সঙ্গীহীন অসহায় জীবন

সঙ্গীহীন অসহায় জীবন

আমি আর মীম বেলকনিতে একে অপরের পাশাপাশি নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে দাড়িয়ে আছি।
:-আমি চলে গেলে তুমি থাকতে পারবে তো,একা একা?(মীম)
:-হুমম,কেন পারবো না?এতদিন যাবৎ তো আমি একাই থেকেছি।এখন বাকি জীবন না হয় একা একাই কাটিয়ে দিবো।(আমি)
:-তুমি পারবে তো?
:-হুমম,জানো খুব ছোটবেলায় মাকে হারাই।মায়ের ভালোবাসা আমার আর পাওয়াই হয় নি।তেমনি ভাবে বাবারও।বাবা তার ব্যবসার কাজে আমাকে নিয়ে বিদেশের দিকে পাড়ি দেয়।বাবার সাথে বিদেশের মাটিতে আমার প্রায় বিশ বছর কাটে।।ওই বিশ বছর আমি ওখানে ছিলাম একজন বন্দী কয়েদির মতো।পাইনি কারো কাছ থেকে একটুখানি ভালেবাসা।বাবা ওখানে ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময় বাহিরে থাকতো।তাই আমাকে একা একা বাসায় থাকতে হতো।
এই বলে একটু থামলাম।
:-বিদেশের মাটিতে আমার মন টিকছিলো না।তাই বাবাকে বলে ওখান থেকে দেশে চলে আসি।
সিদ্ধান্ত নিই,বাবার সাথে আর সম্পর্ক রাখবো না।
সেটাই করেছিলাম।
উনার সাথে আর কোন যোগাযোগ করি নাই।
এই বলে আবারও থামলাম।
মীমের দিকে তাকালাম।দেখি ও আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
:-দেশে এসে বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের উপর ভিত্তি করে আমি চলছিলাম।ওহহ,এর মাঝে আমার,তোমার আর তোমার পরিবারের সাথে পরিচিয় হয়।
:-……….(মীম)
:-ইতিমধ্যে তোমার বাবা আমাকে তোমাদের পরিবারের একজন ভাবতে শুরু করে।এর মাঝে কখন যে আমি তোমাকে আপন ভেবে ভালোবাসতে শুরু করি,তা টেরই পাইনি।
:-……….(মীম)
:-তো,তোমার বাবা হঠাৎ করে আমাকে বলে উঠে,আমার যদি মত থাকে তাহলে উনি তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে চান।তো,আমি যেহেতু তোমায় আগে থেকে ভালোবাসতাম,তাই আমিও রাজি হয়ে যাই।আর আমিও ভেবেছিলাম তুমিও হয়তো বা আমায় ভালোবাসো।কিন্তু বাসর ঘরেই আমি জানতে পারি তুমি আমাকে ভালোবাসো না।তুমি নাহিদকে ভালোবাসো।যাক,ওসব কথা এখন না বলাই ভালো।তোমায় আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।আর শুনো,আমি তালাক নামার পেপারটা টেবিলে রেখে এসেছি।আচ্ছা,তুমি দাড়াও,আমি নিয়ে আসি।
এই বলে আমি বেলকনি থেকে রুমের দিকে চলে আসি।
রুমে এসে চোখের পানি মুছে,টেবিল থেকে তালাকনামার পেপারটা নিয়ে আবারও বেলকনির দিকে গেলাম।
:-এই নাও।
মীমের দিকে পেপারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি।
:-হুমম,
এই বলে আমার হাত থেকে পেপারটা নিলো মীম।
তারপর আমার হাত থেকে কলমটা নিয়ে,শেষবারের মতো আমার দিকে তাকালো।
:-নাও,
কাগজে সাইন করে পেপারটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো,মীম।
আমিও পেপারটা হাতে নিয়ে নিলাম।
:-নাহিদের সাথে তোমার কথা হয়েছে?(আমি)
:-হুমম।(মীম)
:-ও কি বললো?
:-ও আমাকে বললো ও নাকি সকালে স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
:-ও,আচ্চা তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।
:-হুমম।
এই বলে রুমের দিকে চলে গেলো সে।
আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকলাম।কিছুতেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না।
চোখ বেয়ে পড়তে লাগলো পানি।
কিছুসময় ওখানে দাড়িয়ে থেকে আমার রুমে চলে আসলাম।

রাত প্রায় ১টা বাজতে চললো।চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম আসছে না।
অপর দিকে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে পড়তে বালিশটা ভিজে গেলো।
তাই,আমি বালিশটা চেন্জ করে আরেকটা বালিশ নিয়ে নিলাম।
আশ্চার্য ব্যাপার হলো,যাকে আমি ভালোবাসি,সেই আমার ভালোবাসার মুল্য দিলো না।যদিও কিছুসময় আগে সে আমার বউ ছিলো।কিন্তু এখন তো ও আমার বউ নয়।তাহলে ওর জন্য আমার চোখে পানি আসবে কেন?
ওহহ,হয়তো বা ওকে খুব ভালোবাসি তাই।
কালকে সকালে ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।আর আমি শুধু ওর চলে যাওয়াটা দেখবো।তো আর কি করবো?এছাড়া যে আমার আর কিছুই করার নেই।
নাহ,আমাকে ঘুমাতেই হবে।এই ভেবে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলাম।
ড্রয়ার থেকে ঘুমের ঔষধের পাতাটা বাহির করে,এক এক করে সবগুলো খুলে হাতে নিলাম।ঔষধগুলো একসাথে সাথে মুখে নিয়ে পানি খেয়ে নিয়ে,আবারও শুয়ে পড়লাম।
নাহ,এবার ভালো করে ঘুমানো যাবে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম,তা টেরই পেলাম না।

যখন ঘুম ভাংলো,তখন দেখি অনেক বেলা হয়ে গেছে।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি,বেলা বারোটা বাজতে চলেছে।
তাড়াতাড়ি করে উঠে অপর রুমের দিকে গেলাম।দেখি রুমের দরজা খোলা।
ভেতরে তাকালাম।দেখি মীম রুমে নেই।
পুরো বাসা খুঁজে ফেললাম।কিন্তু ওকে কোথায়ও খুঁজে পেলাম না।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে রুমে গেলাম।
খাটে বসলাম।
মাথায় কোন কিছু কাজ করতেছে না।
তখনই আমার চোখ পড়লো,টেবিলের দিকে।
দেখি ওখানে একটা চিঠি রাখা।
উঠে গিয়ে চিঠিটা হাতে নিলাম।
চিঠিটা মেললাম,,,,
———
জানি,তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসো।কিন্তু কি করবো বলো?নাহিদ ও আমাকে খুব ভালোবাসে।ওর সাথে আমার তিন বছরের রিলেশন।ও তো আমার জন্য সব করতে প্রস্তুত।
ওর জন্য আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আর হ্যাঁ,ভেবেছিলাম চলে যাওয়ার সময় তোমার সাথে দেখা করে যাবো।কিন্তু পারলাম না।
আমি তোমাকে ডাকতে গিয়েছিলাম।কিন্তু ডাকিনি।কারণ,তুমি ঘুমাচ্ছিলে।তাই শেষবারের মতো,তোমাকে দেখে নিয়েছিলাম।
যাইহোক,এবার মুল কথায় আসি।
তুমি আমার জন্য কোনভাবে মন খারাফ করো না।একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও।আশা করি তোমরা খুব সুখী হবে।
আর কিছু লিখার মতো সময় আমার কাছে নাই।
নাহিদ বার বার ফোন দিতেছে।
ভালো থেকো।আর নিজের খেয়াল রেখো।
বিদায়।
ইতি,
মীম
———–
চিঠিটা পড়ে আমার দুচোখ দিয়ে পানির স্রোত বইতে থাকলো।
চিৎকার করে কাঁদতে চাইতেছি।কিন্তু পারছি না।
কেন পারছি না?
সেটা আমি নিজেও জানি না।

যাইহোক,
এভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর।

“আপনি রাজু না?”

মার্কেটের বাহিরে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম।
তখন পেছন থেকে কথাটা ভেসে এলো।
তাই পেছনে তাকালাম।
দেখি একজন মহিলা,একটা তিন কি চার বছরের বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
:-হুমম।কিন্তু আপনি কে?(আমি)
:-………..(মহিলা)
মহিলা কিছু না বলে বোরকার মুখোসটা খুললো।
:-এবার চিনেছো?
:-মীম,তুমি?(অবাক হয়ে,বললাম)
:-হুমম,আমি।কেমন আছো?(মীম)
আমি সিগারেটে শেষ টান মেরে ফেলে দিলাম।
:-খুব ভালো।এ কে?
মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম আমি।
:-আমার মেয়ে।(মীম)
:-আংকেল,তোমার নাম কি?
মেয়েটার গালদুটো টেনে বললাম,আমি।
:-আমার নাম রাজিফা।(মেয়ে)
:-খুব মিষ্টি নাম।(আমি)
:-তোমার নামের সাথে মিল রেখে,নামটা রেখেছি।(মীম)
:-মেয়েটা দেখতে ঠিক তোমার মতো হয়েছে।(আমি)
:-নাহিদও তাই বলে।(মীম)
:-ওহহ,আচ্চা নাহিদকে যে দেখতেছি না।কোথায় ও?(আমি)
:-অফিসের ঝামেলা থাকায় ও আসতে পারে নাই।(মীম)
:-ওহহ,তোমরা তাহলে কোথায় থাকো?(আমি)
:-আমরা এই শহরের বাহিরে থাকি।বাবার বাসায় এসেছি কিছুদিনের জন্য বেড়াতে।
:-ওহহ,ভালো কথা।
:-আচ্চা,তুমিতো আগে সিগারেট খেতে না?তাহলে এখন খাও কেন?
:-একাকিত্ব দূর করার জন্য মদ,সিগারেট এগুলোকে বেঁছে নিয়েছি যে?
:-একাকিত্ব মানে?তুমি বিয়ে করনি?
:-বিয়ে?হা হা হা,আমার দ্বারা আর কখনো ওসব হবে না।আচ্ছা,একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
:-হুমম,করো,
:-আমার জন্য কি তোমার মনে একটুও ভালোবাসার জন্ম নেয় নি?
:-…………..(মীম)
জবাবে মীম কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকলো।
:-আম্মু,আমি আর দাড়াতে পারছি না।(রাজিফা)
:-চলো,ওই কপিশফ টায়
গিয়ে বসি।
আমাকে উর্দেশ করে বললো,মীম।
:-আমার কাছে ওই সময় নেই।আচ্চা,আমি তাহলে এখন আসি।ভালো থেকো।
এই বলে মীমের সামনে থেকে চলে যেতে লাগলাম।
কিছুদূর যাওয়ার পর,মীমের দিকে ফিরে তাকালাম।
দেখি ও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমি ওকে একটা হাসি উপহার দিয়ে ঘুরে রওয়ানা দিলাম,এক অজানা পথের উর্দেশ্যে।

…………………………………………….সমাপ্ত……………………………………….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত