তারা পরস্পর দম্পতি

তারা পরস্পর দম্পতি

রাত ৮টা। সেন্ট্রাল মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সেন্ট্রাল মসজিদের এই প্রাঙ্গণটি কেন জানি ভীষণ ভালো লাগে। চারদিকে বিরাট হৈচৈ অথচ এই জায়গাটি নীরব।

সেই নীরব জায়গা থেকে প্রস্থান করার সময়, এক বৃদ্ধা ফকির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার পিছু পিছু আর এক বৃদ্ধ ফকির এসে তার পাশে দাঁড়ালেন। তাদের দুজনের পাশাপাশি দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা দেখে মনে হল, তারা পরস্পর দম্পতি।
বৃদ্ধা মহিলা কাতর কন্ঠে বললেন, ‘কয়টা টাহা দ্যান, ভাত খামু।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কয় টাকা হলে ভাত খেতে পারবেন?’

বৃদ্ধা বললেন, ‘আছে তো ২০ ট্যাকা। কিন্তু দুইজনের ভাত খাইতে লাগবে ৬০ ট্যাকা। আপনে পারলে ৫০ ট্যাকা দ্যান আর না পারলে ৪০ ট্যাকা দেন।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘৫০ টাকা দিলে তো ১০ টাকা বেশি হয়ে যাবে। অতিরিক্ত ১০ টাকা দিয়ে কি করবেন?’

বৃদ্ধা বললেন, ‘খাওনের পর একটু পান খাইতে মনে চায়। দুজনে ৫-৫ ১০ টাকা দিয়ে দুইটা পান খামু। এর লাইগা ৫০ ট্যাকা চাইছি।’

তাদের দুজনকে সাথে নিয়ে তাদের পছন্দের খাবারের দোকানে গেলাম। সেটাকে দোকান বললে ভুল হবে, রাস্তার পাশে হাড়ি পাতিল নিয়ে বসে আছে আর চারদিকে গোল হয়ে হাতের উপর প্লেট নিয়ে সবাই খাচ্ছে।

আমরা তিনজনও সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। তাদের দুজনকে খাবার দেওয়া হল।
তারা দুজন নীরবে খাচ্ছে আর আমি তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। খেতে খেতে বৃদ্ধা মহিলা তার প্লেটের একটি গোশতের পিস বৃদ্ধের প্লেটে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনের তো বুকের গোশত বেশি পছন্দ। খান মজা আছে।’

তাদের এই মজা বিনিময় দৃশ্য কেন জানি না, আমার চোখ দুটোকে ঝাপসা করে দিল।

বিদায়ের মুহুর্তে তারা যখন পান চিবুচ্ছিল তখন বললাম, ‘আপনাদের সঙ্গে খাওয়ার আমার বিরাট ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই মেহমানকে বিদায় করতে গিয়ে খেয়ে ফেলেছি। আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণ থাকুক তা কখনোই চাইবো না। আমি প্রায় শুক্রবার রাতে এই জায়গাটিতে বসে থাকি। একদিন দু’জনেই আসবেন, একসঙ্গে ডিনার করব ইনশা আল্লাহ।’

তারা যখন বিদায় নিচ্ছিল তখন তাদের চকচকে দৃষ্টি তাদের আনন্দের মাত্রাটা জানান দিচ্ছিল। তারা ফিরে যেতে যেতে একে অপরের দিকে চেয়ে যখন গল্প করছিল তখন মনে হচ্ছিল, দু’টি সুখ যেন গল্প করছে।

মৃদ্যু বৃষ্টির মাঝে হেটে হেটে বাসায় যাচ্ছি। আজ আর রিক্সার দেখা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এক্সচেঞ্জ অফিসের সামনে দেখলাম, একজন রিক্সাওয়ালা রিক্সাও হুট তুলে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা বাঁশের বাঁশি। একজন বলল, ‘এই রিক্সা যাবা?’
জবাবে বললেন, ‘নাহ।’
তিনি আবারো বললেন, ‘১০০ টাকা দিবো। চল?’
জবাবে বললেন, ‘কইছিনা যামু না। যতোই দেন আইজ আর যামু না।’
তাদের এরূপ বাক্যব্যয় করা দেখে আমার আর কিছু বলার সাহস হল না।

সেই রিক্সা অতিক্রম করে যখন পথ চলতে শুরু করলাম, তখনই সেই রিক্সাওয়ালার বাঁশিতে করুন সুর বেজে উঠল। তার সেই করুন সুর আমাকেও করুন স্মৃতির সাগরে ভাসিয়ে দিল। পরোক্ষণেই মনে হল, এই বাঁশির সুর রিক্সাওয়ালা ভাইটির সুখ। আর পেট ভরে ভাত খেয়ে দুজনে গুজুর-গুজুর আর ফুসুর-ফুসুর গল্প করে আপন গন্তব্যে যাওয়ার মাঝে সেই দুই বু্দ্ধ ফকিরের সুখ।

সুখের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। সুখ এক-একজনের কাছে এক এক রকম। তাই নিজের সুখ কোথায়, তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত