অন্তহীন বিবর্তন

অন্তহীন বিবর্তন

কিশোর…. ওঠ বাবা। ভার্সিটি যাবিনা???
– উফফ! মা। যাবোতো। আরেকটু ঘুমাই না। আর ৫ মিনিট
– না ওঠ। পরে দেরী হলে বলবি আমি কেন তোকে তাড়াতাড়ি উঠায়নি। সব দোষ আমার হবে। তুই ওঠ।
– আচ্ছা যাও বলবনা। এবারতো ঘুমাতে দাও…
– ঘুমা। বেশি করে ঘুমা। পরে দেরী হওয়াতে আমাকে কিছু বললে কান ছিড়ে দিব। ফাজিল ছেলে……….
নাহ্। আর ঘুমানো যাবেনা। ভার্সিটিতে যাবার আগে একটা টিউশানি করায় কিশোর। আজ কিছু টাকা পাবার কথা আছে সেখান থেকে।
কিশোর বিছানা ছেড়ে চোখ ডলতে ডলতে ফ্রেশ হতে যায়। নাস্তা সেরে বেড়িয়ে যায় ও।।
কিশোরদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িতে ও আর ওর মা আছে। বাবা মারা গেছে ও ছোট থাকতে। ওর মা অনেক কষ্টে ওকে ভার্সিটি পড়তে পাঠিয়েছে। ও BBA তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মাকে আর কাজ করতে দেয়না ও। পাঁচটা টিউশনি করায় । অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু ওর একটাই কথা মাকে আর কাজ করতে দিবেনা। অনেক করেছে মা।।।।
সন্ধায় টিউশানি করায় একটা মেয়েকে। মেয়েটার নাম রিশা। দেখতে খুব সুন্দর। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
ইদানিং মেয়েটার আচরণ কেমন যেন লাগে।
নাহ্! সাবধানে থাকতে হবে।
এসবের মধ্যে জড়াতে চায়না কিশোর। অবশ্য কিশোরেরও খারাপ লাগেনা রিশাকে।
ভাবতে ভাবতেই রিশাদের বাড়ির দরজার সামনে চলে আসে। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে যায়। যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল কেউ………..
হ্যা। ওটা রিশাইইই………….
– আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া
– ওয়ালাইকুম আসসালাম
দুজনেই ভেতরে আসে
– কেমন আছেন কিশোর ভাইয়া
– ভাল। তুমি????
– জ্বি ভালো।
– আচ্ছা চল পড়া শুরু করি
-হুমমম
পড়ার ফাঁকে,,,,,,
– আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– কর। পারলে বলব। না পারলে সরি 🙂
– আরে পড়ার বিষয়ে না…….
– তাহলে???
– অন্য একটা ব্যাপার
কিশোর কিছুটা বুঝতে পারছে ও কি জানতে চায়….
– আচ্ছা বল
– ইয়ে মানে, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে???
কিশোর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে……
– কি হল বলুন…..
– তোমার জানতে হবে না। তুমি পড়,,,,,,
রিশা চুপচাপ মন খারাপ করে পড়তে থাকে।
পড়া শেষেও ওর মন খারাপ দেখে কিশোর বলে
– আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।
এটা শুনে রিশার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিশোর চলে আসে।
কিছুদিন যাবৎ রিশা আরো কাছে চলে এসেছে কিশোরের। কিন্তু কিশোর আগের অবস্থানেই।।।
কলিংবেলের শব্দে ভেতর থেকে দরজা খুলে যায়।
রিশা একটা নীল শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে। কিশোরকে ভেতরে এনে দরজা আটকে দেয়…………
– এই বলতো আমাকে কেমন লাগছে? বউ বউ না??
এটা শুনে কিশোরের facial expression এমন হয় যে এক্ষুণি চোখদুটো বেড়িয়ে আসবে…….. :O
হা করে আছে ও
– এই বলনা। চোখ ফেরাতে পারছোনা তাইতো???
সলজ্জ একটা হাসি দেয় রিশা।
কিশোরকে একটু ধাক্কা দিয়ে….
-এই বলনা……
কিশোর সেন্সে এসে রাগের ভাব নিয়ে….
– এই মেয়ে তোমার সাহসতো কমনা! আমাকে তুমি করে বলছো কেন হ্যা???
– বা রে! বিয়ের পরতো তুমিই বলতে হবে।
-কার বিয়ে? কিসের বিয়ে???
– তোমার আর আমার বিয়ে
– পাগল-টাগল হলে নাকি???
– না। একদম ঠিক আছি।
আসলে আর দেরী করতে চাইছিনা। সিট এখনো খালি আছে। যদি কেউ বুক দিয়ে দেয়??????
– মানে???
কিশোরের দিকে এগোতে এগোতে…
– এই তুমি কি কিছুই বোঝোনা? এত বোকা কেন তুমি???
– কি..ক.ক..কি বুঝবো? পেছাতে পেছাতে বলে কিশোর.
– এই যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।।
ততক্ষণে কিশোর wall এর সাথে ঠেকে গেছে…..
কিশোর একটু শক্ত হবার চেষ্টা করল……..
– তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এটা কখনো সম্ভব না।
– কেন?
– সম্ভব না ব্যাস। আর তুমি যদি further এমন কর তাহলে আর পড়াতে আসব না।
এসব শুনে রিশার চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে থাকে।
– Listen, কেঁদে কোনো লাভ নেই। যেটা বলেছি সেটাই।
কথাগুলো বলতে কিশোরেরও কষ্ট হচ্ছিল। আসলে ওউ রিশাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু ও জানে রিশা ওদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না।
– তুমিও শুনে রাখ, কাল থেকে আমাকে আর তোমার দেখতেই হবে না।
– পাগলামী করনা রিশা। বোঝার চেষ্টা কর….
– না আমি কিচ্ছু বুঝতে চাইনা। তুমি বল তুমি আমায় ভালবাসবা????
– রিশা তোমরা অনেক ধনী। আমাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারবানা তুমি।
– তুমি একবার হ্যা বল। আমি সব পারবো।
কিশোর শুধু একটু হাসে আর বলে…..
– পাগলিটা কাঁদলেতো অনেক কিউট লাগে।
রিশা কিশোরকে জড়িয়ে ধরে। শুরু হয় নতুন একটা প্রেমের অধ্যায়ের……….
**************************************
৭ মাস পরঃ
ভালোই চলছিল তাদের প্রেম। কিশোর এখন একটা পার্টটাইম job করে আর শুধু রিশাকে পড়ায়।
আজ পড়াতে এসে রিশাকে অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছিল…..
– কি হয়েছে?
– বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বলেই কিশোরের দিকে তাকায়
– এখন????
– চল পালাই। তোমাকে ছাড়া আমি কারো বউ হতে পারবনা কিশোর।
বলেই কাঁদতে থাকে ও…..
– কিন্তু চলবে কি করে আমাদের…..? হাজার পনের টাকার একটা চাকরী করি। তাও পার্টটাইম। এই আছে এই নেই।
– আমি কিচ্ছু জানিনা।
– রিশা তুমি মানিয়ে নিতে পারবেতো আমাদের সাথে????
– পারবো।
– তাহলে চলো।
কিছু বন্ধুবান্ধব ডেকে কাজী অফিসে যায় তারা…..
কাজী সাহেব বলে…..
– দেনমোহর কত হবে???
রিশাই হাসতে হাসতে বলে
-পাঁচলাখ এক টাকা।
– কিশোর ওর দিকে চোখ বড় করে তাকায়।
-কি গো! দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ। আর তুমি……( কপট রাগ দেখিয়ে)
– কিশোরও হাসতে হাসতে রাজী হয়ে যায়
বিয়ে হয় ওদের।
রিশার বাবা কিশোরকে শাসিয়ে যায়।
কিশোরের মায়ের কোন সমস্যা নেই। শুধু তিনি ভাবেন, রিশা পারবেতো?????
– শুরু হয় তাদের সংসার জীবন।
প্রথমে ভাল চললেও। এখন রিশার অনেক সমস্যা হয়।
কিশোরের সাথে মনোমালিন্য হতেই থাকে। কিশোর মন খারাপ করে কিন্তু রিশাকে কিছু বলেনা….
– কিশোর, আমি আর তোমার মায়ের সাথে থাকতে পারব না। তুমি অন্য কোনো বাসা নাও।
– আমি আমার মাকে ছাড়তে পারব না। মা আমার জন্য অনেক করেছে। কি হয়েছে বল? আমি সমাধান করার চেষ্টা করব।
– আমি ঐ বুড়িটার সাথে থাকতে পারবনা।। ব্যাস।
এটা শুনে রিশাকে থাপ্পড় মারে কিশোর……
রিশা বলে…..
– তোমাকে বিয়ে করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমি আজই বাবার বাড়ি চলে যাব…..
ব্যাগ গুছিয়ে চলেও যায় রিশা। কিশোর আটকেছিল। কিন্তু শোনেনি……
আজ কিশোর রিশাকে নিতে আসছে। বসার ঘরে ও বসে আছে। রিশা আসলে….
– রিশা I’m sorry. বাসায় চল
– কোথায় যাবো? বাসায়? হাসালে…..
ঐটা বাসা? আমি যাবোনা ঐ বস্তির ঘরে।
যত্তসব ফকির-ফাকারের দল।
– এটা শুনে কিশোর কষ্ট পায়। চলে আসে ও।
কিশোর বাসায় বসে আছে। এমন সময় ওর ফোন আসে। ফোন ধরে……
-আসসালামুআলাইকুম! কে বলছেন।
ওপাশ থেকে সালামের উত্তর দিয়ে….
– আমি অ্যাডভোকেট হাসান। আপনাকে কাল একটু আমার অফিসে আসতে হবে।
কিশোর ইনাকে চেনে। ওর শ্বশুড়ের প্রাইভেট lawyer.
– কখন?
– কাল সকাল নটায়
– আচ্ছা
পরদিন অফিসে গিয়ে দ্যাখে রিশা আর ওর বাবা বসে আছে। অজানা ভয়ে ওর বুক মোচড় দিয় ওঠে।
– আরে আসুন মি. কিশোর। বসুন……
বসে কিশোর….
– যে কারনে আপনাকে ডাকা। আসলে রিশা ম্যাডাম আপনার কাছ থেকে ডিভোর্স চাইছেন। কাগজপত্র সব রেডি। শুধু সই করা বাকি….
কিশোর চমকে উঠে রিশার দিকে তাকায়। কিন্তু ও নির্বিকার।
– এমনটা কোরোনা রিশা প্লিজ। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তোমাকে সুখে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আমাকে ছেড়ে যেওনা। তুমিওতো আমাকে ভালবাসো।
বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলে কিশোর…..
– ভালবাসিনা। বাসতাম কোনো একসময়। কিন্তু এখন ভুল ভেঙ্গেছে। তোদের মত ফকিরের বাচ্চাদের জন্য ভালবাসা নয়।
কথাগুলো শুনে পাথর হয়ে যায় কিশোর। চুপচাপ সই করে দেয় কাগজগুলোতে…..
চলে আসার সময়। উকিল ডেকে বলে…..
– দেনমোহরেরর পাঁচলাখ টাকা আপনাকে দিতে হবে এক সপ্তাহের ভেতর। নইলে আপনার বাড়ির উপর দখল নেয়া হবে।
এটা শুনে কিশোরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এতগুলো টাকা এত কম সময়ে কোথায় পাবে ও! বাড়িটা নিয়ে নিলে মা কোথায় যাবে?
ছোট্ট করে বলে
-দিয়ে দেব।
বলে উঠে চলে আসে…..
আজ সপ্তম দিন। রিশার বিয়ে।
রিশা আজ অনেক খুশি। ছেলে আমেরিকা থাকে। অনেক বড়লোক। রিশার কাছে একটা পার্সেল আসে।
খুলে দেখে টাকা আর একটা চিঠি……
রিশা
ভাল আছো নিশ্চই। তুমি ভাল থাকো আমি সেটাই চাই। তুমি আরো খুশি হবে এটা যেনে যে, তুমি যখন চিঠিটা পড়ছো আমি তখন অনেকদুরে। একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে। আকাশের তারা হয়ে তোমাকে দেখছি। তোমার আর কোনো পিছুটান রইল না। বাদ দাও,তোমার হকের টাকা তোমায় দিলাম। তুমি আমার থেকে পাচলাখ টাকা পেতে। তোমাকে সাড়ে চারলাখ দিলাম। বাকি পঞ্চাশ হাজার মাকে দিয়েছি। ওদের কত করে বললাম আর পঞ্চাশ টা হাজার টাকা বেশি দিতে।
দিলনা গো।
মাফ করে দিও।
আসলে তোমাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
একদম অসহ্য লাগছিল বুকের ভিতর।
তাই হার্টটা বিক্রি করে দিলাম।
একদিকে বুকের ব্যাথা থেকে মুক্তি পেয়েছি আবার তোমার ঋণ ও খানিকটা পরিশোধ করলাম।
ভালোই লাভ করেছি, বলো…
একটা কথা রাখবে রিশা? আমার মাকে একটু দেখো।
আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আমি নেই শুনলে আমার মা অনেক কষ্ট পাবে। আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলে দিও আমি আর নেই।
আর একটা কথা রাখবে?
আমার লাশটা মেডিকেলের মর্গে আছে। নিয়ে এসে একটু দাফন করে দিও। তুমিতো জানো মা ছাড়া আমার কেউ নেই।
জানো রিশা, আমারো অনেক বাঁচতে ইচ্ছে করত। কিন্তু সেটা তোমাকে ছাড়া নয়। যাকগে, সবার ইচ্ছে পুরণ হতেই হবে এমনতো কথা না। দোয়া করি তোমার সব ইচ্ছা যেন আল্লাহ পুরণ করেন। নতুন জীবনে ভাল থেকো, সুখে থেকো। সবাইকে ভাল রেখ। আর যাকে ভালবাসবে মন থেকে বেসো।।
ইতি
তোমার স্বামি (রাগ করোনা প্লিজ।শেষবারের মত বললাম)
কিশোর
………………………….
কিশোররররররররররর………
চিৎকার করে কেদে উঠে ধপ করে মাটিতে বসে পরে রিশা।।।
চিঠিটা পড়তেই রিশার বাবার চোখটাও ভিজে আসে।।।
তারপর…???
শেষ পর্যন্ত রিশা আর বিয়ে করেনি।
সত্যিই ভালোবাসা একটি অন্তহীন বিবর্তন।।

………………………………………(সমাপ্ত)……………………………….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত