আজ নীরার সাথে ব্রেক আপ করতে যাচ্ছি, আমাদের সম্পর্ক ছিলো দীর্ঘদিনের,দীর্ঘ ৮ বছর পর মনে হলো আমরা ভুল পথে হাঁটছি, তাই দুজন সম্মত হয়েই বিচ্ছেদের পথে রওনা হয়েছি।
আমি নীরার জন্য অপেক্ষা করছি বাসটেন্ডে, ঠিক আগে যেভাবে দাঁড়াতাম, নীরা আসলো, গালে মুচকি হাঁসি, নীরার দিকে হাত বাড়ালাম,নীরা হাত ধরে হাটছে ওভারব্রিজের সিঁড়িতে। আমরা দুজনই তাকালাম দুজনের দিকে,নীরা আজ চশমা পড়েনি,লিপস্টিপ দেয়নি, নীল একটা জামায় খারাপ লাগছে না,তবে চোখ দুটো ফুলে ফেঁপে আছে, চোখে চাপা একটা রাত জাগা আর্তনাদ জেনো ডেকে যাচ্ছে।
আমরা দুজন পাশাপাশি ওভারব্রিজে দাঁড়ালাম, রাস্তায় লাল,কালো, নীল বাস ছুটাছুটি করছে, ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে টাকা রোজগারের ধান্ধায়, পেয়েও গেলো একটা। বাসটার নাম বসুমতি, বসুমতি একটা সুন্দর নাম, তবে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে নামটা বহুমতি হলে ভালো হতো !
আমাদের মতো, ট্রাফিক পুলিশের মতো, আমাদের মত বহু, আজ যা ভালো লাগে,কাল তা বিরক্ত লাগে,পরশু মনে হয় গত হওয়া দিনগুলোই হয়তো ভালো ছিলো , এর পরদিন হয়তো আগামীর দিকে ছুটি নয়তো গত হওয়া দিনগুলোতে।
আমি ও নীরা ঠাই দাড়িয়ে,হঠাত নীরা বললো
-আচ্ছা এতো মানুষ কোথায় যায় ? পুরুষ-মহিলা সবাই যাতায়াত করে,বাসা কি লক করে যায় নাকি কেউ থাকে ?
– হয়তো থাকে,হয়তো না।
আবার আমরা নিশ্চুপ। মিনিট খানেক পর নীরাকে বললাম চলো লাঞ্চ করি ?
-তুমি খেতে পারো,আমি খেয়ে এসেছি।
-৮ বছরে তো কখনো খেয়ে আসতে না,পাশাপাশি বসে দুজন খাবো বলে অপেক্ষা করতাম
– নীরা উত্তর না দিয়ে বললো- আমার মাথা ব্যথা করছে,চলো হাঁটি
-আমি হাটবো না,এখানেই ভালো লাগছে,দেখো কত মানুষ ছুটছে, রাস্তার যেনো কোন শেষ নেই,আকাশের মতো বিশাল
নীরা নিশ্চুপ তখনো, বুঝলাম ওর ভালো লাগছে না, আমরা হাঁটতে লাগলাম
নীরার দিকে হাত বাড়ালাম,আমার সাথে থাকলে কখনোই ও একা হাটে না,তবে আজ নীরা একাই হাঁটছে।
নীরার বোধহয় অনেক মনখারাপ, অবশ্য মন খারাপ হবারই তো কথা, আমরা একটা ফাস্ট ফুড শপে বসলাম,নীরার পেস্টি অনেক পছন্দ, দুইটা অর্ডার দিলাম।
নীরা আমার মুখে চামচ এগিয়ে দিচ্ছে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
-অবাক হচ্ছ ?
-নাহ
-এখনো তো আমাদের ব্রেক আপ হয়নি,হবে কিছুক্ষণ পর।
-তা ঠিক, আমিও ওর দিকে এক চাপচ এগিয়ে দিলাম।
আমরা ফুসকা খেলাম রাস্তা থেকে, ঝাল করে বাদাম আর চানাচুর ভাজাও খেলাম। আজ কারো মুখে তেমন কথা আসছে না, তাও হাঁটলাম দুজন,আজকের পর হয়তো আর কখনো হাটা হবে না, কেউ সকালে ফোন দিয়ে বলবে না গুড মরনিং, খেয়েছো ? কি করছো ? আজ দেখা করবে ? আমরা আজ থেকে মুক্ত, কেউ কাউকে চিনবো না,জানবো না। যেখানে কারো দীর্ঘশ্বাস এর খবর আসতো সেখানে কে কেমন আছে সেটা হয়তো আর কখনোই জানা হবে না ।
আমার আর বেশিদূর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না,
-নীরা?
-বলো
-বিয়ে কবে করবে ?
-যেদিন বাসায় দিবে
-আমাকে দাওয়াত দিবে না ?
-তুমি আসবে ?
-নাহ
“অথচ এই উত্তরটা কিছুদিন আগেও ছিলো এমন- তুমি আসবে ?
আমি না আসলে তুমি বিয়ে কাকে করবে ?বিয়ে তো হবে না,তুমি লগ্নভ্রষ্ট হবে”
আমরা আরো খানিকটা হাঁটলাম
আজ রাস্তার মন খারাপ মনে হচ্ছে, গাড়ি গুলোর গতি অস্বাভাবিক লাগছে, কেমন জেনো সব এলোমেলো, হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম।
-আচ্ছা আমাদের ব্রেক আপের কারণ ?
-তেমন কারণ নেই,তুমি কিছু পেয়েছো ?
-তাইতো তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম,যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ব্রেকআপ কেন করেছি ?
– তুমি আর আগের মতো নেই !
-তুমি ও তো নেই
-আর কি কারণ ?
-আগের কারণের উত্তর কি জানো ?
-কি ?
-আমাদের সম্পর্ক অনেক বেশি বছর হয়ে গেছে, তোমার পজিটিভ নেগেটিভ সব দিক আমার জানা,ঠিক তোমারো, আমরা ভালো দিক খুব কম মনে রাখি, মাথায় কেবল খারাপ দিকগুলোই বারবার ফিরে আসে, আর এতো বছরের খারাপ দিক গুলো জমে জমে বেশি হয়ে গেছে, তাই ভালো কিছু স্থায়ী হবার সুযোগ পায় না।
– ঠিক বলেছো। আর একটা দিক হলো তুমি আমাকে সময় দেও না আগের মতো, আগে কত কি করতে আর এখন ?
-এটার ও উত্তর আছে, আগে আমরা দুজনই টিন এজার ছিলাম, ভয় ছিলো কম, উদ্ভট কিছু করে বসতাম আর এখন দিনদিন আমরা ম্যাচিউরড হচ্ছি, নিজেদের নিয়ে ভাবতে শিখেছি, চাকরিজীবী হয়েছি, অনেক দিক ভাবতে হয়, ভাবনাগুলোতে প্রায়োরিটি জন্ম নিয়েছে,ভালোবাসা আগের মতোই আছে কিন্তু অন্য ভাবনা গুলো কিছুটা সময় দখল করে নিয়েছে।
-হুম
-আর ?
-আর তো কারণ পাচ্ছি না
– তাহলে ব্রেকআপ টা আজই করছি তাইতো ?
-হ্যা
আমরা দুজন আবারো হাঁটছি, নীরা বললো চলো শপিং করি
-তুমি করো আমি কিছু কিনবো না
-আমি তোমাকে একটা কালো শার্ট কিনে দিবো, এটাই আমাদের শেষ স্মৃতি। আমি যখন থাকবো না, শার্ট টা তুমি যখনই পরবে মনে হবে আমার কথা,আর ভাববে আমিই সঠিক ছিলাম, তখন আর আমাকে বা আমার মতো কাউকেই খুজে পাবে না। হয়তো আমার চেয়ে ভালো পাবে হয়তো খারাপ কিন্তু নীরা তোমার জীবনে একটাই থাকবে।
আমি নীরাকে আর কিছু বলতে পারলাম না,নীরা ক্যাটস আই থেকে ২৩০০ টাকা দিয়ে একটা কালো শার্ট কিনে দিলো। আমিও নীরাকে একটা কালো শাড়ি কিনে দিলাম একই কারনে।
আমরা হাঁটলাম অনেকটা তবে হাটানুযায়ী কথা খুবই কম বলছি। এর মধ্যে অকারনেই রাগারাগি হয়ে গেলো ক্ষানিকটা কোন প্রকার কারণ ছাড়াই।
নীরা বললো
-তুমি ভূড়ি কমাবে,একটু কম করে খাবে। আর হ্যা, তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,রাতে একটু ঘুমিয়ো প্লিজ,আর রাত জেগো না
-তুমিও সাবধানে যেয়ো,রাস্তা সাবধানে পার হয়ো আর সম্ভব হলে পৌঁছিয়ে একটা ফোন দিও।
-আচ্ছা, সামনাসামনি এটাই কি আমাদের শেষ কথা ?
-হুম ! আচ্ছা আমার একটা নেগেটিভ দিক বলে যাও যাতে অন্য কাউকে বিয়ের পর এটা ঠিক করতে পারি।
-তুমি অনেক রাগি,হুটহাট ডিসিশন নাও, অনেকটা ভয়ঙ্কর, কিন্তু তোমাকে দেখে তা মনে হয়না। আমি জানি তুমি কতটা ভয়ঙ্কর ! কিন্তু তাও কেনো জানি তোমার উপর মায়া কাটাতে পারি না।
– হ্যা জানি, ভয়ঙ্কর মানুষদের উপর মায়া জন্মে ,কখনো ভালোবাসা জন্মে না।
-প্লিজ কথা পেঁচিয়ো না,তোমার সাথে কথায় আমি পারবো না।
– আমার উপর কোন কমপ্লিমেন্ট করবে ?
-আমি ক্ষানিকটা ভেবে উত্তর দিলাম “না” ।
-আমাদের শেষ কোন কথা ?
– আমি মরে যেতে চায়, পাখির গানে, সূর্যাস্তের সাথে যেখানে গেলে কেউ কাউকে আর ছেড়ে যায় না।
– নীরা আর কথা বাড়ালো না, নিশ্চুপ বাস চলা দেখছে। আচ্ছা আমাকে কি বাসে উঠিয়ে দিবে ?
-আর একটু খানি দাঁড়াবে নীরা? রাতের নিয়ন বাতিতে তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।
-হুম
-আমার হাতটা একটু ধরে দাঁড়াবে নীরা ?আমার শরীরটা কাপছে।
নীরা আমার হাত ধরে দাড়ালো, আর বললো- তোমার কি আমাকে কিছুই বলার নেই ?
– আছে
– কি ?
– ব্রেক আপ ডেট টা কি কিছুটা পেছানো যায় ? ধরো ১৪ ফেব্রুয়ারী, আমাদের তো কোন এক ১৪ তারিখেই পরিচয় হয়েছিলো তাইনা ?
– ওকে তাহলে একটা শর্ত আছে আমার।
– কি ?
– তুমি ১৪ তারিখ আমার দেয়া কালো শার্ট টা পরে আসবে আমিও তোমার দেয়া শাড়িটা পরবো।
– আমি মুচকি হাসলাম
– আর হ্যা,তোমাকে নিয়ে আরেকটা কথা বলতে চায় ?
– কি ?
– এতো চিবিয়ে চিবিয়ে হাসো কেন ? মন খুলে হাসতে পারো না ?কথা বলতে পারো না ?
– যেমন?
– যেমন হলো এভাবে –নীরা আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাচতে পারবো না,প্লিজ ব্রেক আপ করো না, আমি তোমার পাশে সারাজীবন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। তুমি বলো তো!দেখি বলতে পারো কিনা !
– আমি কি সারাজীবনই দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি দুজন একটা বাসায় থাকবো ?
– তুমি কি চাও ?
– যা তুমি চাও !
– তুমি বলো তুমি কি চাও
– আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে নীরা ? আমার অনেক ভয় হচ্ছে, মনের ভেতর বৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
– আহ আসছে ব্রেকআপ করে জড়িয়ে ধরতে তাও আবার এতো মানুষের সামনে,বাসে উঠিয়ে দাও,রাত হয়েছে আমাকে যেতে হবে।
– সাবধানে যেয়ো,রাস্তা সাবধানে পার হয়ো।
– আচ্ছা ❤
– বাস ছুটছে নীরাকে নিয়ে, মিনিটখানেক পর মোবাইলটা বেজে উঠলো
– হ্যালো নীরা- কোথায় বসেছ ? পাশে পুরুষ নাকি মহিলা ?
– পুরুষ
– হুহ,একদমই কথা বলবে না কিন্তু, আর ফাকা হয়ে বসো,গায়ে জেনো গা না লাগে…।
– কেন কেন ? আমার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বসবো,আমাদের তো ব্রেকআপ।
– মাইর চিনো ? বউ পিটানো আবুইল্লার মতো পিটামো এইসব আবার বললে
– আমিও পারি পিটাইতে…।। হুহ, আচ্ছা
প্রতিবার যাওয়ার সময় তোমার এতো মন খারাপ হয় কেনো ?
– এটাই ভালোবাসা, বুঝছো………।। ❤ ❤
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা