আচ্ছা , আপনি হিমুর বইগুলো পড়েছেন ? অনেক সুন্দর না গল্পগুলো ? ইশ ! আমি তো হিমুর প্রেমে পড়েছি অনেক আগে – ও আচ্ছা ! তাই নাকি ? হিমুতো বন্ধনে জড়ায় না , জানেন না ? বাস্তবে হিমু থাকলে তো আপনার দশা রূপার মতই হতো । – নাহ ! আমি ওকে আমার প্রেমের ফাঁদে ফেলতাম । সে আমাকে ছেড়ে যেতেই পারত না । – তাই ? আপনি ছেলেদের খুব ভালোভাবে পটাতে পারেন মনে হচ্ছে ! । বাস্তবে হিমু থাকলে তাকেই আমি বিয়ে করতাম । এভাবেই তার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল । প্রথম দেখাও হয়েছিল সেদিন , এক বিয়ের অনুষ্ঠানে । আমি ছিলাম বরপক্ষ আর ও ছিল কনেপক্ষ । বিয়ের অনুষ্ঠান আমার কাছে খুব বিরক্তিকর লাগে , তবুও খাওয়াদাওয়ার লোভে না গিয়ে পারি না । তো সেদিন এমন একটা অস্বস্তিকর গরমের দিনে এক বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম এক অপরিচিত কমিউনিটি সেন্টারে । রাত আটটার বেশি বাজে , তবুও কেন খেতে ডাকছে না সে চিন্তা করতে করতে আমার প্রিয় এক্সপেরিয়াতে ফেসবুকে মেসেজ দেখছিলাম । তখনি পিছন থেকে একটি মেয়ের গলা শুনতে পেলাম । – আপনি কি বরের কিছু হন ? পিছন ঘুরে তাকালাম । নীল শাড়ি পড়া এক নারী । প্রথম দেখাতেই ধাক্কামত খেলাম । মনে হল আকাশ থেকে কোন নীলপরী নেমে এসেছে ডানা লুকিয়ে । বাইরে থেকে সে ধাক্কাটা সামলে জবাব দিলাম , ‘হে । আমি বরের বন্ধু । আপনি ?’ – আমি কনের খালাতো বোন । তো , একা দাঁড়িয়ে আছেন যে ? সাথে কেউ নেই বুঝি ? – আসলেই নেই । আর আমার এসব লোকারণ্য ভালো লাগেনা । তাই নীরব জায়গা খুঁজে নিয়ে একটু নিঃশ্বাস নিচ্ছি । আপনি একা কেন ? – আমি ? আমিও একা থাকতে পছন্দ করি । দুইজন একা মানুষ এক হয়ে কথা বলছি , কেমন না ব্যাপারটা ? হা হা হা । এভাবেই কথা হচ্ছিল আগন্তুকের সঙ্গে । আগন্তুক ? না তো । তেমন তো লাগছে না , মনে হচ্ছে অনেক পুরনো বন্ধু আমরা । পরিচয় , নাম , সবই জানলাম । বয়সে তিন বছরের ছোট , নাম মৃদুলা । নাম শুনে মনে হল এ নামটা ওর সাথেই যায় । যাই হোক , সেদিন অনুষ্ঠান শেষে যখন ফিরছিলাম তখন কি যেন মনে করে তাকে আমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে আসলাম । সেও হাসিমুখে নিল , বলল , ‘আবার দেখা হবে ।‘ আমিও জানতাম আবার ওর সাথে আমার দেখা হবে , খুব শীঘ্রই । সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার পর ক্লান্তি আমাকে ছাড়ল না । সটান হয়ে শুয়ে ঘুমে তলিয়ে গেলাম । স্বর্গের পরী মৃদুলার কথা মনে করার জন্য এক সেকেন্ড সময়ও পেলাম না । পরদিন সকালে মোবাইলে দেখলাম ৩টা মিসড কল , সবগুলোই একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে । পাত্তা দিলাম না , মনে করলাম দরকার হলে আবার ফোন করবে । একটা ওয়ার্কশপে যোগ দেয়ার কথা ছিল সেদিন , তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম । দুই ঘণ্টা পরঃ বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলাম , হঠাৎ নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম , ‘শুনছেন ?’ পিছন ফিরে তাকালাম । মৃদুলা । ভেবেছিলাম খুব শীঘ্রই দেখা হবে কিন্তু এতটাই কম সময়ের মধ্যে হবে চিন্তা করতে পারিনি । আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম , ‘আপনি ? এখানে?’ – ওয়ার্কশপে এসেছি । আপনি ? – আমিও । আমি আর আমার বন্ধুরা অনেক আগে থেকেই এমন একটা ওয়ার্কশপের জন্য অপেক্ষা করছিলাম । বাই দা ওয়ে , আজও কি আপনি একা ? – না । আমার দুই বান্ধবী এসেছে । আমি আপনাকে দেখে আসলাম । ও হে , কাল রাতে আপনার নাম্বারে ফোন করেছিলাম কিন্তু পাইনি । – ওইটা আপনার নাম্বার ? আমি বুঝিনি । আসলে কাল রাতে খুব ক্লান্ত লাগছিল , তাই আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । দুঃখিত । – ঠিক আছে । আমার জন্য আপনি আপনার ঘুম মাটি করবেন নাকি ? আমি কি আপনার প্রেমিকা ? হা হা হা । এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ও চলে গেল । যাবার পরপরই আমার বন্ধুরা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরোতে লাগল যেন আমি কতকিছু করে ফেলেছি । বন্ধুদের এই একটা সমস্যা , কোনকিছুই স্বাভাবিক করে নিতে পারে না । সবসময় মনে করে ‘ডাল মে কুচ কালা হে ।’ থাক ওদের কথা । মৃদুলার সাথে দেখা হবার পর থেকে মনে কেমন যেন একটা চঞ্চলতা অনুভব করছিলাম । কেন জানি না , একটা আলাদা শান্তি পাচ্ছিলাম । মনের মাঝে একরকম সাম্রাজ্যবাদ ভর করছিল বারবার । নাহ , আজ রাতে আমিই ওকে ফোন করব । যখন বাড়ি ফিরছিলাম , হেডফোনে গান বাজছিলঃ আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে , দেখতে আমি পাইনি তোমায় , দেখতে আমি পাইনি । এত সহজে কেউ আমাকে দুর্বল করে ফেলবে , চিন্তা করিনি । মেয়েরা বোধহয় এমনি , খুব সহজে মায়ায় জড়িয়ে ফেলতে পারে । সেই মায়ায় আটকা পড়ে সুখের স্বপ্ন দেখে আমার মত সুপ্ত প্রেমিকেরা । রাতে ফোন করলাম । প্রথমবার সাড়া পেলাম না । আবার করলাম , তখন রিসিভ করল , ‘হ্যালো ।’ আহা , কি মিষ্টি গলা মৃদুলা নামের নারীটির ! সারারাত কথা হল , কি কথা হল সেসব বলব না । এতকিছু না বলাই ভালো । এরপর থেকে মৃদুলা ছিল আমার প্রতিদিনের মানুষ । কথা , দেখা , সময় কাটানো , সবই হতো । ও কবিতা খুব পছন্দ করে আর আমি নিজেও মাঝে মাঝে কবিতা লিখি । ওকে স্বরচিত কবিতা পড়ে শোনাতাম , ও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত । ওকে নিয়ে লেখা কবিতাও ওকে শুনিয়েছি কিন্তু বলতে পারিনি সেগুলো ওকে নিয়ে লেখা । একসময় অনুমতি নিয়ে তুমি করে বলতে শুরু করলাম । এভাবে চলতে চলতে কখন যে ওকে নিজের করে নিয়েছি বলতে পারব না । ভালবেসে ফেলেছি ওকে । কিন্তু বলার মত যথেষ্ট সাহস আমার ছিল না , যদি চলে যায় এই ভয় ছিল সবসময় । একবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম , ‘আচ্ছা , তুমি আমাকে তুমি করে বলতে পারো না ? আপনি শুনতে আমার ভালো লাগে না ।’ ও বলল , ‘নাহ । আপনার জন্য তুমি আসে না । আপনি তো বড় । আপনিই বলি ।’ – তুমি বিয়ে করলে তোমার হাসব্যান্ডকে কি আপনি করে বলবে ? – হয়তো বলব । হা হা হা । আরকিছু বলতে পারলাম না । বলার সাহস হল না । সাম্রাজ্যবাদী মনটা কেমন যেন পতনের ধ্বনি শুনতে পেল । একটা জিনিস বুঝলাম , ‘ভালবাসার রাজ্যে গণতন্ত্রের কোন স্থান নেই ।’ এরপর থেকে মৃদুলা কেমন যেন হেঁয়ালি হয়ে গেল । অর্ধেক কথা বলে , বেশি হাসে , ফাজলামোর প্রবণতা বেশি । আমার কাছে ও কেমন যেন অচেনা মানুষ হয়ে গেল । মনে হল এ আমার মৃদুলা নয় , অন্য আরেকজন । আমার মৃদুলার হয়ে এই মৃদুলা প্রক্সি দিচ্ছে । এরকম আর সহ্য করতে পারলাম না । ঠিক করলাম মনের কথা সব বলে ফেলব । রাতে ফোন করতে গেলাম , দেখলাম ওয়েটিং । দুই – তিনবার চেষ্টা করলাম । নাহ , ওয়েটিং । ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম , ও ফোন দিল । রিসিভ করলাম , ‘হ্যালো ।’ – আপনাকে একটা কথা বলব । কাল দেখা করতে পারবেন ? – আমিও তোমাকে একটা কথা বলব । ঠিক আছে । – আচ্ছা । কাল সকাল ১১টায় …………….. আসবেন । রাখি । সাথে সাথেই ফোন রেখে দিল । আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিল না । মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল । পরদিন একটু ভালো করে সেজেগুজে গেলাম , মনের কথা বলব তাই । ওর সাথে দেখা হল । – বল তোমার কথা । – আপনি না কি বলবেন বলছিলেন ? – তোমারটা আগে বল , তারপর আমি বলব । মৃদুলা ব্যাগ থেকে একটা রঙিন খাম বের করল , ‘আমার বিয়ের কার্ড । আগামী সপ্তাহে বিয়ে । আপনি আসবেন কিন্তু ।’ মুহূর্তের জন্য অনুভূতিহীন হয়ে গেলাম । বাস্তবে ফিরতে একটু সময় লাগল কিন্তু ওর সামনে নিজেকে সামলে নিলাম । ওকে বললাম , ‘কংগ্রাচুলেশন ! তো পাত্র কি করে ?’ – কানাডায় থাকে । নিজেরা বিজনেস করেছে । অনেক ভালো ছেলে । প্রতিদিনই তো কথা বলি । ওকে কিন্তু আপনিই বলি । হা হা হা । – হুম । ভালো । শাদি মোবারক । আমার একটা কাজ আছে , আমি আসি । – আপনি না কি বলবেন বলছিলেন ? – থাক । অন্য আরেকদিন বলব । আজ আসি । চলে আসলাম । পিছে পড়ে রইল মৃদুলা , ওর জন্য লেখা কবিতা আর আমার না বলা মনের কথা । বাসায় ফিরে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম , অন্য নামের পাশে ওর নাম দেখার ইচ্ছা বা সাহস আমার হলনা । ভালবাসায় ভদ্রতা বলে কিছু রাখতে নেই , হতে হয় সোজাসাপটা । নাহয় ভদ্রতাই সাড়া জীবনের দীর্ঘশ্বাস হয়ে যেতে পারে । আর গণতন্ত্রেরও স্থান নেই এখানে , দরকার সাম্রাজ্যবাদী মন । সাম্রাজ্যবাদই তোমাকে ভালোবাসার জয় এনে দিতে পারবে । সেদিনের পর আর কোনদিন মৃদুলার সাথে যোগাযোগ করিনি । মৃদুলাও করেনি । স্বামীর সাথে সুখের সংসার করছে , আমাকে কেন মনে রাখবে ? আর মনে রাখলেও কয়েকদিনের বন্ধুই ভেবেছে , এর বেশিকিছু নয় । এরপর আর ভালবাসতে পারিনি , একাই আছি । এখন আমি একামনেই সম্রাট , একনায়ক । আমার মন জুড়ে এখন সাম্রাজ্যবাদ । কিন্তু সবশেষে আমি একটি ব্যর্থ প্রেমের কাহিনীর একজন ব্যর্থ প্রেমিক হয়েই থাকলাম ।
.
………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………..
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা