একবিংশের রবিনসন ক্রুসো

একবিংশের রবিনসন ক্রুসো

১।
অপরেশ স্যার আমাকে তার বাসায় দেখা করতে বলার পর থেকে বন্ধুমহলে আমি মোটামুটি হাসির পাত্র।

অপরেশ স্যারের নামে স্ক্যান্ডালগুলো খুব স্থূল হলেও তার বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে কখনো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

সেই ছিয়ানব্বই এর ব্যাপারগুলো আজকের মত ছিল না।

ছোট মফস্বলের একমাত্র কলেজের ইংরেজির প্রফেসরের বিরুদ্ধে আজকের দিনের ছাত্রছাত্রীদের মত আন্দোলন করার সাহস কারো ছিল না।

অপরেশ স্যার পাগলা কিসিমের ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সব ছিল নারীঘটিত। লুনা, তারান্নুম, সেলিনা আপারা সোচ্চার হয়েছিলেন।

হিতে বিপরীত হয়েছে, আপারা কালারড হয়ে গেছেন।

ধারনা করা হয়, এরকম আরো বহু ছাত্রীর সাথে হয়েছে, যেসব ঘটনা কখনো দিনের আলো দেখেনি।

লুনা, তারান্নুম, সেলিনা আপা এবং আরো এরকম নাম না জানা অনেক আপাদের সাথে কি ঘটেছিল কারো ধারনা নেই, তবে এ নিয়ে বহু ফ্যান্টাসি কলেজে চালু আছে।

যে কারণে ইংরেজি বিভাগে কলেজে কেউ ভর্তি হতে চায়না।

আমার সাথে ঘটে যাওয়া ট্রাজেডির শান-এ-নুযুল শুনলে কিঞ্চিৎ ধারনা আসবে অপরেশ স্যার কি কিসিমের পাগল।

গেল সোমবার আমি বন্ধু সেলিমকে আমার বইখাতা গছায়ে দিয়ে গার্লস স্কুলের গেটের সামনে অপেক্ষা করছিলাম পিংকিকে এক নজর দেখার জন্য।

এর মাঝে ক্লাসে অপরেশ স্যার এসে সবাইকে এসাইনমেন্ট দেন এক হাজার শব্দের মধ্যে একটা “বাংলা” গল্প ক্লাসের শেষে তাকে জমা দিতে।

যারা জমা দিবে না, ফাইনাল পরীক্ষায় তাদের পাঁচ নম্বর মাইনাস। সেলিম অবগত আমার হিজিবিজি গল্প লেখার শখ সম্পর্কে।

সে আমার লেখা গল্প জমা দেয়।

এসব এসাইনমেন্টের শেষে সচরাচর দু’একজনের ডাক পড়ে স্যারের রুমে।

আর কালেভদ্রে কেউ কেউ এই চেম্বার থেকে প্রমোশন পেয়ে স্যারের বাসায় ডাক পায়।

সেলিনা, তারান্নুম, লুনা আপারা বাসায় ডাক পেয়েছিলেন। বন্ধু সেলিম চেম্বারে ডাক পেয়ে সত্য স্বীকার করে নিয়ে আমার নাম বলে দেয়।

অতঃপর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমার ডাক পড়ে অপরেশ স্যারের বাসায়। এ আমন্ত্রন উপেক্ষা করার উপায় নাই।

সেলিনা, তারন্নুম, লুনা আপারা আমন্ত্রন নাকচ করেছিলেন, তারা আজও পাস করতে পারেননি। তারান্নুম আপা, সেলিনা আপার বিয়ে হয়ে গেছে।

লুনা আপার খবর কেউ জানেনা, শোনা যায় উনি এখন ঢাকা থাকেন।

স্যারের আমন্ত্রন উপেক্ষা না করতে পারার কারনটা বলি।

বাসা থেকে শাহাদত খাঁন (আমার পিতা) যেসব ক্যারিয়ার অপশনগুলো আমাকে দিয়েছেন, ফেল করা ব্যাপারটা তার মধ্যে পড়েনা।

অগত্যা আমাকে আমন্ত্রন রক্ষা করে যেতে হয় অপরেশ স্যারের বাড়িতে, ইতিহাসের প্রথম পুরুষ হিসাবে।

যাবার আগে আরিফুল টিটকারি মেরে বলে, “ শেভ কইরে যাইস মনি, না হলি পরে অপরেশ বাবুর পছন্দ হবেনানে।“

শুনে মনির আর শোভন ঠ্যা ঠ্যা শব্দে হাসে।

সেলিমেরও হাসতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সে সাহস করে উঠতে পারেনা।

অপরেশ স্যারের জারুল ঘেরা বাড়ির উঠোনে আমার পরিচয় হয় অন্য এক জগতের সাথে।

“সবুজ সংঘ” তার নাম। সবুজ সংঘের সভাপতি ছিলেন অপরেশ স্যার।

সংঘের একটা মাসিক ছোট প্রকাশনা বের হতো। সেটার সম্পাদক ছিল অপরেশ স্যারের মেয়ে, অপর্না। অপর্না।

আহ! মারিজুয়ানার মত মাথার রগগুলো শীতল করে দেয় আজো নামটা। অপর্না।

২।

২০০২ সালে ঢাকা আসার পর পুরো একটা বছর মানুষের প্রাথমিক পাঁচটা চাহিদার তিনটার উপর দিয়ে বিশাল ঝড় যায়। অন্ন, বাসস্থান, চিকিৎসা।

এ আত্মীয়, সে আত্মীয়ের বাসায় দু’দিন পাঁচদিন করে থাকি। তাদের সহ্যসীমা পার হয়ে গেলে নতুন লতায় পাতায় আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠি।

কোন কোন আত্মীয়ের বাসায় আবার এক রাতও জায়গা হয় না। এর মাঝে টাইফয়েড বাঁধিয়ে বসি।

সবচেয়ে দায়িত্ববান আত্মীয় মাসুদুর রহমান মামার বাসায় এই সময়টা ছিলাম। সারাদিন মামীর গজগজানি শুনতাম।

টাইফয়েডটা একটু ভাল হলেই বের হয়ে পড়লাম আবার জীবন জীবিকা বাসস্থানের সংগ্রামে। অপরেশ স্যারকে একটা চিঠি লিখি।

তেরো দিন পর তেঁজগাও পোস্ট অফিসে ফিরতি চিঠি আসে সবুজ সঙ্ঘের সদস্য নিলয় বাবুর ঠিকানা সম্বলিত। নিলয় বাবুর তখন উঠতি দিন।

একটা উপন্যাস বেরিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদের সাথে পার্সোনালি দেখা করেছেন।

হুমায়ুন আহমেদ তাকে দশ মিনিট সময় দিয়ে গল্প করেছেন, পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন।

যা হোক, নিলয় বাবুর মেসের উনার রুমের ফোরে আরো দু’জনের সাথে আমারো জায়গা হয়।

নিলয় বাবুর কাছে আমার জীবনে বহু ধরনের কৃতজ্ঞতা আছে।

তবে যেটা কোনভাবেই শোধ হবার নয় সেটা হলো ঢাকা শহরে একটা মাথা গোঁজার ঠাই।

নিলয় বাবু আমাকে একটা টিউশনি ঠিক করে দেন উচ্চ বেতনের।

ঢাকার বুকে আমি উপার্জন করতে শুরু করি। আমার জীবনের মাইলফলকগুলোর মধ্যে এটাও একটা।

নিজ শহর ঝিনাইদহে ছাত্রজীবনে আমি বহু টিউশনি করিয়েছি। তবে ছাত্রী এই প্রথম। ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রী, অর্ভি।

ঝিনাইদহের পোলাপান গৃহশিক্ষককে বাঘের মত ভয় পায়। ছাত্র তো বটেই, ছাত্রের বাপ-মা ও গৃহশিক্ষককে “স্যার” সম্বোধন করে।

ঢাকার অবস্থা মনে হয় অন্যরকম।

অর্ভিকে বেশ সিরিয়াস টাইপের মনোযোগী ছাত্রী ভেবেছিলাম।

সেদিন Gerund এবং Participle এর মধ্যকার সূক্ষ পার্থক্য বুঝানোর সময় হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসে, “ভাই আপনার গার্লফ্রেন্ডের নাম কি?”

আমি খানিকটা বিষম খেয়ে ঢোক গিলি। ঝিনাইদহ হলে এতক্ষনে ছাত্রের পশ্চাতদেশে দুইটা লাঠি ভাঙা হয়ে যেত।

কিন্তু নিজেকে বুঝালাম, “ওরা দিত তিনশো টাকা করে, এরা দেয় তিন হাজার”।

ব্যাপারটা হজম করে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলি, “ জেরান্ড হলো ভার্ব এর একটা ফর্ম যেটা noun হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

আর পার্টিসিপল হলো ভার্ব এর একটা ফর্ম যেটা adjective হিসাবে ব্যবহার করা হয়”।

অর্ভি খুব বুঝার ভান করে মাথা নাড়ে আমার দিকে তাকিয়ে, যেন তার করা বোমা প্রশ্নটার কথা সে নিজেও ভুলে গেছে।
সেদিন মেসে ফিরে অপর্নার কথা বহুদিন পর খুব মনে পড়ে। জীবনে বহুকিছুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় অপর্নার হাত ধরে।

রবীন্দ্রসাহিত্যের সাথে আমার পরিচয় অপর্নার হাত ধরে। তার আগ পর্যন্ত আমার কাব্যের দৌড় “মাছি ভনভন, থালা ঝনঝন” পর্যন্তই ছিল।

কিংবা ইংরেজি সাহিত্য ক্লাসে কেতাব স্যারের গেলানো উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর I wandered lonely as a cloud.

অপর্না আমাকে শেখায় একশো বছর আগে কেউ বলে গেছেন “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”।

আমি তখন কিছুটা বুঝতাম, কিছুটা বুঝতাম না।

অপর্না পরোয়া করত না, এক নাগাড়ে আবৃত্তি করে যেত।

আমিও বোঝাবুঝির খুব একটা পরোয়া করতাম না, আবৃত্তির ভংগিমাটা খুব ভাল লাগত যে।

আমাকে প্রথম চুম্বন স্বাদ দেয় অপর্না। ১০ আগস্ট, নবগঙ্গার পাড়ে ছায়ানটের বটগাছটার তলে সেদিন বিকেল ফুরিয়ে আধো আলো আধো ছায়া।

অপর্নার কমলা রঙের গ্লস পড়া মিষ্টি গন্ধের ঠোঁটটা যখন আমার ঠোঁট থেকে এক সেন্টিমিটার দূরে, তখন আমার মনে একটা অদ্ভূত প্রশ্ন জাগে।

আর আমি তখন যেটা করি, সেটাকে ইংরেজরা বলে “Thinking out loud”।

আমি অপর্না কে জিজ্ঞাসা করে বসি, “ তুমি এর আগে কাউকে চুমু খেয়েছ?” অপর্না কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “ কেন?

আগে কাউকে চুমু খেলে কি আমাকে চুমু খাবেনা তুমি?” আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, “খাবো”।

ততক্ষনে পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন অতিক্রম করে ফেলেছে আমার রক্ষনশীল মন।

অপর্না পাকা পাঁচ মিনিট আমার ওষ্ট ওর ঠোঁটের মাঝে নিয়ে চেপে ধরে রাখে।

ওর আগ্রাসন বাড়ে। আমার সা’দাতিয়া মার্কেট থেকে কেনা হলুদ হলুদ গেঞ্জিটায় কাদা মেখে যায় ওর আগ্রাসনে।

আঁধার থেকে বের হয়ে নিয়ন আলোর স্ট্রিটল্যাম্পের নিচ দিয়ে যখন ভালমানুষের মতন ফিরছিলাম, শাড়ি পড়া অপর্নাকে আমার বড্ড বৌ বৌ লাগছিল।

ওর হাত ধরতে ইচ্ছা করছিল। অপর্নার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ আমার বুকে সে কি তৃষ্ণা!

যেন একটা ম্যারাথন দৌড়ে আসার পর মাত্র এক চুমুক পানি পান করতে দেয়া হয়েছে আমাকে। এই তেষ্টা বুকে নিয়ে আমি ঘুরি আরো সতেরোটা দিন।
সম্বিত ফিরে পাই নিলয় বাবুর গলা খাঁকারিতে। অবশ্য তার উপন্যাস বের হয়েছে দেখে ভদ্রতা করে তাকে “নিলয় বাবু” ডেকে যাওয়া ঠিক হচ্ছেনা।

আমার সমবয়সী, তাকে এখন তুই করে ডাকি। নিলয় এখন বন্ধুমানুষ।

নিলয় প্রশ্ন করে, “তোকে যে তোর উপন্যাসটার মেন্যুস্ক্রিপ্ট রেডি করতে বলেছিলাম, করেছিস?”।

আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, “না”। বন্ধু জানালো আমাকে বাইশ তলার উপর থেকে ফেলে দেয়াটা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশে এখন “অপারেশন ক্লিনহার্ট” এর পর এই ব্যাপারটা সবচেয়ে জরুরী। বইমেলার আর মাত্র মাসখানেক বাকি।

বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।

বন্ধু জিজ্ঞাসিল বই ছাপানোর ব্যাপারটা আমার বাপ করে দিবে কিনা। আমার প্ল্যানটা আসলে কি।

ভেবে বললাম, “নেগেটিভ স্যার, স্বার্থের বাইরে আমার বাপ একটা হারানো বিজ্ঞপ্তিও ছাপিয়ে দিবেনা”।

যা হোক, বন্ধুর ঝাড়িঝুড়ি খেয়ে অপর্নাচিন্তা বাদ দিয়ে মেন্যুস্ক্রিপ্ট দেখায় মন দিলাম।

সে বছর বইমেলায় আমার প্রথম উপন্যাস বের হলো, নাম “যে কাব্যেরা ছন্দেনা”। পাঁচশো কপির মধ্যে দেড়শ কপির মত বিক্রি হলো।

বাকিগুলো পড়ে থাকল।

প্রকাশনী থেকে বেশ গালাগালি খেতে হলো, আমি নতুন লেখক, কোন পয়েন্ট অফ সিম্প্যাথি নাই। ব্যাপারটা অপরেশ স্যারের কানে গেল।

সবুঝ সংঘের কিছু সেভিংস ছিল। অপরেশ স্যার রেগেমেগে “যে কাব্যেরা ছন্দেনা” এর বাকি কপিগুলো এবং বইয়ের স্বত্ব কিনে নিলেন।

জুনে একটা বিখ্যাত মাসিক পত্রিকায় হঠাৎ একজন ক্রিটিক বইটা সম্পর্কে ভাল ভাল কিছু কথা লিখলেন।

ফিচারের পর আমার উপন্যাসটা হিট করে গেলো।

“সবুজ সংঘের” আব্দুল্লাহ ভাই বেশ মার্কেটিং বুঝতেন। সবুজ সংঘ তখন “সবুজ প্রকাশনী” হিসাবে ছোটখাটভাবে দাঁড়িয়ে গেল।

জীবনে প্রথমবার ভাগ্য নামক বস্তুটাকে বাস্তব বলে মনে হতে লাগল।

৩।

আজকে অর্ভির একটা একশো নম্বরের পরীক্ষা নিচ্ছি। প্রশ্নপত্র হাতে দিয়ে একটু চিন্তাভাবনার ফুসরত পেলাম। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলাম।

নিজেকে একটু সময় জরুরী হয়ে পড়েছে। “সবুজ প্রকাশনী” আজ আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করল একটা স্টল কেনার মাধ্যমে। সেখানে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ অপর্নার সাথে দেখা হয়ে গেল পাঁচ বছর পর। অপর্না সবুজ প্রকাশনীর সম্পাদক। একটু মুটিয়েছে, চোখের নীচে একটু কালি পড়েছে।

পাঁচ বছর আগে বড্ড নিটোল সুন্দরী ছিল। চোখের নীচে ডার্ক সার্কেলটা যেন সৌন্দর্য্য আরো বাড়িয়েছে।

চাঁদের কলংক যেমন চাঁদের সৌন্দর্য্য বাড়ায়।

অথবা হতে পারে অপর্নার রুপমুগ্ধতা আমার মধ্য থেকে কখনো কাটবার নয়।

তবে এটা ঠিক যে পাঁচ বছর আগে সে বড় ছিপছিপে কিশোরী গড়নের ছিল।

আজ খুব নারী হয়ে উঠেছে।নাহ ওর রুপ নিয়ে বেশি ভাবা যাবেনা।

খালেদ হোসেইনি বলেছেন, “Beauty is an enormous, unmerited gift given randomly, stupidly.”।

এর চেয়ে বরং স্মৃতি নিয়ে ভাবা যায়।

ছিয়ানব্বইয়ের সেই বিকালে অপর্না ওর পিতা তথা অপরেশ স্যার সংক্রান্ত আমার সকল ভুল ধারনা ভাঙায়।

সেলিনা, লুনা আপাদের লেখনীতে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্যার।

লুনা আপার লেখনী শক্তিশালী না হলেও চিন্তাধারাটা শক্তিশালী ছিল, এদের সবার থেকে।

আমি তাদের লেখা পড়লাম, হতাশায় ভুগলাম তাদের সান্নিধ্য না পেয়ে।

সবুজ সংঘের ওয়ার্কশপে যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা এমনকি ঢাকা থেকেও লোক আসত।

কোন এক অদ্ভূত কারএ ব্যাপারটা গোপনীয় ছিল। তখন বুঝিনি কেন, এখন বুঝি।

সবুজ সংঘের সবাই আমার আর অপর্নার প্রেমের ব্যাপারটা জানত, অপরেশ স্যার বাদে। জানিনা স্যার এখন জানেন কিনা।

আমাদের শেষ দিনগুলোয় আমার আর অপর্নার খুব ঝগড়া হতো।

আমি ওর প্রেমে এত গাঢ়ভাবে পড়ে গিয়েছিলাম যে, আমার ভালোবাসা মাহাত্ম্য হারিয়েছিল।

আপাতঃ মাহাত্ম্য। প্রচন্ড ভালোবাসা মানুষকে পরাধীন হয়ে যেতে উস্কানি দেয়। আমার তখন পরাধীন হতে ভাল লাগত।

নিজের সুখ দুঃখ ওর কাছে সঁপে দেয়াটা নেশায় পরিনত হয়েছিল। সাবমিশনের সুখ এলএসডি এর নেশার মতন।

প্রতিটা ঝগড়ার পর আমার অপর্নাকে প্রচন্ড দেখতে ইচ্ছা হতো।

অসুস্থ একটা ব্যাপার, অপর্নার ক্রুটিগুলো ভুলতে চাইতাম ওর রুপে মুগ্ধ হয়ে। রুপ দেখে স্বাদ মিটত না।

ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থেকেও দিনশেষে একটু না পাওয়া যেন রয়েই যেত।

অপর্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। সেবার যখন ছুটি শেষে ও চলে যাবে ঢাকা, আমাকে চরম পাগলামিতে পায়। আমি ওকে দিয়ে অংগীকারনামা লেখালাম।

অপর্না লিখল, “আমি, অপর্না, ২৮ নভেম্বর ১৯৯৭ দিবা বারোটার দিকে অনিকের সাথে দেখা করব অঙ্গীকার করছি”। নীচে ওর স্বাক্ষর।

অপর্না অঙ্গীকার রাখেনি, এর পর পাঁচটা আটাশ নভেম্বর কেটে গেছে। আমাদের দেখা হয়নি।

আজকের আগ পর্যন্ত। আজ দেখা হয়েছে, কোন কথা হয়নি।
ভাবনার রেশ কাটতে দেখি অর্ভি পরীক্ষা শেষ করে আমার দিকে চেয়ে আছে। কতক্ষন হয়েছে জানিনা। আমি জিজ্ঞাসা করি, “শেষ?”।

মৃদু হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলে, “ভাইয়া আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?” বলে নিচে তাকিয়ে থাকে।

কিছুক্ষন নিচে তাকিয়ে থেকে আবার মুখতুলে বলে, “অথবা কোন বান্ধবী যাকে পছন্দ করেন? ভাইয়া আপনি কুচ কুচ হোতা হ্যায় দেখেছেন?”।

অর্ভি মেয়েটাকে মাঝেসাঝে আমার অদ্ভূত লাগে। অথবা হতে পারে সতেরো/আঠারো বয়সের হরমোন। সঠিক জানিনা, তবে এ হরমোনকে যে পাত্তা দিতে হয়না এটা জানি।

আমি বলি, “ পরশু আসব না, একবারে শনিবারে আসব। আরেকটা মডেলটেস্ট নিব”। অর্ভি অস্ফুটস্বরে বলে, “আপনি মডেল টেস্টই নিতে থাকেন।

“ আমি উত্তরপত্র নিয়ে উঠে চলে আসি তাড়াতাড়ি। কিছুটা ভড়কে। রাস্তায় এসে হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা অর্ভির চোখে কি অশ্রু ছিল? সর্বনাশ!

মাসিক রুটি রোজগারে টান পড়বে এই সর্বনাশ হলে।

মেস এ ফিরে দেখি কেউ নেই। মেস এ আমার এখন একটা বিছানা হয়েছে। নিলয় বেশ টাকা পয়সা রোজগার করছে। কিছুটা গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিত্ব হয়েছে।

বাসায় একটা ল্যান্ডফোন নেয়া হয়েছে। বিল নিলয় দেয়। আমি বড় বুবুকে ফোন দেই। বলা হয়নি আমরা দুই ভাইবোন। বুবুর নাম আনিকা।

বুবুর সাথে অনেক্ষন ধরে কথা হয়। দুলাভাইকে নাকি ইদানিং তার সন্দেহ হয়। বুবু ছোটবেলা থেকেই কিছুটা রোবট টাইপের।

তার কোন অনুভূতি সে প্রকাশ করেনা, অথবা করতে পারেনা। দুলাভাইকে তার সন্দেহ হয় অন্য নারী নিয়ে, এটা যেন শুধুই একটা স্টেটমেন্ট।

এর পিছনে তার রাগ, হতাশা, দুঃখ, ভালোবাসা কিছুই প্রকাশ পায় না কথায়। বুবুকে আমি অপর্নার সাথে দেখা হবার কথা জানাই।

পাঁচ বছর পর আমার মধ্যে হয়ে যাওয়া ঝড়ের কিছুই অবশ্য বলা হয় না।

বয়স বাড়লে হয়ত আমরা সবাই বাইরের দিক দিয়ে রোবট হয়ে যাই, কেউ কেউ ভিতর থেকেও।

ক্লাস এইটে স্কুলে আবৃত্তি, আশি মিটার দৌড়ে ফার্স্ট হওয়া আনিকা এখন নকশী কাথা বুনে। এরপর বুবু আমাকে আমার কাছে একটা বোমা ফাটায়।

অপর্নার বিয়ে হয়েছে দু’মাস আগে। ওর জামাই একটা সরকারী ব্যাংকের অফিসার। কথা শেষে আমি ফোন রেখে ঘুমিয়ে যাই।

রাতের খাবার খাওয়া হয়না।

৪।

সকালে ঘুম ভেংগেই অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। যেদিন অপর্নার চিঠি এসেছিল, সে আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চায় না।

কারনটা এতটাই অস্পষ্ট যে সেটা বলছি না। সে সময়টা খুব খারাপ ছিল। বন্ধুরা কখনোই হিন্দুর মেয়ের সাথে আমার প্রেমের ব্যাপারটা সাপোর্ট করেনি।

তাদের কাছে গিয়ে দুঃখ হালকা করার চেষ্টা তাই বাতুলতা হতো। চেষ্টা করিনি। একদিন ছাদে বসে কাঁদছিলাম ভেউ ভেউ করে। আনিকা দেখে ফেলে।

আনিকার সাথে আমার কোন সখ্যতা ছিল না, সম্পর্ক ছিল মারামারি খুনোখুনির। সেদিন ব্যাপারটা পাকাপাকিভাবে পরিবর্তন হয়ে।

আমি বুবুকে জড়ায়ে ধরে কাঁদি। বুবু জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে, আমি বলিনা।

বুবু বড় মানুষের মতন মাথায় হাত বুলায় আর অপেক্ষা করে আমি কখন বলবো।

বুবু এত বড় হয়েছে আমি জানতাম না। আমি বুবুকে সেদিন সব বলি।

“আরো ভাল মেয়ে আসবে কিংবা যে তোকে এত কষ্ট দিল তাকে ভেবে কাঁদিস না” এই ধরনের টিপিকাল কিছু বুবু বলেনা।

শুধু সবসময় আমার খেয়াল রাখে, আমার সাথে কথা বলে। এমনকি আমার সাথে কলেজ পর্যন্ত যায়। আমি সঙ্গী পাই, তবে তাতে দুঃখ লাঘব হয় না।

আমি মাঝেমাঝেই খাতা কলম নিয়ে বসি লিখতে। বুবু বলে, “জানিস তো কথাটা? If a writer ever loves you, you will never die.”।

আমি ব্যাপারটা জানিনা, না সূচক মাথা নাড়ি। বুবু বলে এখন কিছু লিখিস না, ওকে সেই সম্মানটা দিস না।

একমাত্র ঘৃনাবাক্য যেটা বুবুর মুখ থেকে বের হয়েছিল।

আমার কষ্ট বুবু নিতে পারেনি, এতটুকু ঘৃনা আসতেই পারে। আমার তবুও শুধু লিখতে ইচ্ছা করে, আর লিখতে বসলেই তাতে বারবার অপর্না আসে।

রাতগুলো কঠিন ছিল, এত স্মৃতি, এত স্মৃতি।

দুইটা মানুষ এক বছরেই এত স্মৃতি তৈরী করতে পারে সেটা তখন বুঝেছিলাম।

অপর্নার হাতের উষ্ণতা মিস করি, চোখের তারার খেলা, ভ্রু নাচানো, থুতনির পাশে অবাধ্য ভাঁজ যেটা আবার জোয়ার ভাটার মত আসে আবার মিলিয়ে যায়,

সবচেয়ে বেশি মিস করি বোধ হয় ওর চুমু। এসব ভাবতে ভাবতে রাতের শেষ প্রহরে ঘুম আসে বটে।

সকালটা আরো খারাপ, স্নিগ্ধ সকালে ঘুম ভেংগেই প্রথম যে কথাটা মনে হয় সেটা হলো অপর্না আমার জীবনে আর নেই।

প্রতিদিন যেন নতুন নতুন করে নিজেকে এটা বিশ্বাস করাতে হয়। এই দশা ছিল ছয় মাস।

আজকের সকালটা অনেকটা সেই পাঁচ বছর আগেকার সকালগুলোর মতন ছিল। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা আর মনে প্রচন্ড বিষাদ নিয়ে ঘুম ভাঙে।

আমার জীবনে অপর্না ছিল না, কিন্তু ওর বিবাহের খবর যেন আমার জীবনে ওর ফিরে আসার সমস্ত ফ্যান্টাসিকে পার্মানেন্টলি অস্বীকার করে আজ।

আমি বুঝি, হৃদয়ভঙ্গের কোন কিশোরকাল বড়কাল নাই। হৃদয় সবসময়ই নাজুক।

কিন্তু মস্তিষ্কটা আর নাজুক নয়। আমি পেটে কিছু দিয়ে আমার দিনের কাজ নিয়ে বসি। অর্ভির খাতাটা দেখতে হবে।

মেয়েটা ভাল ছাত্রী, হিন্দি সিনেমা টিনেমা ইদানিং বোধ হয় দেখছে কিন্তু তাতে পড়ালেখায় কোন প্রভাব পড়েনি।

একশোতে বিরানব্বই পেয়েছে। কিন্তু একি! উত্তরপত্রের শেষ পাতায় একটা কবিতা।

“তখন তোমার বয়স আশী, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায়
নিজেই ভীষণ চমকে যাবে, ভাববে এ কে ? সামনে এ কোন ডাইনী?
মাথা ভর্তি শনের নুড়ি, চামড়া যেন চোত-বোশেখের মাটি
চক্ষু দুটি মজা-পুকুর, আঙুলগুলো পাকা সজনে ডাটা !
তোমার দীর্ঘষ্বাস পড়বে, চোখের কোণে ঘোলা জলের ফোটায়
মনে পড়বে পুরনো দিন, ফিসফিসিয়ে বলবে তুমি,
আমারও রূপ ছিল !
আমার রূপের সুনাম গাইত কত শিল্পী-কবি !
তাই না শুনে পেছন থেকে তোমার বাড়ির অতি ফচকে দাসী
হেসে উঠবে ফিকফিকিয়ে
রাগে তোমার শরীর জ্বলবে ! আজকাল আর ঝি-চাকরের নেই কোন
ভব্যতা !

মুখের উপর হাসে ? এত সাহস ? তুমি গজগজিয়ে যাবে অন্য ঘরে
আবার ঠিক ফিরে আসবে, ডেকে বলবে, কেন ?
কেন রে তুই হাসিস ? তোর বিশ্বাস হলো না ?
আমারও রূপ ছিল, এবং সেই রূপ দেখে পাগল
হয়েছিলেন অনেক লোকই, এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় !
সবাই যাকে শ্রদ্ধা করে, যার কবিতা সবার ঠোটে ঠোটে
প্রতিবছএর জন্মদিনে যার নামে হয় কয়েক ঘন্টা বেতারে গান বাজনা
সেই তিনি, সেই কবি এমন বুড়ীর জন্য পাগল
হয়েছিলেন ? হি হি হি হি এবং হি হি হি হি
রাগে তোমার মুখের চামড়া হয়ে উঠবে চিংড়ি মাছের খোসা
তুমি ভাববে এক্ষুনি সুনীলকে ডেকে যদি সবার
সামনে এনে প্রমাণ করা যেত ।
কিন্তু হায়, কি করে তা হবে ?

সেই সুনীল তো মরেই ভূত পঁচিশ বছর আগে
কেওড়াতলার চুল্লীতে যার নাভীর চিহ্ন খুঁজেও পাওয়া যায়নি !
তাই তো বলি, আজও সময় আছে
এখন তুমি সাতাশ এবং সুনীলও বেশ যুবক
এখনও তার নাম হয়নি, বদনামটাই বেশি
সবাই বলে ছোকরা বড় অসহিষ্ণু এবং মতিচ্ছন্ন
লেখার হাত ছিল খানিক, কিন্তু কিছুই হলো না ।
তাই তো বলি, আজও সময় আছে
দাঁড়াও তুমি অখ্যাত বা কুখ্যাত সেই কবির সামনে
সোনার মতো তোমার ঐ হাত দু’খানি যেন ম্যাজিক দন্ড
বলা যায় না, তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে একদিন সে হতেও পারে
দ্বিতীয় রবিঠাকুর !

তোমার সব রূপ খুলে দাও, রূপের বিভায় বন্দী করো
তোমার রূপের অরূপ রঙ্গ তাকে সত্যিই পাগল করবে
তোমার চোখ, তোমার ওষ্ঠ, তোমার বুক, তোমার নাভি…
তোমার হাসি, অভিমানে গুচ্ছ গুচ্ছ অশোক পুষ্প…
কিন্তু তুমি তখনই সেই সুনীল, সেই তোমার রূপের পূজারীর
চুলের মুঠি চেপে ধরবে, বলবে , আগে লেখো !
শুধু মুখের কথায় নয়, রক্ত লেখা ভাষায়
কাব্য হোক রূপের, শ্লোক, অমর ভালোবাসায় ।“

সুনীলের অনেক উপন্যাস পড়েছি। তবে নীললোহিত যে এত সুন্দর কাব্য লিখেন জানা ছিল না। কিন্তু এ যে বুবুর ভাষায় “বড়দের কাব্য”।

অষ্টাদশী অর্ভি এ কাব্য কিভাবে শিখল। আমার ধাতস্ত হতে সময় লাগে। আমার বুধবার পড়াতে যাবার কথা ছিল না। আমার তর সয় না।

আমি পড়াতে যাই, অজুহাত একটা তৈরী করে নেয়া যাবে না হয়। গিয়ে দেখি ছাত্রী নেই, দাদুবাড়ি গেছে। ছাত্রীর মা জানায় ওদের দাদুবাড়ি যশোর।

আমি একটা ফাঁকা মাথা নিয়ে ফিরে আসছিলাম।

আসার পথে দেখি বইয়ের শো-কেসে অসংখ্য বইয়ের মাঝে আমার জ্বলজ্বলে কমদামী প্রচ্ছদের “যে কাব্যেরা ছন্দেনা”, প্রথম মূদ্রন।

আমি ঝড়ের মতন আবার মেসে ফিরি। উত্তরপত্র খুলে আবার কবিতাটা পড়ি। বারবার পড়ি। কবিতার মধ্যে না বলা কথা ছিল বুঝতে পারি।

পাঠক, আমার উপন্যাসের নায়িকা ছিল অপর্না। শেষ মুহূর্তে আমি এডিটর চাচাকে নামটা পরিবর্তন করে দিতে বলি।

এডিটর চাচা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “কি নাম দিব?”। আমার মাথায় র্যান্ডমলি প্রথম যে নামটা এসেছিল, সেটা ছিল অর্ভি।

আমার প্রথম ও একমাত্র উপন্যাসের নায়িকার নাম অর্ভি।

৫।

আমি ২০০৪ সালে একটা সরকারী চাকরি পাই। প্রথম পোস্টিং হয় রংপুর শহরে। এরপর তিনশহর ঘুরে আজ ২০১৬ সাল।

আমার পোস্টিং এখন যশোর। একমাস হলো এসেছি। ব্যাপারটা ভাল, আমার জন্মশহর থেকে একঘন্টার দূরত্ব। যশোর ঐতিহাসিক শহর।

আমি মাঝে মাঝে আমার সাইকেলটা নিয়ে ছুটির বিকালে শহরটার সরু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি।

“শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।“
কাল বিজয় দিবস প্যারেড। স্টেডিয়ামে বিজয় দিবস প্যারেডে মেয়র সাহেব দাওয়াত দিয়েছেন সস্ত্রীক। দাওয়াতপত্র পড়ে মুচকি হেসেছি।

যশোরে আমার অখন্ড অবসর। বৃদ্ধ শাহাদত খাঁন আজও আশা জিইয়ে রেখেছেন ছেলে বিয়ে করবে। বয়স যে চল্লিশের কোঠায় পড়ল খবর নেই।

বয়স থাকতে যে চেষ্টা করেননি টা নয়।

বান্দরবান থেকে যখন রাজশাহী পোস্টিং নিয়ে এলাম ২০০৮ এ, তখন ঝিনাইদহের রহমত চাচার অষ্টাদশী মেয়ের সাথে আমার বিবাহ ঠিক করেছিলেন বাবা।

মেয়েটার সাথে বেশ কিছুদিন কথাবার্তা দেখা সাক্ষাত হয়। বয়সের সাথে সাথে প্রচন্ড পরিপক্কতার পার্থক্য তো ছিলই।

সেদিন বুঝেছিলাম ব্যাপারটা হয়ত আর আমাকে দ্বারা হবেনা। তবে মেয়েটা, কি যেন নাম, আজ আর মনে নেই, বেশ লক্ষী ছিল।

একবার ছুটি শেষে যখন রাজশাহী ফিরে যাচ্ছিলাম, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না। টিন এজ মন, নাজুক, অল্পতেই কাতর।

সেদিন সৈয়দ শামসুল হকের “পরানের গভীরের ভেতর” কবিতাটার কথা মনে পড়েছিল। আর পিছিয়ে গিয়েছিলাম। সাহস হয়নি আর বিবাহের।

“আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?-
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান ।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাশীঁর লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়,একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।“

আমার মধ্যে কাব্যের নেশা ধরিয়েছিল আমার ছাত্রী অর্ভি।

২০০৩ সালে ও যখন যশোর থেকে ফিরেছিল, ততদিনে সাময়িক আবেগ বিস্ময় সামলে নিয়েছি।

মেয়েটার পড়ালেখার দৌড় বহুদূর। শো-কেসে সাজিয়ে রাখা তাক তাক বইগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য ছিল না। প্রতিটা সে পড়েছে।

আমি সন্তর্পনে তার কাছ থেকে কাব্যশিক্ষা নিতাম। সাজেশন নিতাম। শিক্ষার তো বয়স নাই।

বুঝেছিলাম মেয়েটা মনের দিক দিয়ে আমার সমান, কিংবা হয়তো তার থেকেও বড় ছিল। কাব্যজ্ঞান মানুষের বয়স বাড়িয়ে দেয়।

মেয়েটা এইচ এস সি দিল, আমি ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর যোগাযোগ রক্ষা হয়নি।
চল্লিশের কোঠায় এসে আজ পূর্বের করে আসা ছোট ছোট ব্যাপারগুলো অনেক এমপ্লিফায়েড হয়ে ধরা দেয় মনে।

কি হতো যদি সেদিন অপরেশ স্যারের আমন্ত্রন রক্ষা না করতাম, অপর্নার সাথে পরিচয় না হতো।

অথবা কি হতো যদি সবুজ প্রকাশনীর স্টলে সেদিন ইগো না ধরে রেখে অপর্নার সাথে দুটো কথা বলতাম।

অপর্না নাকি এখন কানাডা থাকে, বুবু বলেছিল।

কি হতো যদি যশোরের মেয়ে অর্ভির সাথে একটু মন খুলে কথা বলতাম ছাত্র শিক্ষক ট্যাবুকে পাত্তা না দিয়ে।

এমনকি এও ভাবি যে কি হতো, রহমত চাচার কিন্নরী কন্ঠের আমার থেকে চৌদ্দ বছরের ছোট মেয়েটাকে বাড়ি ফিরে বিয়ে করতাম।

এমনতো নয় যে তার ঠোঁট ফোলানো বাচ্চাসুলভ কান্না আমি পরে আর একবারও ভাবিনি।

আজকাল ওদেরকে আমার ফেসবুকে নীল থেকে হঠাৎ ধূসর হয়ে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া নামগুলোর মত লাগে।

এরকম অসংখ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি সাইকেল চালিয়ে ছুটে চলি এলেন গিন্সবার্গের যশোর রোড ধরে, গন্তব্যবিহীন।

মাগরীবের আজান পড়ে। কোন এক মোড়ে একঝাঁক স্কুলড্রেস পড়া কিশোর-কিশোরী হল্লা করে কোচিং থেকে ফিরে।

কিংবা কে জানে, হয়ত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিজয় দিবস মেলায় গিয়েছিল।

নিউ মার্কেটের সামনে আসতে এক নারীকে দেখে অর্ভি বলে ভ্রম হয়, আমি সাইকেল থেকে নেমে সন্তর্পনে ফলো করি।

না এ অর্ভি নয়, অর্ভির নাক আরো খাঁড়া ছিল।

চোখদুটো আরো চকচকে ছিল। এরকম প্রতিদিন কাউকে না কাউকে আমার অর্ভি বলে ভুল হয়।

আমি ক্লান্ত হই না, নতুন করে খুঁজে চলি প্রতিদিন যশোরের মেয়ে অর্ভিকে। বড্ড নিঃসঙ্গ লাগে আজকাল, বড্ড নিঃসঙ্গ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত