কাব্যের ভালোবাসা

কাব্যের ভালোবাসা

কাব্য আর যারিনের সম্পর্ক ৩ বছর হতে আর কিছুদিন বাকি।কিন্তু সব কিছু যেন পাল্টে গেছে। কারণ টা ছিল সন্দেহ আর অবিশ্বাস।তবো ও তারা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু জেদ আর অভিমানের আড়ালে দুজন ঢাকা পরে গেছে।

আগের মতো কিছুই নেই।আগে একজন অন্যজন কে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না,আর আজ তারা একজনের থেকে অন্যজন অনেক দূরে।মাঝে মাঝে কষ্ট তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।মনে পড়ে যায় ফেলে আসা স্মৃতি গুলোর কথা।সেই দিন গুলো।

কয়েক মাস আগের কথা:———

কাঁদতে কাঁদতে যারিন কাব্যকে এসে বিয়ে করার কথা বলে।এই নিয়ে আগে অনেক বার তাদের মধ্য ঝামেলা হয়েছে।যারিন অনেক বার কাব্য কে বিয়ের কথা বলেছে।কিন্তু বার বার কাব্য তা এড়িয়ে গেছে।যাবে নাই বা কেন,তার তখন বিয়ে করে বৌ নিয়ে সংসার করার সামর্থ নেই।কারণ সে বেকার।

সেই কথা যারিন মানতে পারে না।যারিনের কিছু করার ছিল না।ইন্টার পাশ করার পর থেকে বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিতে শুরু করে।যারিন অনেক বাহানা করে বিষয় টা এড়িয়ে যায় কিন্তু তা নিয়ে ঝগড়া হতে থাকে কাব্যের সাথে।

এভাবে চলে প্রায় এক বছর।কিন্তু কাব্য এই বিষয় টা একটু ও সিরিয়াসলি নেয় নি ভেবে যারিন ব্রেকআপ করে।কিন্তু কাব্যের কিই বা করার ছিল।অনেক চেষ্টা করে ও সে কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারে নি সে।তাই দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার ছিল না তার।শেষ বারের মতো যারিনের চলে যাওয়া দেখছিল সে।আর ভাবছিল এটাই হয়তো শেষ দেখা।

এর পর কয়েক মাস কেটে যায়।যারিনের সাথে কাব্যের যোগাযোগ হয় না।কাব্য ভেবে নেয় যারিন হয়তো এতোদিনে বিয়ে করে ফেলেছে।স্বামী নিয়ে খুব ভালো আছে।এসব ভেবে তার চোখ জলে ভেসে যায়।যেখানে তার থাকার কথা ছিল সেখানে যারিন অন্য কারো বুকে প্রতি রাতে মাথা রাখবে।হাত ধরে ঘুরে বেড়াবে।

কাব্যের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন যারিন আর সে তাদের সংসারের স্বপ্ন বুনেছিল।সেদিন যারিন বলেছিল…

:-এই শুনো বিয়ের পর কিন্তু প্রতি রাতে আমি তোমার বুকে ঘুমাবো।কোনো বাহানা চলবে না।
:-আহা রে।এত্ত বড় মেয়ের ভার আমি সইতে পারবো না।বরং এক কাজ করবো একটা কোলবালিস এনে দেব সেটার বুকে ঘুমিয়ো আর ইচ্ছে হলে উপরে উঠে ঘুমিয়ো ওটা তো আর ব্যথা পাবে না।তোমার ওজন ও বইতে পারবে।
:-কিহ!!!!!(রেগে কাব্য কে মারতে শুরু করলো)
:-আরে আরে মেরে ফেলবে নাকি?
:-হ্যাঁ,মেরেই ফেলবো।আমি কোলবালিসে ঘুমাবো?
:-তো কি হয়েছে।আমি কি তোমার ভার নিতে পারবো?
:-অহ এই কথা!করবো না বিয়ে যাও।
:-কেন,কেন?
:-কারন আমি প্রতিরাতে আমার স্বামির বুকে ঘুমাবো।প্রতিদিন তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো।আর আমি যখন রান্না করবো সে পেছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরবে।আমি লজ্জা পাবো,আমাকে ছেড়ে দিতে বলবো কিন্তু সে ছাড়বে না।আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবে ভালোবাসি।
:-এত্ত সখ?
:-হুম!আরো আছে।
:-তা আর কি আছে শুনি?
:-প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমার কপালে আলতো চুমু দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে।
:-এএহহ!আমি এসব পারবো না।
:-কেন?
:-আমার ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়।আর রান্নার সময় জড়িয়ে ধরলে তরকারি পুড়ে যাবে।আর সেই তরকারি আমায় খেতে হবে।আমি কি পাগল শুধু শুধু ইচ্ছে করে এসব পুড়েযাওয়া জিনিস খাবো?
:-আমার জন্য একটু কষ্ট করতে পারবে না?(কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে কাব্যকে জিগ্যেস করলো)
:-না এসব পারবো না।
:-অহ!(যারিনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো)
:-এইযে পাগলি কাঁদছো কেন?
:-তুমি আমাকে ভালোবাসো না।
:-কে বলেছে বাসি না?আর কিছু করি বা না করি,আমার এই পাগলি টা কে সব সময় খুশি তে রাখবো আর অনেক ভালোবাসবো।
:-সত্যি?
:-তিন সত্যি।

হঠাৎ মোবাইলে কারো কল আসার শব্দে কাব্যের ঘোর ভেঙ্গে যায়।কাব্য বিরক্ত হয়।ফোনের স্ক্রিনে চোখ যেতেই বুকের বাম পাশ টা কেমন ব্যথা করে উঠে।সেই নাম্বার,যে নাম্বারে কিছু সময় আগে ও দিন রাত অন্তত ৭/৮ ঘন্টা কথা হতো।হাত কাঁপতে লাগলো কাব্যের।ফোন টা রিসিভ করে কানের কাছে নিল।সাথে সাথে যারিনের কন্ঠটা শুনতে পেল।কাব্য মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল।অন্য দিক থেকে বার বার কাব্য বলে যারিন ডাকছে।কিন্তু কাব্য নির্বাক হয়ে রয়েছে।কখন চোখ জলে ভরে গেছে কাব্য নিজেই জানে না।

এক সময় কাব্য কথা বলা শুরু করলো।

:-ভালো আছো যারিন?
:-ভালো,তুমি কেমন আছো?
:-আমার আর থাকা!বাদ দাও।নিজের নতুন সংসারে কেমন লাগছে?তোমার স্বামী নিশ্চই তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমায়।খুব ভালোবাসে?
:-হুম খুব ভালোবাসে,পাগল আমার জন্য।
:-তা তো হবেই তোমার মতো মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
:-তুমি কি নতুন কাউকে ভালোবাসো?
:-নাহ!জীবনে একবার ভালোবেসেছিলাম।তাকে যখন পাই নি আর কষ্ট পেতে চাই না।
:-তার মিথ্যে আশায় এখনো বসে আছো?
:-মিথ্যে সে হতে পারে।কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না।
:-সে যদি তোমার কাছে ফিরে আসে,তাকে আপন করে নেবে?
:-এখন সেটা সম্ভব না,সে এখন অন্য কারো।
:-কিন্তু সে যে কাব্য কে ছাড়া তার জীবনে আর কাউকে মেনে নিতে পারে নি।সে আজো কাব্যের।
:-কিন্তু সে অন্যের নামে নিজের জীবন লিখে দিয়েছে রেজিস্ট্রি নামক একটা কাগজে।যার দাম ভালোবাসার থেকে অনেক বেশি।
:-না কাব্য,আমি বিয়ে করি নি।
(কাব্য এক মুহূর্তের জন্য কাব্য স্তম্ভিত হয়ে গেল)
:-তুমি বিয়ে করো নি?
:-না।সেদিন আমি বাড়িতে আসার পর অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলাম।আমার কষ্ট দেখে মা খুব কান্না করতো।আমার কথা মা বুঝতে পারেন আমার কষ্ট টা আর বাবা কে রাজী করানোর দায়িত্ব নেন।কিন্তু মা বাবাকে তোমার বিষয়ে বললে তিনি রাজী হন নি।আমার বিয়ে ঠিক করেন এক ধনি পরিবারের ছেলের সাথে।আমি অনেক বলেছি,কিন্তু কেউ আমার কথা শুনে নি।

যেদিন আমার বিয়ে হবার কথা ছিল সেদিন আমি অনেক পালাতে চেষ্টা করি কিন্তু পারি নি।কোনো উপায় না পেয়ে আত্বহত্যা করতে যাই।কিন্তু মা দেখে ফেলে।আমি অনেক কাঁদি আর বলি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।সেদিন রাতে মা আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।কখনো ভাবি নি মা আমাকে এভাবে সাহায্য করবে।

বেরিয়ে আসার আগে মা আমার হাতে কিছু জামাকাপড় আর টাকা দিয়ে দেয়।আমি বিয়েবাড়ি থেকে পালিয়ে তোমার হোস্টেলে যাই কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি তুমি হোস্টেল ছেড়ে চলে এসেছো।আর কোথায় গেছ তা কেউ বলতে পারে নি।অনেক বার কল দিয়েছিলাম তোমায় কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিল।

সারা রাত আমি তোমার হোস্টেলের রাস্তার পাশে দাড়িয়ে ছিলাম।একের পর এক কল দিয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্যে ছিল না।তাই তোমাকে পাই নি।সকাল হতেই আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি বাবা বসে কাঁদছে।বাবা কে অই অবস্থায় দেখে আমি অর্ধেক মরে যাই সাথে তোমায় না পাওয়ার কষ্ট।তার পর যখন আমি বাবা বলে ডাকলাম বাবা
বলে আমি তাদের জন্য মরে গেছি।আর কখনো যেন সেখানে না যাই।আমার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয়।শেষ বার দেখেছিলাম মা কাঁদছিল।বাবা কে বোঝানোর চেষ্টা করছিল।কিন্তু লাভ হয় নি।

সেখান থেকে আমি চলে আসি।ভেবেছিলাম কোনো বান্ধুবীর বাসায় কিছুদিন থাকবো।কিন্তু সেখানে ও ঠাই হলো না।সমাজে সবাই আমাকে খারাপ বলতো।অবশেষে মায়ের দেয়া কিছু টাকা দিয়ে ময়মনসিংহ চলে আসি।এখানে একটা হোস্টেলে আমি থাকি।কয়েকটা বাচ্চা জোগাড় করে তাদের এখন টিউশানি করাই।যে টাকা আসে তাতে হোস্টেল ভাড়া আর আমার পড়াশোনা চালাই।আজ খুব তোমার কথা মনে পড়ছিল তাই ফোন দিলাম।আর দেখো,আজ পেলাম।অথচ সেদিন তোমাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।

:-আমায় ক্ষমা করে দিও।আমি জানতাম না তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে।তাই নিজের ঠিকানা ফোন নাম্বার সব পাল্টে ফেলেছি।কিছুদিন হলো একটা কাজে নাম্বার টা চালু করি।

:-এখন আর এসব বলে কি হবে কাব্য।সব তো শেষ।
:-কিচ্ছু শেষ হয় নি।আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।সেই নদীর পাড়ে যেখানে আমরা দুজন মিলে অনেক সময় পাড় করেছি।আসবে তুমি?
:-আসবো,তবে আমার জন্য কি আনবে মনে আছে তো?
:-হুম,অনেক গুলো গোলপ,আর একটা চিরকুট।যেটাতে লিখা থাকবে আমি তোমাকে ভালোবাসি।সেই আগের মতো।তুমি তো প্রত্যেক ভালোবাসা দিবসে এটাই আমার কাছে চাও।
:-হুম,আর আজো এটাই চাই।
:-আর তুমি কিন্তু লালপাড় সাদা শাড়ী পড়ে আসবে।আমি মন ভরে তোমাকে দেখবো।
:-হুম আসবো!আচ্ছা এসে কি করবো?
:-পৃথিবীর সেই মূল্যবান শব্দটি উচ্চারন করবো যা বলার জন্য শতশত বছর অপেক্ষা করা যায়।

:- (যারিন কেঁদে ফেলল)
:-আরে পাগলি কেঁদো না,কাল তো দেখা হচ্ছে।দেখবে সব ভুলিয়ে দেব।খুব ভালোবাসবো তোমায়।
:-আমিও!

পরেরদিন সকালে…..

যারিন আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে।কাব্যের কথা মতো শাড়ী,সাথে লাল টিপ,চুড়ি,মাথার চুল ছেড়ে রেখেছে।কাব্য বলতো চুল ছেড়ে রাখলে নাকি যারিন কে পরীর মতো লাগে।আজ সে কাব্যের সাথে দেখা করতে যাবে তাই কাব্য যেভাবে পছন্দ করে সেভাবেই সেজেছে।হাতে একটা ডাইরি।যেটায় এই সব দিনগুলোর কথা লিখে রেখেছে সে।কাব্যকে দেখাবে বলে।

একটা সিএনজি নিয়ে হোস্টেল থেকে বেড়িয়ে যায় সে।ওদিকে কাব্য সেই সকাল থেকে নদীর ধারে অপেক্ষা করছে।সকাল পেড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।কিন্তু যারিন এখনো এলো না।কাব্য বুঝতে পারছে না কি করবে।অনেক বার ফোন করার পর হঠাৎ যারিনের ফোন বন্ধ হয়ে গেল।কাব্য বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।

প্রায় সন্ধ্যার আগে আগে যারিনের নাম্বার থেকে ফোন এলো।কেউ একজন বলল যারিন হাসপাতালে।কাব্য সাথে সাথে হাসপাতালে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়লো।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।

কাব্যের গাড়ী টা এক্সিডেন্ট করলো।কাব্য কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো।কিন্তু যাবার আগেই কাব্য এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।

সেদিন হাসপাতালে দুটো মৃত্যু হয়েছিল।একটা এক্সিডেন্টে অন্য একটা ধর্ষণ।মানুষ নামের কিছু জানোয়ার এই ভালোবাসা দিবসে মেয়েটিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।ভালোবাসা নামের একটি পবিত্র শব্দ কে পাপের বেড়াজালে আটকে ফেলেছে।যা নষ্ট করে দিল দুটি জীবন।

দুটো লাশ একসাথে মর্গে রাখা হলো।যারিন আর কাব্য।কাব্যের পকেটে রাখা চিরকুট টা রক্তে ভিজে গেছে।আর যারিনের ডাইরি টা পড়ে আছে রাস্তার এক কোণে ধুলো এসে জমা হয়েছে তাতে।
কেউ সেগুলো লক্ষ করে নি।

কেউ জানে না এক অমর ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটলো আজ।

হয়তো তারা এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে অপেক্ষায় আছে আবার এক নতুন জন্মের অথবা এই সীমাহীন আকাশে কোথাও হারিয়ে গেছে।অথবা দুটি আত্মার মিলন ঘটেছে।কে বলতে পারে?কি হয়েছিল।

শুধু বলা যায় ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না।মৃত্যু তাদের আলাদা করতে পারে না।

কিন্তু যারিনকে সেই কথাটি আর বলা হলো না কাব্যের।যে কথাটি শুনার জন্য হাজারো বছর অপেক্ষা করা যায়।…………………
ভালোবাসি……ভালোবাসি…..ভালোবাসি

………………………………………….সমাপ্ত……………………………………

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত