রুমে বসে খেলা দেখছি। বাংলাদেশ বনাম ইন্ডিয়া। একি সাথে হাতে ফোন নিয়ে গেমস খেলছি। একটু পরে আব্বাজানের আগমন। আব্বাজানের খেলার প্রতি একটু এলার্জি আছে। তাই টিভিটা অফ করে দিলাম। আব্বাজান খুব নরম সূরে বললো,
– বয়স কি তোর কম হইছে।
কথাটা শুনে বুঝতে পারলাম না। কোন কারনে হটাৎ এই প্রশ্ন। ফোনে গেমস খেলার জন্য নাকি?
– কেন আব্বাজান? হটাৎ এই প্রশ্ন কেন?
– কেন আবার! বয়স তো তোর কম হয়নি। আর কত সিঙ্গেল লাইফ কাটাবি?
এবার আমার বুঝার বাঁকি রইলোনা যে আব্বাজান কি বলতে চাইছেন। আমি অবুঝের মতো করে বললাম,
– আমি সিঙ্গেল কই আব্বাজান? আপনি আছেন, আম্মাজান আছেন, দু ভাই বোন আছে।
– তোর সাথে আর কথায় পাড়া যাবেনা। আমি বিয়ের কথা বলছি।
– আব্বাজান খুব সুখে আছি। বিয়ের পর, এটা করো, সেটা করো, এই দ্বায়িত্ব, ঐ দ্বায়িত্ব আমি পারবোনা আব্বাজান।
– বিয়া করা কিন্তু ফরয কাজ।
– হুম বড় হয়ে নেই তখন করবোনে।
– হ্যাঁ আমরা মরে যাওয়ার পর করবি জানি তো।
– ছিঃ আব্বা এসব বলেনা।
– আমি এতো কিছু জানিনা তুই বিয়ে করবি।
– জোর করে বিয়া করাইবেন?
– নিজে থেকে যে এজন্মে করবিনা তা ভালো করেই জানা আছে! তাই জোর করেই করাবো।
– আমি কি মেয়ে মানুষ নাকি আব্বাজান?
– তুই মেয়ে মানুষ এর থেকে কম কই? মেয়ে মানুষ হইলে ভালই হইতো।
– তাহলে অধরাকে বিয়ে দিয়ে দাও।
– আমি আর কোন কথা শুনতে চাইনা। রাত হইছে ঘুমা গিয়া। কাল সকালে রেডি হয়ে থাকবি তোকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবো কাজ আছে।
– বুঝতে পারলাম না আমাকে কি চালান করে দিবে? তবে এটুকু ভেবে সন্তুষ্টি হলাম। এয়ারপোর্টে কেউ মেয়ে দেখতে যায়না হিহি।
অতঃপর সকালে রেডি হয়ে আব্বাজান এর সাথে রওনা দিলাম। এক ঘন্টা লাগবে প্রায় এয়ারপোর্টে যেতে। মাঝপথ থেকে সুমন আংকেলকেও গাড়িতে নিলো। ওনাদের কথা-বার্তায় যা বুঝলাম। আজ সুমন আংকেল এর মেয়ে ইংল্যান্ড থেকে দেশে আসছে। সুমন আংকেল আমাকে খুব ভালো করেই চেনে। আমিও খুব খারাপ চিনিনা। আমাকে খুব আদোর করে।
.
এয়ারপোর্টে গিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর একটা মেয়ে আসছে আমাদের দিকে লক্ষ করে। মেয়ে বলা মনে হয় ঠিক হবেনা। ছোট একটা টি শার্ট, শর্ট প্যান্ট, চুলে লাল, নীল রং করা। কাঁধের পিছনে ব্যাগ। তো আপনারাই বলে তাঁকে কি আর মেয়ে বলা যায়। আমার নিজেরিই লজ্জা করছে। আব্বায় মনে হয় অবাক।
.
এসে মুরুব্বীদের সালাম তো দূরের কথা ইংলিশে ছাড়া কথাই বলেনা। আব্বায় কিন্তু ইংলিশে এক্সপার্ট। আমি বেকুবের মতো এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকি। গাড়িতে উঠার আগে মেয়েটার সাথে কথা হয়নি। কথার এক পর্যায়ে যখন জানলাম মেয়েটার নাম অপলকা তখন আমার জ্ঞান হারাবার মতো অবস্থা। অপলকা কারো নাম হয়? তাও আবার এই পুরো ছেলের নাম। আমার মেয়েটাকে মেয়ে মনে হয়নি। ছেলেই মনে হয়েছে। নামের সাথে পুরো উল্টো মেয়েটা।আমার উপর কিছুটা বিরক্ত হয় মিস অপলকা কারণ আমি উনার কথার উত্তর বাংলাতে দিচ্ছি বলে। একটা ইংলিশ শব্দও উচ্চারণ করিনি। আর উনি একটা বাংলা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কে জানে বাংলা পারে কি না। পারলেও হয়তো ভুলে গিয়েছে শুনলাম গত ১২ বছর ধরে ইংল্যান্ডে আছে।
.
সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম আব্বায় যখন বললো এই ইংলিশ ম্যামের সাথে নাকি আমার বিয়ে দিবে। আমি বুঝলাম না আব্বায় নিজের ছেলেকে কেন আরেকটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে। ঘটনাক্রমে জানতে পারলাম পরে যে ইংলিশ ম্যামের সাথে আমার বিয়ে নাকি ছোট বেলা থেকেই ঠিক করা। শুনে ইচ্ছে হইছিলো আমিই দেশ ছেড়ে পালাই।
.
মানুষ তো কমপক্ষে একটা মেয়েকে বিয়ে করে। কমপক্ষে একটু লাজুক হবে। হোক কালো। বিয়েটা হয়ে যাবে খুব শীগ্রই যা বুঝা যাচ্ছে আংকেল আর আব্বার কার্যকলাপ দেখে। বিয়েটা আটকানো ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। অতঃপর খুব কষ্ট করলাম কিন্তু কোনো কাজ হলোনা। পরে ভাবলাম একটাই শেষ রাস্তা আছে ইংলিশ ম্যামকে বুঝাতে পারলেই কাহিনি খতম। ইংলিশ ম্যামকে একটা জায়গায় ডেকে ভালো করে বুঝালাম প্রায় এক ঘন্টা ধরে কিন্তু কোন ফল হলোনা। তাঁর কথা হলো তাঁর বাবা যদি কোন রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দেয় সে রিকশাওয়ালাকেই বিয়ে করবে। এর পরে আমার আর কি কথা থাকতে পারে! আমার কষ্টটা আর দেখলোনা!
.
অতঃপর বিয়ে হবেই আমারও আর কিছু করার নেই। বাড়ি থেকে পালানো কেন দেশ ছেড়েও পালাতে কয়েক ঘন্টার ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আব্বার মাথা হেড হবে ভেবে একটা ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে।
.
কয়েকজন ছাড়া কেউ তো বিশ্বাস’ই করেনা যে সুমন আংকেল এর একটা মেয়ে আছে। একটা নামীদামী ফাইব ষ্টার হোটেলে বিয়ে হলো আমাদের ঝলমলে,লাল, নীল আলোর মেলায়।
.
অতঃপর বাসর রাত। বাসর ঘরে গিয়ে দেখি ইংলিশ ম্যাম সেই মোবাইলে চ্যাটিং নিয়ে খুব ব্যাস্ত। আমিও কোন কথা না বলে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর বিয়ে করা ছেলে বউ ডাকলো।
.
– আজকে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত আপনি এখনি ঘুমাবেন? (ইংলিশে বললো)
– একটা বাঙ্গালী বউ হলেই আমি বেশ খুশি থাকতাম। আসা করি এর পরে কমপক্ষে আমার সাথে আর ইংলিশে কথা বলবেন না। আমার ছোট ভাই, বোন আর মা’র সাথে তো না’ই।
উত্তরে মেডাম কিছু বললোনা। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে আবার শুবার পথে মেডামকে বলি ” ফ্রেশ হয়ে নাহয় ফেসবুকিং করবেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসেন আমি ঘুমালাম ” শুয়ে শুয়ে ভাবছি শাড়ি মনে হয় আজ ছাড়া আর কোনদিন পড়েনি। শাড়িতে বেশ সুন্দরী’ই লাগছে। নামের সাথে যায় একেবারে। আর কোনদিন শাড়ি পড়বে বলে মনে হয়না। আজ মনে হয় চাপে পড়ে শাড়ি পড়েছে। বিয়ে তো আর শাড়ি না পড়ে হয়না কমপক্ষে।
.
নুডুলস ছাড়া আর কিছু রান্না করতে পারেনা। আব্বাকে বললেও বলে থাক আমি নুডুলসই খাবো বউমা’র হাতে তোর কোন সমস্যা? সবচেয়ে কষ্ট হয় ছোট ভাই’টা মাত্র এইটে পড়ে ইংলিশ আর কতুটুকু বুঝবে। তাই ওর কাছে আসেনা। অধরা একটু আদটু বললেও মন খুলে কি আর কথা বলতে পারে? যাহ বলে সব আব্বাই। মা আর কি কথা বলে।
.
বাংলা পারে তবে মুখ দিয়ে ইংলিশ’ই এসে যায়। এরি মধ্যে ওকে নিয়ে বাইরে যাবো দূরের কথা আমিই বাইরে যাইনা দরকার পড়লেও। অফিসে যাই আসি। বাড়িতে এটা ওটা নিয়েই সময় পাড় হয়ে যায়। তবুও আব্বায় বুঝেনা তারর বউমা’কে কিছু বলেনা। আস্তে আস্তে বাংলায় কথা বলা শুরু করে। সমস্যা তো ঐ একটাই মুখ দিয়ে আগে ইংলিশ’ই এসে যায়। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।
.
একদিন রাতে জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা আপনি আমার সাথে এরকম বিহেব করেন কেন? আমি কি আর জেনে শুনে ইংলিশ বলি? অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বুঝেন অবশ্য!
– আচ্ছা ধরেন আমি ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো যদি আচরণ করি তাহলে আপনার কিরকম লাগবে? আপনার অবশ্যই স্বামী হীসেবে একজন পুরুষ মানুষ চাই? তেমনি আমারও তো একজন বাঙ্গলী মেয়ে চাই। ইংলিশ কালচার ইংলিশেই সীমাবদ্ধ থাক।
– এর জন্য আপনার তো আরো আমাকে সাহায্য করা উচিৎ আর আপনি কি করেন?
– আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
– মনে হয় কিছুই বুঝেন না।
– অনেকটা এরকমই।
.
ভেবে সস্থি পেলাম যে বিয়ে করা ছেলেটা মেয়ে হতে চাচ্ছে। আর যেহেতু সাহায্য চেয়েছে যেহেতু আমারও সাহায্য করা উচিৎ। প্রথমত আব্বাকে কিছুদিন অন্য কোথাও বেড়ানোর জন্য পাঠাতে হবে। নাহয় আব্বার সামনে গেলেই ইংলিশে বলা শুরু করে দুজনেই। অতঃপর বুঝিয়ে বললাম আব্বাও রাজি হলো।
.
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে শিখছে আম্মাজানের থেকে। রান্না ঘরে গেলেই উনি ঘেমে একাকার হয়ে যায়। চোখগুলো লাল হয়ে যায়। অধরা কদিন চোখে কাজল দিয়ে দেয়। তারপর থেকে নিয়মিতই কাজল দিতে চেষ্টা করে কিন্তু এখনও শাড়ি পড়তে পড়তে পারেনা। এর জন্য নিজের কাছে নিজেই অনেক রাগ হয় মেডামের।
.
দিন যায় আর মনে হয় প্রেমে পড়ছি মেডামের। রাগের মুখটা অনেক বেশিই কিউট লাগে। যদিও রাগটা নিজের উপরেই দেখায়। খুব কষ্টে কিছু সাধারণ রান্না শিখলো যেমন ডিম ভাজি সহ সাধারণ রান্নাবান্না। ওর কাছে এটুকুই অনেক। তবে নুডুলস খুব ভালো রান্না করে বলতে পারে। ওর কষ্টে রান্না করা খেতে আমার অসুবিধে হয়না। হোক লবণ,মরিচের কম বেশি। তবুও তো চেষ্টা করছে আর আমার এতে এপ্রিশিয়েট করা উচৎ।
.
টিভিতে বাংলা কিছু রুমান্টিক নাটক দেখে মেডামেরও ইচ্ছে হলো শাড়ি, চুড়ি, চোখে কাজল, কপালে টিপ দিয়ে আমার সাথে ঘুরতে যাবে। ফুসকা খাবে। অতঃপর অধরা মেডামকে সাজিয়ে দিলো প্রায় তিন ঘন্টা সময় নিলো। কিন্তু কাহিনি হলো এরকম সাজে দেখে এই প্রথম মনে হয় বউ’র উপর ক্রাশ খেলাম। কথাটা আমি বলেওছিলাম। মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো “তবে মনে হয় বাঙ্গালী হতে পারছি”
.
এই প্রথম মেডামকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া। অনেক ঘুরলাম, কোন নামীদামী রেস্টুরেন্টে যায়নি খেতে। রাস্তার পাশে ফুসকা খেয়ে দুজনেই সন্তুষ্ট। সবচেয়ে ভালো লেগেছে রিকশা দিয়ে ঘুরার ব্যাপার’টা সত্যিই। এর থেকেও ভাল লেগেছিলো। নৌকা দিয়ে নদীর মাঝখানটায় বসে শহর’টা দেখা। অবশ্য মেডাম অনেক ভয়ও পেয়েছে। তাই আমার হাতটা ধরে বসেছিলো।
.
দীর্ঘ ৩ মাস পর ইংলিশ ছেলেটাকে বাঙ্গালী বউ বানাতে পারলাম। এর জন্য আব্বাকে সবচেয়ে বেশি ভুমিকার দ্বায়ী করতেই হয়। মা,অধরারও কম নয়। আমি শুধু পাশেই থেকেছি। হু এখন আমার বউ সত্যিই অপলকার মতো। কমপক্ষে সকালে নিজের হাতে ডিম ভাজি করে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।
.
বউটার যত টি শার্ট, প্যান্টসহ ছেলে জাতীয় সব পোষাক জানালার ওপাশ দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে। কিছু শখের চশমাও ছিলো অগুলাও ফেলে দিয়েছে। এখন তো বাইরেও বের হয়না বোরখা ছাড়া। আমি ভেবে পাইনা টি শার্ট আর শর্ট প্যান্ট পড়া মেয়েটা আজ বোরখা ছাড়া বের হয়না। এখন সত্যিই আমি অনেক গর্ববোধ করি আমার অপলকাকে নিয়ে।
……………………………………..(The End)……………………………..
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা