. অফিসের কাজ প্রতিদিন যেন বেড়েই চলেছে।আজ একটু দ্রুত বাসায় যাওয়ার কথা ছিল রিহানের।কিন্তু আজো দেরি করে ফেলেছে।বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই দরজা খোলে গেল।যেন দরজার ও পাশে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল কেউ।ভেতরে প্রবেশ করতেই….
সারাদিন শুধু অফিস, অফিস আর অফিস। এই, তোর ইচ্ছে করে না আমাকে সময় দিতে? তাহলে ভালোবাসলি কেন? আমাকে বিয়ে করলি কেন?’
চোখজোড়া আগুনের মত হয়ে আছে সীমার।
বউ-এর কাছে এমন ব্যাবহার সবসময়ই প্রত্যাশিত রিহানের। ভালোবাসার প্রকাশ হয় এতে। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে রিহান নিশ্চুপ। বউ-এর মেজাজ এখন খুব গরম । এই মুহূর্তে ভালো কথা বললে বউ পেয়ে বসবে। তাই প্রতিক্রিয়াটা হওয়া চাই বিপরীত।
মনে মনে রিহানও রেগে আছে। বউটা একদম বে-আক্কেল। স্বামী এত গরমের মধ্যে জ্যাম ঠেলে অফিস সেরে বাসায় এসেছে, কোথায় স্বামীকে একটু আদর করে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দেবে, তা না উল্টো ঝাড়ি!
-জানো সীমা, আজ কি হয়েছে?
-চুপ কোনো কথা না।
-একটা মেয়ে….
‘একটা মেয়ে’ কথাটা শুনে রিহানের দিকে ফিরে তাকায় সীমা। ‘কি হয়েছে একটা মেয়ে?’ -কলার চেপে ধরে সে।
-বাসে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
-ও, আর ওমনি তুই মজনু হয়ে গেছিস তাই না? দাড়া মজা দেখাচ্ছি।
-কি মজা?
-তোর আজ ভাত বন্ধ। যা গিয়ে গোসল কর।
বাড়ন্ত ভুড়িটা একটু আগে চলছে রিহানের। আর রিহান ভুড়ির ঠিক পিছনে। এক মাত্র ছেলে এসে জাপটে ধরে রিহানকে।
-আব্বু তোমার পেট এত মোটা কেন?
-জানিনা আব্বু।
-তুমি কি মহিলা?
-মহিলাদের পেট মোটা হয়?
-হুম, আম্মুরও তো ছিল, যখন আমি আকাশে ছিলাম।
রিহান থতমত খেয়ে যায়। ছয়বছর বয়সী ছেলে এত কিছু জানে কিভাবে?
-তোমাকে এসব কে বললো?
-কেন কাল তুমিই তো ছবি দেখিয়ে বলেছো।
-কি বলেছি?
-একটা ছবিতে আম্মু মোটা ছিল তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এ ছবিটা কার? তখনই তো তুমি বললা।
রিহান সাহেব জিহ্বার আগায় কামড় বসিয়ে দেন। ছেলেটা এরকম ইচড়েপাকা হবে এটা ভাবা যায় না ।
চলো বাবা, আজ আবার ছবি দেখবো। -রিহান সাহেব বললেন তার ছেলেকে।
ছবি দেখানোর এক পর্যায়ে রিহান সাহেবের ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করলো, আব্বু এই ছেলেটা আর এই মেয়েটা কে? রিহান সাহেব উত্তর দিলেন, এরা তোমার আব্বু আম্মু।
পিচ্চি ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বললো, আমার আব্বু আম্মু এত ছোট! তাহলে তোমরা কারা?
রিহান সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, এটা আমাদের ছোট কালের ছবি
তার ইঁচড়েপাকা ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বললো, তোমরা এত ছোট বয়সে বিয়ে করেছিলে! আব্বু আমিও করবো
ওয়ারড্রব এর কোনা ঘেসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির কোণা পেচাতে পেচাতে এসব দেখছিল সীমা। অবস্থা এখন বড়ই বেগতিক। এই ছেলে বাবা মার মান সম্মান শেষ করে দিবে।
সীমার মুচকি হাসিটা কানা চোখে দেখছিল রিহান। খুব শান্তি পায় সে। সীমার হাসির মাঝে যেন স্বর্গ খুঁজে পাওয়া যায়।ভালোবাসা আর কাছে থাকার অটুট বন্ধন।
আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা- কলেজগামী এক তরুণীকে দেখে ভীষণ ভালো লাগে রিহানের। কলেজ পোশাকে সব মেয়েকে ভালো লাগে না, কিন্তু এ মেয়েটা রিহানের বুকের ভেতরে থাকা কলিজার ভেতর তীর ছুড়ে দিয়েছে। ভাব জমায় রিহান। কিন্তু না, ভাব হয় না। সুন্দরী মেয়েদের ইগো বেশি।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়। রিহান সেটা চায় না। রিহান চায় ভালোবাসতে, কাছে টানতে। কলেজ থেকে কতদিন যে সীমার পিছু নিয়েছে তার হিসেব নেই। কিন্তু সীমা বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবে না তাকে। প্রেক্টিক্যাল খাতাও লিখে দিতো সীমার। রিহানকে মানসিক অনেক সাপোর্ট দিলেও তারা শুধুই বন্ধু।
না, এভাবে চলে না। রিহান চাচ্ছে না এভাবে।
-দেখ সীমা, তুই যদি আমাকে ভালো নাই বাসিস তাহলে প্লিজ লিভ মি…
-দেখ রিহান আমরা বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু
-আমাকে ভালোবাসতে সমস্যা কোথায় তোর?
-আমার পরিবার….
-যদি তোর পরিবার কে রাজী করাই?
-আমি জানিনা।
-শোন তাহলে, আজ থেকে এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কিছু শেষ!
সীমা ধীর পায়ে রিহানের থেকে দূরে সরে যায়। এক দিন, দুই দিন যায়। সীমার মন আর মানছে না। সে তার অজান্তেই রিহানের হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিটা মেয়ের কাছেই তার পরিবার আগে। কখনোই চাইবে না পরিবার কষ্ট পাক….
নাহ…রিহানকে চাই। কলেজের শেষ দিন আজ। এর পর কে কোথায় যায় তার কোনো ঠিক নেই। রিহানকে খুঁজছে সীমা। পাচ্ছে না। কোথাও পাচ্ছে না। কোনো জায়গায় নেই সে।
সেদিন তো পেলোই না,এর পরের তিন বছরেও রিহানকে পেলো না সীমা। হটাৎ একদিন রিহান তার বাসায়। রিহান ভালো জায়গায় পড়ে,ভবিষ্যত উজ্জল। এখন নিশ্চয় হিয়ার আর আপত্তি নেই…কিছু শোনার আগেই রিহানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে সীমা। সবার সামনে। হাত দিয়ে মারতে থাকে তাকে। ‘তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলি,তুই জানিস না ভালোবাসি তোকে আমি। ‘
ছেলেটাও আবেগী হয়ে পড়ে। সবার সামনেই শক্ত করে ধরে মেয়েটা কে। কিছু বছর পর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় তাদের। সংসার আলো করে আসে ছোট্ট একটা ছেলে। তবে তারা এখনো একে অপরকে তুই করে বলে। সীমার নির্দেশ এটা। বিয়ের পর এটা সীমার প্রথম চাওয়া ছিল। দরজায় খিল দিয়ে রিহান যখন রূমে ঢুকলো সীমা সরে গিয়ে এই কথাটাই বলেছিল-
-এই শোন, আমি আগে তোর বন্ধু পরে বউ। যদি কখনো বউ হিসেবে আমার কাছে কিছু লুকাতে চাস তাহলে বন্ধু সীমাকে বলবি। নইলে তোর খবর আছে।
রিহান হাসে। তারো ইচ্ছে করে রবি ঠাকুরের মতো বলতে, ‘আমি পাইলাম, ইহারে আমি পাইলাম, সে আমার সম্পত্তি নয় সে আমার সম্পদ’
আর এভাবেই শুরু হয় দুটো মনের লুকানো স্বপ্ন যাত্রা।
এভাবেই আজ তারা দুজন দুজনের। একটি বিশেষ দিন কিছুক্ষণ পরই। সীমা মনে মনে ক্ষেপছিল। এই ছেলেটা ভুলে গেছে এই দিনটাকে। কিছুই আনলো না। হাতে করে একটা তরমুজ এনেছে। কিপ্টা কোথাকার।
রাত দশটা। সীমা ডাইনিং সাজায়। পিতা, পুত্র খেতে আসে। সীমাও খায়। সীমা বারবার রিহানের দিকে তাকাচ্ছিল। তার চোখে মুখে আজকের দিনের অনুভুতির ছিটেফোঁটা ও নেই। খাওয়া শেষে সীমা কঠিন গলায় বললো, ‘তরমুজ কাটবো?’
বাম পাশের দাঁত দিয়ে ভাত চিবুতে চিবুতে নিষেধ করল রিহান।
রাত বারোটা। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিল সীমা। রিহান ডেকে বললো, ‘সীমা তরমুজ খাবো, গরম পড়েছে খুব’
তরমুজ কাটতে যেয়ে সীমা প্রচণ্ড রকম শক খেলো। তরমুজের ভেতর এটা কি? হাত দিয়ে ধরতেই টোন দিলো, ‘হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি।’
সীমা এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে একটা লাল খামও আছে।
ভিজে গেছে তরমুজের রসে। সীমা খুলে দেখে। ‘একটু ছাদে আসবা?’ লিখাটা দেখেই সীমা দৌড় দিয়ে ছাদে উঠে।
একটা পাঞ্জাবি পরে আছে রিহান। সীমা ধীর পায়ে তার দিকে এগুয়।
-কি ভেবেছিলে? আমি ভুলে যাবো?
-তুই একটা শয়তান…এত ভালোবাসিস কেন আমায়?
সীমা কেদে দিচ্ছে। রিহানের বুকে মাথা রাখে। রিহান তার একটা হাত চেপে ধরে। সীমা আরো আবেগী হয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশে একটুও মেঘ নেই। আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা নৌকা ভাসছে। অর্ধ চাদ! আজ তাদের পূর্ণিমা রাত! অর্ধ না, পূর্ণ পূর্ণিমা আর পূর্ণ ভালোবাসা।
পেছনে বোমা ফোটার মত কয়েকটা বেলুন ফোটার আওয়াজ আর পার্টি স্প্রে সীমা আর রিহানকে এলোমেলো করে দিলো।
‘হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি টু মাই প্যারেন্টস’ ছোট্ট ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো। বাবা মা দুজনই ছেলেটাকে কাছে টেনে নিল। এক সাথে চাদের আলো দেখছে সবাই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা