ইন্টার্ভিউ দিয়ে বের হতেই শুভ দেখে মিরপুরের বাস দাঁড়িয়ে। আর দেরি না করে বাসে উঠে পরলো। দুপুরবেলা! তার উপর খাঁ খাঁ রোদ। জানালা দিয়ে রোদ আসার কারণে বাসের একপাশ পুরো ফাকা। একপাশ কিছুটা ভর্তি।
 ভর্তি পাশটার পেছনের দিকের একটা সীটে বসে তিথিকে কল দিলো। অমনি পাশে এসে বসলো এক অপরিচিতা মেয়ে। তিথি কল রিসিভ করে হ্যালো বলেছে এমন সময় পাশের সীটে বসা মেয়েটা শুভকে বলে বসলো -” এগারো নাম্বার যায় এই বাস ? ”
 শুভ হ্যা বলে তিথির সাথে কথা বলবে তার আগে মেয়েটা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো , ” আমাকে একটু বলে দিবেন এগারো নাম্বার আসলে ? প্লিজ! আমি এর আগে কখনো যাই নি। ”
 শুভ শুধু উত্তরে মেয়েটাকে হা বলে মোবাইলটা কানের কাছে নিয়ে হ্যালো বলতেই তিথি জিজ্ঞেস করলো, ” সাথে কে ? ”
 -” কেউ না তো।”
 -” মিথ্যুক! এইমাত্র একটা মেয়ে তোমাকে বলেছে এগারো নাম্বার আসলে ডেকে দিতে। ”
 -” তা বলেছে। কিন্তু সে তো আর আমার সাথে নয়। ”
 -” কোথায় আছো ?”
 -” বাসে আছি ফার্মগেটের জ্যামে। ”
 -” নামো। ”
 -” হা ? ”
 -” তোরে নামতে কইছি নাম।”
 -” আচ্ছা! কল কাটো নামতেছি। ”
 -” কল কাটবি না। তুই ফার্মগেট থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসবি। তাও আমার সাথে কথা বলতে বলতে। ”
 -” বলছি যে সোনা। অতো সময় কথা বলার ব্যালেন্স নেই তো ফোনে।”
 -” তুই কল কাট। আমি কল দিতেছি। পাশের সীটে মেয়ে মানুষ বসলে খুশীতে গদগদ হয়ে পিরিতের আলাপ শুরু করে দেস। জলদী নাম। ”
 শুভর কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। এই খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চৈত্রের দুপুরে কোন পাগল ফার্মগেট থেকে হেটে মিরপুর যাবে ? শুভর যেতে হচ্ছে। ইদানীং তিথি কেমন যেনো বদলে গেছে। সবকিছুতেই সন্দেহ করে বসে। সাথে করে হেডফোনটাও আনে নি। একহাত দিয়ে মোবাইল কানে ধরে কতোক্ষণ কথা বলতে বলতে যাওয়া যায় ?
 ২.
 -” আমি স্যরি সোনা। ”
 শুভ একি শুনছে ? ভুতের মুখে রাম রাম! তিথি স্যরি বলছে! অবিশ্বাস্য ব্যপার বটে। অবাক হওয়ার পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে শুভ জিজ্ঞেস করে, ” তুমি স্যরি কেন বলছো সোনা ? ”
 -” দুপুরে তোমাকে হেটে আসতে বললাম তাই। আসলে তোমার পাশে অন্য কোন মেয়ে বসুক তা আমি মানতে পারি ন। ”
 -” সমস্যা নেই সোনা। হাটাহাটি করা তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মনে হয় একটু বেশী হেটে ফেলেছি ; তাই পা ব্যথা করছে। ”
 -” এই পাখির আওয়াজ পাচ্ছি! কোথায় ডাকে পাখি এই রাতের বেলায় ? ”
 -” হাবিবি আর ইয়ো বেবি চেঁচামেচি করছে। ”
 -” ওরা কারা ? ”
 -” তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি। আমার রুমে দু’জোড়া পাখি আছে। মেয়ে দু’টোকে এক খাচায় রেখেছি। আর ছেলে দু’টোকে এক খাচায় রেখেছি। ছেলে দু’টো হচ্ছে ওদের প্রেমিক। মেয়ে দু’টোর নাম হাবিবি ও ইয়ো বেবি। ছেলে দু’টোর নাম আশিক, দিওয়ানা। ওই মেয়ে পাখি দু’টো আমার সাথে চেঁচাচ্ছে। ”
 -” কেন ? ”
 -” ওদের প্রেমিক দু’টোকে আলাদা খাচায় রেখেছি তাই। ”
 -” আলাদা রেখেছো কেন ? ”
 -” আমি আর তুমি আলাদা থাকি। ওদের এক সাথে কি করে রাখি ? ”
 -” কিন্তু তোমার বারান্দায় কোন দিন পাখি দেখলাম না তো। ”
 -” আমার রুমে রেখেছি ওদের। আমার সুখ দু:খের সাথী ওরা। সারারাত ওদের সাথে কথা বলেই কাটিয়ে দেই। ”
 -” কি বললি হারামী ? সারারাত ওদের সাথেই গল্প করিস তাহলে আমি ফেসবুক একাউন্ট খুললাম কেন ? জলদী পাখি বারান্দায় রাখ। সারারাত পাখির সাথে পিরিতের আলাপ করো ; আর আমি এদিকে রাত জেগে বিছানায় শুঁয়ে শুঁয়ে পাশ বদলাই। কাল সকালে যেনো পাখি বারান্দায় দেখি। ”
 -” আচ্ছা সোনা! এখন রাখি। মা নানুবাড়ী যাবে। বাসে তুলে দিতে যাবো এখন। রাখি সোনা। ”
 -” তোর রাখারাখির গুষ্টিকিলাই। পাখি যেন বারান্দায় দেখি। ”
 প্রচণ্ড রাগ নিয়ে কলটা কেটে দিয়ে তিথি। শুভ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। হুট করে কি হলো তিথির ? মেয়ে মানুষ তো দূর শুভর পাশে কোন পাখিও সহ্য করতে পারছে না।
 ৩.
 কলিংবেল বেজেই চলেছে। ঘুম ভর্তি চোখ নিয়ে শুভ বিছানা থেকে উঠে যায়। মা বাসায় নেই। কোথায় একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাবে। কে যেন এসে কলিংবেল দিচ্ছে।
 ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে দরজা খুলে শুভ। দেখে তিথি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা ব্যাগ। ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল দেখছে ভেবে শুভ চোখ ডলে। উঁহু! তিথিই দাঁড়িয়ে। শুভ কিছু বলার আগেই শুভকে ধাক্কা দিয়ে তিথি রুমে প্রবেশ করে বলে -” পাখি কই ? ”
 শুভ ইশারায় নিজের বেডরুমটা দেখায়। তিথি জোরে জোরে হেটে বেডরুমের দিকে এগোয়। পেছন পেছন ছুটে শুভ।
 বেডরুমে প্রবেশ করেই তিথি বলে, ” পাখি না বারান্দায় রাখতে বলেছিলাম। আমি যখন থাকবো তোমার সাথে রুমে কোন পাখি রাখতে পারবে না। বুঝলে ? ”
 শুভর কোন উত্তর নেই। তিথি পেছন ঘুরে শুভকে খুঁজতে গিয়ে দেখে শুভ আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
 প্রেমিকা বাসায় এসেছে। কেউ নেউ রুমে দু’জন ছাড়া। কোথায় একটু প্রেম প্রেম খেলবে। আর শুভ কিনা ঘুমাচ্ছে। শুভকে ডাকতে গিয়েও ডাক দেয় না তিথি। ভাবে ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।
 ৪.
 আরো প্রায় দু’ঘন্টা পর ঘুম ভাঙে শুভর। অবশ্য দু’ঘন্টায় অতোটা ভালো ভাবে ঘুমোতে পারে নি শুভ। কি জানি বাসায় কি করছে তিথি। কখনো থালা বাসনের আওয়াজ হয়। কখনো বা দরজা খোলার আওয়াজ। এতো আওয়াজের মাঝে ঘুমোন যায় ?
 শুভকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই তিথি বললো, ” যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। নাস্তা বানিয়েছি নিজের হাতে তোমার জন্য। ”
 শুভ খুশীতে লাফিয়ে উঠে। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে। লুচি, ধনে পাতার চাটনি আর মাংস। মনে হয় কবুতরের। শুভ বড়সড় একটা মাংসের টুকরো মুখের মাঝে দিয়ে বলে, ” বাহ! সেরকম হয়েছে। কবুতর কোথায় পেলে ? ”
 -” কবুতর না। তোমার পাখি রান্না করেছি। ”
 ” কি? ” বলেই শুভ দৌড়ে রুমে যায়। পাখির খাঁচার দিকে তাকাতেই বোকা বনে যায়। দু’টো খাঁচার একটিও নেই। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না শুভ। চেঁচিয়ে না বলেই বমি করে দেয়। বমি করতে করতেই শুভ ফের জিজ্ঞেস করে -” খাঁচা কি করেছো ? ”
 -” ফেলে দিছি। ”
 শুভ আবার ওয়াক করে বমি করে দেয়। নিজের পোষা পাখির মাংস নিজে খেয়েছে কথাটা ভেবেই শুভর গা শিউরে শুধু বমি হতে থাকে।
 ৫.
 বিকেলে ছাদে উঠে শুভ। সারাদিন ধরে বমি করেছে। শরীর বড্ড ক্লান্ত। তিথি কেন এমন করলো ? ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না শুভ।
 তিথিদের ছাদে শুভ ডাকতে লাগলো -” ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ। ” কিন্তু আজ ডাকের মাঝে কোন জোর নেই। তবে তিথি ঠিকই শুনতে পেলো।
 কিছুক্ষণ বাদ ছাদে তিথি আসলো। শুভকে দেখেই বললো, ” মা জিজ্ঞেস করেছে ছাদে যেই কুকুরটা আসে তার গলার আওয়াজে আজ জোর নেই কেন ? ”
 শুভ কোন উত্তর দেয় না। তিথি আবার জিজ্ঞেস করে -” এংগেল পরীবানু কে ? ”
 -” জানি না। ”
 -” জানো না ? তোমার ডিপিতে লাভ রিএক্ট দিয়েছে। আবার নিচে কমেন্ট করেছে-” শুভ তোমায় হেব্বি লাগছে। ”
 -” ওহ! ওর নাম মর্জিনা বানু। অন্তুর খালাতো বোন আবার অন্তুর প্রেমিকাও। ”
 -” কিন্তু মর্জিনা তো অন্তুকে ভাইয়া বলে ডাকে। ”
 -” এখন এটা আমি কি করবো ? অন্তুকে ভাইয়া ডাকে ; আমাকে নাম ধরে ডাকে । এটা কি আমার দোষ ? ”
 ঠাশ! কোন কিছু না ভেবেই তিথি থাপ্পড় দিয়ে বসলো শুভকে। বলতে লাগলো -” ফাজলামি করো! তুমি জানো না কার দোষ ? ”
 শুভ রেগে গিয়ে বললো -” তুই দাঁড়া। ” তারপর হুট করে নিজেদের ছাদে এসে নিচে নেমে গেলো। তিথি বুঝতে পারছে না শুভ কোথায় গেলো।
 একটু পর আবার শুভ হাজির। তবে হাতে ফলকাটার চাকু। চাকুটা তিথির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” এখন গিয়ে পরীবানু থুক্কু মর্জিনা বানুরে জবাই করো। তারপর ঝাল মশলা বেশী করে দিয়ে ভুনা করে আমায় দিয়ে যাও। লুচি দিয়ে খাবো। আরে তুমি কি পাগল হয়ে গেছো ? বাসে পাশে একটা মেয়ে বসলো তার জন্য আমাকে হেটে হেটে বাসায় আসতে হলো। আমার রুমে দু’জোড়া পাখি ছিলো। তাদের সাথে কথা বলি ; তাই তাদের ভুনা করে খাওয়ালে। এবার মর্জিনারেও তাই করো। ইউ আর টোটালি ইনসেন। ”
 শুভ আর দাঁড়ালো না। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে ফিরে আসলো। শখের পাখিগুলোর এমন হাল কিছুতেই মানতে পারছে না। পাখির কথা মনে করেই আবার ওয়াক করে বমি করে দিলো।
 ৬.
 মাগরীবের আজানের পর পর শুভর বাসার দরজায় কলিংবেলটা বেজে উঠে। বিরক্তি নিয়ে শুভ উঠে যায় দরজা খুলতে।
 দরজা খুলে কাউকেই দেখতে পেলো না শুভ। তবে কেউ না থাকলেও শুভ অবাক হলো প্রচণ্ড।
 দু’টো পাখির খাঁচা একটার উপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা। বিন্দুমাত্র ভুল হলো না শুভর নিজের পাখিগুলোকে চিনতে। আর শুভকে দেখামাত্রই হাবিবি,ইয়ো বেবি, আশিক ও দিওয়ানা একসাথে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো।
 খাঁচার উপর একটা শাদা কাগজে কি যেন লিখে তার উপর সেই ফল কাটার চাকুটা রাখা। শাদা কাগজটা হাতে নিয়ে শুভ পড়তে শুরু করে –
 ” স্যরি! আমি ওদের নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কি পেয়েছো ওদের মাঝে জানতে। তোমাকে কষ্ট দিতে নয়।
 রাগ করেছো ? কি করবো বলো ? আমার তোমার বিছানা-বালিশ থেকে শুরু করে তোমার পায়ের ছেঁড়া জুতোটার উপরও হিংসে হয়। সারাক্ষণ আঠার মতো তোমার গায়ে লেগে থাকে।
 রাগ করো না লক্ষীটি।
 ভালবাসি। ”
 শুভ চিঠিটা পড়ে একা একাই বিড়বিড় করে হাসতে থাকে। আর ফিসফিস করে বলে -” বোকা মেয়ে কোথাকার! “
  










