ভালবাসা এখানে অন্যরকম

ভালবাসা এখানে অন্যরকম

দুঃখিত,এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া…

ধুর, মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তিথির… একে তো রাত বাজে ১২ টা, এখনও আসছে না, তার উপর গাধাটা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। আসুক, আজকে অভির একদিন কি আমার একদিন… বারান্দায় বসে অভিকে শিক্ষা দেয়ার প্ল্যান করছে তিথি। বাসায় আর কেউ নেই । কাজের মেয়েটা গতমাসে বাড়িতে গেছে, এখনও আসে নাই, আর মনে হয় আসবে না। ওরা দুইজনই চাকরি করে, তার উপর তিথি রান্না বান্না তেমন একটা পারে না । তারপরেও কোনমতে কাজ চালাচ্ছে, অভি অনেক হেল্প করে কাজে। আজ ওর অফিস ছিল না, তাই ভাবল আজ অভির জন্য ভাল কিছু রান্না করবে। মাকে ফোন দিয়ে রেসিপি নিয়ে অভির পছন্দের অনেক কিছুই রান্না করেছে… আর আজই ওনার আসার কোন খবর নাই,কি এমন কাজ পড়ে গেল… ফোনটাও বন্ধ। মেজাজটাই খারাপ লাগছে…

কলিংবেল বাজল… অভি ঘরে ঢুকতেই তিথি ঝাড়তে শুরু করল,

-এত দেরি কেন আজ? আর ফোনই বা বন্ধ কেন শুনি?

– ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল,সরি…

-একবার জানাতে তো পারতে, কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি।

বিরক্ত স্বরে অভি বলল,

-আরে বাবা বললাম তো চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল,তাই জানাতে পারি নাই… এত প্যাঁচাও কেন তুমি? ক্ষুধা লেগেছে, খাবার দাও।

আহত চোখে অভির দিকে তাকাল তিথি। বলল,’ টেবিলে খাবার দিচ্ছি, ফ্রেশ হয়ে এসো।’

খেতে এসে চুপচাপ খাওয়া শুরু করল অভি। একটা কথাও বলল না, একবারও বলল না যে এতকিছু তুমি কিভাবে রান্না করেছ? তিথির কান্না পাচ্ছে। অভি কি একবারও বলতে পারত না যে ‘ তুমি খেয়েছ’? ওর হয়ত তিথির কথা মাথাতেই নেই। অভিটা এরকমই… তিথি খুব ভাল করেই অভিকে চেনে, তারপরেও প্রতিবার কষ্ট পায়। তিথি আর না পেরে বলেই ফেলল,

-তুমি এমন কেন? আমি কত কষ্ট করে তোমার জন্য এত কিছু রান্না করলাম, একসাথে খাব বলে কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি, আর তুমি আমাকে একবারও বললে না খেতে।

শুনে থতমত খেয়ে গেল অভি…

-সরি সরি… প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছিল তো… আমি যে কি না? কেন যে বার বার এরকম করি… i m sorry…প্লিজ কষ্ট পেও না,প্লিজ।

অভিটা এরকমই। তিথি ঠিক অভিকে বুঝতে পারে না… ও যে ইচ্ছা করে তিথি কে কষ্ট দেয় তা না… ও ব্যপারগুলা বোঝেই না,তিথি জানে। ওদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩ বছর হল, এর আগে প্রায় ৪ বছর প্রেম করেছে ওরা। প্রেম বিষয়টা আসলে অভির সাথে যায় না। পুরাই রোবট টাইপ একটা মানুষ, কেন যে ওর মত একটা ছেলের প্রেমে পড়ল তিথি ভেবেই পায় না। সবসময় তিথির একটাই অভিযোগ ছিল যে অভি একটুও romantic না। ওর বান্ধবীর boyfriend রা ওদের জানপাখি প্রানপাখি কতকিছু ডাকতো ,কতকিছু করত, আর অভি এসবের ধারকাছ দিয়েও যেত না। তিথি জানে অভি ওকে ভালবাসে, কিন্তু ওর সবকিছুতে এত নির্বিকার ভাব ভাল লাগে না। বিয়ের আগে তিথি খুবই confused ছিল যে অভি আসলেই ওকে ভালবাসে কি না। তারপরেও risk নিয়েছে এবং অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে বিয়েটা করেই ফেলেছে। ভুল করে নি তিথি, এটা ও জানে। ও জানে অভিও ওকে ওর মতই ভালবাসে…ভালই আছে ওরা, তারপরেও এসব ছোটখাটো ব্যপার মাঝে মাঝেই ওকে কষ্ট দেয়।

খেতে খেতে তিথি অভিকে বলল,

-আজ মা ফোন দিয়েছিল

-কি বলল আম্মু? আমাকে তো ফোন দেয় না, ছেলের চেয়ে বউএর দরদ বেশি দেখা যায়। আমার মা টা তোমার মত এই দজ্জাল মেয়ের মধ্যে কি যে পাইছে আল্লাহই জানেন।’ বলেই মুচকি হাসল অভি… এই ব্যপারটা ওর খুবই ভাল লাগে। মেয়েটার মধ্যে কি যেন আছে, সবাইকেই আপন করে নেয়।

-ফাইজলামি বাদ দাও, মা বলল নাতির মুখ দেখতে চায়… অনেকদিনই মা আকার ইঙ্গিতে বলেছে,আজ সরাসরিই বলল। আমারও এরকমই ইচ্ছা,তুমি কি বল?

-আজব!! তোমাকে বলেছি না এখনি না… কেন কয়দিন পর পর এই টপিক তোল?- রাগান্বিত স্বরে অভি বলল।

-এখন না তো কখন? ৩ বছর তো হয়ে গেছে… আমাদের না প্ল্যান ছিল ২ বছর পরেই একটা বাবু হবে আমাদের?

-ওসব বিয়ের আগের কথা এখন কেন তুলতেছ?

-মানে কি? বিয়ের আগের কথা কি এমনি ছিল? কত না প্ল্যান ছিল আমাদের,বাবুর সবকাজ তুমি করবা,আমি শুধু বসে বসে দেখব। বাবুর নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছিলাম আমরা। এখন এরকম কেন কর তুমি?’ চোখে পানি টলমল করছে তিথির

– আমাকে আরও কিছুদিন সময় দাও। আরেকটু গুছিয়ে নেই। আর আম্মুকে আমি বুঝিয়ে বলব। ব্যপারটা আপাতত বাদ দাও।

– আর কতদিন বাদ দিব? কিছু বললেই তুমি avoid করে যাও …আজকে তোমার প্রব্লেমটা ক্লিয়ার কর আমাকে।

-ধুর, এর জন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। কথা তো কিছু বুঝবা না, অযথা তর্ক করবা…

– কোনটা অযথা তর্ক?শুনি? বিয়ের আগে একরকম কথা, বিয়ের পরে আরেকরকম কেন? আর অযথা অজুহাত দিবা না, আমাদের অবস্থা যথেষ্টই ভাল… আর গুছিয়ে নেয়ার কিছু নাই।

-তোমার সাথে কথা বলারই কোন মানে হয় না।- বলে বেডরুমে চলে গেল অভি, ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল।

তিথি বারান্দায় একা বসে আছে… এই একটা ব্যপার কোনভাবেই মিলাতে পারে না ও। আর সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু বাচ্চা নিতে চায় না অভি। বললেই রাগারাগি করে, অথচ ওরই এই ব্যাপারে আগ্রহ বেশি ছিল। কাঁদছে তিথি… মাঝে মাঝে রাগও লাগছে। কেন এরকম করবে অভি? অযথা কেন রাগারাগি করবে? আগে সবসময় অভিকে বলত তিথি ‘ এমন কি করেছ তুমি আমার জন্য যাতে আমার মনে হয় যে তুমি আমাকে ভালবাস?’ আজ আবার এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে অভিকে।

সকালে অভি এসে তিথিকে বলল,

– আমি সরি তিথি, কাল একটু বেশি করে ফেলেছি… সরি,মন খারাপ করো না,প্লিজ

তিথি কোন কথা বলল না। রাগে ওর গা কিটকিট করছে। নাস্তা করে অফিসে চলে গেল,ফোনটা বন্ধ করে দিল।

তিথি অফিস থেকে ইচ্ছা করে দেরি করে ফিরল,এসে দেখে অভি শুয়ে আছে। ও আর কোন কথা না বলে খেয়ে শুয়ে পড়ল। অভির সাথে কোন কথাই বলল না। পরদিন সকালে উঠে ফোন অন করতেই দেখে ওর এক বড় আপু ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ওর cousine,ডাক্তার। তিথি কল ব্যাক করল। আপু ফোন ধরেই বলল,

-কি সমস্যা তোর? তুই এখনও অভিকে বলিস নাই যে ওইটা ফান ছিল?

– মানে কি!!!!তুমি কিসের কথা বলছ?

-তোর প্রেগন্যান্সির কথাটা…

-কি বল তুমি? তুমি সেদিন অভিকে কি বলেছিলা??

-আমি ওকে বলেছিলাম যে তোর একটা প্রব্লেম আছে, তুই কখনও প্রেগন্যান্ট হলে তোর এবং তোর বাচ্চা দুইজনেরই মারা যাওয়ার possibility আছে। আমি তো ভেবেছিলাম তুই ওকে তখনই বলে দিয়েছিস। কাল অভি আমাকে ফোন দিয়ে বলে যে এর কি কোনই treatment নেই? আমিতো অবাক… অভিকে কিছু বলি নাই,তারপর থেকেই তোকে ফোন দিচ্ছি।

ফোন রেখে তিথি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে… বিয়ের ২ বছর আগের কথা। অভির কোন কাজেই ওর মনে হত না যে অভি ওকে ভালবাসে।অভি ওকে আসলেই ভালবাসে কি না এটা টেস্ট করার জন্য তিথি ওর ডাক্তার cousine কে বলেছিল অভিকে এই কথাটা বলতে। তারপর সেদিনই অভির সাথে ওর কি নিয়ে যেন ঝগড়া লাগে,এরপর ৩ দিন কথা বলে নাই।এর মাঝে তিথি ভুলে গেছে এই ব্যপারটা। আপুকেও জিজ্ঞেস করতে মনে ছিল না। ওর মাথায় কিছুই ছিল না, আর অভি এটাকে সত্য ভেবে 5 টা বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছে!! ও কোনদিন মা হতে পারবে না জেনেও অভি ওকে বিয়ে করেছে, এতদিনে একবারের জন্যও ওকে বুঝতে দেয় নাই… আর সেই অভিকে ও ভুল বুঝেছে এতদিন!!! অভি সবসময় বলত,’আমি হয়ত তোমাকে সুখি করতে পারি না, আর দশটা boyfriend বা husband এর মত romantic কথা বলতে পারি না, কিন্তু কোন একদিন তোমার জন্য এমন কিছু একটা করব যেটা সবাই করে না।’ অভি আজ সেটা করে দেখিয়েছে। মা হতে পারবে না জেনেও কয়টা ছেলে বিয়ে করে??এতটা ভালবাসে? তিথির চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে, এই ছেলেটাকে সে এত কষ্ট দিয়েছে…

তিথি রুমে গিয়ে দেখল অভি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে… দৌড়ে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়ল তিথি… সব খুলে বলল… শুনে অভি হাসতে হাসতে বলল,

-দিলা তো আমার শার্ট এর বারটা বাজিয়ে… এখন অফিসে যাব কিভাবে?? অফিসে আমার এত্তগুলা সুন্দর সুন্দর মেয়ে কলিগ… আমার একটা ইমেজ আছে না…

বলেই দিল দৌড়… এখন এই দজ্জাল মেয়ের আসেপাশে থাকাটা নিরাপদ না।

হাতের কাছে একটা বালিশ ছিল তাই নিয়ে তিথি ছুটল ওর পিছনে,

– আজ তোমার অফিসে যাওয়া আমি বের করতেছি… দাড়াও…

ভাবটা এমন যে বালিশ দিয়েই অভির মাথাটা ফাটিয়ে দিবে আজ।

একজনের পিছনে আরেকজন সাড়া ঘর দৌড়াচ্ছে, দুইজনেরই চোখে পানি আর মুখে হাসি… প্রকৃতি খুবই অদ্ভুত!!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত