-আশিক থামো বলছি?
পেছন থেকে ডাক শুনে আশিক থেমে গেল।
নদিয়া রাগি দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে বলল
-তুমি ঐ ছেলেকে মেরেছো কেন?
-কেন মেরেছি তুমি ভালো করেই জানো।
-তাই বলে মেরে রক্ত বের করে দিতে হবে? তুমি চিনো ঐ ছেলেকে? এমনটা আর কখনো করবে না।
-সে যেই হোক আমার কোন আসে যায় না। তোমাকে কোন ছেলে বিরক্ত করবে আর আমি চুপ করে দেখব তা অসম্ভব।
-পরে যদি তোমার কোন ক্ষতি করে? তখনতো আমাকেই দোষারোপ করবে।
-তাতে আমি ভয় পাই না। তোমাকে কোন ছেলে বিরক্ত করলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না।আর মেরে কেটে ফেললেও ভুলেও তোমার দোষ দিব না। কেন বুঝ না ভালোবাসি তোমায়। অন্যকোন ছেলের তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোও সহ্য হয় না।
-কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না।
-তবুও তোমায় আমি ভালোবাসি।
নদিয়া কিছু কথা শুনাতে গিয়েও থেমে গেল। জানে বলে কোন লাভ নেই।
আশিক ছেলেটা মারামারি একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষকে কোন ছেলে বিরক্ত করতে দেখে আর সহ্য করতে না পেরে সাথে সাথে ছেলেটির নাকে জোরে এক ঘুষি মারে। নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হয়ে যায়। পাশের দু’জনে হাসপাতালে নিয়ে যাবায় ব্যস্ত হয়ে পরে আর যাবার সময় বলে যায় ‘কাজটা ঠিক করলি না এর প্রতিশোধ আমরা নিবোই।’
নদিয়া সম্পূর্ণ বিষয় পাশ থেকেই দেখল তারপরেই উপরোক্ত কথোপকথন হয়।
নদিয়া আশিকের কান্ড দেখে কিছুটা খুশি হলেও কেন জানি আশিককে সহ্যই করতে পারে না।
আশিক নদিয়াকে প্রায় ২বছর ধরে ভালোবাসে। কিন্তু নদিয়া তাকে একটুও ভালোবাসে না। খুবই কঠিন মনের মানুষ। আশিক নিজেও জানে না কেন তাকে ভালোবাসে না। আশিক কখনো কোন অন্যায় করিনি, নেশা করে না,রাজনীতি করে না, দেখতেও সুন্দর তবুও আশিক বুঝতে পারে না কী দোষের জন্য তাকে ভালোবাসে না। আশিক মাঝে মাঝে বলে ‘কেন যে এই কঠিন মনের মেয়েটির প্রেমে পরতে গেলাম দেশেতো আরো মেয়ে আছে তাদের প্রেমে কেন পরলাম না? অন্তত এতো কষ্ট পাইতে হতো না।’ এখন কিছুই করার নাই নদিয়াকে এতোটাই ভালোবেসে ফেলেছে যে এক মুহূর্তের জন্যেও নদিয়া ব্যতীত অন্যকিছু ভাবতে পারে না। আর অন্যকোন মেয়েতো, অসম্ভব।
এই দু’বছরে বহুবার নদিয়াকে প্রপোজ করেছে আশিক। ফলাফল হয় থাপ্পড় না হয় অপমান। তবুও আশিক তাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। আশিকের দুঃখ একটাই নদিয়ার কাছে কখনো বিন্দুমাত্র ভালোবাসা পেল না। শুধু কষ্টই পেয়ে গেল। নদিয়া তার ভালোবাসা একটুও বুঝল না।
বিকালে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার সময় বাসার পথে গলি দিয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা হলে এই গলিতে তেমন মানুষজন থাকে না। হঠাৎ ৫-৬জন ছেলে তার সামনে এসে হাজির হল। আশিক সকলের দিকে একবার করে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করল, নাকে ব্যান্ডেজ করা ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারল ‘এটা সেই ছেলে যাকে সকালে ক্যাম্পাসে মেরে নাক ফাঁটিয়ে দিয়েছিলাম। তখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল আর সাথে মাত্র দু’জন থাকায় কিছু বলেনি। রাজনীতি করে বলে এখন দল নিয়ে এসেছে তৃপ্তি সহকারে প্রতিশোধের জন্য। সবার মুখে ক্রোধ স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে যা আমাকে না মেরে কমবে না।’
ঘিরে ধরেছে সবাই আশিককে ফলে পালাতেও পারছে না। দুইজন আশিকের বাহু চেপে ধরল বাকি সবাই ইচ্ছামতো এলোপাথারি কিল ঘুষি দিতে থাকল। কেউ মাথায় কেউ পেটে কেউ পায়ে মারতে থাকল। আশিক এতোজনের সঙ্গে একটুও পেরে উঠল না। একজন ডান হাতে জোরে মোচর দিল তারপর নাকে ব্যান্ডেজ করা সেই ছেলেটা অত্যন্ত জোরে লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করল। আশিক চিৎকার করে মাথা চক্কর দিয়ে উঠায় নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে গেল। তবুও তারা থামল না পা দিয়ে সবাই ল্যাথি দিতে লাগল আর বিচ্ছিরি ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল। আশিক মাথায় হাত দিয়ে কোনরকমে মুখটা ঢেকে রাখছে। মাথার পাশে রক্তাক্ত হয়ে গেছে। চারপাশ থেকে লোকজন আসতেই সবাই স্থান ত্যাগ করল। তারা আশিককে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেল। মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে অনেক কিছু হয়ে গেল।
ঘণ্টাকয়েক পরে আশিক আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল। চুখ দুটো ফুলে রক্তজমে লাল হয়ে আছে। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সুন্দর মুখটা অন্যরকম হয়ে গেছে। মাথায় বড় করে ব্যান্ডেজ করা। গলার সঙ্গে হাত ঝুলিয়ে রাখা। বন্ধুরা অনেক আগেই চলে এসেছে। আশিককে দেখে হতভম্ব হয়ে আছে।
-কে করেছে তোর এই হাল? শুধু একবার বল সে যেই হোক সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব।
-থাকনা। কি দরকার শত্রুতা বাড়ানোর। আমার সঙ্গে শত্রুতা করে যদি নদিয়ার কোন ক্ষতি করে আমি নিজেকে মাফ করতে পারব না।
শুনেতো নারাজ বন্ধুরা। সবাই রেগে আগুন। বন্ধুরা জানে ও কিছুতেই বলবে না এতোকিছুর পরেও না।
তারা ঠিকই নিজেরা খোঁজ নেয়া শুরু করে দিল।
অবাক হলেও সত্যি আশিক মারামারি ও রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। যদিও বন্ধুদের বলতে চেয়েছিল সে ছেলেদের কথা কিন্তু নদিয়ার কিছু হয়ে যাবার ভয়ে আর বলল না। আত্নরক্ষার জন্য নিজে নিজে একটু মারামারি শিখে রাখলেও অনেকজন থাকায় তখন কিছু করতে পারে নাই।
৫দিন ধরে বেডে পরে থাকল। কোথাও যেতে পারল না। নদিয়া একদিনও আশিককে দেখতে আসল না। আশিকের খুব দেখতে ইচ্ছা করছে, একটুও থাকতে পারছে না কিন্তু বাইরে যাবার মতো শরীর এখনো সুস্থ না হবায় যেতেও পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছিল আশিকের। যাকে একটাদিন না দেখলে শান্তিতে থাকতে পারে না তাকে ছাড়া ৫টা দিন যে কীভাবে কাটিয়েছে তা আশিকই ভালো জানে। এই কয়টি রাত আশিক ঘুমাতে পারে নাই ঘুমের ঔষধ খেয়ে কোনরকমে একটু ঘুমিয়েছে।
বন্ধুদের দিয়ে অনেক অনুরোধ করাল নদিয়াকে একটিবার যাবার জন্য কিন্তু নদিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ‘সে আমার এমন আপন কেউ না যে লোকেদের হাতে মার খেলে দেখতে যেতে হবে। এমনকি মরে গেলেও দেখতে যাবো না।’ আশিক বন্ধুদের কাছ থেকে এই কথাগুলো শুনে খুব বেশি কষ্ট পেল। কিন্তু নদিয়াকে দেখতে না পেয়ে কষ্ট আরো বেড়েই যাচ্ছে আশিকের। যাকে শুধু দেখেই এই দুটি বছর অবহেলা সহ্য করার শক্তি পেল তাকে না দেখতে পেরে আজ আশিকের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সিদ্ধান্ত নিল সে ভার্সিটিতে যাবেই। আশিক জানে তার এই অবস্থাই বন্ধুরা কখনোই যাইতে দিবে না।তাই আশিককে দেখে যখন তারা ভার্সিটিতে চলে গেল। তারপর আশিক একাই রওনা হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্য। অনেকবার পরেও যাচ্ছিল তবুও নিজেকে সামলালো। রিকশায় করে ভার্সিটিতে গেল। পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা হাঁটতে পারছিল না কোনমতে কষ্ট করে হাঁটছে। এখনো মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ প্রথমদিনের মতোই আছে। আশিকের কাছে এই ব্যাথা অনেক তুচ্ছ নদিয়াকে দেখতে না পারার ব্যাথার কাছে।
ঔইতো নদিয়া ক্যাম্পাসে পুকুর পাঁড়ে এক বান্ধবীর সাথে বসে গল্প করছে। আশিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হৃদয়ের আর শরীরের সব ব্যাথা যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল মুহূর্তেই। এমনভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে কতকাল দেখি নাই। মনটি প্রশান্তিতে ভরে গেল। হৃদয়ে পরম শান্তি অনুভূত হচ্ছে। আশিকের চোখে অশ্রু টলমল করছে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে নিচে পড়ল। আশিক হয়ত খেয়ালই করিনি তার চোখ দিয়ে পানি পরছে। এই পানি কষ্টের না আনন্দের। নদিয়াকে দেখতে পারার আনন্দ।
সেইসাথে আশিকের ভালোবাসা দেখে বন্ধুদের চোখেও পানি চিকচিক করছে। তারাতো নদিয়াকে ভালোবাসার সেই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবই জানে।
তাদের মাঝে কয়েকজন নিজেদের ভিতরেই বলছে ‘শালা এতোভালোবাসতে কোন মানুষ পারে এই প্রথম দেখলাম নিজ চোখে।’ ‘সত্যিই দোস্ত তোর ভালোবাসার কোন তুলনা হয় নারে।’ ‘তোর এই ভালোবাসার কাছে ঐ মেয়েটি হার মানবেই খুব শীঘ্রই মানবে। তোদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
হঠাৎ আশিক মাথা ঘুরে পরে যায়। অনেকক্ষণ ধরেই মাথা ব্যাথা করছিল আশিকের কেননা আশিকের মাথায় আঘাতটা অনেক ক্ষত হয়ে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছিল তখন। ভীষণ দুর্বল শরীর তার উপর ইচ্ছার জোরে কষ্ট করে এতোদূর আসা মাথার উপর অতি পেশার দেয়াতে এমন হয়েছে। ডাক্তার বলেও দিয়েছিল দুই সপ্তাহ সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে কিন্তু কে শুনে কার কথা।
বন্ধুরা সব আশিকের কাছে গেল। আচমকা পরে যাওয়াতে কৌতূহলবশত কিছু মানুষও জড় হয়ে গেছে। নদিয়া ছোট ভিড় দেখে আগ্রহ নিয়ে আসল। এসে আশিককে এই অবস্থায় দেখে খুব মায়া লাগল। বন্ধুদের আশিককে বকতে শুনে বুঝতে বাকি রইল না তাকে এক ঝলক দেখার জন্যেই এতো কষ্ট। অপরাধবোধ কাজ করছে তার মাঝে।
(২)
১মাস ১০দিন পর আশিক এখন পুরো সুস্থ। আশিক এখনো নদিয়াকে আপন করে পাইনি। এতোদিন নদিয়ার সাথে একটা কথাও বলতে পারেনি। কেননা নদিয়া আশিককে হাত জোর করে অনুরোধ করে বলেছিল ‘আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে না খবরদার। আর যদি বিরক্ত করো তাহলে আমি এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব।’ নদিয়া রাগ করে বললেও আশিকের তাকে হারানোর ভয় তীব্র ছিল বলে কথা বলার হাজার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বলে না। আশিকের খুব কষ্ট লাগে বুকটা বার বার কেঁদে উঠে কিন্তু কিছুই করার নাই শুধু দূর থেকে দেখা ছাড়া। এরই মাঝে আশিক সুখ খুঁজার বৃথা চেষ্টা করে। আশিকের তার ভালোবাসার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নদিয়া একদিন ঠিকই তার ভালোবাসা গ্রহণ করবে। শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তার বন্ধুদের বলতো। আশিকের মতে ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরী। এটি ভালোবাসাকে বৃদ্ধি করে।
নদিয়ার বান্ধবীরা অনেক বুঝাতো অনেক বলেছে যে ‘আশিক তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে রে নদিয়া। তাকে আর কষ্ট দিস না। অবহেলা করিস না তাকে। কেউ তোকে আশিকের মতো ভালোবাসতে পারবে না। একবার তার ভালোবাসাটা গভীরভাবে দেখ একটুও ক্রটি পাবি না।’ ‘সব ছেলে এক না।’ কিন্তু নদিয়া বলেই দিছে ‘প্রেমকে যতোটা ঘৃণা করি তার থেকে বেশি পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি।’
ভার্সিটি ক্লাস শেষে নদিয়া বের হচ্ছে। ক্যাম্পাসে আশিক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। আশিক দেখল তার থেকে কিছু দূরে সেদিনে তাকে মারা কয়েকটি ছেলে নদিয়ার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নদিয়া কাছাকাছি ঐদিক দিয়ে যেতেই ঐ ছেলেগুলার ভিতর একজন নদিয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে ‘দোস্ত মা*টা খুব হট। ওহ কী ফিগার। শা* ভোগ_
আর কিছু বলতে পারল না ততক্ষণে আশিক ছেলেটার বুকের উপর ল্যাথি দিয়ে শুইয়ে ফেলছে। যদিও ছেলেটি লম্বা স্বাস্থ্যবান একটি ল্যাথিতে কিছু হবে না। পাশের ছেলগুলো অবাক হয়েছে খুব। তারা আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। আশিক এখন ফুল একশন মোডে চলে গিয়েছে। আশিক ঝপ করে মেঝেতে বসে পরে ডান পাশের ছেলেটার পেটে পাঞ্চ কষালো। ভুষ করে মুখ দিয়ে পেটের সব বাতাস বের হয়ে এলো। বসা থেকে উঠতে গিয়ে ফুটবলে হেড করার মতো মাথা দিয়ে আঘাত করলো পরবর্তী ছেলের থুঁতনিতে। উল্টোদিকে দড়াম করে আছড়ে পরল। স্বাস্থ্যবান লম্বা যে ছেলেকে প্রথম দিকে বুকে ল্যাথি মেরেছিল সে আশিকের উপর ঝাঁপিয়ে পরল। আশিক একপাশ সরে যাবার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। গরিলা সদৃশ ছেলেটা ওকে দুহাতে চেপে ধরল। ধীরে ধীরে হাতের চাপ বাঁড়া বাঁড়াচ্ছে, আশিকের দুহাত ছেলেটার বেষ্টীর ভেতর আটকা পড়েছে। মনে মনে বলছে আশিক ‘শয়তানটার উদ্দেশ্য কী? আমার পাঁজরের হাঁড়গুলো একটা একটা করে ভাঙবে?’
বাকিসব ভার্সিটির ছেলে মেয়েরা মজা দেখতে ভিড় জমিয়েছে। আশিকের এক বন্ধু দেখার সাথে সাথে বাকি বন্ধুদের ডেকে নিয়ে আসতে লাগল। হয়ত কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে সবাই।
আশিক ওর মাথা খানিকটা পেছনে নিয়েই আবার সামনে ছেলেটার কপাল বরাবর একটা বাড়ি মারল। ছেলেটা আশিকের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এভাবে শক্ত মাথা দিয়ে মেরে যে তাকে দুর্বল করে দিবে তা ধারণার বাইরে ছিল তার। আশিক ছেলেটিকে আর মারার সুযোগ না দিয়েই মুষ্টিবদ্ধ বাঁ হাতে ছেলেটার চোয়ালের নিচ থেকে উপরের দিকে একটা আপারকাট মারলো। এই মারটা আশিক বের করেছে প্রিয় স্ট্রিট ফাইটার গেইমটা খেলে। ছেলেটি মাটিতে পড়ে গেল। বাকিরা আশিককে মারতে শুরু করার আগেই আশিকের বন্ধুরা চলে আসল। প্রচুর মারামারি হলো মিনিট কয়েক ধরে। আশিক মারল আবার কয়েকটি মার খেল তবে প্রস্তুত থাকায় তেমন একটা আঘাত করতে পারি নাই। প্রভাবশালী ছাত্রলীগ করা উপরের ক্লাসের বড় ভাইয়েরা মিলে থামালো তাদের।
তাদের বাজে কথা বলার জন্য আশিক এতোকিছু করলো মার পর্যন্ত খেল ভাবতেই নদিয়ার চোখে পানি চলে আসল আশিকের ভালোবাসা দেখে।
বড় ভাইয়েরা দুই দলকে আলাদা করে সবকিছু শুনে ঐ শয়তান ছেলেদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয় সেই সাথে সাবধান করে দেয় তাদের। কেননা বড় ভাইদের মাঝে ২জন আশিককে অনেক ভালো করেই চিনতো আগে থেকেই পরিচিত ছিল। তারপর দুই দলে হ্যান্ডশেপ করে মিটমাট করে নিল।
বাসায় এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল “যাকে এতো কষ্ট দিয়েছি এতো অবহেলা করেছি বছর ধরে আমি। হাসপাতালের বেডে পরেছিল তবুও দেখতে যায়নি যে আমি। আশিক কি না সেই আমাকে নিষ্ঠুর এই মেয়েকে এতো ভালোবাসে? কতো অপমান করেছি থাপ্পড় দিয়েছি ঘূণা করেছি_ _ _ _ _ _ _ _ _”সব মন করতে লাগল আর কাঁদতে লাগল।
অনেকক্ষণ পর চোখটা মুছে নিল নদিয়া। দু’দিন আর ভার্সিটিতে গেল না।
ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছে না ঘুমাচ্ছে না । নদিয়ার নিজেকে ভীষণ পাপী অপরাধী মনে হচ্ছে ‘আশিককে এভাবে আমার কষ্ট দেয়া ঠিক হচ্ছে না।’
তবুও কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে আজ ভার্সিটিতে গেল। নদিয়া জানে তার চোখ ফোলা দেখে আশিক ঠিকই জেনে যাবে যে খুব কান্নাকাটি করেছি। ভার্সিটিতে প্রবেশ করতেই নদিয়া এদিক ওদিক তাকাল তারপর হাঁটতে লাগল।
-আমাকে খুঁজছিলে বুঝি নদিয়া? (হাসি মুখে)
নদিয়া আশিককে দেখে হকচকিয়ে গেল
-না.নাতো। তোমাকে খুঁজব কেন?
-তাহলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলে যে? আর এই দু’দিন ভার্সিটিতে আসো নাই কেন?
-আমার এক বান্ধবীকে খুঁজছিলাম। আর আমার ইচ্ছে হইছে তাই দুইদিন আসি নাই। বিরক্ত করো না সরো এখন।
বান্ধবীর কথা শুনে আশিকের মুখ একেবারে চুপসে গেল কী ভাবল আর কী শুনল।
আশিকের এই অবস্থা দেখে নদিয়ার ভীষণ হাসি আসল।
আশিক মন খারাপ করে ক্লাসে বসে আছে। মনে করছে নদিয়ার মনে একটু জায়গা হয়েছে কিন্তু না নদিয়া আগের মতোই আছে।
ক্লাস শেষে নদিয়া বাইরে গেল আশিক কী মনে করে নদিয়ার পিছু নিল। উপরতলায় একজনের সাথে দেখা করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। সিঁড়িটার মাঝখানে পানি পরে আরো পিছলা হয়ে ছিল কিন্তু নদিয়া সেদিকে খেয়াল না করেই যেই পা দিছে ঐখানে সঙ্গে সঙ্গে পিছন দিকে উল্টা হয়ে পরে যাবার আগেই কাছাকাছি আশিক থাকাই দ্রুতবেগে নদিয়ার পাখির মতো হালকা শরীরটা ধরে ফেলল। নদিয়ার আশিকের হাতের স্পর্শে শিহরণ দিয়ে উঠল শরীরে। আশিকের মুখটা নদিয়ার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল। কী করবে বুঝতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল নদিয়া।
একটু পর চোখ খুলে দেখে আশিক নাই। নদিয়া অনেক খুশি তার কিছু হয়নি, আশিক না ধরলে হয়তো মাথাই ফেঁটে যেত। নদিয়া মনে মনে ভাবছে আশিক চাইলেইতো আমাকে কিস করে ফেলতে পারতো, নদিয়া জানতো পুরুষ জাত শুধু সুযোগ খুঁজে চান্স পেলে হাতছাড়া করে না, এদের আকর্ষণ আর ভালোবাসা শুধু সুন্দর রূপের প্রতি। কিন্তু আশিককে দেখে খুবই অবাক হলো। তার স্পর্শে নদিয়া অদ্ভুত অনুভূতি টের পেল নিজের মাঝে। অনেক চেষ্টা করেও আশিককে অন্য পুরুষদের সাথে খারাপ মনে করে এই অনুভূতি শেষ করতে কিন্তু পারলো না। নদিয়া আশিকের মাঝে তার জন্য হৃদয়ভরা ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না।
নদিয়ার ভুল ভাঙতে লাগল। সে বুঝতে পারে পুরুষ জাতের মাঝেও কিছু পুরুষ আছে যারা সত্যিই কখনো খারাপ হয় না। নদিয়া আশিককে ভালো না বাসার প্রধাণ কারণই এটাই যে পুরুষ জাতিকে চরমভাবে ঘৃণা করত। এই ঘৃণার সৃষ্টি হয় তার অতি প্রিয় বান্ধবীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক করে একাধিক বন্ধু মিলে সুযোগ বুঝে সতীত্ব হরণ করেছিল যার ফলে সেই মেয়েটি আত্নহত্যা করে। প্রিয় বান্ধবীর এই আত্নহত্যাতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল নদিয়া। এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল নরম মনটা পুরুষদের প্রতি পাথরের মতো নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে আরো কিছু পুরুষদের ভয়ংকর রূপ দেখে ঘৃণাতে মনটা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল পুরুষদের প্রতি। সেই জন্যেই আশিকের এতো ভালোবাসা ঘৃণার চোখে দেখে আসছিল।
আশিক নিজে নিজেই বলছে “নদিয়া তোমার এতো কাছে এসেও ছুঁয়ে দিতে পারলাম না মিষ্টিমাখা মুখটি। ছুঁয়ে দিতে পারলাম না পাঁপড়ির মতো সেই একজোড়া ঠোঁটটি। খুব ইচ্ছা করলো কিন্তু পারলাম না এই ভয়ে তুমি আমাকে আরো খারাপ ভাববে আরো ঘূণা করবে। খুব ভালোবাসি নদিয়া। একটিবার আমার ভালোবাসা ফিল করে দেখো।”
নদিয়া শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নাই। আশিককে আর মন থেকে সরাতে পারছে না। পারছে না আর আশিকের ভালোবাসা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে।
আশিকের ভালোবাসা ফিল করতে পেরেছে নদিয়া দেরীতে হলেও। ভালোবেসে ফেলেছে আশিককে। হার মানল আশিকের ভালোবাসার কাছে। নদিয়ার পাথরের মতো মনটি গলিয়ে ফেলেছে আশিক তার ভালোবাসা দিয়ে।
আশিক ক্যাম্পাসে একা একা পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে আছে বিষন্ন মনে। সবসময়ই এমন থাকে।
নদিয়া আশিকের সামনে আসল। আশিকের অবাকে চোখের পলক পরছে না।
নদিয়া বলতে লাগল
-তুমি কী আমাকে এখনো ভালোবাসো?
-হুমম অনেক।
-আমিতো তোমাকে অনেক অপমান করেছি, আঘাত করেছি, কতো কাঁদিয়েছি এতো কষ্ট দিয়েছি তবুও কেন, কেন তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো? আমিতো তোমাকে একবিন্দু ভালোবাসাও দি নাই। তারপরও কেন এতো ভালোবাসো?
-কেন জানি না। শুধু জানি “ভালোবাসি তাই ভালোবাসি।”
-যদি আমি কখনোই তোমাকে ভালো না বাসি?
-তবুও আমি জীবন্ত লাশ হয়ে তোমাকে ভালোবেসে যাব আজীবনে সবসময় ।
নদিয়া আর পারলো না নিজেকে সামলাতে পারলো না কান্না ধরে রাখতে ঝাঁপিয়ে পরল আশিকের বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আশিকের বুকে মাথা রেখে বলল ‘এতো ভালোবাসা কোথায় রাখব আমি?’
-এতো ভালোবাসার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা দিও।
-একটু নয় অনেক ভালোবাসা দিব যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আর কখনো কষ্ট দিব না মাফ করে দেও আমায়।
দুজনের মাঝে কোন কথা নাই জড়িয়ে ধরে আছে একে অপরকে শক্ত করে।
চারপাশে আশিক ও নদিয়ার বন্ধুদের করোতালি শোনা গেল। লজ্জায় একে অপরকে ছেড়ে দিল। নদিয়ার মুখখানা লাল হয়ে আছে।
তাদের দু’জনের অসীম ভালোবাসা দেখে, বন্ধুদের থেকে সবশুনে তাদের অনুরোধে দুই পরিবারের মানুষও রাজি হয়ে গেল। আশিকের লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরী হতেই দু’জনে নতুন এক বন্ধনে আবদ্ধ হলো।
হ্যাঁ নদিয়া তার কথা রেখেছে। সত্যিই আশিকের কল্পনার থেকেও বেশি ভালোবাসে। মাঝে মাঝে নদিয়ার পাগলামী ভালোবাসা দেখে আশিক বলে উঠে ‘পাগলী আমার এতো ভালোবাসে কেন ?’ তখন নদিয়া বলে “ভালোবাসি তাই ভালোবাসি।” দু’জনেই হেসে উঠে।