঃপর পায়েসটাকে নিয়ে খুব দ্রুততার সাথে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ঘড়ির কাটার সাথে পা মিলিয়ে আজ চলতে থাকলাম, একটা সিএনজি তে উঠলাম, ঘড়ির কাটাটা আজ মনে হচ্ছে একটু তাড়াতাড়ি ঘুরছে কিন্তু আমার পথ চলাটা যেনো শেষ হচ্ছে না।
হঠ্যাৎ করে রাস্তায় জ্যামে আটকে গেলাম, না, আজ লেট করবো না, সি এনজি থেকে নেমে হাটতে লাগলাম।
অবশেষে হসপিটালে পৌছালাম, তিনতলার ৬ নং কেবিনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।
কিন্তু যতই এগোচ্ছি ততই ভয় যেনো আমাকে কামড়ে ধরছে এই ভেবে যে ওর কিছু হলো না তো।
অবশেষে কেবিনে গিয়ে পৌছালাম, -কিন্তু কেবিনে গিয়ে দেখলাম আমার শাশুড়ি এক পাশে বসে কান্না করছে আর ফারহান অর্থ্যাৎ আমার দেওয়ার আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করে দিয়েছে। কিন্তু শাহীনকে কোথা ও দেখতে পেলাম না। হঠ্যাৎ করে কেবিনের দিকে নজর পড়তেই দেখি শাহীন ঘুমিয়ে আছে একটা নিস্পাপ শিশুর মতো, কিছু বুঝে উঠার আগেই ফারহান আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললো – ভাবি ভাইয়ের লেখা শেষ চিঠি।
বিস্মিত হয়ে চিঠিটা খুললাম, দেখলাম তাতে লেখা আছে – আমি জানি আজকে ও তুমি লেট করবে, তোমার লেট করার স্বভাবটা আর আমি বদলাতে পারলাম না। কিন্তু কি জানো? কিছু ক্ষেএে সামান্যটুকু লেট তোমার জিবনের সব সুখ কেড়ে নিতে পারে, তাই দয়া করে একটু সময়ের প্রতি খেয়াল রেখো।
ভালোবেসে তোমায় আমি বিয়ে করেছিলাম, খুব ইচ্ছে ছিলো তোমার হাত ধরে মৃত্যু অবদি পথচলার কিন্তু তা হয়ে উঠা হলো না।কেননা বিয়ের ৬ মাস পর আমি জানতে পারলাম আমার কিডনি দুটো ড্যামেজ হয়ে গেচ্ছে, সেদিন ইচ্ছে করছিলো এসে তোমাকে সত্যি কথাটা বলে দেই, কিন্তু তোমায় এতো বেশি ভালোবেসেছি যে খুব স্বার্থপর হয়ে গেলাম আর তাইতো আমার কষ্টের ভাগ তোমাকে দিতে পারলাম না। কারন আমি জানতাম তুমি ভেঙ্গে পড়বে।
তোমার আমার প্রতি যাতে ঘৃনা জন্মে তাই তো তোমার সাথে খারাপ আচরন করতে শুরু করলাম, তোমার নতুন জিবন কামনা করেছি তাইতো তোমার কাছ থেকে ডির্ভোস চেয়েছি আর তোমায় এতো বেশি ভালোবেসেছি যে আমার ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর আগে তোমার মুখটা দেখে যেনো মরতে পারি কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। তুমি না আমাকে সবসময় বলতে আমি বদলে গেচ্ছি আসলে কি জানো মানুষ কখনোই বদলায় না শুধু সময় এবং বাস্তবতার সাথে- সাথে মানুষ বদলে যাওয়ার অভিনয় করে। নতুন করে জিবনটাকে শুরু করো আর নিশ্চয় আজ তোমার জন্মদিন এ জিনিসটা তুমি ভুলে গেচ্ছো। এটা ও তোমার একটা বাজে স্বভাব আমি তো আর তোমার সাথে থাকবোনা, তাহলে এসব বাজে স্বভাব কে সুদ্রে দিবে বলোতো? , তাই নিজেকে একটু কেয়ার করো। তোমার জন্মদিনের গিফটটা আমার মাথার পাশের টেবিলে রাখা আছে একটু কষ্ট করে নিয়ে নিও। ভালো থাকিস পাগলি।
ইতি
তোর পাগল।
চিঠিটা পড়ে মনে হলো কেউ একজন যেনো আমার বুকের মাঝখানে একটা তীর মেরে দিলো, শাহীনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ, তারপর ওর মাথার পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে একটা বক্স রাখা। বক্স টা হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম সেই পুরনো গিফটটা ঘড়ি। বাইরে তখন আকাশ কাদছিলো আর গিফটটা দেখে আমার মনের আকাশে ও বৃষ্টি দেখা দিলো।আর, বার – বার সুদূর থেকে সেই আওয়াজটা যেনো আমার কানে ভেসে আসলো, – ভালো থাকিস পাগলি, ইতি তোর পাগল।।।