মজার একটা ঘুম দিচ্ছিলাম।ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল।
কিন্তু কলটা রিসিভ করার মতো ইচ্ছেটা নেই।
কারন এই মহূর্তে আমার কাছে ঘুমটাই বেশি গুরুত্বপূর্ন।
তবে ফোনটাও নাছোড়বান্দা, বেজেই চলছে,বেজেই চলছে।ইসসসসসস,,,,আর বুঝতে বাকি রইলো না যে,কে কল করে আমার ঘুমের মধ্যে হরতাল চালাচ্ছে।
কি আর করার,ফোন টা হাতে নিয়ে রিসিভ করতেই……
—-কিরে সজিব,তোকে সেই কখন থেকে কল করছি।কিন্তু তুই রিসিভ কেন করছিস না।কি এমন করিস তুই??
—-ও,,,তুই???
সরি রে দোস্ত,আমি এই মহূর্তে যেখানে আছি,সেখানে নেটের খুবই সমস্যা।
সো তুই এখন ফোনটা রাখ।
—-মানে কি???তুই কি চাঁদের দেশে হানিমুন করতে গিয়েছিস নাকি রে???
ফাজলামো বাদ দিয়ে কথা বল বলছি,না হলে কিন্তু……
—-ওই ওই না হলে কিন্তু কি হা??
—-তোর শার্টের কলার ধরে চাঁদের দেশ থেকে নিচে নামাবো আর কি।
আমি ও ভয় পেয়ে সাথে সাথেই শুয়া থেকে ওঠে বসে পড়লাম।
কারন ও যেমন গুন্ডি মেয়ে,ওর দ্বারা সবই সম্ভব।
আমি বললাম……
—-হুম এখন কি বলবে বলো জানু,আমি এখন রোমান্টিক মুডে আছি।
—-ওই জানু মানে কি?
অনেকক্ষন যাবত তোর ফাজলামি সহ্য করছি কিন্তু।চলে আসবো তোর বাসায়??
—-ওই ওই না, একদমই না।
তোর আসতে হবে না রে দোস্ত,আমিই আসছি।বলেন ম্যাডাম কোথায় আসতে হবে??
—-ক্যাম্পাসে চলে আয়।
—-ঠিক আছে,তুই থাক আমি আসছি বলেই কলটা কেটে দিলাম।
.
পরিচয়টা ই তো দেওয়া হলো না।
আমি সজিব।এইবার একটা সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ৩য় বর্ষের ছাত্র।আর এতক্ষন যার সাথে কথা বললাম,ও অামার ছোটবেলার বান্ধবী তানিয়া জাহান তুলি।আমরা একই ক্লাশে পড়ি।
আমরা দুজন সেই ছোট বেলা থেকেই এক সাথে আছি।
সারাদিন যতই ঝগড়া করি না কেন,কেউ কারো সাথে কথা না বলে থাকতেই পারিনা।
আমাদের রোজই দেখা করতে হয়।
তানিয়া আমাকে না দেখে থাকতে পারে কিনা জানিনা,তবে আমি ওরে না দেখে থাকার কথা চিন্তা ও করতে পারিনা।
একবার তানিয়ার খুব জ্বর ছিল,আমার সাথে দেখা করতে পারেনি,আমি বহু চেষ্টা করে ও যখন ঘুমাতে পারছিলাম না,তখন রাত ১.৩০মিনিটে ওর বাড়ির সামনে দাড়িয়ে ছিলাম,ফোনে বললাম আমি নীচে দাঁড়িয়ে আছি,একটু আসবি।পরে ও খুব কষ্টে শোয়া থেকে ওঠে বারান্দায় এসেছিল।
তারপর আমি তানিয়া কে একটা নজর দেখে বাসায় চলে আসছিলাম।
পরে ঘুমাতে পেরেছিলাম।
নাইলে সারাটা রাত নির্ঘুমই কাটতো।
আরেক বার তানিয়ার সাথে ঝগড়া করার পর ১দিন কথা বলিনি।পরে তানিয়া কল করে সেই কি কান্না।তখনই বুঝছিলাম,তানিয়াও আমার সাথে কথা না বললে আমার মতই কষ্ট পায়।
.
যাই হোক পরে গেলাম ক্যাম্পাসে।
যেতে যেতে একটু লেট হয়ে গেল।
তানিয়ার কাছে বসতেই ও আমায় কয়েক টা কিল ঘুসি বসিয়ে দিলো।
আমারও কিছুই করার ছিল না,কারন দোষ যেহেতু করছি।
তারপর আর কি,,,অনেকক্ষণ একসাথে দুজনে ফুচকা খেয়ে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
হঠাৎ একদিন রাত ৩টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ছি আমি।
রীতিমত ঘামছিলাম আমি।খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখছি।ঘুমের মধ্যে যা দেখলাম,তা বাস্তবে হবে ভাবতেই হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেল।স্বপ্নে দেখলাম,হঠাৎ দেখতে এসে বরপক্ষ তানিয়াকে বিয়ে পড়িয়ে বাসায় নিয়ে চলে গেছে।যার কারনে তানিয়ার সাথে আমার আর দেখাই হয়নি।
খুব খারাপ লাগছিল।শালার স্বপ্ন গুলো কেমন জানি অদ্ভুদ।কোন শেষ শুরু নেই।
যাই হোক পরে সাথে সাথেই তানিয়াকে কল করলাম।অনেক বার কল করলাম কিন্তু রিসিভ করলো না।
মনে হয় ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু আমার আর সেই রাতে ঘুম হলো না।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,সকাল হলে ই তানিয়ার সাথে দেখা করে, তানিয়াকে আমার মনের কথা বলবো।
ওকে ছাড়া যে আমার জীবন শূন্য তা ওকে বুঝিয়ে বলতেই হবে।
না হলে কবে জানি আবার স্বপ্নটাই সত্যি হয়ে যায়।
.
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই তানিয়ার কল আসলো।
—-কিরে সজিব, তুই কি সারা রাত ঘুমাস না নাকি?এত রাতে কল করলি যে??
আমি তো সজাগ ই পাইনি।সরি রে দোস্ত।
—-ওকে ওকে সরি বলতে হবে না।আসলে ঘুম আসছিলনা তো তাই কল করছিলাম।
আজ কি তুই আমাকে একটু সময় দিতে পারবি?
কিছু কথা ছিল তোর সাথে।
—-আচ্ছা ৯টায় চলে আয় ক্যাম্পাসে।আমার ও তোকে কিছু বলার আছে।
আমি বললাম….
—-না রে আজকে ক্যাম্পাসে নয়,আজকে অন্য কোথাও দেখা করি চল।
—-ও বলল,ওকে চল তবে কলেজের সামনের রেস্টুরেন্টাতে যাই।
আজকে তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবো।
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আল্লাহ ই জানে কি সারপ্রাইজ দেয়।
তবে কি তানিয়ারও আমার প্রতি অন্য রকম ফিলিংস কাজ করে?তানিয়াও কি তবে আমাকে ভালোবাসে??সেটা আজ ই ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
.
এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ৯টা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি।
পরে তাড়াতাড়ি কথামত ওই রেস্টুরেন্ট টা তে গেলাম।তবে পৌছাঁতে পৌছাঁতে ৯.৩০মিনিট বেজে গেছে।
গিয়ে দেখি তানিয়া আগে থেকেই ওই খানে বসে আছে।আজকে খুব সুন্দর লাগছে ওকে।নীল একটা শাড়ী পড়ছে,অস্থির সুন্দর লাগছিল।
তবে আজকে তানিয়া একা নয়,সাথে আমাদের কলেজের এক বড় ভাইও বসে আছে।
দেখেই মনের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে।
কে এই ছেলে?আর তানিয়ার সাথেই বা কেন বসে আছে?
তবে কি……?
আর ভাবতে পারছিনা।
হঠাৎই তানিয়ার ডাকে বাস্তবে ফিরলাম…
—-কিরে সজিব,কি এত ভাবছিস তুই??
ভাবলাম আজকে তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো,আর তুই কি না ডুবে আছিস ভাবনার সাগরে।
কাকে নিয়ে এত ভাবছিস রে তুই?
তানিয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিঁয়ে আছি আর মনে মনে বলছি, কি করে বুঝাই,আমার ভাবনা জুড়ে শুধু তুই আর তুই,,তোকে ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার।
.
পরে তানিয়া আমায় যা বললো তা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
তানিয়া ওর সাথে থাকা ছেলেটার হাত ধরে বললো
—-ওর নাম আবির।
ও আমাদের কলেজেই পড়ে।
এইবার ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।
আর আমরা দুজন দুজন কে খুবই ভালোবাসি।
সামনের মাসেই বিয়ে করবো আমরা।
আজকেই বাসায় জানাবো দুজন।
আমি শুধু হা হয়ে তানিয়ার কথা গুলো শুনছিলাম।কথাগুলো শুনে আমি বললাম……
—-কই আগে তো কখনই বলিস নি যে,তোর বি এফ আছে?আমায় কি এতই পর ভাবিস।
—-আসলে আবিরই কাউকে জানাতে মানা করেছিল।ও বলেছিল,আগে ওর পরিবার কে রাজি করবে,পরেই সবাই কে জানাবে।কিন্তু আমি আর তোকে না জানিয়ে থাকতে পারলাম না।
কথাগুলো নির্বাক দর্শকের মতো শোনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা।
শুধু তানিয়ার দিকে তাকিঁয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম Best of luck,wish u a very happy marriage life my best friend….
বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
.
পরে তানিয়ার সাথে আস্তে আস্তে যোগাযোগটাই কমিয়ে দিলাম।
খুব কষ্ট হতো,কিন্তু কষ্ট হলেও করার মতো কিছুই ছিলোনা।কারন আমি ওর আর আবিরের জীবনে কাটাঁ হতে চাই না।ওর সুখের জন্য না হয় নিজের ভালোবাসাটা বিসর্জন দিলাম।তবুও ও সুখে থাকুক।
দেশে থাকলে ওর কথা বারবার মনে পড়বে আর কথা বলতে মন চাইবে, এতে ওর আর আবিরের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে তাই ওর থেকে দুরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
তাই আব্বুকে বলে তার কাছে সিঙ্গাপুর চলে গেলাম।পরে অবশ্য খোজঁ নিয়ে জানতে পারলাম তানিয়ারা বিয়ে করেছে।ভালোই নাকি আছে।প্রথম প্রথম একবার দুবার ফোন দিলেও
পরে আর তানিয়ার সাথে কোন যোগাযোগ করি নাই।ও ভালো থাকুক এটাই আমি চাই। কি দরকার মায়া বাড়িয়ে।
.
৩ বছর দেশের বাহিরে থাকার পরে যেদিন দেশে আসলাম,তার পরদিন ই হঠাৎ রাস্তায় আমার তানিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেলো।আমি প্রথম দেখাই চিনে ফেলেছি তানিয়াকে।তাই কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম…..
—-কিরে তানিয়া কেমন আছিস তুই??
—-ভালো।তোর কি খবর??তুই তো একটা বেঈমান,সেজন্যই হঠাৎ আমাকে একা রেখে সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছিলি।
—-ওই বোকা,একা কই?তোর স্বামী তো ছিলোই।
—-হুম স্বামী ছিল,কিন্তু আমার জীবনে বন্ধুত্বের শূন্যস্থান টা পূরন করতেও তোকে খুব প্রয়োজন ছিল।
তানিয়া কথা গুলো শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তবে আমি তাকিঁয়ে আছি ওর চোখের দিকে।ওর চোখ গুলো ভেজা।
এর মধ্যে ওর চেহারাটাও কেমন জানি ফ্যাকাশে।তাই অতসত না ভেবে জিজ্ঞাসাকরেই ফেললাম…..
—-কিরে দোস্ত তোর বিবাহীত জীবন কেমন চলছে?তোর স্বামীর কি খবর?
স্বামীর কথাটা বলতেই কেমন জানি একটা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।
আমি তানিয়ার হাতটি ধরে বললাম…
—-কিরে দোস্ত কি হলো তোর?কাদঁছিস কেন?
প্লিজ কাদিসঁ না।আমার সহ্য হয়না,বিশ্বাস কর,তোর কান্না আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা।প্লিজ বল কি হয়েছে তোর?
পরে তানিয়ার মুখ থেকে শুনলাম,ওর স্বামীর নাকি একটা এক্সিডেন্ট এ দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।
কথাটা শুনে বুকটা দুমড়েমুচড়ে উঠল।হয়তো আমি তানিয়াকে আমার করে পাইনি,তবে আমি চেয়েছি ও যার কাছেই থাকুক ভালো থাকুক।
ভালো লাগছিলো না।তাই ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
.
বাসায় এসে সারাক্ষণ তানিয়ার স্বামীকে নিয়েই ভাবছিলাম।কি করা যায়?কি করলে তানিয়ার মুখে আবারও সেই হাসিটা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।পরেই মনে পরে গেল সেই কথাটি,”ভোগে নয়,ত্যাগেই প্রকৃত সুখ নিহিত”
।তাই সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম।
কালই তানিয়ার স্বামীর অপারেশন।নতুন চোখ লাগানো হবে।অপারেশনও ভালোই হলো।তাই সে এখন দেখতে পাবে বলে ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছে।
আমিও শুয়ে আছি একই হসপিটালের অন্য একটি বেডে।তানিয়া ছুটে এলো আমার কাছে।
এসেই হাপাঁতে হাপাঁতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো
—-কেন তুই তোর একটা চোখ আমার স্বামী কে দিয়ে দিলি??
—-আমি বললাম,আমার তো আর এমন সৌভাগ্য নেই,যাতে তোকে সারাজীবন দেখবো।
তাই তোর স্বামীর চোখ দিয়েই তোকে সারাজীবন দেখার জন্য আমার একটা চোখ তোর স্বামী কে দিয়ে দিলাম।যাতে আমার এই চোখ, তোর সারা জীবনের চলার পথের সঙ্গীহতে পারে,ওই চোখের দিকে তাকালে যেন মনেহয় আমি সবসময় তোর পাশে ই আছি।বন্ধুর জন্য এটুকু করতে না পারলে কেমন বন্ধু হলাম বল।
কথাটা শুনে ই তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।জানি ও অনেক কষ্ট পেয়েছে,কিন্তু ওর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।শুধু ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়াকে ভালোবাসা বলে না,সে দুরে থাকলেও তার প্রতি অনুভূতি থাকাটাকেই ভালোবাসা বলে।সুখে থাকুক তানিয়া,আমিও সুখে থাকবো,ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আর অনুভূতিগুলিকে নিয়ে……
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা