স্বপ্নের জীবন

স্বপ্নের জীবন

পদার্থবিজ্ঞানের মোটা বইটা হাতে নিয়ে আপনমনে হাটছি । মনে মনে নিউটন , আইনস্টাইন , ফ্যারাডের সূত্রগুলো মনে করছি আর ঐ ব্যাটাগুলোর চোদ্দগুষ্টি উদ্দার করছি । একটু পর স্যারের বাসায় পরিক্ষা । অথচ যা পড়েছি সবই ভুলে গেছি প্রায় । হটাত্‍ ঠাস্ করে মাথার পিছনে কে যেনো থাপ্পড় দিলো । আমার তখন মেজাজ এমনিতেই গরম । তার উপর মাথার মধ্যে এতো নিখুঁত চপোটাঘাতের পর মগজের টেম্পারেচার গলনাংক থেকে স্ফুটনাংক পৌছে গেলো ।

দাড়িয়ে গেলাম । হাতের মুঠো পাকিয়ে , দাতে দাত চেপে ঘুরেই একটা ঘুষি দিতে গেলাম থাপ্পড়ের অসভ্য মালিককে ।কিন্তু আমার হাত মাঝপথেই থেমে গেলো । আমার সামনে পরী দাড়ানো । ভারি পাওয়ারের চশমার আড়াল থেকে বড় বড় মাথাময় চোখগুলো দেখতে পেলাম । সেখানে তখন ভয় খেলা করছে। হাত নামিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললাম “এখনই তো মাইর খাইতি । তারপর হসপিটালে নিয়ে যেতে হতো আমার ।” পরী দ্বিগুন ঝাঝালো কন্ঠে বললো “তো কি করবো ? ধ্যান্দা পোলা । কয়বার ডাকছি জানিস ! কি চিন্তা করিস এতো ?”

আমি তখন বিমর্ষ কন্ঠে বললাম “আরেহ্ বলিস না । ঐ ব্যাটা নিউটন , আইনস্টাইনের সূত্র পড়তে পড়তে লাইফটা হেল হইয়া গেলো । টাইম মেশিন থাকলে অতিতে গিয়া সবডিরে খুন করতাম ।” আমার কথা শুনে পরী হেসে কুটিকুটি । হাসতে হাসতে ওর চোখে পানি এসে গেলো । হাসলে ওকে বেশ ভালো লাগে । আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে ।

ইন্টারের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি । পরীও ভর্তি হয়েছে এখানে । বুয়েটে টিকার পরও কেনো সে এখানে ভর্তি হলো ঐ রহস্যের সমাধান হাজার ভেবেও খুঁজে পেলাম না । আমাদের আড্ডার প্রধান ছিলো পরী । আমার বরাবরই এসব আড্ডা ভালো লাগে না , তার চেয়ে নিজের জগত্‍ নিয়ে থাকতেই বেশি ভালো লাগে । কিন্তু পরীর জন্য আড্ডাতে বসতেই হয় । কত যে ফন্দি করি পাগলিটার হাত থেকে বাচার ! কোন লাভই হয় না । একেবারে গ্রিক বীর হারকিউলিসের মতো দুর্নিবার পরী ।

একবার বাসায় শুয়ে আছি । ও বার বার ফোন দিচ্ছিলো । আমি ইচ্ছা করে ফোন রিসিভ করিনি ।
পরী বাসায় আসে । আম্মাকে জিজ্ঞেস করে “আন্টি নীল কই ?” আম্মা হাসিমুখে দেখিয়ে দেন আমার রুম । আম্মা আব্বা পরীকেকে এত্তো আদর করে আর সাপোর্ট করে যে মাঝে মাঝে কনফিউজ হয়ে যাই আসলে তাদের সন্তান আমি ! নাকি পরী

পরী রুমে ঢুকে অনেকক্ষন ডাকাডাকি করে আমি । আমি তখন ভান করে আছি ঘুমানোর । পরী একের পর এক ঝাড়ি দিচ্ছে । আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আজকে আর যাই হোক ঘুম থেকে উঠবো না। একটু পর পরী চলে গেলো । আর আমি তখন খুশিতে আটখানা । এখন আমার ছাম্মাকছাল্লো টাইপের নাচ দিতে ইচ্ছা করতেছে ।

মুখে ৩৬০ ওয়াটের বাল্বের আলোর মতো হাসি ফুটে উঠলো । হটাত্‍ ছপাত্‍ করে আমার সারা শরীরে পানি পরলো । আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম । তাকিয়ে দেখি পরী একটা বালতি নিয়ে দাবাং স্টাইলে দাড়িয়ে আছে । ঐ দিন আমার কপালে নানান দুর্ভোগ জুটেছিলো । থাক ওসব না বলাই ভালো । তারপর থেকে আমি একেবারে ভালো ছেলে হয়ে গেছি । পরীর সব আজাইরা কাজে আমাকে হাজির দেখা যেতো।

এভাবেই চলছিলো সব । হটাত্‍ একদিন শুনি পরীর বাবা মারা গেছেন । খবরটা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে গেলাম । আঙ্কেল আমাকে ভীষন আদর করতেন । আব্বা আম্মাকে নিয়ে দ্রুত তাদের বাসায় গেলাম । গিয়ে দেখি সেখানে অনেক মানুষ । আঙ্কেলের লাসটা যেখানে রাখা তার পাশেই আন্টি আর পরী আহাজারি করছে । আম্মা দ্রুত গিয়ে পরীর আম্মুকে ধরলেন । পরীকে ওভাবে কখনো কাদতে দেখি নি।

ঐ দিনই প্রথম পরীজন্য আলাদা একটা টান অনুভব করেছিলাম । মনের গহিনে পরী যে তার নিজের স্থান করে নিয়েছে সেই দিনই প্রথম খুঁজে পেলাম । ঐ দিন আঙ্কেলকে কবর দিয়ে আসার পর পরী আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো । তার দিকে এগিয়ে গেলাম । প্রাণচন্বল পরীরর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না ঐ পরীর মধ্যে । বুকের ভিতর একটা বিশাল শূন্যতা টের পেলাম সেদিন । পরীর কাছাকাছি যাওয়ার পরই , সে হু হু করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো আমাকে । শক্ত করে ধরে রইলো আমাকে । আমি সেদিন হতভম্ব হয়ে যাই । পরীকে পাল্টা জড়িয়ে ধরার সাহস ছিলো না । কষ্ট হচ্ছিলো খুব ।

তারপর পুরো এক মাস পরীর সাথে দেখা করিনি । ওকে কিভাবে বলবো যে ওকে আমি ভালবাসি । দোটানায় আছি । ও কি আমাকে ভালবাসে ? এই ছাইপাশ চিন্তা করতে করতে এক মাস চলে গেলো । পরী তখন আঙ্কেলের মিলাদ আর বাসার টুকটাক কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো । আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলো আবার । আরো কয়েকমাস পর । পরী তখন পুরোপুরি স্বাভাবিক । আমি অপেক্ষায় আছি ১৪ই ফেব্রুয়ারির । ঐ দিন যেভাবেই হোক ওকে বলবই বলবো । ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভোরে ওকে ফোন করে টিএসসিতে আসতে বললাম । ও জানতে চাইলো কেনো । কিন্তু আমি কিছু না বলে ফোন কেটে দিলাম ।

দাড়িয়ে ছিলাম । দূর থেকে দেখলাম পরী আসছে । লাল সাদা একটা শাড়ি পরেছে সে । অপূর্ব লাগছে তাকে । পান্জাবিটা ঠিক করে নিলাম । ফুলগুলো আড়াল করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে । তার কাছাকাছি গিয়ে তাকে অবাক করে দিয়ে একটা হাটু গেড়ে তার সামনে বসলাম । তারপর গোলাপ গুলো তার সামনে ধরে বললাম . .

“তোমায় নিয়ে হৃদয়ে আমার হাজার সপ্ন আঁকা , তুমি আমার সেই রাজকণ্যা , সপ্নে যাকে দেখা ।
তোমার জন্য হৃদয়ে আমার অনেক ভালবাসা , যেথায় আছে একটা ঘর , সুখ আনন্দে ঠাসা ।
জড়িয়ে নাও আপন করে এই আমাকে , হৃদয় দিয়ে বলছি তোমায় , ভালবাসি তোমাকে ।”

আবার বুক তখন ধুকপুক করছে । পরীর হাস্যজ্জ্বল মুখটা থেকে হাসি মুছে গেলো । আর আমার হৃদপিন্ড একটা বিট্ মিস করলো । পরী কিছু বলছে না । চুপ করে দাড়িয়ে আছে । আমি আর কিছু না বলে উঠে দাড়ালাম । ঘুরে হাটা ধরলাম । হটাত্‍ ঠাস্ করে মাথায় থাপ্পড় মারলো কে যেনো । মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো । ফুলসহ মুঠো এক করে ঘুরেই ঘুষি দিতে গেলাম । মাঝপথেই থেমে গেলো আমার হাত । পরী দাড়িয়ে আছে । তার চোখে অশ্রু মেশানো হাসি খেলা করছে ।

আমার পান্জাবির কলার ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে বলল “টানা ৫ বছর লাগিয়েছিস কথাটা বলতে । আর এক বছর গেলে তোকে খুন করতাম আমি ।” আমি তখন খুশি হব কি ! বাতাসের অভাবে খাবি খাচ্ছি । উফ্ কলারটা এত্তো জোরে ধরেছে ! যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।।।।।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত