আকাশে আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রাতের বেলা এখন সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। মাঝে মধ্যেই আকাশ কালো মেঘে একেবারে
ঢেকে থাকে। তারউপর চলে একটানা কুকুর বিড়াল যাকে বলে cats and dogs. আজ দুপুরেই বৃষ্টি বিদায় নিয়েছে টানা ৭ দিন
বর্ষনের পর। এর মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার বর্ষনে বিরতি নিতেও দেখেছি। যাইহোক চাঁদের দিকে মনযোগ দিতে যাব তখনই
– রবি ভাই?
পিছনে তাকাবো কিনা ভাবছি। চাঁদটাকে এখনো ভালমত দেখিনি তাই পিছনে তাকানোর দিকে আর মনোনিবেশ করলাম না।
– ভাই একবার পিছনে তাকাইয়া দেখেন কে আসছে।
– লিটু?
– জি ভাই!কণ্ঠ শুইনাই বুঝবার পারছেন!
– কে আসছে?
– নিশি আপামনি।
– হুম। তুমি যাও!
– জি আচ্ছা।
লিটু আমার রুমমেট। ৫ দিন হলো একসাথে থাকি।এই পাঁচদিনেই ব্যাটা আমার সম্পর্কে ভালমতন জানাশুনা করে নিয়েছে।
এমনকি নিশির সম্পর্কেও কিছু গোপন করতে পারি নাই। নিচে যাওয়ার সময় তারাহুরায় বেশ জোরেসোরেই দরজার সাথে মাথায়
গুতা খাইল। আমি শব্দটা বেশ উপভোগ করলাম। ঠকাস!
কিছুটা লজ্জা পেয়ে অমনি সে নিচে নেমে গেল।
– আচ্ছা রবি তুমি কি কখনো ঠিক হবে না?
চাঁদ নিয়ে গবেষনা শেষে পিছনে ফিরে তাকালাম।প্রশ্নটা নিশি করেছে। তাই ভালমতন বুঝবার চেষ্টা করলাম।
– আমি কোন দিক থেকে প্রতিবন্ধি নিশি?
– তোমাকে আমি সে কথা বলিনি।
– তাহলে?
– আমি বলেছি যে তোমার বাড়ি ভাড়া দেওয়ার মত যোগ্যতা কবে হবে? তুমি যে বাড়ি ভাড়া দাও না সে কারনে বাড়িওয়ালা
তোমাকে সামনের মাসে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে তা কি তুমি জানো?
– আমাকে তো ই-মেইল করে নাই। আজকেও চেক করছি।
– ফাজলামি বন্ধ করো।আমি ২ মাসের ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি এখনো ২ মাসের ভাড়া বাকি।
– বাড়িওয়ালাকে একদিন পানিপড়া খাওয়াবো।
– রবি!
– আমি দুঃখিত নিশি। (একটু করুন সুরে)
নিশি হনহন করে হেটে নিচে চলে গেল। বুঝলাম নিশি বেশ উদ্বিগ্ন আমার বেকারত্বের ব্যাপারে।
অবশ্য বেকার জীবন মন্দ না। সারাদিন কোনো কাজ নেই। অফিসের ঝামেলা নেই। বসের ঝারি শোনার কোনো চিন্তা নেই।
বিন্দাস লাইফ। তবে টাকা না থাকায় যে বাড়িভাড়াটাও দেওয়া হচ্ছে না এ জন্য আমিও কিছুটা চিন্তিত।
আর কিছু ভাববনা এখন তাই নিচে চলে আসলাম। নিশি চলে গেছে।
বেকার জীবনে কাজ না থাকলেও আজকে আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে। রাত ১২ টার সময় নিশিদের বাড়ির সামনে
যেতে হবে। বেশ কিছু মোমবাতি সাজাতে হবে। সেইসাথে কিছু গিফটও কিনতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ৮ টার
মত বাজে মানে এখনো হাতে ৪ ঘন্টার মত সময় আছে।
কাল নিশির জন্মদিন। লিটুকে একবার ডাকব কিনা ভাবছি। ওকে নিয়ে দোকানে যাওয়াটা বেশ লাভজনক। ছেলেটা ভাল কায়দায়
দামদর করতে পারে। একবার ২৫০ টাকার একটা টি- শার্ট ১৫০ টাকায় কিনে দিয়েছিল।
– লিটু! ওই লিটু!
– ভাই ডাকছেন?
– একটু রেডি হয়ে আস তো। দোকানে যাইতে হবে।
– ভাই কিছু কিনবেন?
– কালকে নিশির জন্মদিন।
– ভাই আগে কইবেন তো। চলেন চলেন!
অতঃপর শাড়ির দোকানের দিকে রওনা হলাম। নিশির নীল রঙ খুব পছন্দ তাই ওর জন্য নীল রঙের একটা শাড়ি কিনলাম। লিটুর
গায়ে ধরে দেখলাম ওকেও বেশ মানায়! এবার ওর জন্য একটা আংটিও কিনলাম। বাড়ি আসব এমন সময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
দেখি ১০ টার মতন বাজে। নিশির বাড়ি যেতে প্রায় ১ ঘন্টার মত লাগবে বাঁকি এক ঘন্টা সব ঠিক ঠাক করতেই চলে যাবে। তাই
আর দেরি না করে লিটুকে বিদায় দিয়ে নিশিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা আরাম্ভ করলাম। যানবাহনের সংকটে ভুগতে হলো বেশ
কিছুক্ষন তারপর কোনোমতে একটা সি এন জি তে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছালাম।
নিশির বাবা মা কেউ নেই। অবশ্য একটা ছোট বোন আছে তবে সে আমাকে চেনে। আমি দেরী না করে কাজে লেগে পড়লাম।
বাড়ির সামনে পাকা করা কিছুটা ফাঁকা জায়গা আছে। ওখানেই মোমবাতিগুলো দিয়ে লাভ টাইপের কিছুর আকৃতি তৈরী করলাম।
ভিতরে লিখলাম “Happy Birthday Dear Nishi”
আসার সময় কয়েকটা বেলুনও কিনেছিলাম। সেগুলো গেট এর সঙ্গে বেঁধে দিলাম।
রাত প্রায় ১২ টা বাজতে চলেছে। এবার নিশি কে চমকে দেবার পালা। আমি নিশিকে একটা কল দিলাম
– হ্যালো নিশি?
– হ্যা বলো এত রাতে ফোন করছো কেন?
– না এমনি হঠাৎ তোমার কথা খুব মনে পড়ে গেল।
– ও আচ্ছা।
– নিশি একটু নিচে আসবা?
– মানে?
– অত মানে বুঝে কাজ নেই। তুমি একটু নিচে আসো।
– আচ্ছা দাঁড়াও আমি আসতেছি।
কিছুক্ষন পর নিশি নিচে নেমে এলো। আমার কান্ড কারখানা দেখে তো ওর চক্ষু ছানাবড়া। আমি দেরী না করে নিশির সামনে হাঁটু
গেরে বসে পকেট থেকে আংটিটা বের করে বললাম,”হ্যাপি বার্থডে টু ইউ নিশি। আজকের এই শ্রেষ্ট মুহুর্তে এক বেকার যুবক
তোমাকে সিটি গোল্ডের আংটি দিয়ে উইশ করছে।”
রিং পড়িয়ে দিতে দিতে,”তুমি কি সেই বেকার যুবকের অনুপ্রেরনা হবে? তার জীবন সঙ্গী হবে?”
নিশি কিছু বলছেনা দেখে ওর মুখের দিকে তাকালাম। প্রথমে যা দেখলাম তাতে বোঝা গেল কিছুটা তেঁতে গেছে। পর মুহূর্তেই
কান্না করে বসল।
– ওই পাগল! সিটি গোল্ডের কথাটা না বললেও হত!
– (সুন্দর করে একটা হাসি দিলাম) তোমার জন্য আরেকটা উপহার আছে।
বলতে বলতে নীল শাড়িটা বের করে নিশির হাতে দিলাম।
– নিশি শুধু তোমারি জন্য।
– ছিনেমা দেখা বাদ দিতে বলছিলাম না। আর এত টাকা তুমি পাইছো কই বলো তো?
– ইয়ে মানে লিটুর থেকে কিছু ধার করছিলাম! আচ্ছা আমি কিন্তু উত্তরটা পেলাম না?
– আমি সারাজীবন তোমার ই ছিলাম, তোমার ই থাকবো।
কথাটা শেষ করতে না করতেই কান্না শুরু করলো। আমার বুকে ঠাঁই খুঁজে নিল। আমি দেরি না করে সুসংবাদটা দেওয়ার প্রস্তুতি
নিলাম।
– নিশি আরেকটা কথা বলবো?
– বলো।
– তোমার এই বেকার যুবক কিন্তু এখন বাড়িভাড়া দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে।
– মানে? (বেশ খুশি হয়ে)
– আমি একটা চাকরির জন্য এপ্লাই করেছিলাম এবং ইন্টারভিউ ও দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই একটু আগে মেসেজ দিয়েছে। এপয়েন্টমেন্ট লেটার কালকে পাবো। (আরো খুশি হয়ে)
– আজকে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে জানো রবি!
– আনন্দটা কতক্ষন থাকবে জানিনা। (মনে মনে)
– কি বললে?
– না মানে দিশাকে লিটু খুব পছন্দ করে।
– তুমি লিটুকে তোমার সাথে এনেছো তাই না?
– তুমি বুঝলে কিভাবে? (অবাক)
– গেটের ঐপাশে চোরের মত ঘোরাঘুরি না করে ভিতরে আসতে বলো।
– লিটু! ভাই লিটু!
– ভাই ডাকতেছেন?
– হ্যাঁ। তোমার ভাবি তোমাকে একটু ভিতরে আসতে বললো।
– জি ভাই আসতাছি।
লিটু ভিতরে আসার পর দেখি ওর আপ্যায়ন বেড়ে গেল। নিশি বেশ মিষ্টি মিষ্টি কথা শুরু করে দিল। ইতিমধ্যে দেবর ডাকটাও আমার কানে পৌঁছালো।
– লিটু তুমি নাকি আমার ছোট বনকে পছন্দ করো?
– ইয়ে মানে ভাবি মানে রবি ভাই বলছে?
– যেই বলুক। শোনো আমার বোনটা কিন্তু ভীষন জেদী। সামলে রাখতে পারবে তো?
– ভাবি এই জীবনটাও দিয়ে দিতে পারব।
নিশি কিছুক্ষন হাসল। তারপর আমার কাছে এসে কানে কানে বলল,”ওদের বিয়েটাও একসাথেই দিয়ে দেব ভাবছি।” আমি,”কিন্তু দিশা যদি ওকে পছন্দ না করে?” “সে তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও।”
হ্যাঁ নিশি তার কথা রেখেছে। আজকে আমাদের চার ইয়াতিমের বিয়ে হচ্ছে।
ও হ্যাঁ বলতেই তো ভুলে গেছি আমি আর লিটু দুইজনেই ইয়াতিম। আচ্ছা এইসব কথা না হয় থাক।
এখন আমি চাকরি করি। বাড়ি ভাড়াও সব মিটিয়ে দিয়েছি। লিটু আর আমি বউদের নিয়ে ওই বাসাতেই থাকি।
আজকে যেহেতু পূর্ণিমা তাই নিশিকে প্রমিস করেছিলাম একসাথে চাঁদ দেখব।
ছাদের উপর আমি আর নিশি একসাথে বসে আছি।
– চাঁদটা খুব সুন্দর তাইনা রবি!
– তোমার থেকে না।
– থাক হইছে তোমার মিথ্যা প্রশংসা!
– নিশি একটা কবিতা শুনবে?
– সত্যি! (খুব আনন্দিত হয়ে)
আমি শুরু করলাম
” এক বিন্দুতে আমি বন্দি
পৃথিবীর এই বিশালতায়।
হাজারো তারার ভিড়ে একা হয়ে যাই
কখনো এক অস্তমিত সূর্যালোকে সন্ধ্যায়,
মনে পড়ে যায় কত স্মৃতী
গেঁথে থাকা এমনের এক কোনায়।
জানালার দার ঝাপটায় বারে বারে
ঝড়ো হাওয়ায় এ মনের ঘরে,
বিরহিনি ডাকে সাথিহারা সুরে
বেদনাতে বুঝি বুক ভাসায়।
অনেক তারার ভিড়ে
আবার তোমায় খুঁজে পাই
চাঁদ হয়ে থেক এমনের আকাশে
নিকশ কালো এক বিশালতায়।”
নিশি আমার বুকে মাথা রেখে কবিতা শুনছে…ওর দুচোখে শুধু খুশির ধারা বইছে। এর থেকে আর বেশি কিছু আমি চাইনা। শুধু ও খুশি থাকুক। বেঁচে থাকুক আমাদের ভালোবাসা।