ঘুম থেকে উঠেই অরূপের মনটা খারাপ! ঘরটা বেশ অন্ধকার। দুটো বেড, দুটো টেবিল আর টেবিলের উপর দুইগাদা বই; অরূপের আর ফিরোজের। এই হল দুজনের ভাগাভাগি মেসের রুম। মেসের লোকসংখা চার রুমে আটজন, বুয়া এসে প্রতিদিন রান্না করে দিয়ে যায়।
অরূপ ঘুম থেকে একটু দেরিতেই ওঠে। পাশে রাখা মোবাইলে সময়টা দেখলো ১০টা বাজে। বেড থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শিয়রে রাখা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোটাকম্বল’ ;কাল অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে পড়তে রেখে দিয়েছে। এক সপ্তাহ ভার্সিটি বন্ধ, কোন কাজ নেই, শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে।
হঠাৎ মোবাইলে ভাইব্রেশনে বেজে উঠলো। স্কিনে তাকিয়ে দেখে তার কাজিন সামিয়া কল দিয়েছে।
-হ্যালো?
= ভাইয়া, আজ বিকেলে ফ্রি আছেন?
-কেন, কি হয়েছে?
=আজ আপনার সাথে বইমেলায় যাবো।
-আচ্ছা আসিস।
=সাথে আমার এক বান্ধবিও যাবে; বান্ধবি দেখতে কিন্তু অনেক সুন্দরী!
-তাহলে তোর বান্ধবিকে আনার দরকার নেই; প্রেমে পড়ে যেতে পারি।
=দেখেন কপালে জোটে কি না!
-আচ্ছা কখন আসবি?
=আমরা বিকেল ৪টায় ছবিরহাটে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।
অরূপ মানিব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখে ৮০টাকা মাত্র। বইমেলায় গেলে বেশ কিছু খরচার ব্যাপার-স্যাপার আছে। কিন্তু টাকা পায় কোথায়?
পরে রুমমেট ফিরোজের নিকট থেকে ১০০০ টাকা ধার নিয়ে ছবির হাটে রওনা দিল।
সামিয়া ও তার বান্ধবি ইপ্সিতা, দুজনেই হাজির। সত্যিই ইপ্সিতা মেয়েটা অনেক সুন্দরী। তার কাজিন যেটুকু বলেছিল তার চেয়ে একটু বেশিই সুন্দরী! গোলগাল চেহারা, চুল বেশি লম্বা নয়, কেমন যেন কার্টুন কার্টুন দেখতে। অরূপের খুব পছন্দ হয়ে যায় ইপ্সিতাকে।
অরূপ ইপ্সিতার পাশে গিয়ে দেখলো উচ্চতায় তার সাথে মানায় কি না! বেশ দারুণ যায়! সামিয়াকে একটা ফটোও তুলতে বললো।
পরে অরূপ তাদের দুজনকে বইমেলা ঘুরিয়ে দেখাল। দুজনকে দুইটা বই কিনে গিফট করলো।
একটা রেস্টুরেন্টে কিছু খাওয়া-দাওয়া করলো। সর্বসাকুল্যে অরূপের ৭০০টাকা গচ্চা গেল!
রাতে আবার সামিয়ার কল,
=হ্যালো ভাইয়া?
-হ্যা, বল।
=ইপ্সিতা আপনাকে পছন্দ করে নি। আপনি লম্বায় অনেক ছোট; আর মেয়েরা তো লম্বা ছেলেদের পছন্দ করে!
-কেন, তোর বান্ধবি কি তালগাছ পছন্দ করে? লাগবে না ভালোবাসা; ৭০০ টাকা ইনভেস্ট করলাম, সব পানিতে গেল।
রেগে ফোন রেখে দেয় অরূপ! মেজাজ চরম বিরক্ত! এই মূহুর্তে সে যদি পারতো তবে নিজের উপর দিয়ে রোলার চালিয়ে আরো দুই ইঞ্চি বড় করে ফেলতো। ৫ ফুট সাড়ে ৪ ইঞ্চি কি খুব ছোট হয়ে গেল? যত্তসব!
একটু পরেই দেখে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে মোবাইলে কল-
-হ্যালো, কে বলছেন?
=ভাইয়া, আমি সামিয়ার বান্ধবি ইপ্সিতা বলছি। সামিয়ার কাছে আপনার নাম্বারটা নিলাম।
-হ্যা, কি অবস্থা?
=ভাইয়া, আজকের দিনটা আমার জীবনের চরম আনন্দের দিন! আপনি একটা বই গিফট করেছেন। প্রথম কেউ আমাকে কিছু একটা গিফট করলো এবং সেটা বই। ভেবেছি আমিও আপনাকে কিছু একটা গিফট করবো। (অরূপ মনে মনে ভাবে, যাক ইনভেস্টের টাকা কিছুটা হলেও উসুল হবে।)
আগামি ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে তে ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্র সরোবরে বিকেল ৪টায় আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।
বলেই রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা না করে দ্রুত কলটা কেটে দেয় ইপ্সিতা।
অরূপ যথাসময়ে রবীন্দ্র-সরোবরে গেল এবং দেখলো এখনো ইপ্সিতা আসে নি। কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করলো, ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ২০ মিনিট- নাহ, মেয়ে তো আসে না। ‘মেয়েটা কি আমার সাথে ফাজলামি করছে?’ অরূপ মনে মনে বললো। ভ্যালেন্টাইন ডে তে মনে হয় অরূপ চরম একটা বোকা বনে গেল!
পরে বিরক্ত হয়ে ফিরে আসার জন্য কয়েক পা এগিয়েছে; পিছন থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ, ‘ভাইয়া’! দেখে ইপ্সিতা। গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। কি দরকার ছিল এমন লুকোচুরির?
‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে’ বলে ইপ্সিতা একটা লাল রঙের গোলাপ দিল অরূপকে।
জবাবে অরূপও বললো, ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে’।
-কিন্তু গিফট শুধু একটা গোলাপ? আমি মনে করেছিলাম দামি কিছু।
=গোলাপ কি দামি কিছু না? গোলাপের সাথে যে দামি একটা জিনিসও আপনাকে গিফট করেছি; সেটা এখনো বোঝেননি!
-‘বুঝেছি’ বলেই অরূপ আর দেরি না করে তার দেওয়া গোলাপ দিয়েই তাকে প্রোপজ করে।
গল্পের মতই তাদের ভালোবাসার শুরু হল। দুজনের কেউই এখনো বুঝে উঠতে পারে নি কিভাবে তাদের ভালোবাসাটা হয়ে গেল!
তাদের ভালোবাসায় বিকেলের সূর্যটা যেন লজ্জায় লাল গেল! ছুটে চলেছে তার নিজস্ব গন্তব্যে।