সন্তান নাকি ভালবাসা

সন্তান নাকি ভালবাসা

অামার স্বামী অামাকে বহুদিন বলেছিল তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন করে ঘর বাঁধার জন্য। অার অামার স্বামী অামাকে এতটাই ভালবাসে যে কখনো তাকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারিনা। নিজের বাবা মায়ের মত যদিও কেউই অাদর করেনা, তবুও অামার শশুড় শাশুড়ী অামাকে নিজের সন্তানের মতই ভালবাসে।
লোকমুখে শুনতাম বউ শাশুড়ীর নাকি যুদ্ধ হয়। অথচ অামার শাশুড়ী অামাকে নিজের মেয়ের মত করে ভালবাসা দিয়ে অাগলে রেখেছে। তেমন শশুড় শাশুড়ীর ভালবাসা রেখে অামি কোথায় যাব?
অামি এই পরিবারের বড় বউ। অামার দুটি দেবর পরে বিয়ে করেছে। দেবর দুজন অামাকে যথেষ্ট সম্মান করে। দেবরের বউ দুজনও বড় বোনের মত ভালবাসে। ওদের এত ভালবাসা রেখে অামি কোথায় যাব? একটি সন্তানই কি সব? নাকি সবকিছুর মূলে রয়েছে সবার ভালবাসা?
.
অাট দশটা মেয়ের মত অামিও চোখে জল নিয়ে লাল বেনারশী পড়ে, অজানা এক ভয় নিয়ে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম।
পারিবারিক মতামতের উপর ভিত্তি করে বিয়ে হওয়াতে অামার স্বামীকেও অামি ভাল করে চিনতামনা।
অথচ তার মায়ার বাঁধনে সে কতটা অাপন করে জড়িয়েছে অামাকে। তাকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাই করতে পারিনা।
কখনো কারো প্রেমে পড়িনি। খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর স্বামীকে ভালবাসব। অামার অাশা অার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মজার বিষয় হল, বিয়ের রাতে অামার স্বামী অামাকে প্রেম নিবেদন করেছে।
খুব একটা গুছিয়ে নয়, তবুও কথাগুলো ভাল লেগেছিল।
“সোমা, অাজ নতুন জীবনের শুরুতে কথাগুলো কিভাবে নিবে জানিনা। তবুও অামাকে কথাগুলো বলতেই হবে। অামি লাট সাহেবের ছেলে নই, মোটামোটি বেতনে চাকরী করি। অামি হয়তো তোমাকে দামী দামী সোনা গয়না প্রতিমাসে দিতে পারবনা। বা বড় বড় স্বপ্ন পূরণ করতে পারবনা। তবে অামার মনে জমিয়ে রাখা ভালবাসা দিতে পারব। সারাজীবন বুকে অাগলে রেখে ভালবাসতে পারব। তুমি কি অামাকে ভালবাসবে? অামি একটিবার তোমার প্রেমে পড়তে চাই। ”
কি দিব উত্তর অামি? অামার স্বামীর কথায়ই অামি তার প্রেমে পড়ে গেছি। শুধু ছোট করে একটি কথা বলেছিলাম, “অামি অাপনাকেই চাই, অাপনার ভালবাসা চাই। ”
প্রথমবার কথা বলেছিলামতো, তাই অাপনি করে বলেছিলাম। পরদিন থেকেই তুমি করে বলতে হয়েছে।
.
এর পর থেকে যে অামি তার প্রেমে পড়েছি, অাজো পর্যন্ত সে অামাকে কোন প্রকার কষ্ট দেয়নি। কষ্টতো দিয়েছে অামার ভাগ্য। যদিও বহু ডাক্তার দেখানোর পরও অামাদের দৈহিক সম্পর্ক এক প্রকার হতনা বললেই চলে। কিন্তু অামার স্বামীর অফুরন্ত ভালবাসা ছিল। শেষে উন্নত ডাক্তার দেখানোর জন্য অামার স্বামীকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকেও একই রিপোর্ট অাসল। অামার স্বামীর বাবা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ইন্ডিয়া থেকে এসে সেদিন অামার স্বামী অামাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। যদিও এই প্রথম তার কান্না অামি দেখতে পেয়েছি। কেঁদে কেঁদে বলছিল,
“জানো সোমা? অামি কোনদিন বাবা হতে পারবনা। অামার নাকি সে ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি যে বলেছিলে তোমাকে পরীর মত একটা ফুটফুটে বাবু এনে দিতে, আমি কখনো তোমার পরীর মত বাবু এনে দিতে পারবনা। অামি অনেক অসহায়। তুমি অামাকে ক্ষমা করে দাও সোমা। তুমি অামাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও। অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। অন্য কেউ অবশ্যই তোমাকে পরীর মত বাবু এনে দিতে পারবে। ”
সেদিন অামার স্বামীর সাথে অামিও কান্না করেছি। বলেছি, “তোমাকে ছেড়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবনা, তোমার এখানেই অামি সুখ খুঁজে নেব। ”
দ্বিতীয়বার অামার স্বামী কেঁদেছিল অামার পাগলামি দেখে। এলাকার মেলা থেকে অামি বড় একটি পুতুল কিনেছিলাম। অামার স্বামী অফিস থেকে ফিরে দেখে অামি পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছি। “কাঁদেনা সোনা অামার, ক্ষিধে পেয়েছে? এই নে, খেয়ে লক্ষী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়। ”
আমার স্বামী সেদিও বলেছিল, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও।
অামি যথাসম্ভব নিজেকে হাসিখুশী রাখি। যাতে কেউ বুঝতে না পারে অামি কষ্টে আছি। এমনিতেই বাড়ির সবাই জানে যে, বাকি জীবন অামাকে সন্তানহীন থাকতে হবে। একটাইতো কষ্ট, বিয়ের পর মা না হতে পারার যন্ত্রনা কতটুকু তা কেবল তারাই বলতে পারবে যাদের কোন সন্তান নেই। অামিও কাঁদি, তবে অন্ধকারে নিঃশব্দে”
.
মেজো দেবরের বউ গর্ভবতী। সে অামাকে বুবু বলে ডাকে। তার কোন বোন নেই তাই তার বোনের জায়গাটা অামার জন্য রেখেছে। সে দুয়েকদিন ধরে অামার সামনে অাসেনা, লুকিয়ে থাকে। তার ধারনা তার সন্তান হবার খবর শুনে অামি খুশি না হয়ে কষ্ট পেয়েছি। অামি কষ্ট পাব কেন? শুধু দীর্ঘশ্বাস নিয়েছিলাম।
অামি ডেকে এনেছি তাকে।
এই শেফালী, একটু শুনে যাওতো।
বুবু বলে কাছে এসে মাথা নীচু করে অাছে। অামিই বললাম, “কিরে, এত বড় একটা খুশির সংবাদ। তোর বুবুর মিষ্টি কই? ”
প্লেটে করে দুইটা মিষ্টি নিয়ে এল। হঠাৎ দেখি শেফালী কান্না করছে।
এই, শেফালী তুমি কাঁদছ কেন?
মূহূর্তে চোখ মুছে অনর্গল কথা বলতেছে। “জানো বুবু, অামি প্রতিদিন অাল্লাহর কাছে দোয়া করি অামার যেন জমজ সন্তান হয়। অামি তোমাকে অামার একটি সন্তান দিয়ে দেব। আমার স্বামীকেও বলে রাখছি।
অার রাখতে পারিনি চোখের পানি। শেফালীকে জড়িয়ে ধরেছি অনেক্ষন কেঁদেছিলাম সেদিন।

অাল্লাহ এক সাগর সমান “দয়া” নিজের কাছে রেখেছেন, আর এক ফোটা পানি পরিমান “দয়া” সারা দুনিয়ার মানুষকে দিয়েছে। তাহলে অাল্লাহ কত দয়ালু?
অামার মেজো দেবরের বউ অর্থ্যাৎ শেফালীর জমজ মেয়ে হয়েছে। যেদিন হয়েছে সেদিনই অামাকে তার এক মেয়েকে দিয়ে দিছে। অামার দেবর, শশুড় – শাশুড়ী কেউ অাপত্তি করেনি।
অামার সারাজীবনের সুখ একত্র করলেও সেদিনের সুখের মূহূর্তটার সমান হবেনা। শেফালীর এই অাত্মত্যাগ অার ভালবাসার মূল্য অামি কোনদিন দিতে পারবনা।
.
স্বামী যেখানে চাকরী করে অামরা যেখানে বাসা নিয়েছি। অামার মেয়ে এবার ক্লাস ওয়ানে পড়ে। তার নাম রেখেছি তানিশা।
অাজ অামার মেয়ে বলতেছে মা তুমি একটু শুয়ে পড়োতো? অামি প্রশ্ন করলাম কেন? বলতেছে তোমার পেটের উপর মাথা রেখে শুইব।
একটু পরেই অামার পেটের উপর মাথা রেখে তানিশা ঘুমিয়ে পড়েছে।
জমজ সন্তান নাকি দেখতে একই রকম হয়। তবে তানিশার চেহারার সাথে শেফালীর মেয়ের চেহারা আর দৈহিক গঠন অালাদা। অাল্লাহ তানিশাকে অামার জন্যই পাঠিয়েছে।
আল-হামদুলিল্লাহ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত