এইতো ভালোবাসা

এইতো ভালোবাসা

আমি আর তৌশী ভার্সিটি থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম। এমন সময় হটাৎ করে এক ছোট্ট মেয়ে তৌশীর সামনে এসে হাত পাতলো। মেয়েটার বয়স সর্বোচ্চ সাত বা আট বছর হবে।
_ আপা একশ টাকা দিতে পারবেন?
_দেখো মেয়ের সাহস কত? একশ টাকা ভিক্ষা করতে আসছে! আজকাল ভিক্ষুকদের মান বেড়ে গেছে। পাঁচ টাকা বা দশ টাকার নিচে ভিক্ষুকরাও ভিক্ষা নিতে চায় না। আর এই মেয়ে তো একবারে লাপ দিয়ে একশ টাকায় পৌছে গেছে!(তৌশী)
_এই তুমি এতো চিল্লাচিল্লি শুরু করছো কেন, ইচ্ছে হলে টাকা দিবা, না হয় বল দিতে পারবো না। এতো কথা বলার কি আছে? (ফয়সাল)
_তুমি সবসময় আমার কথার একটুও গুরুত্ব দাও না, একটুও দাম দাওনা। এই ভিক্ষুকের সামনে আমাকে অপমান করলে। আমি কি কথা জানি না? তোমার থেকে আমার কথা শিখতে হবে? যাও তুমি ভাগো, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ! তোমার মত আমার নজর এতো ছোট না। যতসব ছোটলোক!
এতটা নিচু তোমার নজর, আমি যদি আগে জানতাম, তাহলে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ইমপসিবল! গতকালকেও তুমি আমি ফুসকা খাওয়ার সময় একটা ছেলেকে তোমার প্লেট থেকে ফুসকা দিয়েছো। তখন আমার কি যে ঘৃণা হয়েছে বুঝাতে পারবো না। তোমাকে আমি কেন বুঝাবো, তোমার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি থাকো তোমার ফকির, ভিক্ষুক নিয়ে।(তৌশী)
_দাড়াও, একটু শেষ কথা শুনে যাও।
_হুম, তারাতারি বল।
_ তোমার সাথে আমি নিজেও সম্পর্ক রাখতে চাইনি। তোমার সাথে সম্পর্কটা হয়েছে তাতেই আমার শিক্ষা হয়েছে। বড়লোকের মেয়েদের মনে যে এতো ভালোবাসায় ভরপুর তা আমি কখনও বুঝতাম না, যদি তুমি না আসতে আমার জীবনে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, কারণ তোমার থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। হ্যাঁ, আমি গরীবদের নিয়েই থাকবো। তবে নিশ্চিত তোমাকে ছাড়া সুখেই থাকবো। তুমি আমার জীবনে একটা প্যারা ছাড়া আর কিছুই ছিলে না। আমি এখন এই প্যারা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি তাই শুকরিয়া!
_এই যা! যা! দেখবো না কি সুখে থাকস যতসব ফকির! আল্লাহ আমাকে তোর মত ফকির থেকে রক্ষা করেছে, তাই আমার শুকরিয়া করা দরকার। থাক তুই তোর ফকির নিয়ে আমি গেলাম।
অতঃপর তৌশী চলে গেলো। ফয়সাল তৌশীর চলে যাওয়ার দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় ভিক্ষুক সেই ছোট্ট মেয়েটি অভির পা ধরে কান্না করে দিলো। আর কান্না কন্ঠে বলতে লাগলো,,
_ভাই আমাকে ক্ষমা করে দেন! আমার জন্য আজ আপনাদের এমন ঝগড়া হলো। আমার জন্য আপা আপনাকে কতগুলো খারাপ কথা বললো। আমি যদি না আসতাম তাহলে আপনাদের এমন হতো না। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। ভাই দয়া করে আমাকে পুলিশে দিবেন না।
_আরে পা ছাড়ো। আশ্চর্য, আমি তোমাকে পুলিশে দিবো কেন!
_ঐ যে পুলিশ এই দিকে আসছে। এখন আপনি যদি পুলিশকে বলে দেন, তাহলে তো পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ভাই দয়া করে আমাকে পুলিশে দিবেন না।
_আরে না, আমি তোমাকে পুলিশে দিবো না। একশ টাকা দিয়ে তুমি কি করবা?
_ভাই, আজ তিন দিন আমার মা অসুস্থ, ঘরে যতটুকু খাবার ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। মা আজ তিনদিন কাজে যায় নাই। আর কাজে না গেলে খাবারও নেই।
আমার মা ইট ভাঙ্গার কাজ করে। কাজ করলে টাকা দেয়, না করলে লাথি মারে।
মঙ্গলবার মা আর আমি অগ্রিম টাকা আনার জন্য গিয়েছিলাম। তখন আমার সামনে আমার মাকে টাকা তো দিলো না, বরং এক লাথি দিল। মা আর আমি বাসায় ফিরে আসছি।
আমার মা কারো কাছে হাত পাততে নিষেধ করছে। মা না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে হাত পাতে না। আর আমিও কোনদিন কারো কাছে হাত পাততাম না।
আজকে না আমার মা খুব বেশি অসুস্থ। কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে অনেক রক্ত বের হয়েছে। আর রক্ত দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছি। যদি আমার মা মারা যায় তাহলে আমি কিভাবে বাঁচবো! তাই মায়ের কথা অবাধ্য হয়ে আপনাদের কাছে টাকা চেয়েছি। বিশ্বাস করেন, আমি মাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমার মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মায়ের জন্য ওষুধ কিনার জন্য টাকা লাগবে, আর দশ টাকা বা বিশ টাকা দিয়ে তো আর ওষুধ পাওয়া যাবে না। তাই আপনাদের কাছ থেকে একশ টাকা চেয়েছি। ভাই আমি জানতাম না, আমার জন্য আপনাদের ঝগড়া হবে। আমাকে ক্ষমা করে দেন।
_তোমাদের বাসা কোথায়?
_ঐ যে নদীটা দেখা যায় না? ঐ নদীর পাড় আমাদের ঘর। আমাদের তো আর নিজস্ব যায়গা নাই যে ঘর করবো। ঐখানেই ছোট্ট করে কাগজ আর বস্তা দিয়ে, আমার মা ঘর তৈরি করছে। আমরা ঐখানেই থাকি।
_একশ টাকায় কি ওষুধ পাবে?
-আসলে আমি তো আর জানি না, ঠিক কত টাকার ওষুধ লাগবে। আচ্ছা আপনি যা পারেন তাই দেন।
_ আচ্ছা শুনো আমি তোমার মায়ের জন্য যত টাকা লাগবে ওষুধ কিনে দিবো।
_আচ্ছা তাহলে তো খুব উপকার হবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে?
_শর্ত! কি শর্ত?
_আপনার মোবাইল নাম্বার দিয়ে যাবেন। যত টাকার ওষুধ কিনে দিবেন আমার মা সুস্থ হলে আপনার মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে দিবো। আর না হয় আমার মা ওষুধ খাবে না।
_হুম চল, আচ্ছা তোমার নাম কি?
_আমার মা আমাকে আরিশা বলে ডাকে। হয়তো এই নামটাই আমার।
_খুব সুন্দর নাম! আচ্ছা ঐ যে ফার্মেসী দেখা যাচ্ছে। চল ওষুধ কিনে নেই।
আমার পকেটে তখন টাকা ছিল। টিউশন করে তিন হাজার টাকা পেয়েছিলাম। অতঃপর ওষুধ এবং কিছু খাবার কিনে আরিশাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। আরিশা আমার মোবাইল নাম্বার নিয়েছিল ঠিকই। হয়তো কোনদিন কল দিয়ে টাকাটা ফেরত দিতে চাইবে। আমি টাকার কথা একটুও ভাবছি না। ভাবছি আরিশার মাকে নিয়ে। কেমন মানুষ তারা, না খেয়ে থাকলেও কারও কাছে হাত পাতবে না। অসুস্থ হয়ে জীবন মৃত্যুর পথে পা বাড়ালেও একটা টাকা ভিক্ষা করবে না। পৃথিবীতে কত রকম মানুষ। কেমন মা আর কেমন মেয়ে! কি অদ্ভুত মেয়ে, মায়ের কথার একটুও অবাধ্য হয়নি!
.
হয়তো আরিশার মা, আমার করুণা করে কিনে দেওয়া ওষুধ খাবে না!
.
আমার এই টাকাটা দিয়ে হয়তো আমি আর তৌশী ঘুরতে পারতাম, বড় বড়, নামীদামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। ভালো কাজে ব্যয় করার তৌফিক দিয়েছেন। এই ছোট্ট মেয়ের মায়ের জন্য এতো আর্তনাদ, মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস আমাকে অবাক করে দেয়। আমারতো আর মা নেই তাই হয়তো আমি বুঝিনা। আমার মা থাকলে আমিও হয়তো আরিশার মত হতাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত