আজ শুভ্রর বিয়ে….

আজ শুভ্রর বিয়ে….

স্থানঃ টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সময়ঃ সকাল পৌনে দশটা।
শুভ্র বসে আছে। ডানহাতে চায়ের কাপ। বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের শলাকা।
সে সিগারেট সবসময় বাম হাতেই ধরে। তার একটা কারনও আছে। ছোটবেলা থেকেই সে বাঁহাতি। সে বাম হাতেই বেশিরভাগ কাজ করে থাকে।

মামা, চা খাইবেন? শুভ্র চোখ
তুলে তাকালো। একজন আধাবয়সী লোক চায়ের ফ্ল্যাস্ক নিয়ে তার
সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
শুভ্রঃ দেখছেনই তো হাতে চায়ের কাপ
আছে। দেখেও কেনো জিজ্ঞাসা করলেন
চা খাবো কিনা..??
চাওয়ালাঃ হেঃ হেঃ হেঃ খেয়াল
করি নাই মামা। সিগারেট খাইবেন?
সিগারেট আছে। দিমু?
শুভ্র এবার মুখে কিছু না বলে বাঁহাত উঁচু
করে সিগারেট দেখালো। চাওয়ালা আর
কিছু না বলে সোজা সামনে হাঁটা ধরলো।

সুপ্রভাত জনাব। স্যরি, আসতে একটু লেট হয়ে গেলো। অফিস টাইম তো, রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিকজ্যাম ছিলরে। কিরে.. কথা বলছিস না কেনো?
শুভ্রঃ আচ্ছা, কিছু কি বলার আছে? এই আর নতুন কি? প্রায়ই তো তুই দেরি করেই আসিস।
এটা আর নতুন কি? আর প্রতিদিন একই কথার জবাব দিতে কার ভাল লাগে বল?
বন্যাঃ হয়েছে হয়েছে!! ভাব নিতে হবে না। সকাল সকাল একটা ঝাড়ি না নিলে হতো না বুঝি?
শুভ্রঃ হিঃ হিঃ হিঃ নিলাম আর কি..
তোকে রাগাতে আমার বেশ ভাল লাগে।
হাঃ হাঃ হাঃ
বন্যাঃ তুই আসলেই একটা….. না থাক,
বলবো না।
শুভ্রঃ জানিস, এই মুহূর্তে আমার
সামনে একটি মানুষ বসে আছে। যার
সৌন্দের্যর কাছে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যই ফিকে। আর রাগলে এই
মানুষটাকে যে আরো কতটা অদ্ভুত সুন্দর লাগে তা তোর মত প্রেত্নি বুঝবে কি করে।
হাঃ হাঃ হাঃ
বন্যাঃ পাম মারা হচ্ছে!! শয়তান কোথাকার..
শুভ্রঃ চা খাবি?
বন্যাঃ হুঁ
শুভ্রঃ চল উদ্দানের ভেতরে যাই। ওখানের চা ভাল। এখানের চাওয়ালার
চা খেলে মনে হয় পুকুরের পানি খাচ্ছি।
বন্যাঃ চল।
মামা, মালা নিবেন? দুজন
বসা থেকে উঠতেই একটি পাঁচ/সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে বললো।
শুভ্রঃ কত রে? দাম কত?
বাচ্চা মেয়েটি বললো, ১০ ট্যাকা দ্যান।
শুভ্র মানিব্যাগ থেকে দশ টাকা বের
করে বাচ্চা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল।
শুভ্রঃ পেছন ফের।
বন্যাঃ কেনো?
শুভ্রঃ বললাম ফিরতে, ফের।
শুভ্র বন্যার খোঁপায় বেলি ফুলের মালাটি বেঁধে দিলো।
বন্যাঃ আজ হঠাৎ এত রোমান্টিক হবার
কারনটা কি শুনি জনাব?
শুভ্রঃ কেন! আমি কি তোকে ভালবাসি না?
বন্যাঃ হ্যাঁ বাসিস। তবুও… আজ একটু
বেশি রোমান্টিক দেখাচ্ছে তো। তা বললাম।
শুভ্রঃ ও! তাহলে ওই সে ওখানে সুন্দরি মেয়েটা বসে আছে তার খোঁপায় মালাটা বেঁধে আসি?
বন্যাঃ হিঃ হিঃ হিঃ যা তাহলে।
দেখি তোর কত সাহস। শোন, সাতসকালে যদি থাপ্পর খাবার শখ
জেগে থাকে, তাহলে যা। আমি বারন
করবো না।
শুভ্রঃ হয়েছে হয়েছে। পাকামো করিস না। চল, মাঠে গিয়ে বসি।
কিরে, চা টা বেশ মজার না?
বন্যাঃ হুঁ।
শুভ্রঃ মামা, একটা সিগারেট দাও তো।
বন্যা তার ভ্যানিটিব্যাগ থেকে একটি লাইটার বের করে এগিয়ে দিল।
শুভ্রঃ এইটা কার! আর তোর কাছে আজকাল এই জিনিসো থাকে! হাঃ হাঃ হাঃ
বন্যাঃ জ্বি না জনাব, এটা আপনারই। গত সপ্তাহে আমি কেড়ে নিয়েছিলাম।
আপনি নিতে ভুলে গেছেন। আমিও
দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর যত সিগারেট খাওয়ার খেয়ে নিন জনাব শুভ্র। বিয়ের পর যদি একটা সিগারেটও খেতে দেখি, এক্কেবারে ঠোঁট দুটো সেলাই করে দেবো।
শুভ্রঃ হিঃ হিঃ হিঃ সে পরে দেখা
যাবে। আগে বিয়ে হোক। তারপর…
বন্যাঃ এত পাজি কেন তুই! আর মাত্র এক সপ্তাহ। খেয়ে নে, যত পারিস।
শুভ্রঃ চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খা জলদি।
বন্যাঃ চল। বসুন্ধরা সিটিতে যাবো।
বলতে বলতে চায়ের দোকানিকে ব্যাগ
থেকে টাকা দিয়ে বললো, কত বিল
হয়েছে তা এখান থেকে রাখুন।
শুভ্রঃ কেনো? ওখানে কি?
বন্যাঃ তোর গায়ে হলুদের
পাঞ্জাবী আমি পছন্দ করে দেবো।
শুভ্রঃ আরে!! কি বলিস! আমার পকেটে একশ টাকার একটা নোট আর কিছু
খুচরা ছাড়া কিচ্ছু নাই। কি দিয়ে কিনবো?
বন্যাঃ সেটা আমার মাথা ব্যাথা। চল।
এইযে মামা, যাবেন? বসুন্ধরা সিটি?
রিকশাওয়ালাঃ হ। উঠেন।
বন্যাঃ ওঠেন।
শুভ্র রিকশায় চেপে বসলো। পাশে বন্যা। রিকশা ছুটে যাচ্ছে।
বন্যাঃ আচ্ছা, আমরা কি বিয়ের পরও একজন আরেকজনকে তুই করেই ডাকবো?
শুভ্রঃ সমস্যা কি! তুই তুমির মাঝে সমস্যা কি? একটা ডাকলেই তো হয়।
বন্যাঃ মানুষজন কি বলবে? শুনতে তখন কেমন দেখাবে না? ( নাক কুঁচকে বললো)
শুভ্রঃ আজিব তো! এই ছোট ব্যাপার
নিয়ে তোর এত মাথা ব্যাথা কেন? What the…. কিছু বললাম না।
বন্যাঃ হয়েছে। আর মেজাজ
দেখাতে হবে না। চ্যান্স পেলেই ভাব
নেয়া তো তোর পুরোনো অভ্যাস। শোন, আমাকে বিয়ে করতে হলে তোর এইসব বাজে অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিতে হবে। পারবি না?
শুভ্রঃ পারবো না মানে!! আবার জিগায়!
একশবার পারবো।
বন্যাঃ একশবার পাবার কোনো প্রয়োজন নেই
বাপু। একবার পারলেই হবে।
শুভ্রঃ ওই হলো একটা…
বন্যাঃ ফাজিলের হাড্ডি কোথাকার।
( মুচকি হেসে বললো)
শুভ্রঃ এই যে! এই যে, এই হাসিটা দেখার জন্যই তো আমি সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকি। কই থাকে এই হাসি! এই হাসি দেখার জন্যই তো এত আয়োজন।
বন্যাঃ দুইদিন পর করবি বিয়ে।
ঢং দেখলে মনে হচ্ছে বাচ্চা ছেলে। বাঁদর কোথাকার।
শুভ্রঃ হেঃ হেঃ হেঃ
বন্যাঃ থামা তোর ক্যাবলামো মার্কা হাসি। এই দুটো নেই?
শুভ্রঃ দুটো কেনো?
বন্যাঃ হলুদটা বৌভাতে পড়বি। আর
খয়েরিটা গাঁয়ে হলুদে। বিয়ের
শেরওয়ানী আন্টি কিনেছেন।
আমাকে বলেছেন।
শুভ্রঃ হ্যাঁ। আম্মু আর মীরা গিয়ে পছন্দ
করেছে। আমি যাইনি। যাইহোক,
একটা ব্যাপার বুঝলাম না, হলুদ
পাঞ্জাবী পড়বো হলুদে। তা না বলে বললি, উল্টো। বৌভাতে কি কেউ হলুদ
পাঞ্জাবী পড়ে নাকি!
বন্যাঃ আমি বলেছি তাই পড়বি। ব্যস…
শুভ্রঃ মাথা ঠিক আছে তো?
নাকি ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে?
বন্যাঃ আমার মাথা ঠিকই আছে। নিজের মাথায় ঢাল। পাগল কোথাকার।
শুভ্রঃ আমি পাগল হলে তো তুই সেই পাগলের বউ হতে যাচ্ছিস। তাহলে….
বন্যাঃ উফ!! বক বকানি থামা এবার। প্লিজ.. এবার সত্যিই আমার মাথা ধরেছে। চুপ থাক প্লিজ।

সন্ধ্যার পর শুভ্রর অন্ধকারে একা একা ছাদে হাঁটতে ভালই লাগে। তাই আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিরে ভাইয়া, কি করছিস একা একা? শুভ্র চমকে গিয়ে হাত থেকে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
মীরাঃ আরে আমি। ভয় পাচ্ছিস কেনো?
শুভ্রঃ আওয়াজ দিয়ে আসবি না!
আমি না বলেছি, যখনই আমার
সামনে আসবি আওয়াজ দিয়ে আসবি!
মীরাঃ স্যরি। কি করছিলি?
শুভ্রঃ আকাশ দেখছিলাম।
মীরাঃ অন্ধকারে আবার আকাশ দেখা যায় নাকি? জানতাম না তো!
শুভ্রঃ যায়। দেখা যায়। এইবার বল
কেনো এসেছিস? কিছু বলবি এইতো?
মীরাঃ না, এমনি। আচ্ছা ভাইয়া,
আজকে কি বন্যা আপুর সাথে দেখা করেছিস?
শুভ্রঃ হ্যাঁ। কেনো?
মীরাঃ না, আম্মা বলছিল বিয়ের আগে ওর সাথে আর দেখা না করতে।
লোকে কি বলবে না বলবে। এ জন্য।
শুভ্রঃ হয়েছে? কথা শেষ হয়েছে?
মীরাঃ হুঁ ( মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো)
শুভ্রঃ তাহলে এখন এইখান থেকে ভাগ।
প্লিজ। আমাকে একটু একা থাকতে দে।
মীরাঃ রাগ করছিস কেন ভাইয়া?
আচ্ছা যাচ্ছি।
শুভ্র ছাদের রেলিং এর উপর বসে আছে।
হাতে সিগারেট। একেবারে ব্যাক টু দ্য
পাষ্ট। কত কিছুর পর, কত বাধা,
নানান জনের নানান কথা। সবকিছুর পর আর কিছুদিন পর বিয়ে। প্রাইভেট টিউটর, প্রথম পড়াতে আসা, তারপর দুষ্টুমি, আস্তে আস্তে ভাল লাগা, তারপর
ভালবাসা। ছেলের তুলনায় মেয়ের
বয়স বেশি। মেয়ে একসময় ছেলের
শিক্ষিকা ছিল। আত্বীয়স্বজনদের নানান
কথা। মেয়ের পরিবার থেকে নানান কথা। অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এইটা সেইটা। অনেক কাঠকয়লা পোড়ানোর পর…. যাইহোক,
মোদ্দা কথা অবশেষে বিয়ে হচ্ছে সেটাই বড় ব্যাপার। ভাবলেই কেমন যেনো লাগে। কত বছর পর আমাদের স্বপ্ন
স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। আর মাত্র ৪/৫ দিন। তারপর বন্যাকে আমার কাছ থেকে পৃথিবীর কোনো শক্তি কেড়ে নিতে পারবে না। আচ্ছা, আমি এসব ভাবছি কেনো! ও তো আমারই ছিল। আছে এবং থাকবে। ধ্যাত
ছাই! বলেই সিগারেট হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো। আরেকটি সিগারেট জ্বালালো। আর গুন গুন করে গান গাইছে।

” ওই সুদূর নীলিমায় মন হারিয়ে যেতে চায়, যেথায় সময় থেমে রয় তোমারই আশায়।

হ্যালো, জনাব। ঘুম ভেঙেছে?
শুভ্রঃ হুম।
বন্যাঃ সারারাত ঘুমোননি বুঝি?
শুভ্রঃ কি জানি।
বন্যাঃ আচ্ছা, বিছানা ছেড়ে ওঠেন। ফ্রেশ হোন। ভুলে গেছেন? আজ কি কথা ছিল?
শুভ্রঃ হ্যাঁ, আমি আসছি। জাষ্ট ১ ঘন্টা।
বন্যাঃ আচ্ছা, ঠিক আছে। শোন শুভ্র…
শুভ্রঃ বলে ফেল।
বন্যাঃ নাহ। কিছু না।
শুভ্রঃ আদিখ্যেতা না করে বলে ফেল তো।
বন্যাঃ না। আজ না। অন্য আরেকদিন বলি?
শুভ্রঃ জ্বি জাঁহাপনা, আপনার মর্জি।
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ.. হ্যাপি বার্থডে টু ইউ.. হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মাই ডিয়ার বাঁদরনি।
বন্যাঃ যাক, মনে আছে তাহলে!
আমিতো ভেবেছি ভুলে খেয়ে বসে আছিস।
শুভ্রঃ নিজেকে আমি ভুলতে পারি,
তোমাকে যাবে না ভোলা।
হাঃ হাঃ হাঃ
বন্যাঃ ঢং দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
আসছে আমার বিশিষ্ট কন্ঠশিল্প শুভ্র.. হাস্যকর।
শুভ্রঃ চোখ বন্ধ কর তো।
বন্যাঃ আবার কি হলো?
শুভ্রঃ আরে একটু বন্ধ কর না প্লিজ..
বন্যাঃ আচ্ছা করলাম।
শুভ্র পকেট থেকে কালো টিপের
পাতাটা বের করে বন্যার কপালের
মাঝখানটায় টিপটি পরিয়ে দিচ্ছে।
বন্যাঃ এবার চোখ খোলা যাবে?
শুভ্রঃ হ্যাঁ।
বন্যাঃ কি হলো?
শুভ্রঃ ব্যাগ থেকে আয়নাটা বের করে দেখুন আমার রাজকন্যা।
বন্যাঃ ওয়াও!! থ্যাংক ইউ মাই গুলটু।
হিঃ হিঃ হিঃ
শুভ্রঃ আইসক্রিম খাবি?
বন্যাঃ হুঁ। খাবো। দুজন মুখোমুখি বসা। শুভ্র গান গাইছে।
নচিকেতার গাওয়া নীলাঞ্জনা।

” হাজার কবিতা, বেকার সবই তা। তার কথা কেউ বলে না। সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা “।

বন্যা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। তার খুব খুব প্রিয় একটি গান। আর অদ্ভুত ব্যাপার
হচ্ছে গানটি শুভ্র খুব চমৎকার
করে গাইতে পারে।
৪ দিন পর…….

আজ শুভ্রর বিয়ে…..
সকাল থেকেই বাসায় আত্বীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, আসা শুরু করেছেন। গেটের
সামনে ব্যান্ড পার্টি দাঁড়িয়ে।
রংবেরং এর কাগজ, বাতি, আর
বেলুনে পুরো বাড়ি সাঁজানো।
মাঝে মাঝে ব্যান্ড
পার্টি বাজনা বাজিয়ে মহড়াও দিচ্ছে।
চারিদিকে সাঁজ সাঁজ রব। মানুষে গমগম করছে।

একেবারে বিয়ে বাড়িতে সরগরম
বলতে যা বোঝায় আর কি.

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত