অতৃপ্ত ভালবাসা

অতৃপ্ত ভালবাসা

পরিচয় হীন হয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর তাই নিজের পরিচয়টা আগে দিয়ে ফেলি,আমার নাম রুদ্র কুন্ডু।নামের আগে অন্য কোনো বিশেষণের অধিকারি হতে পারিনি এখনও।তবে বেকারের তকমাটা গায়ে সবে স্পর্শ করেছে মাত্র,মানে সবে এ.ম.এ. পাশ করে বাবার হোটেলে বসে দিব্য ভাত মারছি দুবেলা আর স্বপ্নে খোঁজ করে চলেছি রাজকন্যার।মনে মনে ভেবে নিলাম যে এই একঘেঁয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসে দিল্লীকা লাড্ডুর(প্রেম)স্বাদ নিতেই হবে এইবার।মনে এই ভাবনা নিয়ে রাস্তা ঘাটে যাওয়া আসা করা পরীদের দিকে নিজের দৃষ্টি ফেলছি।কিন্তু নিজের গ্রামে যে এত ভাল একটা মেয়ে পেয়ে যাব কল্পনা করি নি কখনো।যাই হোক মেয়েটাকে আগে থেকেই চিনতাম বেশ সুশীল,ভদ্র,অল্পভাষী আর পড়াশুনাটা করে সে উচ্চমাধ্যমিকে।আমার মনে দোলা জাগানো মেয়েটির নাম বিভা।প্রথম থেকেই জানতাম এই মেয়েকে রাজী করাতে গেলে আমার কালঘাম ছুটে যাবে।নেমে গেলাম মাঠে,বেশ কিছুদিন তার গতিপথ আর গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলাম নিজের সময় ব্যয় করে।মনে মনে ভাবলাম একটা ভাল ইমেজ তার কাছে তৈরি করতে হবে।অনুঘটক ছাড়া কিছু হবে না বুঝতে পারলাম।পেয়েও গেলাম আমার এক দূর সম্পর্কের বোনকে অনুঘটক হিসেবে।পেরেম কেমন হয় সেটা দেখার আর তর সইছিল না তাই পুরোনো রীতি অনুসরণ করে নিজের সমস্ত অনুভূতি গুলো একটা কাগজে জড়ো করে দিলাম আমার বোনের হাতে গুঁজে তাকে মানে বিভাকে দেওয়ার জন্য।যদিও এটা আমার কাছে শুধুমাত্র একটা কাগজ ছিল না।উত্তরটা না সূচক আসবে সেটা জানতাম।আরে মেয়েরা কি প্রথম বারেই হ্যাঁ বলবে নাকি?তাদের না বাচক শব্দটাকে হ্যাঁ বাচকে রুপান্তরিত করতে গেলে অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়।তবুও রান্না হবে নাকি সন্দেহ।মনে মনে এই সন্দেহ নিয়ে লেগে গেলাম তাকে ইমপ্রেশ করার জন্য।সেইবছরই দুর্গাপুজোতে আমি সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করছি আমাদের পাড়ার অনুষ্ঠানে,দেখলাম বিভা কখন গুটি গুটি পায়ে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে।ব্যাস,সুযোগ পেয়ে আমিও বেশ কিছুক্ষণ আঁখিও সে গোলি মারলাম মানে চোখে চোখে প্রেম নিবেদন করতে লাগলাম।এতেও দেখলাম মহারাণির মন গলল না।মুষড়ে গেলাম একটু হলেও কিন্তু নৌকাতে চেপে হাল ছাড়ার পাত্র আমিও না।হঠাৎ ওর বান্ধবীর মুখে শুনলাম আমার প্রিয়ে গিয়েছে মামা বাড়ির হাওয়া খেতে।আমিও মনে মনে হিসেব কষে চলে গেলাম সেই হাওয়াই ভাগ বসাতে তার মামার বাড়ির বাস স্টপেজে।ওইটুকুই ছিল আমার ক্ষমতা।কিছুক্ষন পর বাড়ি আসার জন্য স্টপেজে এল বিভা আর ওর মা।তবে আগের বাসটা কিছুক্ষন আগে চলে যাওয়ার জন্য আমি বেশ আনন্দই পেলাম আর ধন্যবাদ জানালাম বাসটাকে আর ভগবানকে।বিভার মায়ের সাথে পরিচয় ছিল একটু একই গ্রামে থাকার জন্য।এইবার হিরো ইস্টাইলে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে তারপর বিভার মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,”কাকিমা বাসটা তো এই কিছুক্ষণ হল চলে গেল,পরের বাসটা কখন আসবে ঠিক নেই তাও আবার বিকেলের সময়,তোমরা যদি যেতে চাও তাহলে আমার বাইকে যেতে পারো।”বিভার মা রাজি হল কিন্তু ইতঃস্তত করতে লাগল বিভা।যাইহোক শেষ পর্যন্ত মনের আশাটা একটু পূর্ণ হল বিভাকে নিজের বাইকে নিয়ে আসতে পেরে যদিও সেদিন বিভার ছোঁয়া পায়নি ওর মায়ের বুদ্ধির জন্য।তারপর থেকে আমার মহারাণির মনের বরফটা একটু গলে ছিল আমার জন্য।কিছুদিন পর পর বিভা তার বাড়ির মোবাইল থেকে ফোন করতে লাগল,টুকটাক কথা হতে থাকল।একদিন আমি বর্ধমান যাচ্ছি ঠিক সেইসময় ঝোড়ো হাওয়ার সাথে ভেসে এল একটা মিষ্টি দাবী আমার নায়িকার মিষ্টি গলা থেকে।বিভা একটা ফোন চাইল আমার কাছে।আমিও ভাবলাম আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম কিন্তু পরে দেখলাম ফোন কিনে দেওয়ার মত টাকা আমার কাছে এখন নেই কিন্তু যে করেই হোক ফোনটা তো দিতেই হবে।ফিরে এসে কাছের চেনা এক মোবাইলের দোকানে গিয়ে বাকিতে একটা ফোন কিনে পাঠিয়ে দিলাম বিভার কাছে ওর বান্ধবী মারফত।ইচ্ছে থাকলে কিনা হয়?পড়াশুনার জন্য যদি এইরকম ইচ্ছে জাগত আমার।যাইহোক প্রেমটা এবার জমবে জমবে মনে হল।প্রতিদিন ওই সুরেলা কন্ঠ আমার কানে ভেসে উঠবে,আমার খবর নেবে ভেবেই যেন কি রকম একটা হচ্ছিল।আমার ভাবনায় কোনো ছেদ পড়ল না,ফোনে নিয়মিত কথা হতে লাগল আর মাঝে মাঝে ওর স্কুলে গিয়ে দেখাও।তখন বুঝেছিলাম ওর হাতের ছোঁয়ায় সত্যিই জাদু আছে।ওই হাত আমি হারাতে পারব না কিছুতেই।ওর ছোঁয়াগুলো যেন প্রতি মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে দোলা দিতে থাকল আমার মনে।আর ঘরের কোণে এসে সেগুলোকে সযত্নে সাজিয়ে রাখতাম আমার মনের মণিকোঠায় দরজা বন্ধ করে।তবে বিভার রাগ আর কান্না সামলানো একটু মুশকিলই ছিল আমার জন্য।তবুও ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চার মত মেনে নিত আমার কথা শেষপর্যন্ত।প্রেম করলে বিয়ের কথা তো মাথায় চলেই আসে আর সেটা আরো জাঁকিয়ে বসেছিল আমার মাথায় কারণ আমি বিভাকে হারাতে চাইতাম না আর ওর বাবা আমার সাথে ওর বিয়ে দেবেন না কারণ আমি বেকার।বিভাও পালিয়ে যেতে নারাজ।যাইহোক ফোনে প্রেমালাপ হল বেশ পাঁচ ছয় মাস।তার মাঝে লুকিয়ে ছিল ফোন দিয়ে আবার চেয়ে নেওয়া,মান,অভিমান,রাগ,হাসি,কান্না আর টেনশন।প্রেমে যা হয় আর কি।এবার বুঝলাম লোকে কেন বলে ‘প্রেম দিল্লীকা লাড্ডু খেলেও পস্তাবি না খেলেও পস্তাবি।’ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সাজগোজ করে রঙ্গমঞ্চে নেমে এলেন বিভার বাবা।আমার আর বিভার প্রেমের বারোটা বাজিয়ে তেরোটার কাঁটায় নিয়ে যেতে।হঠাৎ বিভার বাবা আমার দেওয়া মোবাইলটা পেয়ে যায় বিভার কাছে থেকে।ব্যাস শুরু হল প্রাচীন প্রথাগত প্রথা।বিভার টিউশন,স্কুল সব বন্ধ,বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ।বিভার উপর শুরু হল ওর মাথা থেকে আমি নামক ভূতটাকে ঝেড়ে ফেলার জন্য মানসিক অত্যাচার।সব সহ্য করছে মেয়েটা একা একা।এরই মাঝে বিভা একদিন আমায় ফোন করল ওর কাকার মেয়ের সহায়তায় আর আমার মোবাইল টা তখনো ওর বাবার কয়েদি।আমি বিভার কথায় আমার মা আর মামাকে ওদের বাড়ি পাঠায় বেকার হওয়া সত্ত্বেও।কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।বিভাও ভয়ে গুটিয়ে নিয়েছিল সেদিন নিজেকে।এর মাস খানেক পর বিভা আবার স্কুলে টিউশনে যাওয়া শুরু করল কিন্তু ওর বাবার নজর বন্দী হয়ে।তবে আমি লক্ষ্য করেছিলাম বিভার পরিবর্তনটা,বিভার ব্রেনওয়াশ করা হয়েছিল,আমার প্রতি ওর ভালবাসাটা ও যেন ম্লান হয়ে এসেছিল।বোঝাতে থাকলাম ওকে আমার মত করে,কাকুতি মিনতি করলাম ওর কাছে।কিন্তু বিভা তখন মনের মধ্যে পাথর বসিয়ে ফেলেছে আমার জন্য।হয়ত মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভা আমায় অনেক খারাপ কথাও শুনিয়েছিল কিন্তু আমি জানতাম কথাগুলো বলার পর ও বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদবে।আর পিড়ীতি তো কাঁঠালের আঁঠা,যাকে একবার মনের জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয় তার শত অপরাধ ও ক্ষমার যোগ্য।আমিও আশা ছাড়লাম না কিন্তু যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে গেছিল ,বিভা চাইল না তাই।উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কয়েক মাস পর বিভার বিয়ে ঠিক করে ফেলে বিভার বাবা।গ্রামে যেহেতু বিয়ের জন্য এখনও বেশিরভাগ মেয়ের মতামত গ্রহনযোগ্য হয় না তাই এই বিয়েতে বিভার ইচ্ছে কতটা ছিল তা আমার অজানা এখনো।যাইহোক বিভার বিয়ের খবরটা পাওয়ার পর আমার অবস্থাটা রাত্রিগুলো আর আমার বালিশটা নিশ্চয়ই জানে।আমি নির্লজ্জের মত বিভার পরিচিতদের অনুরোধ করতে থাকলাম যাতে করে তারা আমাকে বিভার থেকে আলাদা না করে।দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য তখন আমি।নিজের যন্ত্রণা নিজে নিজেই গিলছি।বিভার মনের অবস্থাটা বোধ হয় একই রকমই হবে।তবে দ্বিতীয়বারের জন্য বিভা আর একটা মোবাইল পেয়েছিল ওর হবু বরের কাছে থেকে আর হ্যাঁ তার দামটাও বেশি ছিল আমার দেওয়া মোবাইলের থেকে।ভেবেছিলাম হয়ত বিভা একবার অন্তঃত ফোন করবে আমায়।কিন্তু সব আশা পূর্ণ হতে হবে এমন মাথার দিব্যি তো আর কেউ দেয় নি।আজ প্রায় দুবছর হয়ে গেল বিভার বিয়ে,একবারের জন্যও কেবল ওর জন্য সেট করা আমার প্রিয় রিংটোন টা আর বাজে নি কখনো।মনে মনে ভাবলাম বিভা সত্যিই হয়ত আমায় ভুলে গিয়ে মানিয়ে নিয়েছে অভ্যস্ত হয়ে গেছে নতুন সংসারে ওর বরের কাছে।মানুষ তো অভ্যাসের দাস।কিন্তু বিভার স্পর্শ গুলো আজও আমায় তাড়িত করছে প্রতিনিয়ত।রুদ্র আর বিভা ওদের প্রকৃতিগত ভাবে পৃথকই থেকে গেল।ওর বিয়ের রাতে আমি বাড়িতে ছিলাম না তবে শুনেছিলাম সব মেয়ের মত বিভাও কেঁদেছিল শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার আগে।তবে তার কান্নার মধ্যে কোথাও কি আমি ছিলাম না?উত্তরটা আমার ও অজানা,এটা বিভা ছাড়া আর কেউই দিতে পারবে না।কিছু কিছু প্রশ্ন সময়ের সাথে সাথে মিলিয়ে যায় কালের নিয়মে উত্তরের আশা পূর্ণ হয় না কখনো।বিভা তুমি ভাল থাকো সারাজীবন,খুব ভাল থাকো তোমার মত করে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত