একা

একা

বৃষ্টি আমার একেবারেই ভাল লাগে না,আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কিছু অপছন্দ করে থাকলে সেটা হলো বৃষ্টি।

মানুষজনকে বৃষ্টি নিয়ে মাতামাতি করতে দেখলে আমার মধ্যে রাগ জমা হয়,মানুষজনের উপর রাগ না,বৃষ্টির উপর রাগ।

মানুষজনের উপর রাগ হলে সেই রাগ কমানোর উপায় আছে,বৃষ্টির উপর রাগ হলে সেই রাগ কমানোর উপায় নেই,সেই রাগ না কমে না কমে বাড়তেই থাকে।

বাড়তে বাড়তে রাগের সাগর থেকে মহাসাগর হয়ে যায়।আমি ছটফট করি।

ছটফট করতে করতে প্রচন্ড রাগে আকাশের দিকে দুই হাত মুঠো করে তুলে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করি,

সেই চিৎকারে ঝড়-বৃষ্টিকে এক নিমেষে শেষ করে দেয়ার প্রয়াস থাকে কিন্তু তার চেয়ে বেশি থাকে শেষ করে না দিতে পারার জন্য তুমুল অসহায়ত্ব।

সঞ্চিতা খুব চেষ্টা করতো আমাকে বৃষ্টি ভালো লাগাতে,আমার লাগতো না।

ঝড়-বৃষ্টি হলেই সঞ্চিতা ক্যাসেট প্লেয়ারে বৃষ্টির গান টান বাজিয়ে দিতো জোরে, জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে যেতো আমাকে বৃষ্টি দেখাতে, আমার ভাল লাগতো না ,

সঞ্চিতার সাথে মায়ের খুব মিল খুঁযে পেতাম।সঞ্চিতার সাথে মায়ের মিল খুঁজে পেয়ে আমি নিজের মধ্যেই ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম,বারবার বলতাম,

‘’তোমাকে কেন এত বৃষ্টি ভালবাসতে হবে?বৃষ্টি ভালবেসো না।‘’

সঞ্চিতা আমার কথা শুনে খুব হাসতো,সেই হাসিও আমার মায়ের মতো।

আমার বয়স যখন ছয় কি সাত বছর ঠিক সেই সময় আমি মাকে আমার চোখের সামনে মারা যেতে দেখি।

আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে,ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়, এই স্মৃতিটা ঝাপসা হয় নি,বরং দিন যত গেছে তত বেশি স্পষ্ট হয়েছে,

চোখ বুজলেই দেখেছি মায়ের সেই চোখ!আমি ভুলতে পারি না!

বৃষ্টি মায়ের খুব পছন্দ ছিল, বৃষ্টি আসলেই মা খুব খুশি হতো!

আনন্দ নিয়ে খিচুড়ি রান্না করতো্‌, চোখে কাজল দিতো,নতুন শাড়ি পড়তো, হাতে কাঁচের চুড়ি পড়তো,

মাঝে মাঝে আমি, বাবা আর মা তিনজন মিলে বৃষ্টিতে ভিজতাম, মা গলা ছেড়ে গান গাইতো, আমাকে কোলে নিয়ে আমার হাসি-খুশি মা বৃষ্টির মাঝে ঘুরে ঘুরে নাচতো!

বাবা লাজুক মুখে মৃদু গলায় বলতেন, ‘’কি করো তুমি পাগলের মতো? মানুষজন দেখবে, চলো ঘরে চলো।

ছেলেটার জ্বর বাঁধাবে নাকি! কি শুরু করলে মীরা? আমি গেলাম, আমার শীত লাগছে!’’

বাবা ঘরে চলে যেতে শুরু করতেই মা বাবার হাত ধরে টান দিয়ে বাবাকে আটকে ফেলতো আর খিলখিল করে হাসতো,

বাবা আমার আর মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ‘’কি পাগলামি! কি পাগলামি!’’ বলে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে হিহি করে কাঁপতেন।

সেদিনও বৃষ্টি ছিল,কয়েকদিন থেকেই টানা ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল!

সেদিন সকাল সকাল টিপটিপ বৃষ্টির মাঝেই মা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মাথা ঢেকে আমাকে কোলে করে নিয়ে কলঘরে গিয়েছিলো দাঁত ব্রাশ করাতে!

মা গুনগুন করে কি একটা গান করছিল!আমার হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দিয়ে মা উঠানে নামলো।

মায়ের গায়ে গাঢ় সবুজ শাড়ি,মাথায় আঁচল দিয়ে ছোট্ট ঘোমটা তোলা, আমি কলঘরে ব্রাশ হাতে ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে মাকে দেখছি,

মা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসলো তারপর সামনে হেঁটে যেয়ে মাটিতে পড়ে থাকা নারকেল গাছের ডাল সরানোর জন্য,

নিচু হয়ে ডালে হাত দিতেই আমি দেখলাম মা ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল!

আমি ভাবলাম মা কাদায় পিছলে পড়ে গেছে,দৌড়ে মায়ের দিকে দিকে ছুটে আসতেই আমি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি….

মা খুব অবাক আর বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আমাকে তার কাছে আসতে না করছে!

আমি কিছুই না বুঝে অবাক হয়ে থেমে গেলাম,মায়ের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম মা আর নড়ছে না,

চোখ দুটো খোলাই আছে,বড় বড় চোখ দুটোতে সেই অবাক আর ভয়ার্ত দৃষ্টি,আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি,

মা কাছে যেতে বারন করেছে তাই যাচ্ছি না!আমি বুঝিই নি আমার হাসি-খুশি মা আমাকে দেখতে দেখতেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!

বাবা বাজার থেকে ফিরে দেখেছিল আমি মায়ের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ‘’মা মা’’ বলে ডাকছি আর কাঁদছি আর মা দূরে চোখ খুলে শুয়ে আছে!

মা মারা গিয়েছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে।ঝড়-বৃষ্টিতে কারেন্টের তার পড়ে গিয়েছিল,মা ডাল সরাতে গিয়ে ভুলে পাশে পড়ে থাকা ভেজা তারে হাত দিয়ে ফেলেছিল!

মারা যাওয়ার মুহূর্তেও মা আমার কথা ভাবছিল,আমি যেন তাকে ছুঁয়ে না ফেলি!

বাবা আর মায়ের মধ্যে ভালবাসা প্রবল ছিল।মা মারা যাওয়ার পরে বাবা তাই অসহায় হয়ে পড়লেন,আমার চেয়েও বেশি অসহায়।

প্রায়ই গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতো,আমি জেগে বাবাকে আমার পাশে দেখতে পেতাম না্‌,অন্ধকারে বাবা চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকতেন।

আমার ভয় লাগতো,গুটিগুটি পায়ে আমি বাবার কাছে যেয়ে কোলে চড়ে বসতাম,বাবা পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে বাবার কোলেই ঘুমিয়ে যেতাম।

কিন্তু বাবা জেগে থাকতেন,রাতের অন্ধকারে হয়তো মাকে খুঁজতেন।মায়ের কথা মনে হলে আমার মন খারাপ লাগতো,তবু বাবা তো ছিল।

কোন একদিন দুপুরে বাবা আমাকে ফুফুর বাসায় রেখে আসলেন।বাবা যাওয়ার আগে বাবার হাত ধরে বলেছিলাম,

‘’তাড়াতাড়ি আসবে তো বাবা?তুমি না আসলে আমার বুকের মধ্যে কেমন করে!এসো বাবা।‘’

বাবার চোখে কি জল দেখেছিলাম?হয়তো ছিল, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন শক্ত করে, শেষবারের মতো ছিল আমি তখন জানতাম না।

জানলে বাবাকে আমি ছেড়ে দিতাম না।

বাবা আর আসলেন না আমাকে নিতে।আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম বারান্দার গ্রীল ধরে,

রাতে কারো দরজার ঠকঠক শব্দ শুনলেই লাফিয়ে উঠে বসতাম, কিন্তু না!বাবা আসতেন না।

আমাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু আমি বুঝে গেলাম বাবা আর কখনো আসবেন না।

‘’বাবা কবে আসবে ,বাবা কবে আসবে’’ এই প্রশ্ন করা থামিয়ে দিলাম,বাবার জন্য আর অপেক্ষা করতাম না।

ফুফা অনেক খোঁজ-খবর করেছিলেন কিছুদিন,পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদ দিয়েছিলেন,জলজ্যান্ত একটা মানুষ এভাবে উধাও হয়ে তো যেতে পারেন না।

কিন্তু কোন খোঁজ বের করতে না পারায় এক সময় ফুফা হাল ছেড়ে দিলেন।আমিও হাল ছেড়ে দিলাম।

তবু মনের সারাক্ষন মনে হতো,বাবা আছেন,বাবা আসবেন একদিন ঠিক !

রাস্তা দিয়ে বাবার বয়সী কাউকে দেখলেই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠতো, বাবা বলে ভুল হতো! একসময় সব থেমে গেল,বাবা আর ফিরলেন না !

আমি বড় হতে লাগলাম ফুফুর কাছে।ফুফা-ফুফু দুইজনেই আমাকে ভালবাসতেন,বাবা-মায়ের মতো হয়তো নয় কিন্তু বাবা-মায়ের থেকে কিছুটা কমও নয়!

সঞ্চিতাকে যখন আমি মায়ের মারা যাওয়ার ঘটনা বলেছিলাম সঞ্চিতা হাউমাউ করে করে কেঁদে ফেলেছিল।সেদিনও বৃষ্টি ছিল,সঞ্চিতার চোখেও বৃষ্টি।

সঞ্চিতার মুখ ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলাম,

‘’তোমার চোখে কখনো বৃষ্টি এনো না।আমার বৃষ্টি ভাল লাগে না,জানোই তো;আকাশের বৃষ্টি হোক আর তোমার চোখের বৃষ্টিই হোক!

তোমার চোখে বৃষ্টি মানায় না,রোদ মানায়।তোমার চোখে সবসময় রোদ ধরে রেখো সঞ্চিতা,আমার জন্য!’’

আমি কখনো ভাবি নি এই আমার জন্য সঞ্চিতার এত ভালবাসা থাকবে!ফুফু যখন আমাকে সঞ্চিতার ছবি দিয়েছিলেন আমি অবহেলায় ফেলে রেখে দিয়েছিলাম।

একবারও ছবির দিকে তাকাই নি!ফুফু অবাক হয়ে বললেন,

‘’ওরকম করে ছবিটা ফেলে রেখে দিলি কেন?পছন্দ হয় কি না দেখ!’’
‘’তোমরা পছন্দ করলেই হবে ফুফু,আমার দেখতে হবে না।তোমরা যেরকম বোঝো!’’

ফুফু রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।আমি ছবিটা দেখি নি।আগ্রহ হয় নি।টেবিলের উপর পড়ে ছিল অনেক অবহেলায়,জঞ্জালের মাঝে।

একদিন সকালে অফিসে বের হওয়ার সময়….

তাড়াহুড়া করে একটা জরুরি ফাইল টেবিল থেকে টান দিতেই অনেক কাগজপত্রের সাথে সঞ্চিতার সেই ছবিটাও মেঝেতে পড়ে গেল।

কাগজ তুলতে তুলতে আমার চোখ গেল ছবিটার দিকে।

আমি স্তব্ধ হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম; নীল শাড়ি পড়া খুকী খুকী চেহারার একটা মেয়ে, বড় বড় চোখে কাজল,

মাথার লম্বা চুল আলগোছে বেনী করে সামনে রাখা, আর কপালে নীল টিপ, হাতে দুই গাছি চুড়ি, কানে ছোট্ট দুল!

ঠোঁট টিপে কেমন একটা ভঙ্গী করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছে,যেন ছবি তোলা হচ্ছে জন্য তার খুব অভিমান হয়েছে!

আমি তাকিয়েই থাকলাম ছবিটার দিকে!অফিসে যেতে হবে,দেরী হয়ে যাচ্ছে সেই কথা ভুলেই গেলাম।

সারাক্ষন মনে হতে লাগলো, এই মেয়েটা আমার হবে?কখনো কি হবে?

রাতে অফিস থেকে ফিরে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে ফুফুকে মাথা নিচু করে বললাম,

‘’ফুফু,একটা কথা ছিল!’’

ফুফু আমার উপর বেশ কিছুদিন ধরেই রেগে ছিলেন! অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,

‘’বল, কি বলবি!’’

‘’ফুফু,বলছিলাম আমি ছবিটা দেখেছি, যেটা দিয়েছিলে দেখতে।আমার পছন্দ হয়েছে!’’

ফুফু খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন! ফুফুর গায়ে আমি একেবারে আমি আমার মায়ের গন্ধ পাই।

বেশ ফিটফাট হয়ে, নকশা করা পাঞ্জাবী গায়ে চাপিয়ে, দাড়ি কামিয়ে, পরিপাটি চুল আঁচড়ে আমি একদিন সঞ্চিতাকে দেখতে গেলাম!

সাথে ফুফু,ফুফা,ফুফাত ভাই,এক চাচা।

ঘটা করে মেয়েকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে বিব্রতকর, কাজেই বিব্রত হয়ে মাথা নিচু করে রাখতে রাখতে আমার ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেল!

ঘাড়ের এক্সারসাইজ করার জন্য ঘাড় এপাশ ওপাশ ঘোরাতেই দেখি মাথায় কাপড় দিয়ে সঞ্চিতা চুপ করে বসে আছে,তার মুখ হাসি হাসি।

আমি আর ঘাড় নামাতে পারলাম না,এতক্ষনের লজ্জিত-বিব্রত আমি এখন বেহায়া-নির্লজ্জ্যের মতো ঘাড় উঁচু করে সঞ্চিতাকে দেখতে থাকলাম!

আশেপাশের মুরুব্বিরা মুখ টিপে হেসে আমাকে আর সঞ্চিতাকে একা রেখে উঠে চলে গেলেন!

আমি বোকার মতো চুপ করে বসে রইলাম।সঞ্চিতাই প্রথম কথা বললো!

‘’আপনি কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?’’

সেই প্রথম কথা।আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কি সুন্দর কন্ঠ!ও কি গান পারে?

‘’আপনি কি গান গাইতে পারেন?’’

সঞ্চিতা শব্দ করে হেসে উঠলো।আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।প্রেমে পড়লে সব ছেলেরাই কি এরকম দীর্ঘশ্বাস ফেলে?

‘’না ,আমি গান গাইতে পারি না, গুনগুন করেও তেমন গাই না কিন্তু গান শুনতে খুব ভাল লাগে।গান পারি না জন্য আপনার কি একটু মন খারাপ হলো?’’

‘’হ্যাঁ, খুবই মন খারাপ হয়েছে জানেন? আমার ছোটবেলা থেকে খুব শখ, জোছনা রাতে ছাদে পাটি পেতে বসে থাকবো আর বৌ কোকিল কন্ঠে গান গেয়ে শোনাবে!

আপনি গান না পারায় খুব সমস্যা হয়ে গেল! শখটা আর পূরন হলো না!’’

সঞ্চিতা আবার শব্দ করে হেসে উঠলো! আমি চুপ করে তাকিয়ে সঞ্চিতার হাসি দেখলাম।সঞ্চিতা হঠাৎ হাসি থামিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে বললো,

‘’আমার কিন্তু বাবা-মা নেই, জানেন রাশেদ? আমি মামা-মামীর কাছে মানুষ ছোট থেকে।আমাকে অনেক ভালবাসবেন?’’

‘’ভালবাসা দেয়ার মতো আমার কেউ কখনো ছিল না সঞ্চিতা, সবটুকু জমা আছে।তুমি এসে বুঝে নিও।‘’

সঞ্চিতা আমার সংসারে এসে কড়ায়-গন্ডায় সব বুঝে নিল, আমাকেও বুঝিয়ে দিল,

আমার মতো ক্ষুদ্র কারো জন্য এত ভালবাসা কারো কি করে থাকতে পেরে আমার ভেবে খুব অবাক লাগতো।

‘’বৃষ্টি ভাল লাগে না কেন বলো তো?বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখো,মায়ের ছোঁয়া পাবে! মা বৃষ্টি ভালবাসতো তো!মা যা ভালবাসতো তুমি তা কেন দূরে ঠেলে রাখো?’’

‘’না সঞ্চিতা,আমার ভাল লাগে না।তুমি এত বৃষ্টি পছন্দ করো না,আমার ভয় ভয় লাগে!’’

‘’তুমি কি পাগল?আমার হাত ধরে একদিন বৃষ্টিতে ভিজবে,তোমার সব ভয় ভাঙিয়ে দেবো!’’

আমাদের দুই কামড়ার ছোট্ট বাসায় সঞ্চিতা একটা ঘর রেখেছিল বাবার জন্য।

ঘরটা সারাক্ষন সে পরিস্কার করে রাখতো যত্ন করে,বিছানায় ফকফকে চাদর-বালিশ,ঝকঝকে ধোয়া মেঝে।আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতাম,

‘’কেন করো এসব?’’

‘’বাবা আসলে কি হবে? আগোছালো, ময়লা জায়গায় বাবা থাকবেন?

ছেলের বৌ এরকম অকাজের হয়েছে, বাবা জেনে খুশি হবেন?তাই গুছিয়ে রাখি!যদি বাবা কখনো আসেন!’’

সঞ্চিতার কথায় আমি হাসি।বাবা কি আর কোনদিন আসবেন?

সঞ্চিতার এত তীব্র বিশ্বাসে আমারো মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করতো হয়তো বাবা সত্যি সত্যি একদিন আসবেন!

সঞ্চিতার প্রেগন্যান্সির তখন সাত মাস চলছে;খুব সাবধানে থাকতে হয়।ওকে অনেকবার বলেছি ওর মামার বাসায় নয় ফুফুর বাসায় যেয়ে থাকতে।

সঞ্চিতা রাজি হয় নি,নিজের বাসা ছেড়ে,আমাকে ছেড়ে থাকতে ওর ভাল লাগে না।

আমি ওকে একা রাখি না,অফিস থেকে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসার চেষ্টা করি।

সঞ্চিতার ইদানিং খুব অদ্ভুত অদ্ভুত শখ হয়, রাত-বিরাতে অনেক আবদার করে, সেইসব শখ-আবদার পূরন করতে অসম্মতি জানালে খুব অভিমান করে,

কান্নাকাটি, রাগারাগি করে একটা কান্ড বাধায়।আমাকে বাধ্য হয়ে সব আজগুবি আবদার মেটাতে হয়।

সেদিন রাত আটটা থেকে হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো,টানা বৃষ্টি,অল্পক্ষনেই চারদিক প্রায় ভেসে গেল।

আমি আর সঞ্চিতা বৃষ্টি বৃষ্টি রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে গেলাম।

খুব জোরে বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল,পাশ ফিরতেই চমকে গেলাম,সঞ্চিতা আমার পাশে নেই।

লাফিয়ে উঠে আলো জ্বালিয়ে দেখি সঞ্চিতা বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে,বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট আসছে!

বারান্দার দরজার থেকেই দেখলাম সঞ্চিতা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে।রাগ করেই বললাম,

‘’তুমি কি করছো এত রাতে বারান্দায়?’’
সঞ্চিতা আমার দিকে যখন ফিরলো তখন দেখলাম ওর চোখ ভর্তি পানি,আমি তাড়তাড়ি ওর কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

‘’কি হয়েছে তোমার?কাঁদছো কেন?’’
‘’জানি না।আমার খুব মন কেমন করছে।মায়ের কথা মনে পড়ছে।মাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘’আমিও মা হচ্ছি মা!’’

সঞ্চিতা শব্দ করে কেঁদে উঠলো,আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম।আমার গায়েও বৃষ্টির পানি পড়ছে;খুব একটা খারাপ লাগছে না।

মনে হচ্ছে কেউ যেন শান্তির ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে।

সঞ্চিতাকে ঘরে যেয়ে শাড়িটা পালটে ফেলতে বললাম,ভেজা শাড়িতে বেশিক্ষন থাকলে ঠান্ডা বসে যাবে,এই সময় ঠান্ডা লাগানো ঠিক না।

বৃষ্টির পানি বারান্দায় এসে ভেজা ভেজা হয়ে ছিল,ঘরে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে হঠাৎ সঞ্চিতার পা পিছলে গেল, আমাকে ডাক দেয়ার সময়টুকুও পেলো না,

আমি সামনের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম! শব্দ শুনে যতক্ষনে ফিরেছি ততক্ষনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে!

সঞ্চিতা বা আমার বাচ্চা কাউকেই ডাক্তার বাঁচাতে পারেন নি,আমি শুধু ডাক্তারকে বলেছিলাম,

‘’ওর কি জ্ঞান ছিল?আমাকে কি কিছু বলে গেছে?’’

ডাক্তার খুব নিষ্টুরের মতো মাথা ঝাঁকালো।আমাদের বাচ্চাটা মেয়ে ছিল।শান্ত-সুন্দর চোখ বুজে আছে।

আমি কোলে নিয়েছিলাম, প্রথমবারের মতো, শেষবারের মতো!

আমি এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলি নি,আমার কষ্ট হয় নি।শুধু বুক জুড়ে অনেক অভিমান হয়েছে।সবার উপরে অভিমান।

যারা আমাকে এইভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেছে তাদের সবার উপরে অভিমান।

আমার কারো কাছে নালিশ দেয়ার কিছু নেই, অভিযোগ করার কিছু নেই!

আমি সব হারিয়ে একেবারে শূণ্য হয়ে গেছি,আর কিছু হারানোর নেই।কোন দুঃখ-কষ্ট কিছু নেই।

আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে, আমি ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছি, আমার কষ্টে আকাশ কাঁদছে, আমি কাঁদছি না।

আমি আমার চোখে বৃষ্টি নামাবো না, বৃষ্টি আমার সব নিয়েছে, সেই বৃষ্টি আমি আমার চোখে আনবো না!

আমি শুষ্ক চোখে পাহাড়ের মতো স্থির হয়ে থাকবো একাই, শুধু আমাকে নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত