আবির ও তার ভালবাসা

আবির ও তার ভালবাসা

আবির পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। একদম শান্ত। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনি তার আচার আচরন। পরিবারের সবার চোখের মনি। পড়াশোনায় খুব মেধাবী। স্কুলের ফাস্টবয়। স্যাররা তাকে খুব ভালবাসে। বাবা সরকারী চাকরিজীবী। সম্পদের অভাব নেই। ফাস্ট ডিবিশনে এসএসসি পাশ করার পর শহরের সরকারী কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু শহরে ভাল পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও কি যেন এক অজানা কষ্ট ভয়ে নিয়ে বেড়াই। সর্বদায় তার মন পরে থাকে বাড়ির দিকে। তার এই পিছুটান সবাইকে ছেড়ে শহরে আছে বলে নয়। তার পিছুটান হলো একটা ভয়। কেউ বাবা মা কে কষ্ট দিচ্ছে না তো? কেউ তার বোনদের দিকে অশালিন মন্তব্য ছুড়ে দেয় না তো? কেউ তার আদরের ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতেছে না তো? কেউ তাদের ফসলের জমি নষ্ট করতেছে না তো? এমনি হাজারও চিন্তায় মগ্ন থাকে আবির।

আবিরের বাবা একাই। তার কোন ভাইবোন নেই। তাই বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদের মালিক আবিরের বাবা একাই। এই কারনে আবিরের বাবা সবার চক্ষুসূলে পরিনত হয়। বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করতে থাকে গ্রামের লোকজন। কখনো গোয়াল ঘর থেকে রাতের আধারে গরু নিয়ে যাওয়া। কখনো গাছের ফল, কখনো বা ক্ষেতের ফসল কেটে নিয়ে যায় রাতের আধারে। তেমনি একদিন সকালে আবিরের কাছে খবর যায় এক একর জমিতে লাগানো বেগুনের গাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। বেগুনের গাছগুলোতে মাত্র বেগুন ধরা শুরু করেছিল। খবর পেয়েই আবির বাড়ি চলে আসে।

প্রায় একমাস আবির কলেজে যায় না। তার চলা ফেরায় ও কেমন জানি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সারাদিন বাড়িতে থাকে সন্ধ্যায় বের হয়ে অনেক রাতে বাসায় আসে। প্রতিদিনি প্রায় এমনটা ঘটতে থাকে। তার মা বাবা জিজ্ঞাসা করলেও কোন উত্তর পায় না। কিন্তু তাদের কাছে একটা জিনিস পরিলক্ষিত হয় আগের মত আর কেউ অত্যাচার করে না। সময় গড়াতে থাকে। আবির আর ইন্টার মিড়িয়েট পরিক্ষায় অংশগ্রহন করে না। শান্ত আবির একসময় সামান্য কথাতেই অতিরিক্ত রিএক্ট করে। টাকার জন্য বাড়িতে ভাংচুর করে। ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটা গ্রুপে অংশগ্রহন করে। মাঝে মাঝে শোনা যায় সে ডাকাতিতেও অংশগ্রহন করে। ক্রমে ক্রমে এই কথা পুরু গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। থানার ডাইরিতেও তার নাম উঠে যায়। সে বাড়ির বাহির হয়। কিন্তু গ্রামের কেউ আর তার পরিবারের কোন ক্ষতি করার সাহসও করে না। ধীরে ধীরে তাদের গ্রুপের অপরাধের প্রবনতা বাড়তে থাকে। আবিরও একসময় সাথে অবৈধ অস্ত্রবহন শুরু করে। তাদের গ্রুপের সবাই প্রায় কয়েকবার করে ধরা পড়লেও সে কখনো পুলিশের হাতে পড়েনি। একসময় তার বিরুদ্ধে দেখা মাত্রই গুলির অর্ডার হয়। আবির নিজেকে সম্পুর্ণ রুপে আড়াল করে নেয়। গ্রুপের সবার কাছ থেকেই প্রায় নিজেকে দুরে সরিয়ে নেয়।

এখন আর আবিরকে কারও পক্ষে চেনার উপায় নেই। মুখ ভর্তি দাড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। সব ধরনের অপরাধের কাছ থেকে দুরে, সবার চোখের আড়ালে গিয়ে কাটতে থাকে আবিরের সময়। অহনা নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় আবিরের। একসময় মেয়েটির সাথে ভাল সক্ষতা গড়ে ওঠে আবিরের। মেয়েটি আবিরের সব ঘটনা সম্পর্কে অবগত। সেখানেই স্থানীয় একটি হাইস্কুলের শুন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সবার মত অহনাও ঐ পদের জন্য তার আবেদন পত্র জমা দেয়। কিন্তু বিধি বাম ঘুষ ছাড়া চাকরি হবে না। আর মেয়েটির সামর্থ্য নেই ঘুষের টাকা মেনেজ করার মত। বিকালে পুকুরের পাড়ে বসে আছে অহনা। আবির পিছন থেকে অহনাকে ডাক দেয় কোন সাড়া পায় না। আবির ভাবে যে অহনা কথা বলতে বলতে তাকে অস্থির করে তোলে তার কি হল। ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন। ভাবতে ভাবতে আবির অহনার কাছে আসে। লক্ষ্য করে অহনার চোখের কোণে জল জমে আছে। আবির প্রশ্ন করে কি হয়েছে অহনা তোমার চোখে জল কেন। আবিরের প্রশ্ন শুনে অহনার চোখে লোনা জলের তিব্রতা বাড়তে থাকে। একসময় গাল বেয়ে লোনা জল নিচে নেমে আসে। আবিরকে সব খোলে বলে অহনা। আবির সব শুনে অহনাকে বলে এখন হবেনা তো কি হয়েছে পরে তো সময় আছে তখন হবে। অহনা আমার একটু কাজ আছে পরে কথা হবে বলে আবির ওখান থেকে চলে আসে। সেদিন রাতেই আবির জীবনের শেষ বারের মত অপরাধ করে আবির। স্কুলের হেড টিচারের মাথায় পিস্তল তাক করে। পরের দিন সকাল দশটায় স্কুল থেকে ডাক আসে অহনার। চাকরি কনফার্ম হয়। অহনার বুঝতে এতটুকু বাকি থাকে যে কার কারনে সে চাকরিটা পেল।পনের দিন পর স্কুলে জয়েন্ট করে অহনা। একমাস পর অহনা তার চাকরি জীবনের প্রথম বেতন পেয়েছে। বেতন নিয়েই আবিরের জন্য পাঞ্জাবী, পেন্ট, জুতা আর একটা জায়নামায কিনে হাসিমুখে বাড়ি এসে শুনে আবির বাড়িতে গেছে ওর মা বাবার সাথে দেখা করতে। আবিরকে না পেয়ে অহনার চোখে জল এসে গেছে। এদিকে আবির তার প্রায় সব বন্ধুদের সাথে দেখা করে রাত এগারোটার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে আবির। হঠাৎ অনুভব করে আবির কিসে যেন তার পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুল প্রায় সম্পুর্ণ মুখে পুড়ে নিয়ে কামড় বসিয়েছে। ভাল করে খেয়াল করে বুঝতে পারে আবির তার পায়ের আঙ্গুল একটা সাপ আকড়ে ধরে আছে। প্রথম জাকুনিতে সাপটিকে ছাড়াতে না পারলেও দ্বিতীয় জাকুনিতে সাপটিকে ছাড়াতে সক্ষম হয় আবির। অতি কষ্টে বাড়িতে পৌছে আবির। তাদের কাজের ছেলেকে ডেকে বলে আমায় সাপে কেটেছে শক্ত করে বাধই আর মা যেন আমায় স্পর্শ না করে বলেই জ্ঞান হারাই আবির। রাতেই খুব সাবধানে ওঝা এনে বিষ নামানো হয় আবিবের। পরের দিন সকালে আবিরের পায়ে দুটো বাধন রেখে আর পানি পড়া দিয়ে তিনদিন পর বাধনটা খুলবেন বলেই বিদায় নেই ওঝা। ঐদিন ছিল শুক্রবার। আর কিছুই হবেনা বলে পায়ের বাধন খোলে গোসল করে জুমআর নামায পড়তে যায় আবির। মসজিদ থেকে এসে খাওয়া দাওয়া শেষ করে পাশের বাড়িতে যায়। ওখানে বসে কিছুক্ষন টিভি দেখে বাড়িতে চলে আসে আবির। মাগরিব নামাযের সময় হঠাৎ আবিরের বমি শুরু হয়। দশ মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর কূলে ঢলে পড়ে আবির। এদিকে সাপে কাটা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছুই জানতে পারে না অহনা। বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। ওঝা আসে। আবিরের সমস্ত শরীর সুই এর আগাতে জর্জরিত হয়। শরীরের কোন অংশে একফোটা রক্তের সন্ধান মিলে না। আবিরের মৃত্যুর সংবাদ পৌছে যায় অহনার কাছে। পাগলের মত আবিরের কাছে ছুটে আসে অহনা। খবর পৌছে যায় থানা অব্দি। সারা বাড়ি পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে। আবিরের মৃত্যু হয়েছে কিনা এটা নিশ্চত করতে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাই পুলিশ। আবিরের বাবা মা ভাই বোন আর আত্মীয় স্বজনের কান্নায় স্তব্দ পুরো বাড়ি। অহনার বুক ফাটা আর্তনাদে চারদিক ভারি হতে থাকে। আবিরের আর পড়া হয় না অহনার কেনা পাঞ্জাবী আর পেন্ট। সাদা পোষাকে চিরনিদ্রায় সমাধি হয় আবিরের।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত