আজ একটি বস্তিতে বাস করা ছেলের জন্মদিন। যদিও সে জানত না আসলে জন্মদিন কি। তারা এসব বিষয়ে খুব একটা অভ্যস্ত
নয়। তবে আজ থেকে সে বুঝবে জন্মদিন কি জিনিস। ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আজ সকালেই অপারেশন
হবে। ছেলেটির এক মহামারি রোগ আছে। হঠাত সে মাথা ঘুরে পরে যেত। পরে পরিক্ষা করে দেখা গেল তার মাথায় টিউমার
হয়েছে। কিন্তু সেটা প্রাথমিক অবস্থায়। তবে সঠিক সময় চিকিৎসা না হলে তার হাতে বেশি সময় নাই। ছেলটি জানে না তার সাথে
কি হতে যাচ্ছে। তবে সে তার পরিচিত এক ভাইয়াকে বিশ্বাস করে। অপারেশনে যাওয়ার আগে সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা
করতে চেয়েছে। কিন্তু তার ভাই তার সাথে দেখা করেনি। তার ভাই জানিয়েছিল যদি অপারেশন শেষ হয়ে কোন বেইমানি ছাড়াই
বেঁচে ফিরিস তবেই তোর সাথে দেখা করব। ছেলটির মনে জেদ চেপে গেল। সে ভাবল যেভাবেই হোক তাকে বেঁচে ফিরে
দেখাতেই হবে যে, সে বেইমান নয়। তবে হ্যা, ছেলটি কি পেরেছিল তার জেদ পুরন করতে।
কয়েক বছর আগের কথা,
মফস্বলের এক সাধারন পরিবার থেকে মামুন এসেছিল ঢাকায়। এক বেসরকারী ভার্সিটি থেকে ইন্জিনিয়ারিং এ পড়তো সে। স্বল্প
পরিসরের মধ্যে দিয়েই নিজেকে পরিচালনা করতে পছন্দ করত। ভাল স্টুডেন্ট হওয়ার কারনে দুইটা টিউশন খুব জলদি পেয়ে
গিয়েছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভার্সিটি তারপর আবার সন্ধা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত টিউশন করে বেশ দিব্যি চলছিল তার।
প্রথম সেমিস্টার এর শেষের দিকে ভার্সিটি করে বাসায় যাচ্ছিল মামুন। তখনি এক ছোট মেয়ে, বয়স খুব বেশি হলে ৪ বছর হবে।
তার কাছে এসে বলল ভাইয়া দুইটা টাকা দেন ভাত খামু। মামুন বিষ্মিত হয়ে ভাবল এতটুকু বাচ্চা ভাতের জন্য রাস্তায় ঘুরছে।
খারাপ লাগলেও সে ছোট ছেড়া কাপড় পরা মেয়েটিকে
বলল দুই টাকায় তোকে কে ভাত দিবে। মেয়েটি বলল মায়ে বলছে টাকা দিলে ভাত দিবে। মামুন কিছু না বলে ছোট মেয়েটিকে
নিয়ে একটি হোটেল এ ঢুকল। সেখানে মেয়েটির জন্য বিরিয়ানি অর্ডার করল। মেয়েটি না খেয়ে বলল ভাইয়া খাবারটা লইয়া যাই,
বাসায় ছোট ভাইটা আছে ভাগ কইরা খামু। তখন মামুন বলল তুই খেয়ে নে তারপর ভাইয়ের জন্য নিয়ে যাস। তখন মেয়েটি খেতে
শুরু করল। মামুন চোখ বড় করে দেখল খুদা কি জিনিস। অনেকদিন পর এমনভাবে কাউকে খেতে দেখল সে। মেয়েটির খাওয়া
শেষ হলে তার ভাইয়ের জন্য একটা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে সে মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিল। মেয়েটির যাওয়া দেখে
মামুনও তার পিছু নিল। শেষে এক বস্তিতে গিয়ে পৌছে দেখল বেশ কয়েকজন ছোট ছোট ছেলে মেয়েটিকে ঘিরে রেখেছে। তার
থেকে খাবার গুলো নিয়ে সবাই একটু করে খেল। এসব দেখে মামুন নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। অসহায় হয়ে এসব দেখে
ঝাপসা চোখে বাড়িতে চলে আসল।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় সে সিদ্ধান্ত নিল এদের জন্য কিছু একটা করবে। এরপর থেকে মামুন অনেক হিসেব করে চলতে
লাগলো। সেমিষ্টার ফাইনাল শেষে আবার সে সেই বস্তিতে গেল। সেখানে গিয়েই সে কাকে কি বলবে ভেবে পেল না। এমন সময়
সেই ছোট মেয়েটি মামুনের সামনে এসে বলল ভাইয়া আমারে চিনতে পারছেন। ওই যে সেদিন আমারে বিরিয়ানী খাওয়াইলেন।
ভাইয়া আমাগো বাড়ি এইখানে, আসেন আমাদের বাড়ি দেইখা যান।
মেয়েটির কথা শুনে মামুন অবাক না হয়ে পারল না। সেই কবে খাইয়েছে সে আর মেয়েটি এখনও মনে রাখছে। তারপর সেই
মেয়েটি পলিথিন আর বেড়া দিয়ে বানানো একটি বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। সেখানে একটি ঘরেই মেয়েটার মা বাবা আর ভাইসহ
একসাথে থাকে। তার মাকে আমার কথা বলতেই তার মা আমার অনেক দোয়া করল। আমার জন্য কিছু করতে যাচ্ছিল তখনই
আমি বললাম আমাকে যেতে হবে। একটু কাজ আছে। তার মা বলল আমরা গরীব মানুষ হবার পারি তয় খারাপ নই। এই বাড়িতে
প্রথম আইছেন একটু পানি খাইয়া যান। আমি বললাম আমি এখানেই এসেছি একটু কাজে। আমি এর আগেও এসেছিলাম। তাই
আজ এই ছোটদের নিয়ে কিছু করতে চাই। তারপর সেই বস্তিতে অনেকেই একজায়গায় আসল। বস্তিটা ছোট হলেও সেখানে প্রায়
৩০ জনেরও বেশি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রয়েছে। এদের মধ্যে কারও বাবা আছে আবার কারও নেই। তাদের সবার উদ্দেশ্যে কিছু
কেনা কাটা করে তাদেরকে দিয়ে দিলাম। তারপর কয়েকজন কে নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বই কিনে দিলাম। আর বললাম আমি
বুধবার বাদ দিয়ে প্রতিদিন আসব তোদের পড়াতে। মন দিয়ে পড়বি। এতে কয়েকজনের বাবা মা বলল তারা পড়লে তাদের
খাওয়ামু কি। সারাদিন কাজ কাম কইরা যা পাই তা দিয়ে দুবেলা খাবার জুটাইতে পারি না। তাই ওদের বাইরে পাঠাই কয়টা টাকার
জন্যে। তারপরও ভালমত দুবেলা খাওন হয় না। এরপর এখন যদি ওরা পড়ে, তয় ওদের খরচ কেডায় দিব। এসব কথা শুনে আমি
কি করব ভেবে পেলাম না। তবে এক বন্ধুর কথা মনে হতেই আমি তাদের বললাম আপনাদের জন্য কিছু করার ব্যবস্থা করছি। এই
কথা বলে সেদিন বস্তি থেকে চলে আসলাম। এরপর তুহিনের সাথে দেখা করার জন্য ফোন বের করতেই দেখি তানিমা ফোন
দিছে। রিসিভ করে বললাম,
– হ্যালো তানিমা
– হ্যা মামুন, তুমি কোথায়???(তানিমা)
– আমি তো পান্থপথ সিগনালের দিকে যাচ্ছি। কেন কোন দরকার ছিল?
– না মানে এখন একটু ভার্সিটিতে আসতে পারবে।সাথে তুহিন, শাকিলও এখানে আছে।(তানিমা)
– আমি আর কিছু না ভেবে বললাম আসছি।
ভার্সিটিতে পৌছে দেখি ওরা আরও অনেকেই আছে। তারপর ওদের সাথে আড্ডা হল অনেকক্ষন। তুহিনকে সাইডে ডেকে
নিলাম। হ্যা তুহিন আমার অনেক ভাল বন্ধু। আর ওরা অনেক বড়লোক। কিছুদিন আগেই ও বলেছিল ওর বাবার নতুন গার্মেন্টস
এর জন্য কিছু কর্মী লাগবে। তাই তাকে বলে যদি বস্তির প্রতিটা পরিবারের একজনকে ঢুকিয়ে দিতে পারি তাহলে বাচ্চাগুলো
পড়তে পাড়বে। তানিমের সাথে এ ব্যপারে কথা বলতেই সে বলল তারা তো আগে কোথাও কাজ করেনি। তবুও বাবাকে বোঝানোর
চেষ্টা করবে। তবে আমাকে সে বলল আমি কেন শুধু শুধুই এসব ঝামেলাতে জড়াচ্ছি। তখন আমি হাসলাম। এই প্রশ্নের উত্তর তো
আমিও জানি না। শুধু জানি, আমি ভুল কিছু করছিনা। সবার সাথে কথা শেষ করে তুহিনকে বললাম আমার জন্য হলেও একটা
কিছু করতে। তারপর বাসায় চলে আসলাম। রাতে তুহিন ফোন করে বলল বাবা রাজি হয়েছে। তবে তাদেরকে কিছু কাজ শিখতে
হবে। আমি বললাম তুই সাথে থাকলে সেটাও সম্ভব। তাই পরেরদিন আবার তুহিনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বস্তিতে গেলাম এবং
সবাইকে এই সুখবরটা দিলাম। সবাই নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য সবকিছু করতে রাজী হল। তারপর তুহিন কিছু আগের কর্মী
দারা প্রাথমিক কিছু কাজ শিখিয়ে দিল। শেষে তুহিনের কাছে কিছু ছেলেমেয়ে এসে তার হাত ধরে কান্না করল। আর যে যা পারল
বাসা থেকে নিয়ে এসে তুহিনকে আপ্যায়ন করালো। এদের ভালবাসা দেখে তুহিন নিজেও কেঁদে ফেলল। তুহিনের মা নেই।
এরকমভাবে কেউ হয়ত ভালবাসা দেয়নি। তাই কেঁদে ফেলেছে। আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পরলাম না। কিছুদিন পর সবাই
কাজে যোগ দিল আর সবার ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হল। কথামত প্রায় প্রতিদিন আমি আর তুহিন তাদের পড়াতে আসতাম। এর
মাঝে হঠাত তুহিনের বিদেশে যাওয়ার খবর আসলো। আমি সহ সবাই অনেক খুশি। যাওয়ার আগের দিন সে বস্তিতে এসে সবার
জন্য কাপড়-চোপর কিনে দিয়েছিল। সেই ছোট মেয়েটি যার নাম ছিল ময়না। সে সেদিন তুহিনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিল।
তুহিনকে তারা এতটা কাছের করে নিবে তুহিন ভাবতেও পারেনি। সেদিন সবার সামনে ও বলেছিল আমাকে এদের দেখে রাখতে।
আর বলেছিল আমি ফিরে আসব। যে কোন সমস্যা হলে যেন তাকে জানানো হয় বলে সে বিদায় নিয়েছিল। বিদেশে যাওয়ার পর
তুহিনের সাথে খুব একটা কথা হত না। সপ্তাহে একবার তাও আবার কোন সপ্তাহে হতই না। এদিকে আমি সারাদিন নিজেকে
দেখার সময় পেতাম না। দুটি টিউশন, বস্তিতে বাচ্চাদের পড়ানো আবার ভার্সিটিতে ক্লাস করা। সবকিছু মিলে অনেক ব্যস্ততম
জিবন হয়ে গেল আমার। তারপরও যখন একবার ভাবতাম আমি কারও ভাল কিছু করছি, কাউকে শিক্ষার আলোয় আলেকিত
করার জন্য কাজ করছি, নিমিশেই আমার সব ক্লান্তি শক্তিতে পরিনত হত। টিউশনের টাকাটা পুরোটাই বাচ্চাদের বই খাতা পড়ার
পেছনে খরচ করতাম।
দেখতে দেখতে আমি তৃতীয় বর্ষে উঠলাম। আর এদিকে বস্তির বাচ্চাদের বেশ কয়েকজন PSC দিবে এবার। হঠাত খবর পেলাম
তুহিনের বাবা মারা গেছেন। গার্মেন্টস পরিদর্শনে এসে এক ব্রয়লারে হঠাত আগুন ধরে যায়। আর সেখানেই এক সিলিন্ডার
বিষ্ফোরনে তিনি মারা যান। খবরটা শুনে অনেক বেশি খারাপ লাগলো তুহিনের জন্য। উনার লাশটা ঠিকভাবে বোঝাই যাচ্ছে না।
ওভাবেই হাসপাতালে রাখা হল। পরেরদিন তুহিন আসলে লাশ দাফন করা হয়। তাকে কি বলে শান্তনা দিব আমি ভেবে পাচ্ছি না।
ছোটবেলা থেকেই সে মাকে দেখেনি। বাবার কাছেই মানুষ হয়েছিল। আজ তার বাবাও তাকে ছেড়ে গেল। অনেক আত্মীয় স্বজন
বিভিন্ন কথা বলে শান্তনা দিয়ে সবাই চলে গেল। শুধু আমি রয়ে গেলাম। সে একদৃষ্টিতে সামনে ঝোলানো ঝারবাতির দিকে তাকিয়ে
আছে। আমি পাশে গিয়ে বসলাম। এসে থেকে সে কিছুই মুখে নেয় নি এমনকি তার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও বের হয়নি। তাই
তাকে বললাম কিছু খেতে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। তিনি সবসময় বলতেন আমার
জন্য কিছু সম্পত্তি রেখে সবকিছু মানুষকে বিলিয়ে দিবেন। আর আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে একটা নদী আছে
সেখানে একটা ব্রীজ তৈরী করবেন নিজস্ব অর্থায়নে। কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। জানিস বাবা গ্রামে ব্রীজের কাজ শুরু করে
দিয়েছেন। কিন্তু বাবার এক বন্ধু তার সাথে বেইমানি করে উনার অনেক টাকা মেরে দেয়। নিজের বন্ধু যখন এত বড় বেইমানি
করল তখন বাবা তার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। তিনি ইদানিং অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলেন। গ্রামের সেই ব্রীজের কাজে অনেক টাকা
লাগবে। এই টাকা বাবা কই থেকে নিয়ে আসবে এসব কিছু চিন্তা করতে করতে বাবা সিদ্ধান্ত নিল যে গার্মেন্টস বিক্রী করে দিবেন।
আমার সাথে এ ব্যপারে কথা বললে আমি বিক্রী করতে নিষেধ করি। আর ঠিক তখনই আমি আমার বাবাকে হারিয়ে ফেলি।
আসলে বাবা ভুল করে ব্রয়লারের সামনে সিলিন্ডার খুলে দিয়েছিল। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এক কর্মী
আমাকে বলল এ কথা। জানিস আমি আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দ্বায়ী। বলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল।
আমি তাকে বললাম নিজেকে দায়ী করছিস কেন। তুই তো ভুল কিছু করিস নি। আর নিজেকে শক্ত কর। কারন তোর বাবার ইচ্ছা
তোকেই পুরন করতে হবে। আর এখন এত কিছু ভেবে নিজেকে অস্থির করিস না। চল কিছু খেয়ে নিবি বলেই তাকে নিয়ে ডায়নিং
এ এলাম। কিন্তু সে কিছুতেই খাবে না। তারপর বললাম তুই না খেলে যে ওরাও কিছু মুখে দেবে না। তখন তুহিন আমার দিকে
তাকালো। আমি বললাম কাল থেকে বস্তির সবাই না খেয়ে আছে। এখনও কিছু খায় নি তুই কিছু খাচ্ছিস না বলে। বিশ্বাস না হলে
বাইরে বেরিয়ে দেখ। সে কিছু না বলে দৌড়ে বাড়ির বাইরে এলে। দেখলো সবাই খাবার সামনে নিয়ে দারিয়ে আছে। আর সবার
চোখেই পানি। নিজেকে স্থির রাখার মত জায়গা এটা নয় আমিও বুঝেছিলাম। সব ছেলেমেয়েদের কে আকরে ধরে তুহিন চিৎকার
করে কাঁদছে। আমি এবার কিছু বললাম না। এখন কাঁদলে ও একটু শান্তি পাবে। একটু পরে যে যা এনেছিল সবাই তুহিনকে খাইয়ে
দিচ্ছে। আমি অনেক শান্তি নিয়ে এই দৃশ্য দেখছি। ভাবছি যদি এ দৃশ্যটি ক্যামেরায় বন্দি করা হত, সত্যিকারের ভালবাসার এক
করুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত এটা। সবার কাছে এত ভালবাসা পেয়ে সেও সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষন পরেই একটা খাবারের
প্লেট নিয়ে ও আমার সামনে আসলো। সামনে এসে ও আমার চোখের পানি মুছে দিল। কখন থেকে আমি কাঁদছি বুঝতেই পারিনি।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলে সে আমার দিকে এক লোকমা খাবার তুলে ধরল। নিজের অজান্তেই কখন যে
চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল বুজতেই পারলাম না। তাকিয়ে দেখি সেও কাঁদছে। ও বলল নিজে না খেয়ে অন্যের জন্য কিছু করতে
খুব মজা পাস তাই না। দুদিন থেকে না খেয়ে শরীরের কি অবস্থা করেছিস সে খেয়াল আছে। আর কিছু না বলে আমি তাকে
ধরে কাঁদলাম। একটু পরে সব শান্ত হলে সবাই খেয়ে বস্তিতে চলে গেল। সারাদিন তানিমাও ছিল আমাদের সাথে। ওকে বাসায়
রেখে আবার তুহিনের বাসায় এলাম। আজকে ওর সাথেই থাকব বলে। রাতে ওর আমার কাররই ঘুম হল না। ভোরে তাই দুজনে
হাঁটতে বের হলাম। একসময় এক মামার দোকানে এসে চা খেলাম। খেতে খেতেই সে বলল আমি কি করব এখন। আমি বললাম
ব্রীজের কাজ কতদুর হয়েছে। অনেকটাই তবে আরও অনেক টাকা লাগবে। তখন আমি বললাম তুই গার্মেন্টস বিক্রী করে দে।
আর বস্তির লোকেরা এখন কাজ জানে। তাই তাদের কাজ পেতে কষ্ট করতে হবে না। তখন তুহিন বলল এটা করলে তাদের সাতে
খারাপ করা হবে। আমি বললাম খারাপ হবে না তবে সবাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ও চুপ করে থাকলো কারন তার কাছেও আর
কোন পথ খোলা নেই। সেইদিন বিকেলে আমি আর তুহিন বস্তিতে গেলাম। সব কর্মীদেরকে ভালভাবে জিনিসটা বোঝালাম। তখন
সবাই বলল যে আপনাদের জন্য যে কোন কিছু করতে পারি। তাই পরের দিনই সবাই কাজ খুজতে বের হল। অনেকজনের কাজ
জোগার হয়েও গেল। তবে কয়েকজনের হল না। তখন তানিমার সাহায্য নিয়ে ওর বাবার পরিচিত এক লোকের গার্মেন্টস এ কাজ
জোগার করে দিলাম। কয়েকদিন এসব নিয়ে অনেক খাটাখাটি হল। এবার তানিমার বাবার সাহায্যেই গার্মেন্টস বিক্রী করার
বেপারটা পাকা করলাম। যা অর্থ আসবে তা দিয়ে ব্রীজ হয়ে যাবে সঙ্গে তুহিনের জন্যেও কিছু টাকা থাকবে। তাই সবকিছু ঠিক
করে তুহিনের বাবার কাজ পুরো করার জন্য লেগে গেলাম। তুহিন ইদানিং ব্রীজের কাজ নিয়ে অনেক দৌরাদৌরি করেছে।
কিছুদিন পরেই তুহিন আর আমি তাদের গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের নিয়ে ব্রীজ উদ্বোধন করলাম এবং তার বাবার জন্য একটা দোয়া
মাহফিলের আয়োজন করলাম। সবাই তুহিনকে নিজের সন্তানের মত আগলে রাখলো। সব শেষ করে সে বাবার কবরে আসল।
আমিও পাশে ছিলাম। সে অনেক জোরে জোরে বলল বাবা আমি পেরেছি তোমার স্বপ্ন পুরন করতে। এই দেখো তোমার ছেলে, হ্যা
তোমার, শুধুই তোমার ছেলে অনেক বড় আশা নিয়ে বলছে আজ সে তার বাবার স্বপ্ন পুরন করেছে। তুমি কি আজও আমাকে
ক্ষমা করবে না বাবা। বলে কান্না শুরু করল। পিছন থেকে আমি তার কাধে হাত রেখে বললাম এরকম এক ছেলের বাবা কখনই
তার ছেলেকে ক্ষমা না করে থাকতে পারে না। আর তুই কতই ভাগ্যবান বাবা পেয়েছিস ভেবে দেখেছিস। যে নিজে চলে গিয়েও
তোকে সবাইকে দিয়ে গেছে। এরকমটা হওয়াও তো অনেক ভাগ্যের বেপার তাই না তুহিন। তুই শুধু তোর বাবার ছেলে না এখন।
তুই এখন সবার। তোর বাবা তোকে সবার করে দিয়ে গেছে। জিবনের সব থেকে বড় উপহারটাই তুই তোর বাবার কাছে থেকে
পেয়েছিস। এবার সামনে এগোনর পালা তুহিন। আংকেলের জন্য দোয়া কর আল্লাহর কাছে। সঙ্গে শুকরিয়া আল্লাহর প্রতি। তুহিন
তার বাবার জন্য দোয়া করার পর রাস্তায় এক সাথে হাটছি। আজ অনেক হালকা লাগছে। ওখান থেকে সোজা বস্তিতে চলে
আসলাম। আজও তুহিন সবার জন্য কেনাকাটা করল। বস্তিতে গিয়ে সবাই তুহিনকে দেখার জন্য আসল। সেই ছোট মেয়ে ময়না
psc তে প্লাস পেয়েছে। আরও অনেকেই ভাল রেজাল্ট করেছে। সবাইকে সবকিছু দিয়ে সবাইকে ভালভাবে থাকার কথা বললাম।
তুহিন বাচ্চাদের ভালভাবে পড়াশুনা করতে বলল। তারপর তানিমা কে দেখলাম ওখানে সবার মধ্যে। সেও সবার মাঝে লুকিয়ে
ছিল। এতদিন আমি আর তুহিন ব্যস্ত থাকায় তানিমা এদেরকে পড়াতো। তুহিন একটা গোলাপ বের করে তার সামনে এগিয়ে দিল।
তানিমা খুশি হয়ে গোলাপটা নিল। আমি কেমন যেন চুপ হয়ে গেলাম। আর এদিকে তুহিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি
কিছু না ভেবেই হাত তালি দিলাম। আমার দেখাদেখি বাকি বাচ্চারাও হাততালি দেওয়া শুরু করল। তখন তানিমা অনেক রেগে
গেল। চিৎকার দিয়ে বলল থাম তোমরা। দেখলাম তুহিনও লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর তুহিন বলল,
– তুই নিজেকে কি মনে করিস? (তুহিন)
– কেন আমি আবার কি করলাম।
– এই মুহুর্তে কি এসব হইচই করা খুব দরকার ছিল। খুব দাতা হয়ে গেছিস না।(তুহিন)
– বাদ দাও তুহিন। যে বোঝেনা তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। চল এখান থেকে।(তানিমা)
ওরা দুজনি চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে দুজনের হাত ধরে সরি বললাম। অনেক করে সরি বললাম। কিন্তু তাদের রাগ মনে হয়
বেরেই চলল।
তাই বললাম আসলে হঠাত এসব দেখে কি করব বুঝতে পারিনি। তাই হাততালি দিয়েছিলাম। নেক্সটে এরকমটা হবে না। তুহিন
বলল আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তানিমাকে রেখে বাসায় যাব। কাল দেখা হবে তোর সাথে। তারপর বস্তিতে বাচ্চাদের সাথে কিছু
কথা বললাম, তাদের মা বাবার সাথে কথা বললাম। ওরা সবাই নিজের সন্তানকে পড়াতে পারছে বলে অনেক খুশি। কিন্তু ওরা
সবাই তুহিনের জন্য কিছু করতে চায়। তুহিন ওদের জন্য সব দিয়ে দিল আর ওরা কিছুই করতে পারল না। আমি বললাম আপনারা
যা আয় করেন সেটা দিয়ে আপনাদের একটু কষ্ট করে চলতে হয়। তাহলে আপনারা কিভাবে ওর জন্য করবেন। তখন তারা কেউ
তাদের সোনার চেন, কেউ নাকের ফুল,কেউ কানের দুল নিয়ে সামনে আসল। তখন আমি বললাম এসবের কিছু দরকার হবে না।
তা চেয়ে বরং আপনাদের সন্তানকে ভালভাবে পড়াশুনা করিয়ে মানুষ করে তুলুন। আর এই গড়ে তোলা মানুষকে তুহিনের
সামনে দিন যেন তুহিন গর্ব করে বলতে পারে এরাই তার কৃতকর্মের ফল। সবাই বেপারটিতে বেশ ভাল উৎসাহী হল। তারপর
তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে নিজের জন্য পড়তে বসলাম। আমাকেও যে বের হয়ে ভাল
কিছু করতে হবে এই বাচ্চাদের জন্য। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তুহিন ফোন করে বলল কাল সকালে আমার রুমে আসবে।
তাই রাত বেশি না জেগে জলদি ঘুমিয়ে গেলাম।
ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফ্রেশ হয়ে হঠাত মনে পরে গেল তানিমার কথা। একটু কষ্টের সাথে মনে পরে গেল কালকের প্রোপজের
কথা। কিন্তু দুজনের এত রিয়েক্ট করার কারন হিসেবে শুধু হাততালিকে মেনে নিতে পারছিলাম না। তাহলে কেনই বা তানিমা
রিয়েক্ট করল এমন ভাবে। তানিমাকে সেই ২য় সেমিষ্টার থেকে ভালবাসতাম। কিন্তু কখনও বন্ধুত্বের জন্য বলতে পারিনি। আর
কাল তুহিন ওভাবে প্রোপজ করাতে নিজে অনেকটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কি করা উচিত কিছুই মাথায় আসছিল না। তবে
তুহিনের দিকে তাকিয়ে আমি সব ভুলে গেছিলাম। সে অনেক কিছুই হারিয়েছে। তাই তানিমাকে নিয়ে সে যদি সুখে থাকে তবে
আমি সেই কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিতে রাজী আছি।
তাই চিন্তা করলাম তানিমাকে নিয়ে আর ভাবব না। তাকে সরি বলে সমাধান করে ফেলব। কিন্তু তবুও নিজেকে মানাতে
পারছিলাম না। প্রথম ভালবাসা তো তাই হয়ত। এসব ভাবতেই দেখি তুহিন চলে এসেছে। এসেই বলল চল নদীর পারে যাব। আমি
চাদরটা নিয়ে একসাথে বেরিয়ে পরলাম। যেতে যেতে ও বলল ও আবার বাইরে যেতে চায়। পড়াশুনা শেষ করতে চায় সে। আমি
তখন তাকে বললাম এতো ভাল কথা। তবে কি বিয়ে করেই বউ নিয়ে যাবি। তুহিন বলল নিজেকে নিজের মত করে গুটিয়ে নেয়াটা
এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাই না। আমি বললাম এমনভাবে কেন বলছিস। আমি তো তোর কথা ভেবেই….. কিছু বলার
আগে সজোরে একটা থাপ্পর মারল তুহিন। বলল ভাবিস কি তুই নিজেকে। কাল তোকে ফুল দেওয়ার জন্য আমিই তানিমাকে ফুল
দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছিস। কোন কিছুই সঠিকভাবে হতে দিস না। আজ তোকে সব ভালভাবে
বলতে আসলাম কিন্তু এখানেও তুই ঝামেলা করলি। কেন করিস তুই এসব। তানিমাকে তুই এতটা ভালবাসিস অথচ নিজের
ভালবাসাকে অন্যের করে দিতে এতটা তৎপর কেন তুই। খুব দাতা হয়ে গিয়েছিস না। একবারও কি তানিমার কথা ভেবেছিস। সেও
তো বড়মুখ করে এসেছিল কাল তোকে ভালবাসার কথা জানাবে বলে। কিন্তু কাল তো ভালই দেখালি।
একসাথে এতকিছু বলে থামলো তুহিন।
আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে যা বলল তা সত্যি কিনা যাচাই করার চেষ্টা করছি। হঠাত সে বলল কিছু বলছিস না কেন।
আমি বললাম কি বলব। সে তখন হাসলো। তখন আমি বললাম আচ্ছা এসব বাদ দে। তোর বেপারে কিছু বল।
সে বলল পরশু আমার ফ্লাইট। আমি বললাম একটু জলদি হয়ে যাচ্ছে না যাওয়াটা। ও বলল সেখানে কেউ অপেক্ষারত রয়েছে।
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম তবে আর কি। যাও এবার তার কাছে। আরও অনেক হাসি ঠাট্টা করে আমরা বাসায় আসলাম।
পরেরদিন বস্তিতে গিয়ে সে সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলল। তারপর একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। ময়না মেয়েটি তুহিনের
জন্য তার জমানো টাকা দিয়ে একটা শার্ট কিনেছিল। সে শার্টটা তুহিনকে দিয়ে ওকে জোরে ভাইয়া বলে জড়িয়ে ধরল। ময়নার
ছোট ভাইটা বলল আমি বড় হলে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে তো। তুহিন বুঝতে পারছিলনা কিভাবে ছেড়ে যাবে এদের।
তারপরও সব মায়া ত্যাগ করে সেদিন তুহিন চলে গিয়েছিল। ফ্লাইটে উঠিয়ে দেওয়ার সময় আমি তাকে বললাম সত্যি কেউ
অপেক্ষা করে আছে তো। সে হেসে বলল যদি তানিমাকে তোর সাথে একটু দেখতে পেতাম। আরও বলল আমাকে একটা কথা
দিবি। আমি বললাম বল কি কথা। নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিস না। তোর পরিবার তোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম সঙ্গে
সেই বস্তির সবাই। আমি আরও বললাম আমি তাদেরকে এক একটা তুহিন বানাতে চাই যেন তারা তাদের বাবা মা এবং তোর মত
স্বপ্ন পুরোনে সম্পুর্ন খিলারী হয়। তুই যখন দেশে ফিরবি তখন এদের মাঝে যেন নিজেকে খুজে পাশ। তুই যেন এদেশকে তোর
মত করে দেখতে পাশ, যেখানে বেশকয়েকটা তুহিন সবার স্বপ্ন পুরোনে মাহির থাকবে। তুহিন আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বলল আমি
তোকে বিশ্বাস করি এবং মেনে নিয়েছি যে এরকম একটা দিন আসবে। আর এর জন্য আমাকে দেশে এসে দেখে যেতে হবে না।
আমি এই স্পৃহাটুকু দেখতে পাচ্ছি। তোকে আরেকটু অনুরোধ করব। আমি বললাম এভাবে বলছিস কেন। সে বলল আমার উপর
কখনও রেগে থাকিস না। তানিমাকে নিয়ে সুখে থাকবি। মেয়েটা অনেক ভাল। আর সবাইকে দেখে রাখিস। আর তুই আমার দেখা
সবচেয়ে ভাল মানুষের একজন।নিজেকে দেখে রাখিস। আর হ্যা, শুধু তোর স্বপ্ন পুরোনের অংশীদার হতে পারলাম না রে। ক্ষমা
করে দিস আমায় কেমন। আমি তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন বোধ করছি। মনে হল কোথাও কোন সমস্যা আছে। নয়ত তুহিন
এসব কথা বলছে কেন। আমি ওকে বললাম আমি তোর অপেক্ষায় থাকব। আর নতুন জিবনের জন্য শুভ কামনা রইল। ফ্লাইটের
সময় হয়ে এলো। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আমি তখনও জানতাম না যে এটাই আমার সাথে তার শেষ জড়িয়ে ধরা।
তারপর সে চলে গেল। যাওয়ার সময় তার চোখের পানি আমার চোখ এড়ায়নি। তবুও তাকে আমি বিদায় দিয়েছিলাম। এর পর
কয়েক মাস কেটে যায় তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি। অনেক চেষ্টা করেছি তার সাথে কথা বলার কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
দেখতে দেখতে আমার লাস্ট সেমিস্টার ফাইনাল চলে এলো। তানিমাকে অনেকবার সরি বলেছি কিন্তু সে আমাকে এরিয়ে গেছে।
বস্তিতে ছেলেমেয়েরা এখন অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়াশুনা করে। শেষ প্রাকটিকেল পরিক্ষা দিয়ে বস্তিতে আসলাম বাচ্চাদের
পড়াতে। এসে শুনলাম ময়নার ছোট ভাই নাকি হঠাত মাথা ঘুরে পরে গেছে। তারপর পানি ছিটিয়ে অনেকক্ষন পর নাকি সেন্স
এসেছে। আমার কাছে দৌরে এসে বলল ভাইয়া আমার কিছু হয়নি তো। আমি মরে যাব না তো। আমি ওকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
না তোর কিছু হবে না। তোকে যে তুহিন হতে হবে, ওর কাছে যেতে হবে। সেদিন না পড়িয়েই চলে আসলাম। তুহিনের বাসায় মাঝে
মাঝেই যাই দেখার জন্য। বিগত কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। নিজের চাকরী খুজছিলাম। অবশেষে পেয়েছি। সামনে মাস থেকে
জয়েন। কিন্তু একটু টেনশন হচ্ছে আমি চাকরী করলে বাচ্চাদের পড়াবে কে। ভার্সিটিতে পড়াকালীন কিছু ছোট ভাইদের সাথে
পরিচয় ছিল। তাদেরকে কিছু টাকার বিনিময়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করলাম। এতদিন তানিমাকে একটি বারের জন্য দেখিনি। তবে
সেদিন শুক্রবার ছিল বলে বস্তিতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি সবারি বাড়ি ঘর নতুনত্বের আধিক্য পেয়েছে। তামিমাকে বাচ্চাদের
পড়াতে দেখলাম। আমিও চুপি চুপি পিছনে গিয়ে দাড়ালাম।
হঠাড তানিমা ময়নাকে বলল পিছনে যে ভাইয়া দাড়িয়ে আছে তাকে সামনে এসে তোমাদের সাথে পড়তে বল। শুনতে পেয়ে
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম সাথে বুঝলাম আমার আসাটা সে টের পেয়েছে। তাই সামনে গিয়ে ময়নাদের সাথে পড়তে বসলাম।
সবাই মিটি মিটি হাসছিল। হুট করে তানিমা আমায় প্রশ্ন করল,
– I hate u মানে কি?(তানিমা)
– আমি তোমায় ঘৃনা করি।
– কি তুই আমাকে ঘৃনা করিস। তুই দারা। এক পায়ে কান ধরে দাড়িয়ে থাকবি পুরো সময়।(তানিমা)
– আমি তো শুধু প্রশ্নের উত্তর বললাম। প্রশ্নটাই তো এরকম করেছ। উত্তর কি ভুল দিব।
– আবার কথা বলে। যা করতে বলেছি সেটা জলদি কর। না হলে উঠবস করাবো।(তানিমা)
– আচ্ছা আর একটা সুযোগ দাও। প্লিজ।
– আচ্ছা ঠিক আছে বল, তুমি জিবন সঙ্গি হিসেবে কাকে ভালবাস?(তানিমা)
– এরকম প্রশ্ন শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু না ভেবে উঠে এক পায়ে
দাড়িয়ে গেলাম।
তানিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আজ পড়া এখানেই শেষ। তারপর কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলে কিছু টাকা দিয়ে সে
আমার এদিকেই আসছে। বুঝতে পারলাম এদের ঘরবাড়ি গুলো তানিমাই নতুনত্বের রুপ দিচ্ছে। একটু ভালো লাগলো কেন
জানি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল ভাল থেকো। বলেই চলে গেল। কয়েক মাস পর আমি চাকরী ছেড়ে দিয়ে আর একটা ভাল
কম্পানীতে চাকরী নেই। সেখানে বেতনও অনেক ভাল। বাবা মা অনেক খুশি। বস্তিতেও খুশির ঢল পড়েছে। সামনে ময়না ssc
দিবে। কয়েকজন hsc দিবে। সবার ভালভাবে পরিক্ষার জন্য আমি রাতে সেখানে গিয়ে পড়া বুঝিয়ে আসি। এর মাঝেই ময়নার
ছোট ভাইটার হঠাত ঘন ঘন মাথা ব্যথা হচ্ছে। তাই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসলাম আজ। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলল তার
টিউমার হয়েছে। জরুরী অপারেশন করতে হবে। আমি তখনি ভর্তি করে দিলাম। ডাক্তারকে বললাম কাল সকালের মধ্যেই টাকার
ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বস্তিতে যাচ্ছিলাম সবাইকে বেপারটি জানাতে। তখনি তানিমার বাবা ফোন করে বলল তানিমা নাকি এক্সিডেন্ট
করেছে। একটা চোখ নাকি বলে আর কিছু বলতে পারল না। আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে কোন ভাবে কন্ট্রল
করতে না পেরে কেঁদেই দিলাম। বস্তিতে গিয়ে যখন সব কিছু বললাম তখন সেখানে কান্নার রোল পরে গেল। তখনি একজন
মানুষিক প্রতিবন্ধী মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে বলল আমাগো ময়নার ভাই মুন্নারে বাচান আপনে। তানিমা মায়েরে এক চোখ আমি
দিমু। আমি না বাইচা থাকলেও যেন মুন্না বাইচা থাকে। সবাই আমাকে এটাই করতে বলল। তানিমার বাবার সাথে যোগাযোগ করে
কথাটি জানালাম। উনি শুনেই কান্না করে দিলেন। তারপর আমার বন্ধুবান্ধব দের বলে কিছু টাকা, তানিমের বাবা কিছু দিলেন।
তারপরও অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। এত টাকা কোথায় পাব ভাবতেই তুহিনের কথা মনে হল। তার হাতে কিছু টাকা ছিল।
কিন্তু তার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই বলো বাড়িতে গেলাম তার। তার রুমে গিয়ে দেখলাম একটা ডায়রী। হঠাত কলিং
বেল শুনলাম। চিন্তা করলাম এই বাড়িতে আবার কে আসল। দেখলাম কেয়ার টেকার সহ এক মহিলা দাড়িয়ে আছে। উনি বলেন,
আপনি নিশ্চয় মামুন।
– আমি বললাম জি আমি মামুন। আপনাকে চিনলাম না ঠিক।
– আমি জেনিফার। তুহিনের থেরাপিস্ট।
– মানে বুঝলাম না।
– আপনার জানার কথা নয়। ভেতরে চলুন বলছি।
তুহিনের ব্লাড ক্যান্সার ছিল। ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কিভাবে জানি না তার বাবার হঠাত মৃত্যু
হয়। সে দেশে চলে আসে। তারপর আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করে না। পরে অনেকদিন পর ওখানে আসলে সে আমাদের
সাথে কথা বলে। আমাকে পার্সোনালি ডেকে নিয়ে এসব কথা আপনাকে জানাতে বলে। আমি চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাচাতে।
কিন্তু সে অনেক দেরী করে ফেলেছিল। তাই তাকে আর আমরা বাচাতে পারিনি…..
আমি বললাম না। এ হতে পারে না। তুহিন মরতে পারে না। সে আমার সাথে বেইমানি করেছে। আমাকে ফেলে সে এভাবে যেতে
পারে না।
জেনিফার বলল তুহিন বলেছিল আপনি এসব বলবেন। তখন আমাকে সেদিনে তার ফ্লাইটের সময়ের কথা মনে করে দিতে
বলেছে। আমি অসহায় হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম। এই কান্না যে থামার নয়। পেছনে কারোও হাতের স্পর্শ পেতে তাকিয়ে
দেখলাম কেয়ার টেকার চাচাও কাঁদছে। তিনি বললেন বাবা এখন তোমার ভেঙ্গে পরার সময় নয়। তোমাকে যে অনেক কিছু
করতে হবে।
তারপর জেনিফার বললেন তুহিন তার একাউন্ট থেকে কিছু টাকা আপনার জন্য দিয়েছেন। এগুলো রাখুন। আমি বললাম তুহিন
কে কোথায় সমাধী দেয়া হয়েছে। জেনিফার বলল তার বাবার কবরের পাশে। আমি তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে সে বলল
পরশু তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার কথামতই কাউকে না জানিয়ে এসব করতে হয়েছে। আমি বললাম আপনি আমাকে
চিনলেন কি করে। সে বলল আমাকে যেতে হবে। তার চোখেও হঠাত পানি দেখলাম। আমি বললাম আমি আমার প্রশ্নের উত্তর
পেলাম না। সে বলল এখান থেকে যাওয়ার পর এমন একটা সময় নেই যে তুহিন আপনার কথা বলে নি।তাই চিনতে অসুবিধা
হওয়ার কথা নয়। আমি বললাম আপনি তুহিনকে না দেখে যেতে পারবেন না। এখানে আপনি অনেক তুহিন দেখতে পাবেন।
আপনাকে কয়েকটাদিন থাকতেই হবে। আসুন আমার সাথে। উনার কাছে থেকে টাকাগুলো নিয়ে আমি উনাকে সাথে নিয়েই
হাসপাতালে এলাম। এদিকে তানিমার বাবা ফোন করে বলল তানিমার অপারেশন সফল হয়েছে। তবে সেই মহিলার অপারেশনের
সময় হঠাত স্ট্রোক করেছে। ডাক্তারা তাকে বাচাতে পারেনি। হাসপাতালে যেতেই আমি সবাইকে সবটা বললাম। সবাই বলল যা
হবার তা হবে এটা নিয়ে ভেঙ্গে পরলে হবে না। এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বলল বাবা তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। কিন্তু
তুহিনের জন্য হলেও মুন্নাকে বাচাও তুমি। এবার আমি কাঁদলাম না। তাদের বললাম কাল সকালেই ওর অপারেশন হবে। আপনারা
দোয়া করুন। ছোট বড় সবাই তখন থেকে দোয়া করতে শুরু করেছে। আমি মুন্নার কাছে গিয়ে বললাম কাল তোর অপারেশন
হবে। ভয় করছে? সে বলল না, তুহিন ভাইয়া ভয় পেতে নিষেধ করেছে। আমি বললাম কাল তুই আমাকে অপারেশনের আগে
দেখতে পাবি না। যদি তুহিনকে আর আমাকে সত্যি ভালবেসে থাকিস তবে অপারেশনের পর অবশ্যই দেখা করবি কথা বলবি।
কি ঠিক তো। সে কষ্ট করে হলেও একটা হাসি দিয়ে ইংরেজিতে বলল done….তুই ঠিক হয়ে যাবি বলে কপালে একটা চুমু দিয়ে
আমি আর বেশিক্ষন থাকলাম না। জানি থাকলে নিজেকে কন্ট্রল করতে পারব না। ক্যাশে গিয়ে টাকা গুলো জমা দিয়ে
জেনিফারকে আজ হসপিটালেই রেখে আসলাম। তানিমাকে দেখতে যাব। রাস্তা দিয়ে হাটছি আর ভাবছি আজ সারাদিন কেন
এমন হল। সবকিছুই এরকম কেন।
তুহিনের কথা ভাবতেই মনে হল তুই সালা বেইমান। নিজে শুধু দিয়েই গেলি। করও কথা ভাবলি না। একটাবার আমাকেতো
জানাতে পারতি। তানিমাকে কেবিনে নেওয়া হয়েছে। ওর বাবা বলল সেন্স এসেছে কাউকে হয়ত খুজছিল। আমি তানিমার বেডের
সামনে যেতেই সে একচোখ দিয়ে আমায় দেখলো। আর একচোখে নতুন চোখ লাগানে হয়েছে তাই ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে
কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। শুধু দেখলাম একচোখ দিয়েই পানি গড়িয়ে পরল। আমার চোখটাও কেমন যেন ঝাপসা
হয়ে এলো। চোখটা মুছে তানিমার এক হাত চেপে বললাম মুন্নার জন্য দোয়া কর। একটু কষ্ট হলেও কর। কাল তার অপারেশন।
তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে আসছিলাম। তখনি ও হাত ধরে ফেলল। সে কিছু বলতে চায়। আমি মুখের কাছে মাথা নিয়ে
গেলে সে নিভু নিভু গলায় বলে আমি ভালবাসি তোমায়। আমি মুখ তুলে হেসে বললাম আমি জানি। আর আমিও। বলে চলে
এলাম বাইরে। ওর বাবা বলল তানিমা সেই মহিলার লাশ দেখতে চেয়েছে তাই লাশটা কালকে দাফন করা হবে। আমি কিছু না বলে
আজ রাতটা রাস্তায় কাটানোর চিন্তা করলাম।
ভোরের দিকে মসজিদ থেকে আজান শোনা গেলে আমি নামাজ পরার জন্য মসজিদে গেলাম। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম
থেকে উঠতে আজ একটুকটু দেরী হয়ে গেল। আজকের সকালটা অনেক নতুন।
আজ সেই ছেলটির জন্মদিন যে আজ হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। সে জানে না এমনকি
বোঝেওনা কি হচ্ছে তার সাথে। আজ সেই দিন যেখানে ছোট ছেলে মুন্না তার অতিপ্রকৃত দুই ভাইয়ের জন্য এত বড় পরিক্ষার
সম্মুখীন হয়েছে। এবং সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তাকে পারেতেই হবে।
মসজিদ থেকে বের হয়ে হসপিটালের দিকে যাচ্ছি। এতোক্ষনে অপারেশন হয়ে গেছে। পা কেমন যেন যেতে সাহস পাচ্ছে না।
শুধু বারবার মনে হচ্ছে মুন্না তার কথা রাখবে তো। ফেব্রুয়ারি মাসের আজ প্রথম দিন। দুরেই হসপিটাল দেখা যাচ্ছে। ঢুকতেই
দেখলাম বস্তির সবাই এক জায়গায় দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে ময়নাসহ সব বাচ্চারাই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
তারা সবাই কান্না করছে। তখন সেই বৃদ্ধ এসে বলল তুমি পেরেছ। আমি তাদের জড়িয়ে ধরে বললাম আমরা পেরেছি তাকে
বাচাতে। হ্যা মুন্নার সেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভাই হলাম আমি এই মামুন। সবাই অনেক শক্তভাবে আমার সাথে কাঁদছিল সেই সুখের
কান্না। মুন্নার মা বাবার সেই সুখনিঃসৃত কান্না যেন আমার দুনিয়াটাকে শান্ত করে দিয়েছিল। সুখ কি সেটা এই কান্না দেখে বুঝেছি
আমি। হসপিটালে ডাক্তার নার্স থেকে শুরু করে সবাই আজ দেখল ভালবাসার এক জাগ্রতো উদাহরন। অনেকেই এসব দেখে
চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। তা বাবা মা আমার হাত ধরে অনেক কান্না করল। আমি তাদেরকে শান্ত করে বললাম আল্লাহর
কাছে দোয়া চাইতে। তখনি ডাক্তার তার চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বললেন একটু আমার রুমে আসুন। আমি উনার রুমে
গেলাম। উনি বললেন মুন্নার অপারেশন ভালভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তার জন্য কিছু ফরমালিটিস আছে যেগুলো কিছুদিন মেনে
চলতে হবে। আমি বললাম অবশ্যই। তবে আজ ওর জন্মদিন। আজ সন্ধায় আপনি কি থাকবেন। ডাক্তার আমার হাত ধরে
বললেন যে এতগুলো অপরিচিত মানুষের ভালবাসার পাত্র হতে পারে তার কথা কিভাবে না রাখি। তিনি আরও বললেন মুন্নার মা
বাবার থেকে আপনাদের গল্প শুনলাম। খুব আশ্চর্য লাগলো যখন শুনলাম আপনারা দুই বন্ধু আসলে এদের রক্তের কেউ নন।
আপনাকে তো দেখলাম। উনাকে দেখতে পেলে খুব ভাল হত। আমি নিচু স্বরে বললাম তাকে আর দেখা যাবে। সে চলে গেছে
আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে। তারপর আমি তুহিনের ব্যপারে সব খুলে বললাম। তবে আমার বিশ্বাস এই
বাচ্চাগুলোকে দেখেই আপনি তুহিনকে দেখতে পাবেন। ডাক্তার সব শুনে দুঃখ প্রকাশ করে বলল আমি দেখেছি তুহিনকে। মুন্না
যখন অপারেশনের জন্য তৈরী হচ্ছিল তখন তাকে সাহস দেওয়ার জন্য আমি দেখা করেছিলাম। তখন ঐটুকু বাচ্চা আমাকে
বলেছিল যে তার কিছু হলে যেন তার ভাই তাকে বেইমান না ভাবে। এবং তার শরীরের সব কিছুই যেন অন্যের সুবিধার্তে সংরক্ষন
করা হয়। আমি এসব হতভম্ব হয়ে শুনে তাকে বলেছিলাম তোমার কিছুই হবে না। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখ। বিশ্বাস করুন আমি
সেই মহুর্তেই আপনাদের দেখছিলাম তার মাঝে।
তারপর ডাক্তারকে বলে আমি মুন্নার কেবিনে আসলাম তার সাথে দেখা করার জন্য। সে এখনও সেনসলেস। তবে আমি সেখানে
না থেকে সবাইকে নিয়ে এক হোটেলে বসলাম। সঙ্গে রয়েছে সেই ডাক্তার। সবাই না খেয়ে রয়েছে তাই সবার জন্যই খাবার অর্ডার
করলাম। সবাই খাওয়া শেষে বস্তিতে ফিরে গেল। মুন্নার মা, ময়না আর সেই বৃদ্ধ হসপিটালে থাকল। মুন্নার মা আর সেই বৃদ্ধ
আমাকে তুহিনের কথা বলল। আমি মাথা নিচু করে বললাম তুহিন আর নেই। তারপর তাদের সবি বললাম। মুন্নার মা বলল
আমাদের জন্য এত কিছু করল অথচ আমরা কিছুই করতে পারলাম না। বলেই কান্না শুরু করল। বৃদ্ধ বলল আমরা সবাই তার
কাছে যে চিরঋনী। তাদের অনেক কষ্টে শান্ত করে আমি বস্তির সবাইকে এ বেপারে বুঝিয়ে বললাম। তারপর তারা কেবিনে ফিরে
গেল। আমি তখন জেনিফারের কাছে আসলাম। সে এক পোলকে ফোনে তুহিনের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এসেছি
বুঝতেই পারেনি সে। আমি বললাম,
– সে বলেছিল আপনার কথা। যতটাসম্ভব ভালওবাসত আপনাকে।
-……… ( চোখ দিয়ে পানি পরছে) (জেনি)
– আপনি নিশ্চয়ই এতোক্ষনে বেশ কয়েকটা তুহিনকে কাছ থেকে দেখেছেন।
– হ্যা দেখেছি। সাথে আপনাকেও দেখছি। তুহিন শুধু শুধুই আপনার কথা বলত না। তবে কি জানেন আপনার শুরুটা দেখে তুহিন
অনেক মুগ্ধ হয়েছিল।(জেনি)
– জানি। এও জানি তুহিন খুব ভাল মানুষ।
– আমি এখানে কিছুদিন থাকতে চাই। কিছু ব্যবস্থা করতে পারবেন।(জেনি)
– না ব্যবস্থা করলেও আপনি থাকবেন। তবে আমি ব্যবস্থা করব। ১৪ই ফেব্রুয়ারী আমি আপনাকে ফ্লাইট ধরিয়ে দিতে পারব না। এজন্য অগ্রীম দুঃখিত।
– ( কিছুটা অবাক চোখে) সমস্যা নেই আমি যেতে পারব। তবে এতটা রহস্য নিয়ে কথা না বললেও
পারেন।(জেনি)
– আমি হাসলাম। তার ফ্লাইটের সব কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললাম সেদিন টাকা দিতে গিয়ে ভুলে ফেলে এসেছিলেন।
তখন ও হাসলো। সন্ধায় মুন্নার জন্য একটা কেক নিয়ে এসে হসপিটালেই সবার সাথে জন্মদিন পালন করলাম। মুন্নাকে বেশি
উত্তেজিত করা যাবে না বলে ওকে খাইয়ে রেস্ট নিতে বললাম। ও আমার হাত ধরে বলল আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি। তখন
আমি বললাম আমিও আমার কথা রাখব। তারপর জেনিকে একটা হোটেলে তুলে দিয়ে আমি সেই মহিলার লাশ বস্তিতে নিয়ে
গিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করলাম। মহিলাকে দেখার সময় নাকি তানিমা কান্না করছিল দুচোখ দিয়েই। রাতে মুন্নাকে দেখতে এলে ওর
মা বলল একটু আগেই ঘুমিয়েছে। আমি ডিস্টার্ব না করে হসপিটালে তানিমাকে দেখে বাসায় চলে এলাম। অফিসের বসকে ফোন
দিয়ে বললাম সবকিছু। স্যার কাল অফিসে আসতে বললেন।পরেরদিন স্যারকে সব খুলে বললাম। স্যার আমাকে কয়েকদিনের
জন্য হাফঅফিস দিলেন। এরপর কয়েকদিন হয়ে এলো। এতদিনে জেনিই মুন্না এবং তানিমাকে সময় দিত। আজ ৮ তারিখ।
সবাই বলছে রোজ ডে। আমি ৪ টি গোলাপ কিনে একটি মুন্নাকে দিলাম এবল মুন্নাকে দারা জেনিকে দেওয়ালাম। তুহিনের কবরে
গিয়ে একটা ফুল দিয়েই কোন শব্দ না করেই পেছন ফিরে চলে এলাম। তানিমাকে আজ রিলিজ দেয়া হয়েছে। বাসায় নিয়ে
যাওয়ার সময় সরাসরি তাকে গোলাপ না দিয়ে তার হাতে গুজে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আরও কয়েকদিন পর আজ ১১ তারিখ।
আজ নাকি প্রোমিস ডে। যদিও এসবের ভিত্তি নেই তবে বস্তিতে এসে সবার জন্য বললাম আজ কিছু কথা বলব কিন্তু কেউ কাঁদতে
পারবে না। সবাই যার যার মত করে প্রোমিস করল। আমি তখন ধীরে ধীরে তুহিনের সব কিছু খুলে বললাম। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে
গেল নিমিষেই। সবার চোখে পানি ছলছল করছে। আমি তখন চোখে পানি নিয়েই বললাম প্রোমিস ভাঙ্গা কিন্তু অন্যায়। তারপর
সবাই চোখের পানি মুছে আমাকে জড়িয়ে ধরল। জেনি দুর থেকেই সব দেখছিল। সে আজ কিছুই করল না। ১৪ তারিখে মুন্নাকে
রিলিজ দেওয়া হবে আর সেদিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে। সবাই মিলে সেদিন তুহিনের কবরে যাব ঠিক করলাম। ১৩ তারিখ রাতে তানিমা
ফোন করে বলল কি করছ এখন। আমি বললাম অপেক্ষা করছি কালকের। ও আমিও বলে কেটে দিল। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী।
মুন্নাকে হসপিটাল থেকে নিয়ে সোজা সবাই মিলে তুহিনের কবরের কাছে এলাম।
“”” হাতে কোন ফুল ছিল না, ছিল না কোন অপরিস্কার মন।
শুধু ছিল ভালবাসা, হ্যা তুহিন আমরা সবাই তোমারই আপনজন।””””
জেনি সেদিন কবর থেকে একমুঠো মাটি সঙ্গে নিয়ে ভালবাসার মানুষটির সাথে পবিত্র ভালবাসা দিয়ে দিনটিকে উদযাপন
করেছে। সেই একমুঠো মাটি নিয়ে বছরের প্রতিটা ভ্যালেন্টাইন কাটিয়ে দেয়া যাবে এমনই দৃঢ়তা আছে সেই ভালবাসার মধ্যে।
একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে এসে বলল আমার এই তুহিনদেরকে তুমি দেখে রেখ। পিছনে তানিমা তার
কাধে হাত রেখে বলল আমরা দেখব সবাই মিলে। কারন আমরা সবাই মিলেই তুহিনকে গড়ে তুলতে পারি। আমরা তুহিনের
অংশ।
এসব শুনে সে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সামনে বস্তির সবাই তুহিনের কবরকে ঘিরে রেখেছে। আজকালের মত
মেয়েছেলেদের নোংরা ভালবাসা নয় এটা, এটা হল এক পবিত্র ভালবাসার পবিত্র ভ্যালেন্টাইন ডে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
হ্যা তুহিন দেখছিস কি তুই? তাকিয়ে দেখ আজ কতগুলো তুহিন তোর সামনে তোকে ঘিরে ভালবাসার স্রোত প্রবাহিত করছে।
আমরা আর কি চেয়েছিলাম বল। এটাই তো আমাদর কৃতকর্ম রে। আজ আমি যে অনেক একা রে। কেন ছেড়ে চলে গেলি
আমায়। এত এত তুহিনের মাঝে আমি যে তোকেই খুজছি আমার ভাই। আজ আমি পেরেছি রে আমার কথা রাখতে। আর কেনই
বা পারব না বল আমার সাথে যে তুহিনের স্বপ্ন পুরোনের মনেবল আছে। তারপর
তানিমা আমার বাম হাতের সাথে তার ডানহাত মিলিয়ে বলল চল তুহিনকে গড়ে তুলি। প্রতিবার এই দিনে তুহিন হবে তোমার
আমার সবার ভ্যালেন্টাইন। আমরা তুহিনেরই অংশ। তোমার আমার ভালবাসা দিয়ে আমরা তুহিনকে জীবিত রাখব আমাদের
মাঝে। আমি তানিমার হাত শক্ত করে ধরে সজোরে বলে উঠলাম,
যে যাই বলুক, আর যাই কিছু হোক
ভাঙব না কোন আইন।
আমরা সবাই তুহিন গড়ার কারিগড়,
কষ্ট হবে, আচড় আসবে
আসবে জিবনের অনেক বড় ঝড়
কাধে কাধ মিলিয়ে সামলে নেব
ভরসার নাম সেই যে তুহিন
কি করে ভুলব তোকে
তুই আমাদের পুর্ন শক্তির
প্রতিটা বছরের রোজকার ভ্যালেন্টাইন……